ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাশন I রিডিউডস ক্যাপাসিটি
পাঁচ শ থেকে হাজার লোকের বরাদ্দ কমতে কমতে ঠেকেছে দুই শর ঘরে। লাক্সারি স্লোডাউনের কারণে এমন বেহাল, নাকি শোর এমন ইন্টিমেট ফরমেট হয়ে উঠেছে এক্সক্লুসিভিটি প্রদর্শনের নতুন পন্থা। জানার তাগিদ অনুভূত হয় বৈকি
পরিসর ছোট হয়েছে ফ্যাশন উইকগুলোর শোর। প্যারিসের গেল আয়োজন তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ। সিজনের কমবেশি সব কটি শোই ছিল ইন্টিমেট। কোনো কোনো লেবেল তো সরাসরি বাজেটটাই কমিয়ে দিয়েছে। কেউ কেউ আবার ঢেলে সাজিয়েছে আমন্ত্রিতদের তালিকা। এডিটর, সেলিব্রিটি থেকে ইনফ্লুয়েন্সার—ছাঁটাইয়ের লিস্টে যোগ হতে বাদ পড়েননি কেউই।
‘উই আর অপারেটিং উইদ আ রিডিউসড ক্যাপাসিটি’ ইদানীং ফ্যাশন উইকে খুবই প্রচলিত বাক্য। অনেকে একে আবার চিট কোড হিসেবে ধরেন, যার মূল ভাষ্য—‘আমরা অন্যদের অগ্রাধিকার দিচ্ছি।’ কিন্তু এবারের অটাম, উইন্টার ২০২৫-এর শোগুলোতে এটাই যেন বাস্তবতায় রূপান্তরিত হয়েছিল। প্যারিসে অনেক শো উপস্থাপিত হতে দেখা গেছে সীমিত পরিসরে। ফলাফল—অসন্তোষ জাগে এমন অনেক এডিটর ও ক্রেতাদের মনে যারা শোতে জায়গা পাননি। চারটা বড় ফ্যাশন উইকেই বাঘা বাঘা ব্র্যান্ডের অতিথি সংখ্যা পাঁচ শ থেকে হাজার। কিন্তু এ বছর সারাহ বারটনের বহুল প্রতীক্ষিত জিভাঁশির শোতে আমন্ত্রিতদের সংখ্যা ছিল মাত্র তিন শ। একইভাবে পুরো সিজনের সবচেয়ে আকাঙ্ক্ষিত হায়দার আকারমেনের টম ফোর্ডের শোর জন্য মাত্র দুই শ সিট বরাদ্দ ছিল। ব্যাপারটা নিয়ে অবশ্য দুই ডিজাইনারকেই একদম সুনির্দিষ্ট মন্তব্য করতে দেখা গেছে।
বারটনের ভাষ্যমতে, তার উদ্দেশ্য ছিল উপস্থিত এবং তার নকশা করা পোশাকের মধ্যে নৈকট্য তৈরি করা। মডেলদের কতটা কাছে অতিথিবৃন্দের নিয়ে যাওয়া যায়, তিনি সেই নিরীক্ষা করার জন্য তার শোটিকে এমন ইন্টিমেন্ট করে তোলেন। একইভাবে নিউইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে হায়দার বলেন, তিনিও তার শোটিকে ইন্টিমেট অনুভূত করাতে চেয়েছিলেন। তার দৃঢ়বিশ্বাস, এটাই লাক্সারি বা বিলাস; যা সবার জন্য বা সবখানে সুলভ নয়।
এক্সক্লুসিভিটি আর ইন্টিমেসির এই সূত্র প্রয়োগের ফলে শো ফরমেট পাল্টে যাচ্ছে। ঢেলে সাজানো হচ্ছে অতিথি তালিকা। সম্পাদক, ক্রেতা, ইনফ্লুয়েন্সার, সেলিব্রিটি এমনকি বন্ধুদের অনুপাতকেও পর্যবেক্ষণ করা হয় পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে। উদ্দেশ্য—বিনিয়োগ থেকে সেরা রিটার্ন তুলে আনা।
এ বছর অনেক ম্যাগাজিনের এডিটরদের আক্ষেপ করতে শোনা গেছে টিমের জন্য ফ্যাশন শোগুলোর টিকিট জোগাড় করা নিয়ে। ফ্রন্ট রোতে বসা অনেকে এই সিজনে হয় আমন্ত্রণ পাননি অথবা সিট পেয়েছেন দ্বিতীয় সারিতে। যা শো নিয়ে লিখতে বা ছবি তোলার ক্ষেত্রে চরম প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। ফলে প্রায় একই রকম দেখা গেছে বেশির ভাগ এডিটর ও ক্রেতার কাছে থাকা ছবিগুলো। ব্র্যান্ডগুলো যখন কোনো প্রতিষ্ঠানের জন্য মাত্র একটা টিকিটের ব্যবস্থা করে, তখন তা এডিটর-ইন-চিফ বা সিইওর জন্য বরাদ্দ হয়। যারা সাধারণত পাবলিকেশনের রিপোর্টিং অথবা কনটেন্টের ছবি তোলার সঙ্গে জড়িতও নন। ব্যাপারটা খুবই অসুবিধাজনক।
অর্থনৈতিকভাবে বর্তমানে এটা বেশ বোধগম্য, কেন ব্র্যান্ডগুলো তাদের কস্ট কাটিং নিয়ে ব্যস্ত। লাক্সারি স্লোডাউনের প্রভাব ইন্ডাস্ট্রিতে অনেক ক্ষেত্রে এখনো বিদ্যমান। অনেক জনপ্রিয় বিলাসবহুল ব্র্যান্ডের বিক্রি-বাট্টা এখনো নিম্নগামী; যা সামাল দিতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে। ঠিক তখন হাই-ক্যাপাসিটি ফ্যাশন শোগুলোর পেছনে শত সহস্র ডলার খরচ করে যদি মিলিয়নের ঘরে বিক্রি না পৌঁছায়, সে ক্ষেত্রে খরচের রাশ টেনে ধরাতেই আগ্রহী ব্র্যান্ডগুলো। সেই সঙ্গে স্মার্ট হতে দেখা গেছে গেস্ট লিস্ট তৈরির ক্ষেত্রেও। সংখ্যায় নয়, প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে ভ্যালু অ্যাডিশনের ক্ষেত্রে। সেরা প্রেস, কমার্শিয়াল পারফরম্যান্স আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সম্প্রসারণ যেন নিশ্চিত হয়, সে চেষ্টাই করছে ব্র্যান্ডগুলো।
শুধু কি শোর ক্ষেত্রে, খরচ কমিয়ে আনা হয়েছে আমন্ত্রণপত্রেও। একদমই কম সংখ্যায় ফিজিক্যাল ইনভিটিশন গেছে এই সিজনে; বরং ব্যবহার করা হয়েছে ই-মেইল ও কিউআর। পোস্ট-প্যানডেমিক সময়ে ফ্যাশন শোগুলোতে প্রদর্শন এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কতটা শেয়ার হচ্ছে, এ ব্যাপারগুলো বেশি প্রাধান্য পেত। টিকটকের উত্থানের ফলে জেন-জিদের আকর্ষণ করার জন্য মুখিয়ে উঠেছিল ব্র্যান্ডগুলো। এখন যেহেতু বয়সে তরুণ উচ্চাকাঙ্ক্ষী বিলাসী ক্রেতাদের ব্যয়ের হার ধীরে ধীরে কমছে, ব্র্যান্ডগুলো ঝুঁকতে শুরু করেছে বয়স্ক, খরুচে ক্রেতাদের দিকে। যারা স্বভাবতই তারকা, ইনফ্লুয়েন্সার আর সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ে মাথা কম ঘামান; বরং নৈপুণ্য আর ঐতিহ্য তাদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
এক্সক্লুসিভিটি অ্যান্ড ইন্টিমেসি
মজার ব্যাপার হচ্ছে, এখন তরুণেরাও ঝুঁকতে শুরু করেছেন ইন্টিমেট শোর প্রতি। যেসব ব্র্যান্ড একটু আড়ালে-আবডালে থেকে কাজ করছে, তাদের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে দিন দিন। কারণ, এমন অন্তরঙ্গ আয়োজন স্বাতন্ত্র্য বাড়ায় এবং আকাঙ্ক্ষিত করে তোলে। এ ক্ষেত্রে এরমেস এবং দ্য রো-এর দেখানো পথে হাঁটতে শুরু করেছে অনেক ব্র্যান্ড। স্লোডাউন এ ব্র্যান্ড দুটোকে মোটেই দমাতে পারেনি। কারণ, এগুলো হাইপার এক্সক্লুসিভ এবং একান্তে কাজ করাকে প্রাধান্য দেয়। দ্য রো তো তাদের শোর ছবি তোলার ক্ষেত্রে এমবারগো বা অফিশিয়াল ব্যান জারি করে দেয় গোপনীয়তা আর স্বতন্ত্র রক্ষায়। অনেক হাউসের সঙ্গে ব্যাপারটা যায় বটে; তবে সবার ক্ষেত্রে এটা ভালো বুদ্ধি নয়। এমন পরিবেশে মূলত ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের পাশাপাশি ভোক্তাদেরকেও প্রাধান্য দেওয়া হয় বেশি।
ইন্ডাস্ট্রি ইনসাইডারদের মত, রিডাকশন ক্যাপাসিটি ফরমেটের সঙ্গে অর্থনীতির আসলে কোনো যোগ নেই। কারণ, বিভিন্ন সময় অনেক ছোট শো আয়োজনেও খরচ হয় দেদার। আসলে ব্র্যান্ডের অ্যাজেন্ডার ওপর নির্ভর করে অনেক কিছু। অনেক ব্র্যান্ড ইন্টিমেসিকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে দুটি শোর আয়োজনও করে থাকে। আবার ভেন্যু নির্বাচনের ওপরও নির্ধারিত হয় অতিথির সংখ্যা। সে ক্ষেত্রে বাজেট কোনো সমস্যা নয়। অনেক সময় নির্দিষ্ট ভেন্যুতে থিম মেনে শো করার জন্য ব্র্যান্ডগুলোর অতিথি সংখ্যা কমাতে হয়।
স্ট্র্যাটেজিক মুভ
একটি বড় ফ্যাশন শোর গড় মিডিয়া ইমপ্যাক্ট ভ্যালু এবং আসনসংখ্যার ওপর ভিত্তি করে সাধারণত তার টিকিটের মূল্য নির্ধারিত হয়; যা ৭৭ হাজার ডলারের আশপাশে হবে। তাই ক্যাপাসিটি রিডিউস করার সময় কৌশলগত হওয়া জরুরি। মিডিয়া ইমপ্যাক্ট ভ্যালু সাধারণত একটা শোর সঙ্গে সম্পর্কিত পোস্ট, খবরের কাগজে ছাপা আর্টিকেল উল্লেখ আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিক্রিয়ার আর্থিক মূল্য নিয়ে পর্যালোচনা করে। এ ক্ষেত্রে সাধারণত রিটার্ন অব ইনভেস্টমেন্ট মাথায় রেখে অতিথি নির্বাচন করার পক্ষপাতী অনেক ব্র্যান্ডই। তাই বলে প্রেস আর বায়ারদের বদলে শুধু ইন্ডাস্ট্রির মেধাবীদের আমন্ত্রণ জানানো হবে, ব্যাপারটা তেমন নয়। শুধু মিডিয়া ইমপ্যাক্ট ভ্যালু নির্ধারণ করে শোর অতিথি নির্ধারিত হয় না। আর সামনের সিটে বসতে পারেননি বলে সিজনের শো কাভার করবেন না, এমন অদূরদর্শিতাও কোনো এডিটর সাধারণত দেখান না। কারণ, এই ইন্ডাস্ট্রি চলে সম্পর্কের ভিত্তিতে। তবে ইন্ডাস্ট্রির বড় বড় শো যেন তাদের ফুল ক্যাপাসিটিতে আবার আয়োজনগুলো করতে পারে, সেই আশা সংশ্লিষ্ট অনেকের। কিন্তু ইন্টিমেট শোগুলোতে যে অভিনব ভাইব তৈরি হয়, তা অস্বীকারের উপায়ও কি আছে?
জাহেরা শিরীন
ছবি: ইন্টারনেট