skip to Main Content

ছুটিরঘণ্টা I নমপেনে নৌকাদৌড়

তনলাছাপ নদীতে নৌকাবাইচের দৃশ্য। রাজকীয়, অভিনব, মনোমুগ্ধকর। লিখেছেন মঈনুস সুলতান

নদী ও নৌকা আমাকে তীব্রভাবে আকর্ষণ করে। তাই মি. ইয়ান সাম যখন আমাকে কম্বোডিয়ার নমপেন শহরের নৌকাবাইচ দেখার দাওয়াত দিলেন, আমি সঙ্গে সঙ্গে কীভাবে পেশাগত কাজ ফাঁকি দিয়ে নদীতীরে যেতে পারি, তার ফিকির খুঁজতে শুরু করি। অবশেষে যখন মি. ইয়ান সামের অভিজাত কেতার ভিলাটিতে এসে পৌঁছি, তখন বিকেল হচ্ছে। প্রায় ফুট বারো উঁচু সিমেন্টে বাঁধানো প্ল্যাটফর্মের মতো ভিতের উপর পুরোনো দিনের নোনা-ধরা ফরাসি স্থাপত্যের ভিলাটি। প্রবেশপথে সিঁড়ির এক পাশে এক অষ্টবক্র ছায়াতরুর নিচু ডালপালা থেকে ঝুলছে বেগুনি, ল্যাভেন্ডার, নীল ও হরিৎ বর্ণের রাশি রাশি অর্কিড। ছায়াতরুটির তলায় কালচে সবুজ হয়ে যাওয়া শেওলা বা মসের আস্তরণ। এখানে একটি মরচে ধরা লোহার বেঞ্চও আছে। আমি বেঞ্চটিতে বসে ভাবি, ইয়ান সাম বাড়ি আছেন- বলে হাঁক দেওয়া কি সমুচিত হবে? বাড়িখানার আকার-আয়তন দেখে হাঁকডাকের জোশ আসে না। অবশেষে দোতলার ফেঞ্চ উইন্ডো পথে একটি কৌতূহলী কিশোরী মুখকে ক্ষণিকের জন্য দেখা যায়। আমার প্রত্যাশা বিফল হয় না। গলায় গামছার মতো দেখতে ফিনফিনে বস্ত্রখ- জড়িয়ে রুপালি চুলের স্বয়ং ইয়ান সাম সিঁড়ির শেষ প্রান্তে দেখা দেন। ইয়ান সামের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয় ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্বোডিয়া-বিষয়ক এক সেমিনারে। ইয়ান সাম সেমিনারে কম্বোডিয়ার প্রবাসী সরকারের প্রিন্স নরোদম সিহানুক উপদলের প্রতিনিধিত্ব করছিলেন। সে বছর দশেক আগের কথা। তারপর থেকে মাঝেমধ্যে আমাদের সাক্ষাৎ হয়েছে কখনো নমপেনে, কখনো ব্যাংকক বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। আমরা একত্রে বহুবার রেস্তোরাঁয় ভোজন করেছি, আলাপ করেছি কম্বোডিয়ার নৃত্যকলা, মন্দির স্থাপত্য ও রাজপরিবার নিয়ে। কিন্তু ইতিপূর্বে কখনো তাঁর বাড়িতে আসার সুযোগ হয়নি। ইয়ান সাম বিলক্ষণ অতিথিপরায়ণ।

আমাকে তিনি সাদরে সিঁড়ি-সংলগ্ন পেল্লায় একটি হল-কামরায় নিয়ে বসান। হলটিতে বেশ কয়েকটি জলচৌকি পাতা, সেগুলো নরম গদি ও কুশন দিয়ে সাজানো। আমরা দুজনে একটি চৌকিতে বসি, কিন্তু সহসা বলার মতো কিছু খুঁজে পাই না। ইয়ান সাম বারবার ফতুয়া গোছের জামাটির পকেটে অকারণে হাত ঢোকান ও বের করেন। আমি হলঘরের এক পাশে রাখা কালচে হয়ে আসা সিলভারের নৃত্যরতা অপ্সরার মূর্তিটি দেখি। মূর্তিটি উল্টো দিকে ঝোলানো বিরাট একটি তৈলচিত্র। ইয়ান সাম আমার দৃষ্টি অনুসরণ করে বলেন, ছবিটি তাঁর জননীর। তারপর ঈষৎ লাজুক হেসে যোগ করেন, ‘আমার মা প্রাসাদে রাজকীয় ব্যালেতে নাচতেন।’ তারপর তর্জনীর ইশারায় রূপার মূর্তিটিকে দেখিয়ে বলেন, ‘এটি মাকে দেওয়া সে যুগের রাজপুত্র প্রিন্স নরোদম সিহানুকের উপহার।’ আমি ও ইয়ান সাম যখন খুচরা গল্প করছি, তখন পর্দা সরিয়ে ট্রে হাতে হলঘরে আসে ফেঞ্চ উইন্ডোতে দেখা দেওয়া কিশোরী মেয়েটি। সাইড টেবিলে তেঁতুলগোলা শরবতের গ্লাসটি রেখে সে নিচু গলায় খেমার ভাষায় ইয়ান সামের সঙ্গে কিছু বলাবলি করে। আমি ভেতরে ভেতরে ঈষৎ চমকে গিয়ে মেয়েটিকে দেখি। সুচারু খেমার সিল্কের নাচের পোশাক পরা অভিব্যক্তিময় মুখের এ কিশোরী নত চোখে ইয়ান সামের সঙ্গে টুকটাক কথা বলে। অবশেষে সে তার বাবার ফতুয়ায় হাত ঢুকিয়ে বের করে নেয় মানিব্যাগটি। টাকা বের করতে করতে তার মুখে ফুটে ওঠে বিষণ্ন হাসি। আমার কেবলই মনে হতে থাকে, তৈলচিত্র থেকে নাচের শিল্পীটি হলঘরের নকশা কাটা মেঝেতে নেমে এসেছে। ততক্ষণে মি. ইয়ান সামের কিশোরী কন্যা মানিব্যাগ থেকে টাকা তার পার্সে স্থানান্তর করে বাইরে বেরোনোর জন্য দরোজার দিকে হেঁটে যায়। মি. ইয়ান সাম তার প্রস্থানপথের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘আমার মেয়ে, নাচ নিয়েই আছে সারাক্ষণ’। আমি মনে মনে ভাবি, নাতনি পিতামহীর মতো হবে, এতে বিচিত্র কী! আমার চোখ অজান্তে চলে যায় সদর দরোজার দিকে। ওখানে দাঁড়িয়ে কিশোরীটি গ্রীবা বাঁকিয়ে বাপকে বিদায় জানাচ্ছে। পুরোনো দিনের ফেঞ্চ দরোজার রঙিন কাচে প্রতিসরিত হয়ে সূর্যালোক মেয়েটির চুল ও গন্ডদেশ বর্ণিল করে দিতে থাকে।
আমাকে নাও বাইচ দেখাতে নিয়ে যাওয়ার জন্য ইয়ান সাম কোনো তাড়া বোধ করেন না। তিনি ধীরেসুস্থে তেঁতুলের জল খেতে খেতে গল্প করেন। দেয়ালে মলিন হয়ে আসা নৌকাবাইচের ছবি দেখিয়ে বলেন, ‘বাবা যখন বাটাংবাং প্রদেশের গভর্নর, তখন আমরা দৌড়ের নাও নিয়ে প্রতিবছর নমপেনে আসতাম।’ ছবিটির বয়স এত বেশি যে আমি একটি দীর্ঘ নাওয়ের আবছা রেখা ছাড়া আর বিশেষ কিছু উদ্ধার করতে পারি না। তবে পাশে ছোট্ট ফ্রেমে বাঁধানো আরেক ছবি আমার মনোযোগ আকর্ষণ করে। ছবিটিতে বালক ইয়ান সাম কাঠের তৈরি একটি চোখের প্রতীক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘প্রতিটি নৌকাতে সর্বলোক অবলোকনকারী সোনালি চোখ গলুইতে লাগানোর রেওয়াজ আছে। চোখটি পবিত্র, সুতরাং এর উপর দিয়ে হেঁটে কেউ যেতে পারে না। তাই নাওয়ের যাত্রাপথে কোনো ব্রিজ পড়লে- চোখটি নৌকা থেকে খুলে নিয়ে তবে নাও পার করতে হয়।’ আমাদের মধ্যে নাও বাইচের রীতি রেওয়াজ নিয়ে বেশ কিছু কথাবার্তা হয়। তবে ইয়ান সাম নদীতীরে যেতে খামোকা দেরি করছেন দেখে আমি অধৈর্য হতে থাকি। অবশেষে ইয়ান সাম ভেতরের কামরা থেকে ফ্রেমে বাঁধানো একটি ছবি নিয়ে আসেন। এতে রাজা নরোদম সিহানুক ও রানি দুটি রাজসিক চেয়ারে বসে আছেন। রাজদম্পতির পায়ের কাছে ধবধবে সাদা এক জোড়া পিকেনিজ কুকুর কুন্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে। শ্বেত সারমেয় যুগল থেকে কিঞ্চিৎ তফাতে গালিচার উপর জোড় হাতে হাঁটু গেড়ে বসে আছেন স্বয়ং ইয়ান সাম।
সারা দেশের লোক বুঝি আজ নমপেন শহরে এসেছে নাও বাইচ দেখতে। শহরের ট্রাফিক প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম। সবাই হেঁটে নতুন জামাকাপড় পরে, মোটরসাইকেল বা ট্রাইশতে চেপে চলেছে নদীতীরের প্রাসাদ প্রাঙ্গণে। আমি ও ইয়ান সাম বনবন করে ঘুরতে থাকা নাগরদোলাকে পাশ কাটিয়ে বেলুন ও ভেঁপুওয়ালাদের ভ্রুকুটি করে, ফুটপাতে দাঁড়িয়ে থাকা ভিখারিদের উপেক্ষা করে, রীতিমতো ধাক্কাধাক্কি গা ঘেঁষাঘেঁষি করে অবশেষে প্রাসাদ প্রাঙ্গণে এসে দাঁড়াই। রাজতোরণের পাশেই প্রকা- একটি দেয়ালহীন বহুতলবিশিষ্ট ছাদময় ভবন। ভবনটির ছাদ উজ্জ্বল কমলালেবু ও সবুজ রঙে রাঙানো। গৃহটির প্রবেশপথে স্থাপিত রাজা সিহানুকের বিপুল প্রতিকৃতি। ছবিটি একটি বৃহৎ রাজছত্রে ছায়াময়। আমি কৌতূহলী হয়ে প্রাচীরের বাইরে থেকে মূল প্রাসাদ ভবনটির দিকে তাকাই। ইমারতটিও বহুকোণবিশিষ্ট। প্রতিটি কোণের প্রান্তভাগ নৃত্যরতা নারীর হাতের ললিত মুদ্রার মতো বাঁকানো। ভবনশীর্ষে লাগানো একটি মানব মুখাকৃতি, যার একাধিক চোখ চেয়ে আছে চারদিকে। কোথায় যেন শিঙা ফুঁকার ধ্বনি হয়। ধ্বনিটির প্রতিক্রিয়া পড়ে এলোমেলো ভাসমান জনস্রোতে। মনে হয়, শত শত জনতা রাজতোরণ থেকে নদীতীরে যে সড়কটি গেছে, সেদিকে ধাবিত। সঙ্গে সঙ্গে আমরা পুলিশকে তৎপর হতে দেখি। ইয়ান সাম আমাকে বলেন, ‘এখনই রাজা ও রানি নদীতীরে যাবেন নৌকা দৌড় দেখতে।’ বিষয়টি শোনামাত্র আমি ও ইয়ান সাম তেড়ে আসা পুলিশ ও ধাবমান জনতার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য অন্যদিকে হাঁটতে শুরু করি।
আমরা কোনোক্রমে এসে পৌঁছাই নদীতীরে। দেখি গলুইতে সোনালি ছাতা টাঙানো দুটি নৌকা ঘাট ছেড়ে নদীর মাঝ বরাবর এসে ভাসমান জলে ছুড়ে দিচ্ছে পুষ্পাঞ্জলি। উপচার জলে ভেসে যেতেই দ্রুত ছুটে আসে ছিপছিপে একখানা রাজকীয় নাও। নৌকাটির গলুই সোনালি এক সরীসৃপের মূর্তির মতো করে তৈরি। তার কাছে বসে এক তরুণী- সম্ভবত প্রাসাদ কর্মচারী, মহিলা কিছু একটা ঘোষণা দেন। সঙ্গে সঙ্গে নদীজলে জড়ো হওয়া অজস্র নৌকা থেকে উলুধ্বনি করে যেন উল্লাস প্রকাশ করা হয়। সঙ্গে সঙ্গে বেশ কিছু নৌকার ছাদ থেকে শঙ্খ ফোঁকার আওয়াজ হলে মি. ইয়ান সাম ফিসফিসিয়ে বলেন, রাজা ও রানি রয়েল প্যাভিলিয়নে বসে পড়েছেন। এখন তাঁর ইঙ্গিতে বন্দুক ছোড়ার আওয়াজ হলে নাওগুলো বৈঠা ফেলে ছুটবে জল তোলপাড় করে। এখনই বাড়বে ভিড়ের চাপ। তাই আমি ইয়ান সামের পরামর্শে নদীতীর ছেড়ে প্রাসাদ প্রাঙ্গণের দিকে আগাই।
ইয়ান সামের বিজ্ঞতার তারিফ করতে হয়। নদীপাড়ের ভিড় ঠেলে নাও বাইচ দেখতে হলে শরীরে মল্লযোদ্ধার বিক্রম থাকার প্রয়োজন। আমি নিতান্তই নাজুক দেহের বাঙালি বুদ্ধিজীবী। আমি যাতে ভিড়ে চিড়ে-চ্যাপ্টা না হই, তার জন্য ইয়ান সাম নদীতীরে ওয়াগন হুইল নামক একটি রেস্তোরাঁয় আসন রিজার্ভ করে রেখেছেন। আমরা ওয়াগন হুইলের ত্রিতল কক্ষে জানালার পাশে বসে শীতল পানীয় সেবন করি। আমাদের সামনে নদীতে ভাসে অজস্র নাওয়ের মেলা। ভালো করে লক্ষ করি, দুটি ভিন্ন ধরনের নাও দৌড়ে অংশ নিচ্ছে। প্রথম ধরনের নায়ে মাঝি-মাল্লারা বসে বসে দাঁড় বাইছে। অন্য প্রকৃতির নায়ে দাঁড়িরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হইহই করে দাঁড় ফেলছে। দুটি দুটি করে নৌকা ছুটে এসে মাঝনদীতে নোঙর পেতে লাল সালুতে মোড়া স্থির দুটি রাজকীয় নাওয়ের মাঝ দিয়ে খানিক এগিয়ে গিয়ে- দৌড় শেষে ধনুকের মতো বেঁকে অতি ধীরে রাজকীয় প্যাভিলিয়নের সামনে এসে অভিবাদন করে চলে যাচ্ছে। ইয়ান সাম ফতুয়ার পকেট থেকে হাত বের করে লাজুক হেসে বলেন, ‘এ নদীটি কিন্তু মেকং না, এর নাম তনলাছাপ। বর্ষার শেষে খানিক দূরে মেকংয়ের পানি বেড়ে গেলে এ নদীতে জলস্রোত মাস তিনেকের মতো বিপরীত দিকে বয়।’ এ পর্যন্ত বলে ইয়ান সাম আঙুল দিয়ে বেশ দূরে যেখানে এ বিচিত্র নদীটি মেকংয়ের সঙ্গে মিলিত হয়েছে, তা দেখান। নাও বাইচের একপর্যায়ে আমি ও ইয়ান সাম ওয়াগন হুইল রেস্তোরাঁর ছাদে যাই- মেকংয়ের সঙ্গে বিপরীত দিকে বয়ে চলা নদীটির মিলনস্থল ভালো করে দেখতে। তখন সন্ধ্যা হয় হয়। নদী দুটোর সন্ধিতে ছোট্ট একটি দ্বীপে একসঙ্গে অনেক বাতি জ্বলে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে আবার আমরা শঙ্খধ্বনি শুনতে পাই। নদীতে এবার একসঙ্গে ভাসছে সারি সারি নাও। নাওগুলো পরস্পরের সঙ্গে আর প্রতিযোগিতা করছে না, কেবল ভেসে যাচ্ছে ধারাবাহিকভাবে। ইয়ান সাম মৃদুস্বরে বলেন, ‘তিন দিনের নাও দৌড় এবার শেষ হলো। সব কটি নৌকা এবার মিছিল করে ভেসে যাবে রাজার সামনে দিয়ে। সারা দেশের সব কটি প্রদেশ ও জেলা থেকে নমপেনে এসেছে একটি করে নাও। ৩৮০টি নৌকা এবার একসঙ্গে ভেসে যাচ্ছে।’ আমি ম্লান গোধূলিতে প্রায় সম্মোহিত হয়ে দেখতে থাকি, গলুইতে সোনালি চোখগাথা নানা রঙে চিত্রিত অসংখ্য নৌকা ভেসে যাচ্ছে বিপরীত স্রোতে। প্রাসাদ থেকে কামান দাগার মতো আওয়াজ হয়। একেকটি নৌকায় জ্বলে ওঠে অজস্র প্রদীপ। আকাশজুড়ে ফুটে ওঠে আগুনের নকশাময় বৃহৎ ফুলঝুরি। ইয়ান সাম ফতুয়ার পকেট থেকে দুহাত বের করে লাজুক হেসে আকাশের দিকে জোড়হস্ত হয়ে বলেন, ‘প্রাসাদ থেকে প্রভু বুদ্ধের চরণে আগুনের ফুল অর্পণ করা হচ্ছে।’

Mainussultan@hotmail.com
ছবি: লেখক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top