ফিচার Iগৃহতত্ত্ব
ঘরের ধারণার সঙ্গে রয়েছে ‘আমি’র সম্পর্ক। রোদ, জোৎস্না, হাওয়া, বৃষ্টি, মানুষ- সব যখন প্রবেশ্য হয়ে ওঠে, তখনই তা পূর্ণতা পায়। লিখেছেন সুপ্রভা জুঁই
দুর্গাপূজার মূল আনন্দটা এ কারণেই যে দুর্গা ঘরে ফিরছেন, মানে বাপের বাড়িতে, তাঁর জন্মস্থানে। যেমন এই চিত্রে দেখা যাচ্ছে, পার্বতী আসছেন মা-বাবার বাড়িতে সিংহের পিঠে চড়ে, সামনে পুত্র গণেশকে বসিয়ে। পাশে জীর্ণ দশায় আসছেন শিব।
বছরে এই একবার ঘরে ফেরা। তবে বিরাট এই উৎসব কেবল দুর্গার নয়, সব বাঙালিকে তাদের ঘরে ফেরার সুযোগ করে দেয়। যেমন দেয় ঈদ বা বড়দিন। এই ঘরকে চেনা, জানার জায়গাগুলো নিয়ে আমরা কি আলাদা করে ভেবে দেখার চেষ্টা করেছি? আসলে যা শিকড়ের, তাকেই খেয়াল করা সব থেকে কঠিন কাজ। কারণ, সে আত্মায় মিশে থাকে। ‘ঘরছাড়া’র ফিরে আসার ঘরটা কী, তা জানতে পারলেই কাজটি সম্ভব।
![](https://www.canvasmagazine.com.bd/wp-content/uploads/2018/09/ghore-baire-3.jpg)
পিতৃগৃহে ফিরছেন উমা
‘যাও গিরিবর হে, আনো যেয়ে নন্দিনী ভবনে আমার
গৌরী দিয়ে দিগম্বরে, কেমনে রোয়েছো ঘরে,
কী কঠিন হৃদয় তোমার হে।।
-কমলাকান্ত ভট্টাচার্য
‘ঘর’-এর নানা সমার্থক শব্দের একটি হলো ‘আকার’। ঘরহীন হচ্ছে ‘নিরাকার’। বুদ্ধের যেমন অনুসারী ছিলেন অনাকারিক ধর্মপাল। ঘরের কোনো অবস্থান তাদের দর্শনে নেই। আবার একেবারে যে নেই, তা নয়। মানে ‘অধ্যাত্মবাদ’কে সব সময় আমরা ‘বিষয়’ থেকে আলাদা ভাবতে অভ্যস্ত, তাতেই যত মুশকিল। আমাদের দেহ-ঘর যেমন ক’দিনের; এই ঘরও তেমনি ক্ষণস্থায়ী। এই দর্শন ছিল মূলত সক্রেটিসের। তাই ঘরকে যদি একটি যন্ত্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তবেই সেই ক’দিনের আবাসের কাছাকাছি একটা নাগাল পাওয়া সম্ভব। যেটাকে প্রখ্যাত স্থপতি করবুসিয়ার বলেছেন dwelling machine, efficient machine। সে ক্ষেত্রে গৃহযন্ত্র হিসেবে কোনটায় ভালো কাজ করানো সম্ভব, সেটাই স্থপতির লক্ষ্য।
দেহ যেমন খাঁচা, এই ঘরও তেমনই। ঘর বানানো বা ঘর বাঁধা- এজাতীয় কথার মাঝেই বন্ধনটা খুব স্পষ্ট। একটি ‘ঘর’কে ‘ঘর’ হতে হলে তার মধ্যে নিচের এই ১১টি লক্ষণের যেকোনো একটিকে খুঁজে পেতে হয়-
পরিবেশের প্রতিকূল অবস্থা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য যে স্থান তাই ‘ঘর’। যখন মানুষ রোদ ঠেকাতে কপালের উপরে হাত দিল, তখন থেকেই স্থাপত্যের সূচনা!
‘আমার’ ঘর, এইখানে ‘আমার’ শব্দটিই মুখ্য। কারণ, তা স্থানের ওপরে মালিকানা নিশ্চিত করার বার্তা দেয়।
স্থায়ী ঠিকানা একটা বড় ব্যাপার। যেকোনো কাজেই এটা গুরুত্বপূর্ণ। যা ঘরের আরেক লক্ষণ।
‘আমার’ সম্পত্তি সংরক্ষণের স্থান। ‘আমার’ কেনা যা কিছু ‘আমার’ দলিলপত্র যেখানে সুরক্ষিত ও সংরক্ষিত। অর্থাৎ, হলো accusative home ev instrumental home হলো ‘ঘর’।
কিছু বিমূর্ত ধারণার সঙ্গে ঘর আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয়, যেগুলো ঐতিহ্য, অতীত পরম্পরার সঙ্গে সম্পর্কিত, আবার ভবিষ্যতের কথাও বলে।
![](https://www.canvasmagazine.com.bd/wp-content/uploads/2018/09/ghore-baire-1.jpg)
‘মেঘে ঢাকা তারা’য় নীতা যেন আমাদের ঘরের উমা
বিশ্রাম ও রমণের স্থান হলো ‘ঘর’। বিশ্রাম বা ঘুম ঘরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। মৃত মানুষের ঘরের দরকার পড়ে না। আইরিশ ইয়াং ঘরকে home as a repair shop ভেবেছেন। আর প্রেমালাপ, হাত ধরাধরি বাইরে সম্ভব হলেও রমণের জন্য মানুষকে enclosure-এর মধ্যে আসতেই হয়।
আগুন জ্বালিয়ে রান্না করা, শীতে উষ্ণতা আনা, মোট কথা রান্নাঘরকে ‘হৃদপিন্ড’ চিন্তা করে বানানো স্থান হলো ‘ঘর’।
এখানে স্নানাগার, শৌচালয় ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে দৈনন্দিন কাজ করা যায়।
এটি নিভৃত একটি জায়গা যেখানে আবরণ খুলে নিজের শারীরিক এক্সপেরিমেন্ট সম্ভব, নিজেকে বিনির্মাণ করা যায়। আত্মবিশ্লেষণ এবং কল্পনার জন্য ঘর আদর্শ জায়গা।
সামাজিক মানুষের অসামাজিকতার স্থান অর্থাৎ পলায়নের স্থানও।
একটি ঘর হলো পুরুষতন্ত্র চর্চার প্রাচীন স্থান। রান্না, শিশুপালন, কর্তার সেবা ইত্যাদির মাঝে লিঙ্গীয় বৈষম্য এখনো টিকিয়ে রেখেছে এটি। ঘর হলো প্রাচীন গোঁড়ামির সক্রিয় একটি স্থান।
তাহলে বলা যায়, যে বাসা ছাড়েনি সে এখনো মানুষ হয়নি! তাই locative home এর ধারণা বাতিল করে বলা চলে, Ôhome is a place that we left!’। মজার বিষয় হলো, ঘর বানানোরও এটাই আসল হেতু, যেন তাকে ছেড়ে আসা যায়! জীবনানন্দ দাশ যে রকম বনলতা সেনের চোখকে তুলনা করেছেন পাখির নীড়ের সঙ্গে, সেটা সম্ভবত এই গৃহত্যাগী চেতনা থেকে। যে রকম রাম যখন দৃষ্টির বাইরে চলে যান, তখন তাঁর পিতা জানাচ্ছেন, তিনি অন্ধ হয়ে গেছেন। কারণ, তাঁর দৃষ্টি রামের সঙ্গে চলে গেছে!
এই ঘর ছাড়ার কুৎসিত একটি দিকও আছে। যেমন কলোনিয়াল ব্রিটিশ বুর্জোয়া চেতনায় কয়েকজনকে ঘরছাড়া না করলে কয়েকজনের ঘর হয় না। ‘আমার’ বাসা, ‘আমার’ এলাকা, ‘আমার’ পরিধি কী করে ঠিক হয়, তা নিয়ে একটা মজার গল্প আছে। এক আমেরিকান, তিনি বিশাল ভূমির মালিক। তার জমির এক কোণে ছোট একটা বাড়ি। এক পাগল শাবল নিয়ে এসে সেই জমিতে চাষ করতে শুরু করলে মালিক বললেন,
![](https://www.canvasmagazine.com.bd/wp-content/uploads/2018/09/ghore-baire-2-640x640.jpg)
দরজায় মৃন্ময়ী দুর্গা, কারো অপেক্ষায়
-আপনি এখানে চাষ করছেন কেন?
-আপনি বলার কে?
-আমি এই জমির মালিক!
-কী করে হলেন?
-আমার বাবা দিয়েছেন আমাকে!
-তাকে কে দিলো?
-তার বাবা!
-তাকে?
-তিনি রেড ইন্ডিয়ানদের সঙ্গে যুদ্ধ করে পেয়েছেন।
-বেশ তো! আমার কাছে শাবল আছে আমিও যুদ্ধ করবো এই জমির জন্য!
অর্থাৎ যেখানে আমার দৈহিক শ্রম মিশে আছে সেখানটাই আমার জায়গা, আমার অধিকার আছে সেখানে। তাহলে বিষয়টা দাঁড়ালো যে ‘কে’ খাটলো? ‘আমি’ খাটলাম। আমার ‘কে’ খাটলো? আমার ‘দেহ’ খাটলো। এখন এই আমার দেহটা কার! শরীরের সঙ্গে ‘আমার’ যে সম্পর্ক, আমার ঘরের সঙ্গেও তাই।
এখন কথা হলো, এই ‘আমি’ আর ‘আমার শরীর’ কি এক? এক হলে আর আমার শরীর বলা চলে না। আলাদা হলে ‘আমার’ শরীর বলা সম্ভব। আমি আর আমার শরীর একও নই আবার আলাদাও নই, তাহলে আমি আর আমার ঘরের সম্পর্কের মধ্যে একটা দার্শনিক সমস্যার সৃষ্টি হয়। এর সমাধানের আগে পর্যন্ত ঘরকে সংজ্ঞায়িত করা বেশ কঠিন। তাহলে চূড়ান্তভাবে ১১ নম্বর লক্ষণে এভাবে বলা যায়,
যে স্থানের দ্বার খুলে আমি সবাইকে আমন্ত্রণ করতে পারি সেটাই আমার ঘর। এই সকলের মাঝে প্রাণিজগৎ থেকে শুরু করে ঋতু পর্যন্ত বিরাজমান। যার কাছে অতিথি হলো ঈশ্বর সমতুল্য, তিনিই তো প্রকৃত গৃহবাসী।
রবীন্দ্রনাথ যেমন বলেছেন-
‘ওরে গৃহবাসী খোল্, দ্বার খোল্, লাগল যে দোল।
স্থলে জলে বনতলে লাগল যে দোল।
দ্বার খোল্, দ্বার খোল্
আমরা যে ঘরে রোজ ফেরত আসি, তা হলো এক মায়া। সেই চিন্তার আলোকে আমরা সবাই গৃহহীন। কিন্তু ‘এইখানে আমার ঘর ছিল’ ভেবে সেই নস্টালজিয়ার সুখ নিয়ে অতীতে ফিরে ভবিষ্যৎকে আরও নিকটবর্তী করে তোলাই হলো ঘরে ফেরার আসল মজা। এভাবেই ঘর ভেঙে ঘর করা সম্ভব। ঋত্বিক ঘটক তাঁর ‘মেঘে ঢাকা তারা’য় দেখিয়েছে ভাঙা চালের ভেতর দিয়ে তারাভরা একখন্ড আকাশ, আর ভেসে আসছে গান, ‘যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙলো ঝড়ে’। আবার বুদ্ধ ঘর ভেঙেছেন নির্বাণপ্রাপ্তির মাধ্যমে। জন্ম-জন্মান্তরের ফাঁদের এই স্থপতিকে তিনি ধরে ফেলেছেন। বলেছেন, ‘হে স্থপতি তোমার ঘরের ছাদ ফেটেছে, আমি এখন বে-ঘর, বে-আমি!’
অতুল প্রসাদের গানে যেমন-
‘আবার তুই বাঁধবি বাসা কোন সাহসে?
আশা কি আছে বাকি হৃদয়-কোষে।
কতবার গড়লি রে ঘর,
কতবার এল রে ঝড়,
কতবার ঘরের বাঁধন পড়ল খ’সে
বাহিরের মুক্ত মাঠে…
লেখাটি অরিন্দম চক্রবর্তীর স্থাপত্য দর্শন ভাবনায় অনুপ্রাণিত
Shuprava.jui.arch@gmail.com
মৃন্ময়ী দুর্গার ছবি: অতনু সিংহ