skip to Main Content
ক্রিকেটের পুরুষতন্ত্র বনাম বাংলার রয়্যাল টাইগ্রেস!

যে মেয়েরা এশিয়া কাপ জিতে দেশের জন্য সম্মান বয়ে আনলেন, ম্যাচপ্রতি তাঁদের পারিশ্রমিকের অঙ্ক অসম্মানজনক। অধিকন্তু মেয়েদের ক্রীড়াজগৎ নিয়েও কারও তেমন আগ্রহ টের পাওয়া যায় না। এটাও কি মেয়েদের প্রতি পুরুষতান্ত্রিক বৈষম্য নয়? যদিও এশিয়া কাপে বাঙালি মেয়েদের এই সাফল্য ক্রীড়াক্ষেত্রে নারীর ক্ষমতায়নের নতুন দিক উন্মোচন করেছে। এ বিষয়ে লিখছেন অতনু সিংহ।

এশিয়া কাপ জয়ের পর বাংলাদেশের মহিলা ক্রিকেটারদের ‘বাংলার বাঘিনী’ নামে ডাকা হচ্ছে। যেভাবে বাংলার পুরুষ ক্রিকেটারদের এতদিন রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে, ঠিক সেভাবেই মাঠ কাঁপানো বাংলাদেশের মেয়েরা বাংলার রয়্যাল টাইগ্রেস। কিন্তু তাঁরা মর্যাদার দিক থেকে কতটা রয়্যাল, এটাই প্রশ্ন।
হ্যাঁ, যে ‘বাঘিনী’রা জিতেছেন তাঁরাও প্রবল পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থার শিকার! কিংবা কলকারখানার মহিলা শ্রমিকদের মতোই তাঁরাও শ্রম ও প্রতিভার ন্যুনতম দাম পান না। তাঁদের মজুরির অঙ্ক যা তাতে তাঁদের উদ্বৃত্ত শ্রমের মূল্যে ফুলেফেঁপে ওঠে পুরুষবাদ পরিচালিত বিশ্ব লগ্নিপুঁজির অতিজাতীয়তাবাদী ক্রিকেট ইন্ডাস্ট্রি! হ্যাঁ, যাঁরা চ্যাম্পিয়ন হলেন, তাঁদের মজুরি মাত্র ৬০০ টাকা!
এই তথ্য আমরা জেনেছি বাংলাদেশের মেয়েদের ক্রিকেটের এশিয়া কাপ জয়ের পর। এ তথ্যের মাধ্যমে আমরা জেনে গেছি, ক্রিকেট কীভাবে পুরুষতন্ত্রকে ধারণ করে, আমরা জেনে গেছি, পুরুষতন্ত্র কীভাবে লগ্নিপুঁজির অর্থনীতিকে বৈশ্বিক করেছে, জেনে গেছি বৈশ্বিক লগ্নিপুঁজি কীভাবে উগ্র জাতীয়তাবাদের প্রোমোটার আর উগ্র জাতীয়তাবাদ কীভাবে পিতৃতন্ত্র এবং এর কালচারাল ফিন্যান্স ক্যাপিটালিস্ট মিডিয়ামকে মাস মিডিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত করে তার প্রসার ঘটায়। তাই গণতান্ত্রিক লেবাস গায়ে জড়িয়ে বিশ্বপুঁজি, রাষ্ট্রবাদ ও পিতৃতন্ত্রের এই চক্র জেন্ডার ইক্যুয়ালিটির বুকনি ঝাড়তে ক্রিকেট, ফুটবল, হকি ইত্যাদির একটা ফেমিনিন ভার্সন তৈরি করে! কিন্তু ইক্যুয়ালিটি মানে তো অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ইত্যাদি সবকিছুকে নিয়েই, অথচ ছেলেদের দলের সভ্যরা যখন একটা ক্রিকেট ম্যাচ খেলে লাখ লাখ টাকা পারিশ্রমিক পান, তখন মেয়েরা ফেলনার জাত, তাই তাদের জন্য মাথাপিছু ৬০০ টাকা! সাকিব, মাসরাফিরা ক্রিকেট খেললে বহুজাতিক পুঁজির স্পন্সর, বিজ্ঞাপনে তাঁদের প্রতিভার ব্র্যান্ডিং আর জেন্ডার ইক্যুয়ালিটির মেয়েরা তখন আইপিএলের মাঠের ধারে চিয়ার লিডার নামের যৌনবিভঙ্গপণ্য! এবং মেয়েদের কমোডিটি করে তোলার ক্ষেত্রে ভালোই খেলাধুলা করতে পারে পুরুষের দৈবলিঙ্গবিত্তবাদ!
শুরু থেকেই বাংলাদেশের অনেক মানুষের প্রবল আগ্রহ ছিল এই ম্যাচের ওপর, চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর তা জানা গেল। আগ্রহ ছিল বটে, সাকিব, তামিম, মাশরাফিদেরও, যথেষ্ট মাত্রায়। মিরপুর স্টেডিয়ামের ড্রেসিং রুমের টিভিতে চোখ রেখে মালয়েশিয়ার মাঠে বাঙালি মেয়েদের ক্রিকেটযুদ্ধের প্রতিটা মুহূর্ত তাঁরা খুঁটিয়ে দেখেছেন। মেয়েদের এশিয়া কাপ জেতার মুহূর্তুও সেলিব্রেট করেছেন পুরুষ দলের ক্রিকেটাররা। তাঁদের এই উচ্ছ্বাস খুবই উৎসাহব্যঞ্জক ও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কথা হলো, আফগানিস্তানের কাছে বাংলাদেশের পুরুষদের দল না হেরে যদি জিতে দেশে ফিরতো, তাহলে মিডিয়ায় তো সপ্তাহ বা মাসভর তাঁদের নিয়েই আলাপ হতো এবং তখন কতজন মেয়েদের ক্রিকেট দেখার আগ্রহ বোধ করতেন? নাকি পুরুষেরা হেরেছে বলে ক্রিকেটীয় জাতীয়তাবাদকে মেয়েদের ক্রিকেট দিয়ে পূরণ করতে টিভিতে আপনারা চোখ রেখেছিলেন? তার মানে, পুংজাতীয়তাবাদ বিপাকে পড়লে মেয়েরা সেই ধকল সামলে নেওয়ার সংরক্ষিত মাধ্যম নাকি? মাস মিডিয়াতাড়িত গণ-আচরণ সেকথাই বলে! আচ্ছা, টেন্ডুলকার, ধোনি, কোহলির পাশাপাশি কতজন ভারতীয় ক্রিকেট-সমর্থক ভারতের মহিলা ক্রিকেটারদের ব্যাপারে আগ্রহী?
বাঘিনীদের জয় এসব প্রশ্ন ও আলাপকে সামনে এনেছে। মেয়েরা ক্রীড়াজগতের প্রান্তের নয়, আজকে বাঘিনীদের জয়কে আমরা দেখতে পারি ক্রীড়ার জেন্ডার সেন্ট্রালাইজেশনের ডিকনস্ট্রাকশনে এক ডিসেন্ট্রালাইজেশনের স্পর্ধা হিসেবে। যেখানে ছেলেদের মতো মেয়েরাও গুরুত্বপূর্ণ, বরং তাঁরা কিঞ্চিৎ বেশি। কেননা ব্যাঘ্র সমাজে বাঘিনীর হালুমই কার্যকরী, তাঁরাই শিকার করেন, বাঘিনীদের জন্যই টিকে থাকে বাঘেদের বাস্তুসমাজ!
‘বাংলার বাঘিনী’রা দীর্ঘজীবী হোন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top