skip to Main Content

কভারস্টোরি I প্রোটিন পাওয়ারহাউস

পুষ্টি উপাদান হিসেবে প্রোটিন নিয়ে আগ্রহ এখন শুধু ফিটনেসের সীমায় আটকে নেই; এটি একধরনের নতুন খাদ্যচেতনার প্রতীকে পরিণত হয়েছে। প্রোটিন পাওয়ারহাউস তাই এ সময়ের খাদ্যসংস্কৃতির এক প্রবল দাপুটে পরিভাষা। এ ঘিরে বিশদ লিখেছেন সুবর্ণা মেহজাবীন

গরম ভাতে ঘি আর ডাল, কিংবা মুচমুচে পরোটার সঙ্গে ডিমের ঝোল—এসব খাবারের গন্ধে জড়ানো থাকে একরাশ স্মৃতি, আরাম আর নিজস্বতা। খাওয়াকে ঘিরে বাঙালির কত আবেগ, উৎসব; আর সেই খাবারের প্রতিটি স্তরেই জড়িয়ে আছে আমাদের সাংস্কৃতিক পরিচয়। তবে এই পরিচয় এখন সময়ের পালাবদলে নতুন রূপ নিচ্ছে—পাতে শুধু স্বাদ নয়, চাই পুষ্টিও। স্বাস্থ্য ও সুস্থতার প্রতি নতুন করে চোখ খুলেছে আমাদের খাদ্যচেতনা।
এই পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় উঠে এসেছে এক আধুনিক শব্দবন্ধ ‘প্রোটিন পাওয়ারহাউস’। একসময় এই শব্দবন্ধ ছিল কেবল জিমপ্রেমী তরুণদের আড্ডার বিষয়; এখন ধীরে ধীরে সাধারণ মানুষের ডাইনিং টেবিলেও জায়গা করে নিচ্ছে। কারণ, সুস্থ থাকার লড়াইয়ে আজ আমরা বুঝে গেছি, শুধু পেট ভরলেই চলে না; শরীরের প্রয়োজনের কথাও ভাবতে হয়। ঠিক এই বোধ থেকেই প্রোটিন নিয়ে আগ্রহ বাড়ছে। কোথায় আছে বেশি, কোন উৎস সবার নাগালের মধ্যে, কোনটা শিশু-বুড়ো সবার জন্য নিরাপদ—এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন অনেকে। এই নতুন খাদ্যচেতনা শুধু শহরে নয়; ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে গ্রামাঞ্চলেও।
প্রোটিন আমাদের শরীরের প্রতিটি কোষ, টিস্যু, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ এবং এনজাইম, হরমোন ও অ্যান্টিবডির ভিত্তি। অ্যামিনো অ্যাসিড নামক উপাদান দিয়ে গঠিত এই পুষ্টি উপাদান শরীরের প্রতিনিয়ত চলমান নির্মাণ ও মেরামতের কাজে প্রধান ভূমিকা পালন করে। একটি পূর্ণাঙ্গ প্রোটিন উৎসে থাকা নয়টি এসেনশিয়াল অ্যামিনো অ্যাসিড আমাদের দেহ নিজে থেকে তৈরি করতে পারে না; তাই খাদ্য থেকে তা গ্রহণ করতে হয়। প্রতিদিন আমাদের দেহে লক্ষাধিক পুরোনো কোষ ধ্বংস এবং নতুন কোষ তৈরি হয়। এই পুনর্গঠনের কাজ চালাতে প্রোটিন থাকা চাই-ই চাই। প্রোটিন ছাড়া হিমোগ্লোবিন তৈরি হয় না; রোগ প্রতিরোধে দরকারি অ্যান্টিবডি, এমনকি মস্তিষ্কের নিউরোট্রান্সমিটারও গড়ে ওঠে না। এককথায়, শরীরের শক্তি, স্থিতি ও সুস্থতার মেরুদণ্ড হলো প্রোটিন।
পরিচয় সন্ধান
প্রোটিনের পরিমাণ ও গুণমান—উভয়ই অত্যন্ত উচ্চমানের হলে সেই খাবারকে প্রোটিন পাওয়ারহাউস বলা হয়। এই খাবারগুলো দেহের কোষ পুনর্গঠন, পেশি রক্ষণাবেক্ষণ, হরমোন উৎপাদন, রোগ প্রতিরোধ ও মানসিক স্থিতিশীলতার মতো গুরুত্বপূর্ণ শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ায় সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়। সহজ ভাষায় বললে, এই খাবারগুলোই শরীরের সেই ফুয়েল স্টেশন, যেখান থেকে প্রতিনিয়ত শক্তি ও পুনর্গঠনের জ্বালানি সরবরাহ হয়। ‘প্রোটিন পাওয়ারহাউস’ শব্দবন্ধটি প্রথমে জনপ্রিয় হয়েছিল ফিটনেস ইন্ডাস্ট্রিতে। তবে অল্প সময়ে এটি ছড়িয়ে পড়ে স্বাস্থ্যসচেতন সাধারণ মানুষের মধ্যেও। এই টার্ম শুধু প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবারের উপনাম নয়; বরং এটি একধরনের স্বাস্থ্যবোধের পরিচয়, যেখানে মানুষ বুঝে নিচ্ছে শরীর গঠনের পেছনে সবচেয়ে কার্যকর উপাদান কোনটি।
ঢাকার পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রধান পুষ্টিবিদ নিশাত শারমিন নিশি বলেন, ‘একটা সময় প্রোটিনকে কেবল দেহ গঠনকারী উপাদান হিসেবে ধরা হতো। কিন্তু এটি হরমোন, এনজাইম, ইমিউন ফাংশন, এমনকি মস্তিষ্কের কার্যক্রমেও গভীর প্রভাব ফেলে।’ এই কথার ভিত্তিতে বলা যায়, প্রোটিন এখন শুধু প্রয়োজন নয়; বরং খাদ্যচেতনার কেন্দ্রবিন্দু।
ট্রেন্ডের নেপথ্যে
প্রোটিন পাওয়ারহাউস শব্দবন্ধটি আজকের স্বাস্থ্য ও ফিটনেস জগতে একটি শক্তিশালী ট্রেন্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এর নেপথ্যে রয়েছে আধুনিক জীবনযাত্রার পরিবর্তন, স্বাস্থ্যসচেতনতার বিস্তার এবং পুষ্টিবিজ্ঞানের প্রগতি। গত কয়েক দশকে মানুষ শারীরিক সুস্থতা ও দীর্ঘায়ুর প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছে, যেখানে খাদ্যের গুণগত মানের সঙ্গে তার পুষ্টিগত উপাদানের গুরুত্ব বেড়েছে; বিশেষ করে প্রোটিনের ভূমিকা নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং জনসাধারণের মধ্যে তথ্য বিনিময়ের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় এই টার্মের জনপ্রিয়তা বেড়েছে। ফিটনেস কালচারের উত্থান এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় স্বাস্থ্যবিষয়ক ইনফ্লুয়েন্সারদের প্রচেষ্টায় প্রোটিন পাওয়ারহাউস এখন খাদ্য ও সাপ্লিমেন্টের ব্র্যান্ডিংয়ে এক আবেগময় প্রতীক হিসেবে আবির্ভূত।
মানবদেহে প্রোটিনের প্রয়োজনীয়তা
একটি শিশুর বেড়ে ওঠা মানেই যেন প্রতিনিয়ত নতুন এক শরীরের নির্মাণ। জন্মের পর থেকে কৈশোর অবধি এই নির্মাণযজ্ঞের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো প্রোটিন। হাড়ের গাঁথুনি, পেশির বল, ত্বকের লাবণ্য কিংবা চুলের স্বাস্থ্য—সবকিছুর মূলে রয়েছে এই পুষ্টি উপাদান। তবে প্রোটিন শুধু দেহ গঠনের গল্প বলে না; বরং শিশুর মানসিক বিকাশ, রোগ প্রতিরোধক্ষমতা এবং হরমোনের স্বাভাবিক কার্যক্রমেও সমানভাবে ভূমিকা রাখে। অর্থাৎ, শিশুর বেড়ে ওঠা শুধু দৈহিক নয়, একটি পূর্ণাঙ্গ মানুষে পরিণত হওয়ার ভিত গড়তেই প্রোটিনের বিকল্প নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বয়সভেদে প্রোটিনের চাহিদা ভিন্ন। এক থেকে তিন বছর বয়সী শিশুর দিনে প্রয়োজন প্রায় ১৩ গ্রাম প্রোটিন, চার থেকে আট বছর বয়সীদের জন্য তা ১৯ গ্রাম, আর ৯ থেকে ১৩ বছর বয়সে গিয়ে এই চাহিদা পৌঁছায় ৩৪ গ্রামে। এই প্রোটিন চাহিদা পূরণে খাদ্যতালিকায় থাকা চাই ডিম, দুধ, মাছ, মাংস, ডাল, বাদাম ও সয়াবিনের মতো প্রাকৃতিক উৎস; বিশেষ করে ডিম একটি সহজলভ্য ও নির্ভরযোগ্য প্রোটিন পাওয়ারহাউস, যেখানে একটি বড় ডিমে থাকে প্রায় ৬ গ্রাম উচ্চমানের প্রোটিন। স্কুলগামী শিশুর প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় একটি ডিম, এক কাপ দুধ আর এক মুঠো বাদাম অন্তর্ভুক্ত করা গেলে দৈনিক প্রোটিন চাহিদার অনেকটা পূরণ হয়ে যাবে। তবে শুধু পরিমাণ নয়, খাদ্যের উৎসে বৈচিত্র্যও সমান গুরুত্বপূর্ণ। এ বিষয়ে অভিভাবকদের ভূমিকা সবচেয়ে বড়। শিশুর ডায়েটে সুষম প্রোটিন নিশ্চিতে তাদের প্রতিদিনের খাবারে বৈচিত্র্য, পরিমাণ ও মান—সবকিছুর প্রতি সচেতন দৃষ্টি রাখা জরুরি। কারণ, আজকের খাদ্যাভ্যাসই গড়ে দেবে আগামী দিনের সুস্থ সবল প্রজন্ম।
অন্যদিকে, বয়স যত বাড়ে, শরীরের ভেতরে চলতে থাকা সূক্ষ্ম জৈবিক ভারসাম্য ততটাই বদলাতে শুরু করে। পেশির পরিমাণ কমে যায়, হাড়ের ঘনত্ব দৃঢ়তা হারায়, রোগ প্রতিরোধক্ষমতাও দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়ে। এই প্রাকৃতিক অথচ প্রতিকূল পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সঙ্গী হতে পারে প্রোটিন। বিশেষ করে ষাট বছর পেরোলেই শরীর এক বিশেষ ধরনের পেশিক্ষয়জনিত সমস্যার মুখোমুখি হয়, যাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানে বলে সারকোপেনিয়া। চলাফেরা ধীরে ধীরে কঠিন হয়ে পড়ে, মেরুদণ্ডের স্থায়িত্ব কমে যায়, ন্যুব্জতা গ্রাস করতে শুরু করে শরীরকে। অথচ এই পরিস্থিতি প্রতিরোধে প্রতিদিনকার খাবারে পর্যাপ্ত প্রোটিন থাকলে অনেকাংশেই এই ক্ষয়রোধ সম্ভব। গবেষণা বলছে, সুস্থ একজন প্রবীণ ব্যক্তির দৈনিক প্রয়োজন তার শরীরের প্রতি কেজি ওজন অনুপাতে ১ থেকে ১ দশমিক ২ গ্রাম প্রোটিন। অর্থাৎ, ৬০ কেজির একজন বয়স্ক মানুষের প্রয়োজন ৬০ থেকে ৭০ গ্রাম প্রোটিন। কিন্তু বাস্তব চিত্র হলো, আমাদের দেশের প্রবীণদের বড় একটি অংশ এই পরিমাণ প্রোটিন পায় না। ডায়েটে প্রোটিনের অভাব তাদের দুর্বল করে তোলে, শরীরে প্রাণশক্তির ঘাটতি তৈরি হয়, হাঁটাচলায় ব্যথা অনুভব করেন, এমনকি হাড় ভেঙে যাওয়ার ঝুঁকিও বেড়ে যায়। এই অবস্থায় খাদ্যতালিকা নিয়ে সচেতন হওয়া জরুরি। প্রবীণদের জন্য হালকা, সহজপাচ্য, অথচ উচ্চমানের প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার হতে পারে সবচেয়ে কার্যকর পন্থা। যেমন মুগ ডাল বা মিক্সড ডালের পাতলা স্যুপ, ডিমের সাদা অংশ, ছানা, দুধ, মাছ বা হালকা সেদ্ধ মাংস; পাশাপাশি যারা মুখে খাবার খেতে সমস্যা অনুভব করেন কিংবা হজমের জটিলতায় ভুগছেন, তারা চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে বিশেষ প্রোটিন সাপ্লিমেন্টও ব্যবহার করতে পারেন।
এখানে লক্ষ রাখা চাই, প্রোটিন যেন শুধু পুষ্টি নয়; বরং প্রবীণ জীবনের নতুন ভরসাও হয়ে ওঠে। কারণ, বয়স বাড়লেও সজীবতা ধরে রাখার প্রয়োজন কখনোই ফুরিয়ে যায় না।
অতিরিক্তে অপকার
প্রোটিন নিয়ে আমাদের সমাজে প্রচলিত অনেক মিথ বা ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে, যা একদিকে যেমন খাদ্যাভ্যাসে বিভ্রান্তি তৈরি করে, তেমনি শরীরের ওপর ফেলে অপ্রত্যাশিত চাপ। একটি চলতি ভ্রান্ত ধারণা হলো, বেশি প্রোটিনযুক্ত খাবার মানেই পেশি দ্রুত বাড়বে কিংবা সুস্থতা নিশ্চিত হবে। কিন্তু বাস্তবতা অনেক জটিল। অতিরিক্ত প্রোটিন গ্রহণ শরীরের জন্য সব সময় উপকারী নয়; বরং প্রয়োজন অনুযায়ী সঠিক পরিমাণ গ্রহণ করাই স্বাস্থ্যকর। প্রোটিন মূলত নাইট্রোজেন যুক্ত একটি যৌগ, যা অতিরিক্ত গ্রহণ করলে দেহে ইউরিয়ার মাত্রা বেড়ে যায়, আর তা নিঃসরণের জন্য কিডনিকে করতে হয় অতিরিক্ত পরিশ্রম। এই অবস্থা দীর্ঘস্থায়ী হলে কিডনির কার্যক্ষমতা মারাত্মকভাবে কমে যেতে পারে; বিশেষত যাদের আগে থেকেই কিডনিসংক্রান্ত জটিলতা রয়েছে, তাদের জন্য এটি ডেকে আনতে পারে বিপদ। শুধু কিডনি নয়; অতিরিক্ত প্রোটিনের ভার সামলাতে গিয়ে লিভারও আক্রান্ত হতে পারে।
এ ছাড়া উচ্চমাত্রায় প্রোটিন গ্রহণে কোষ্ঠকাঠিন্য, হজমের জটিলতা, পানিশূন্যতা, এমনকি ক্যালসিয়ামের ভারসাম্যহীনতাও দেখা দিতে পারে। অনেক সময় হাই-প্রোটিন ডায়েটের মোহে পড়ে কেউ কেউ প্রয়োজনীয় শাকসবজি, ফলমূল ও ফাইবার বাদ দেন; ফলে শরীরের সামগ্রিক মেটাবলিজম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অতিরিক্ত প্রোটিন খাদ্যের সঙ্গে জড়িত চর্বি ও ক্যালরি শরীরে বৃদ্ধি পায়, যা ওজন বাড়ানোর পাশাপাশি হৃদ্‌রোগ, উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ায়।
প্রোটিন গ্রহণের জন্য নির্দিষ্ট সময় ও খাদ্যের সঙ্গে সুষম ভারসাম্য বজায় রাখাও গুরুত্বপূর্ণ, যা অনেকে উপেক্ষা করেন। এই ভ্রান্ত ধারণাগুলো মানুষের শরীরের প্রকৃত চাহিদা ও স্বাস্থ্যগত প্রভাব বুঝতে এবং প্রোটিন সম্পর্কে বাস্তবসম্মত ধারণা অর্জনে বাধা দেয়।
বিশেষজ্ঞ ভাষ্য
প্রোটিন নিয়ে আমাদের ভাবনার কেন্দ্রে সব সময় ‘পর্যাপ্ততা’ শব্দটি ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু সেটি কতটুকু পর্যাপ্ত? এই প্রশ্নের উত্তর আসলে একরৈখিক নয়; বরং তা নির্ভর করে ব্যক্তির বয়স, লিঙ্গ, দৈহিক পরিশ্রমের মাত্রা এবং সার্বিক স্বাস্থ্য পরিস্থিতির ওপর। এ কথাই স্পষ্ট করে বললেন পুষ্টিবিদ নিশাত শারমিন নিশি। তার মতে, ‘প্রোটিনের ঘাটতি যেমন দেহের গঠনতন্ত্রে ব্যাঘাত ঘটায়, তেমনি অতিরিক্ত গ্রহণও শরীরের ওপর একধরনের চাপ তৈরি করে।’ তিনি ব্যাখ্যা করেন, প্রত্যেক মানুষ আসলে আলাদা বায়োলজিক্যাল কাঠামো। সে কারণে যে পরিমাণ প্রোটিন একজন কিশোর ক্রীড়াবিদের জন্য প্রয়োজন, তা একজন মধ্যবয়স্ক অফিসকর্মীর জন্য মোটেই প্রযোজ্য নয়। ফলে কেউ নিজের অনুমানে ডায়েট নির্ধারণ না করে পুষ্টিবিদের পরামর্শ নেওয়া যুক্তিসংগত।
নিশি আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরেন; তা হলো প্রোটিনের উৎস নির্বাচন। ‘শুধু প্রাণিজ উৎসের দিকে ঝুঁকে থাকলে চলবে না; আবার শুধু উদ্ভিজ্জ উৎসেও প্রয়োজনীয় অ্যামাইনো অ্যাসিড পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে,’ বলেন তিনি। তাই ডিম, মাছ ও মাংসের পাশাপাশি ডাল, ছানা, বাদাম ও সবজির বৈচিত্র্যও থাকা চাই প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায়। এই ভারসাম্য শরীরের কোষ থেকে শুরু করে হরমোনের কার্যকারিতায় একান্ত প্রয়োজনীয় প্রোটিনের পূর্ণাঙ্গ প্যাকেজ নিশ্চিত করে।
একটি সতর্কবার্তাও সংযুক্ত করেছেন এই পুষ্টিবিদ। তা হলো, প্রোটিন হজমের প্রক্রিয়ায় শরীরে পানির প্রয়োজন অনেক বেশি। সুতরাং, যারা প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার খাচ্ছেন, তাদের পর্যাপ্ত পানি পানের বিষয়টিও নিশ্চিত করা সমান গুরুত্বপূর্ণ; বিশেষ করে কিডনিতে সমস্যা রয়েছে, এমন ব্যক্তিদের জন্য এটি হতে পারে জীবনরক্ষাকারী এক সতর্কতা।
সর্বশেষ যে পরামর্শ দিয়েছেন নিশাত শারমিন নিশি, সেটি প্রায় দর্শনের মতোই শোনায়। প্রোটিনকে আমাদের খাদ্যাভ্যাসের একটি মৌলিক ও সচেতন অংশ করে তুলতে হবে। তবে সেটি যেন হয় বৈচিত্র্যপূর্ণ, পরিমিত ও সুষম। তাহলেই দীর্ঘ মেয়াদে শরীরের প্রতিরোধক্ষমতা যেমন বাড়বে, তেমনি স্বাস্থ্যগত স্থিতিশীলতাও।
প্রোটিন ও বাঙালির খাদ্যসংস্কৃতি
প্রাচীনকাল থেকেই বাঙালির রান্নাঘরে প্রোটিন ছিল এক অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ। মাছের ঝোল আর ডাল-ভাত ছিল শুধু স্বাদের নয়; বরং পুষ্টিরও নির্ভরযোগ্য উৎস। গ্রামবাংলার রান্নায় ছোলার ডাল, কলার কোপ্তা কিংবা ডিমের তরকারি যেমন ছিল সাদামাটা খাবার; তেমনি প্রোটিনের ঘরোয়া সম্পদ। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে খাদ্যাভ্যাসে এসেছে বৈচিত্র্য; সেই সঙ্গে বেড়েছে পুষ্টি নিয়ে সচেতনতা। আজ আর প্রোটিন শুধু শহরের স্বাস্থ্যসচেতন মানুষদের আলোচনার বিষয় নয়; খাদ্যতালিকা নিয়ে এখন গ্রামগঞ্জেও চিন্তা বাড়ছে। যদিও এখনো নিম্ন আয়ের অনেক পরিবারে দৈনন্দিন প্রোটিনের চাহিদা পূরণে ঘাটতি থাকে; তবু সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্য ও পুষ্টি নিয়ে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন স্পষ্ট।
স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান লাইফস্প্রিংয়ের পুষ্টিবিদ নিগার সুলতানা মনে করেন, রান্নায় সামান্য পরিকল্পনা ও সচেতনতা থাকলেই প্রতিদিনের প্রোটিন চাহিদা পূরণ সম্ভব। তার মতে, ‘সকালে একটি ডিম, দুপুরে ডাল বা মাছ, আর রাতে দুধ বা ছানা—এই সাধারণ বিন্যাসেই প্রতিদিনের পুষ্টির বড় একটি অংশ নিশ্চিত করা যায়।’ এখানে মূলকথা একটাই, প্রোটিন পাওয়ার জন্য বড় কোনো খাদ্যবিপ্লবের দরকার নেই। প্রয়োজন শুধু রান্নায় বৈচিত্র্য, পুষ্টির প্রতি সচেতনতা এবং আমাদের ঐতিহ্যবাহী খাবারগুলোর মধ্যে প্রোটিনের মূল্য অনুধাবন। কারণ, খাদ্য কেবল স্বাদের জন্য নয়; সেটি হওয়া চাই সুস্থতার চালিকাশক্তিও।
সামাজিক সংশয় রোধে
প্রোটিন ঘিরে সমাজে প্রচলিত কিছু অদ্ভুত এবং কখনো কখনো বিপজ্জনক ভ্রান্ত ধারণা আজও আমাদের খাদ্যসংস্কৃতিতে ছাপ ফেলে রেখেছে। এখনো অনেক পরিবারে বিশ্বাস করা হয়, প্রতিদিন ডিম খেলে নাকি কোলেস্টেরলের মাত্রা আকাশ ছোঁবে। আবার ডালকে দেখা হয় ‘গরিবের খাবার’ হিসেবে, যেন এতে পুষ্টির কোনো মূল্য নেই। নারীদের ক্ষেত্রে এই বিভ্রান্তি আরও গভীর। অনেকে ভাবেন, বেশি প্রোটিন খেলে শরীর ভারী হয়ে যাবে, আকর্ষণ হারাবে। শিশুদের ক্ষেত্রেও এমন ধারণা রয়েছে—শুধু ভাত-তরকারিই যথেষ্ট, অতিরিক্ত কিছু লাগবে না।
এসব ভ্রান্ত ধারণা বা বিভ্রান্তির পেছনে আছে শিক্ষা ও সচেতনতার ঘাটতি; বিশেষ করে গ্রামীণ সমাজে আজও অনেক বাবা-মা মনে করেন, ‘এত দামি খাবার ছেলেমেয়েকে খাওয়ানোর টাকা পাব কোথায়?’ অথচ বাস্তবতা হলো, খরচ না বাড়িয়েও দৈনন্দিন খাদ্যাভ্যাসে কিছু সহজ পরিবর্তন এনে প্রোটিনের ঘাটতি সহজে পূরণ করা সম্ভব। একটি ডিম, এক মুঠো মুগ ডাল কিংবা এক টুকরো মাছ প্রতিদিনের খাবারে যুক্ত করলেই অনেকাংশে পূরণ হতে পারে শরীরের প্রয়োজনীয় প্রোটিন চাহিদা।
বিভ্রান্তি ও ভ্রান্ত ধারণাগুলো শুধরে দিতে প্রয়োজন একটি বিস্তৃত গণসচেতনতা অভিযান। প্রোটিনকে শুধু শরীর গঠনের নয়; বরং জীবনের স্থায়িত্ব ও সুস্থতার অপরিহার্য অনুষঙ্গ হিসেবে তুলে ধরা চাই সমাজের প্রতিটি স্তরে। টেলিভিশন, রেডিও, সোশ্যাল মিডিয়া, এমনকি স্কুল পর্যায়ের পাঠ্যক্রমেও স্মার্ট আহারের ধারণা অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি। কারণ, একুশ শতকের পুষ্টিবিদ্যা এখন স্পষ্ট করে বলছে, শুধু পেট ভরানো নয়; বরং সচেতনভাবে পুষ্টি নিশ্চিত করাই আধুনিক স্বাস্থ্যচেতনার মূলমন্ত্র।
আধুনিক ধারা ও ভবিষ্যৎ
প্রোটিন নিয়ে শহুরে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে আগ্রহ এখন শুধু ফিটনেসের সীমায় আটকে নেই; এটি একধরনের নতুন খাদ্যচেতনার প্রতীক। বিশেষত যারা নিয়মিত জিমে যান বা শরীরচর্চা করেন, তাদের অনেকে ব্যক্তিগত ট্রেইনারের পরামর্শে প্রোটিন শেক বা সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করছেন। কিন্তু এই প্রবণতা কতটা প্রয়োজনীয়, আর কতটা অন্ধ অনুকরণ?
পুষ্টিবিদ নিশাত শারমিন নিশি বলছেন, যাদের খাদ্যতালিকায় এরই মধ্যে পর্যাপ্ত প্রোটিন আছে এবং যারা কঠোর ফিজিক্যাল ট্রেনিং করেন না, তাদের জন্য অতিরিক্ত প্রোটিন সাপ্লিমেন্ট প্রয়োগ অনর্থক তো বটেই; দীর্ঘ মেয়াদে শরীরের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এর বিপরীতে নিরামিষভোজী, প্রবীণ বা যারা শারীরিক কারণে আমিষ গ্রহণে সীমাবদ্ধতা মানতে বাধ্য, তাদের জন্য নির্দিষ্ট প্রোটিন সাপ্লিমেন্ট হতে পারে কার্যকর বিকল্প; তবে সেটি হওয়া চাই কোনো পুষ্টিবিদ বা চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে।
আধুনিক বিশ্বের পুষ্টিবিজ্ঞান আজ আর শুধু পুষ্টির পরিমাণ নিয়ে চিন্তা করছে না; বরং সেটি কতটা পরিবেশবান্ধব, সবার নাগালের মধ্যে ও ভবিষ্যতের জন্য টেকসই—এই প্রশ্নগুলোও সামনে এসেছে। তাই সাসটেইনেবল প্রোটিন এখন বৈশ্বিক গবেষণার কেন্দ্রবিন্দু। উদ্ভিজ্জ বা প্ল্যান্ট-বেসড প্রোটিন, পোকানির্ভর বা ইনসেক্ট প্রোটিন, ল্যাবে তৈরি মাংস কিংবা ফার্মড ফিশ—সবই এখন ভবিষ্যতের খাদ্যশৃঙ্খলে যুক্ত হওয়ার পথে।
বাংলাদেশও এই বৈশ্বিক ঢেউ থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। এরই মধ্যে কিছু তরুণ উদ্যোক্তা স্থানীয়ভাবে প্রোটিন বার, দুধভিত্তিক উচ্চ প্রোটিন পানীয় এবং ভেজিটেরিয়ান বিকল্প তৈরি নিয়ে কাজ করছেন। এই নবীন প্রচেষ্টা ভবিষ্যতের খাদ্যনিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যচর্চার জন্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ; তেমনি এর সম্প্রসারণে প্রয়োজন গবেষণা তহবিল, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা এবং বৃহৎ পরিসরে জনসচেতনতা তৈরি।
তবে শেষ কথা একটাই—প্রোটিন যেন হয় প্রয়োজনের মতো, প্রজ্ঞার মতো। ভরসা রাখা চাই বৈচিত্র্যময় খাদ্যাভ্যাসে, ভুল ভাঙাতে হবে সামাজিক সংস্কারে, আর নিজের শরীরের ভাষা বুঝে নিতে হবে নিজেকেই। কারণ, পুষ্টির এই অধ্যায়ে প্রোটিন কেবল একটি উপাদান নয়; এটি হয়ে উঠেছে এক নতুন জীবনদর্শনের নাম। যে দর্শন বলছে, সুস্থতা শুরু হয় প্রতিদিনের প্লেট থেকে। আর সেই প্লেটেই যদি জায়গা করে নেয় সঠিক প্রোটিন, তবে প্রোটিন পাওয়ারহাউস হয়ে উঠবে শুধু ব্যক্তি নয়, সমগ্র মানবসভ্যতার স্বাস্থ্যবান আগামী দিনের চমৎকার প্রতিচ্ছবি।

মডেল: তমা মির্জা
মেকওভার: পারসোনা
ওয়্যারড্রোব: ব্লুচিজ
ছবি: কৌশিক ইকবাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top