ফিচার I বিবাহে বর্ষামঙ্গল
নীল নবঘনে বিবাহবন্ধনের ইতিহাস বহু পুরোনো। মৈমনসিংহ গীতিকায়ও পাওয়া যায় খোঁজ। মোটেই নতুন কিছু নয়। উইন্টার ওয়েডিং কয়েক দশক ধরে মাতিয়ে রাখলেও শোনা যাচ্ছে প্রত্যাবর্তনের শব্দ। গাঢ় মায়াবী মেঘের ঝালরের নিচে বর-কনের এক হওয়ার গল্প। লিখেছেন সারাহ্ দীনা
শীত এলেই পাওয়া যায় বিয়ের দাওয়াত। কয়েক দশক থেকে বছর শেষের হিম হিম সময়টাকে অনেকে বেছে নিচ্ছেন এই রঙিন উৎসব আয়োজনের জন্য। আরামদায়ক তাপমাত্রা, বছর শেষের ছুটি আর ঘুরে বেড়ানোর স্বাচ্ছন্দ্য এখানে মূল ভূমিকা পালন করে। তাই বলে বাদলা দিনে যে একেবারেই কেউ বিয়ে করেন না, তা কিন্তু নয়। অনেকে বিয়ের উপযুক্ত সময় হিসেবে বেছে নেন এই ঋতু। প্রিয় মানুষকে বলতে চান ‘এসো হাত ধরো, চলো ভিজি আজ বৃষ্টিতে…’। মনসুন ওয়েডিং তাই আলাদা এক অধ্যায়।
শিকড় সন্ধানে
ইতিহাস খুঁজতে গিয়ে শরণাপন্ন হতে হয় ভূগোলের। বাংলাদেশের ম্যাপে এমন অনেক খাল আছে, যেগুলো শুধু বর্ষাকালেই চলাচলের উপযোগী। অন্য সময়ে প্রস্থ কমে আসে এসব জলাশয়ের। কারণ—পানির অভাব। এমন খালের সংখ্যা আগে আরও বেশি ছিল। খাল আর নদী ছিল যোগাযোগব্যবস্থার মূল। আর কৃষিনির্ভর অর্থনীতি হওয়ার কারণে এই সময়টার গুরুত্ব ছিল আলাদা রকমের। বীজ বপন করে খানিকটা নির্ভার হতেন কৃষকেরা। তখন পুত্র-কন্যার জন্য নতুন সম্পর্ক খুঁজতে মন দিতে পারতেন। কৃষিভিত্তিক সমাজে বর্ষাকে ধরা হতো উর্বরতার প্রতীক হিসেবে। বিয়ে মানেই নতুন জীবন, নতুন পরিবার, সন্তান সম্ভাবনা; তাই বর্ষার এই প্রতীকী শক্তিকে বিবাহের সময়ের সঙ্গে যুক্ত করা হতো। বর্ষাকালের বৃষ্টি মানে ‘আশীর্বাদ’—এই বিশ্বাসও বহু অঞ্চলে প্রচলিত। আরও একটি প্রচলিত বিশ্বাসের উদাহরণ প্রাসঙ্গিক। বিয়ের দিন যদি বৃষ্টি আসে, তাহলে কনের ভাগ্য ভালো হয়। কারণ, এতে মনে করা হয়, বৃষ্টি হচ্ছে স্বর্গীয় আশীর্বাদ; যা পবিত্রতা আনে।
বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী বর্ষাকালে থাকে সুবিধাজনক লগ্ন। হিন্দুশাস্ত্রমতে, বর্ষাকাল এবং কিছু বিশেষ মাস শুভ সময় হিসেবে বিবেচিত হলেও তা নির্ভর করে গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থানের ওপর। তাই আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে অনেকে আবদ্ধ হন বিয়েতে। শুধু বৌদ্ধধর্মে এ সময়কালে বিয়ের প্রচলন তেমন নেই। বৌদ্ধ ভিক্ষুরা এ সময়ে ধর্মীয় দিকের বিভিন্ন আচার পালন করেন। মৈমনসিংহ গীতিকায়ও পাওয়া যায় বর্ষাকালে বিয়ের কথা। গানের সুরে সেখানে বর্ণনা করা হয়েছে কনে আর বরের প্রতি ভালোবাসা।
প্রত্যাগমন
মনসুন ওয়েডিং পুনরায় জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে মিলেনিয়ালদের হাত ধরে। জেনারেশন জেডরাও এখন সমান আগ্রহী এ ব্যাপারে। এর পেছনে রয়েছে এই দুই প্রজন্মের দর্শন। প্রকৃতিকে ভালোবাসার আখ্যান। বর্ষার সঙ্গে প্রেমের গাঢ় সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায় সাহিত্যে। যেন সাহিত্যিকেরা এই ঋতুতে ভালোবেসেছেন আর ভালোবাসতে শিখিয়েছেন। কালিদাসের মেঘদূত থেকে হুমায়ূন আহমেদের বর্ষাপ্রীতি—সবই পাঠকের মনে জায়গা করে নিয়েছে। চলচ্চিত্র, গান, কবিতাও এর বাইরে নয়। মেঘ, বৃষ্টি, বজ্রপাত—এমন নানা রকমের রসদ নিয়ে হাজির হয় বর্ষাকাল। এ সময়টায় প্রকৃতির সিক্ততা মানুষের মনও ছুঁয়ে যায়। মানুষ এ সময়ে মন, অনুভূতি, মায়া, ভালোবাসা নিয়ে মনোযোগ দিয়ে আরও বেশি করে ভাবে। মিলিনিয়াল আর জেনারেশন জেডের মানুষদের কাছে ধরণীর প্রতি ভালোবাসা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় মনসুনের সময়ের বিয়ে পেয়েছে ভিন্নমাত্রা।
বরণডালা
রেইনি সিজনের কালার প্যালেটে নীলের রাজত্ব। বিভিন্ন রকম শেডে নীল এসে হাজির হয় একখানে। সংগত দেয় মেঘের ছাই রং আর সাদা, কালো। ফ্যাশন ডিজাইনারদের কালেকশনের খবর নিতে গেলে জানা যায়, অনেকে এ সময়ে নীলের নানান রকম বাহার নিয়ে কাজ করেন। ব্রাইডাল ফ্যাশন ডিজাইনার সাফিয়া সাথী, শুভাগত শুভ এরই মধ্যে কাজ করছেন রেইনি সিজনের বিয়ের পোশাক নিয়ে। তবে এতে কোনো বাঁধাধরা নিয়ম নেই। অন্য রংও বেছে নিতে পারেন। চিরায়ত লাল, সোনালি, মেরুন থাকতে পারে। এর সঙ্গে যোগ হতে পারে সি গ্রিন, টিফানি ব্লু, ডাস্টি ব্লু, ব্লাশ পিংক, রোজ উড, মাস্টারড ইয়েলো, মেরিগোল্ড, আর্দি ব্রাউন, টেরাকোটা, পাউডার ব্লু, আইস মিন্ট, আইভরি ও অফ হোয়াইট। মিউটেড ওভার মেটালিক সূত্র এ সময়ে গুরুত্ব পাবে। অর্থাৎ চকচকে টোনের থেকে একটুখানি গাম্ভীর্যপূর্ণ শেড এখানে গুরুত্ব পাবে বলে ধারণা করা যায়।
এ সময়ে আর্দ্রতা বেশি থাকে। তাই ফ্যাব্রিক বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে সেটি ব্রিদেবল কি না, সেদিকে মনোযোগ জরুরি। মিনিমাল এমবেলিশমেন্ট মানাবে। গোটা পাত্তি, জারদৌসির মতো অলংকরণ যেহেতু পানির সংস্পর্শে কালো হয়ে যায়; তাই এ সময়ের বিয়েতে ব্যবহারের বিষয়ে সাবধানতা জরুরি। হেমলাইন ফ্লোর লেন্থ না হয়ে খানিকটা ওপরে হলে সহজ হবে চলাফেরা।
বিয়ের কনে ও বরের জন্য জুতা অতি গুরুত্বপূর্ণ। আর যেহেতু ঋতুটি বর্ষা, তাই এ বিষয়ে আরও বেশি সচেতনতা জরুরি। ওয়াটার-রেসিস্ট্যান্ট ফ্ল্যাট জুতা বা ব্লক হিল কাদা থেকে পোশাককে রক্ষা করতে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে সক্ষম। ডিজাইনার জুতাও বেছে নেওয়ার চল রয়েছে। এ সময়ের কনেরা জুতার সঙ্গে মিলিয়ে ছাতাও নকশা করে নিতে পারেন। তাতে অনন্যতা প্রকাশ পাবে। বর-কনে বা ব্রাইডাল পার্টির জন্য কালার-কো-অর্ডিনেটেড ছাতা ব্যবহার করতে পারেন। চাইলে ফ্লোরাল, ট্রান্সপারেন্ট বা সৃজনশীল ব্লক প্রিন্টেড ছাতাও ব্যবহার করা যায় বিশেষ ক্যানভাস হিসেবে। যেখানে কাস্টমাইজড ডিজাইনের সুযোগ রয়েছে, সেখানে ফরমায়েশি চাহিদা জানালে মনমতো মিলতে পারে।
বর্ষার হাত ধরে ফোটে কদমফুল। পানিতে টইটম্বুর খাল-বিলে দেখা যায় শাপলা। পদ্মও চোখে পড়ে। সবুজ পাতার ফাঁকে উঁকি দেয় বেগুনি রঙের কলমি ফুল। এসব ফুলে সাজিয়ে নেওয়া যেতে পারে চুল। তাতে স্নিগ্ধতা প্রকাশিত হবে। গয়নায় অতিরঞ্জন নয়। সরলতাই সুন্দর। হোক তা হলুদসন্ধ্যা, মেহেদি অনুষ্ঠান, আশীর্বাদ কিংবা বিয়ে-বউভাত।
মডেল: এফা
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: ক্যানভাস