skip to Main Content

শাড়ীর প্রতি দুর্বলতা নেই, এমন বাঙালি নারী খুঁজে পাওয়া ভার! শাড়ী জগতে বাঙালি নারীর ভালোবাসার একটা বড় অংশ জুড়ে আছে জামদানি। জামদানি শাড়ী সমগ্র বাংলায় সমাদ্রিত। একই সাথে বহির্বিশ্বেও বাংলার বহু নারী ইচ্ছে লালন করেন অন্তত একটি জামদানি তাঁর সংগ্রহে রাখার। আর এই জামদানির সাথে মিশে আছে দেশের কৃষ্টি ও সংস্কৃতি।

জামদানি প্রকৃতপক্ষে মসলিনেরই উত্তরসূরী। স্মৃতি ও শ্রুতি নির্ভর এই শিল্পকলায় কারিগরদের মেধা ও মননে ধৈর্য্য ও অক্লান্ত পরিশ্রমে সৃষ্টি হয় এক সুনিপুণ বস্ত্রকাব্য। এই শিল্পের দক্ষতা বহু শতাব্দী ধরে পরিমার্জিত ও পরিবর্তিত হয়ে বর্তমান জামদানি রূপ ধারণ করেছে। বাংলাদেশের সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের ‌অন্যতমা উপাদান জামদানি বয়ন ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি অর্জনের পর এটি এখন আর শুধু বয়নশিল্প নয়, দেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতিভূ।

জামদানি বস্ত্র বয়নের মূল শক্তিই হলো সুতা। একটি নকশা তোলার জন্য ১০০ থেকে ৫০০ সুতার লাইনের প্রয়োজন হয়ে থাকে। অনেক পারদর্শিতার সঙ্গে জামদানি তাঁতীরা নকশা আঁকেন সরাসরি তাঁতে বসানো টানা ও ভরনার বুননে। আর জামদানি শাড়ির মুল্যায়ন নির্ভর করে শাড়ির গাঁথুনি এবং সুতার কাউন্টের উপর। সুতার কাউন্ট যত বেশি হলেই শাড়ির জমিন ততই চিকন ও সূক্ষ হয়ে থাকে। বর্তমানে ৪০ থেকে ৮০ কাউন্টের সুতার শাড়িই সাধারনত হাট বাজারে বিক্রি করা হয়। তবে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি পৃষ্ঠপোষোকতায় উন্নতমানের জামদানি তৈরি করতে প্রয়োজন কাউন্ট ১০০ থেকে ৩০০। এই ধরনের মিহি সুতা দিয়ে বুনন সময় সাপেক্ষ বিষয়। একটি শাড়ী বুনতে দুইজন কারিগরের ৩ থেকে ৬ মাস, কিংবা নক্সার ভিত্তিতে এক বছরের মতো সময়ও লেগে যায়।

এই বয়ন শিল্পীরা তাদের পূর্ব পুরুষদের কাছ থেকে হাতে কলমে অনুশীলন গ্রহণ করেন। তাঁরা অনেক ধৈর্য্য রেখে, পরিশ্রমের সঙ্গে এই শিল্পের পারদর্শিতা অর্জন করেন এবং পরবর্তিতে তাদের উত্তরসূরিদের মাঝে ছড়িয়ে দিয়ে জামদানির পরম্পরাকে রক্ষা করে আসছেন। তবে জামদানি বয়ন শিল্পীদের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। ১৯৭৫ সালে নারায়ণগঞ্জে প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার জামদানি তাঁতী ছিলেন। অথচ বর্তমানে মাত্র দেড় হাজার পরিবার এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত। নায্য মজুরী, তাঁত সংকট, এবং পৃষ্টপোষকতার অভাবে তাঁতীদের অনেকেই অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের কারনে পরিবর্তন করছেন বয়ন পেশা। আবার অনেকে পরবর্তী প্রজন্মকে তাঁতে না বসিয়ে লেখাপড়া শেখাচ্ছেন চাকুরিজীবি জীবন সন্ধানে। যার ফলে পাবিবারিক পেশা হিসেবেও এটি বিলুপ্তির পথে।

সারা বছরই জামদানি শাড়ীর চাহিদা থাকাই। তাঁতশিল্পে বহু প্রাচীনকাল হতে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও, সিদ্ধিরগঞ্জ, ডেমরা, রূপগঞ্জ, ও তারাবো এলাকায় জামদানি শাড়ি তৈরী হচ্ছে। কিন্তু শিক্ষানবিশ তাঁতী আর ঘরে ঘরে তৈরী হচ্ছে না। বর্তমানে নারায়ণগঞ্জের জামদানি শিক্ষানবিশ সংকট সমাধানে অন্যান্য এলাকা থেকে শিক্ষানবিশ খুঁজে আনতে হয়। এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে সরকারিভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করা যেমন জরুরি, তেমনি বেসরকারি সংস্থাগুলো যারা তাঁতশিল্প ও বয়নশিল্পীদের নিয়ে কাজ করছেন তাঁদেরকেও এগিয়ে এসে তাঁতীদের পাশে দাঁড়ানো দরকার। জামদানি শিল্পকে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করে রাখতে এবং আরও এগিয়ে নেবার জন্য এর বৈশিষ্ট্যকে প্রদর্শন করার দায়বদ্ধতা সকল বাঙ্গালির।

এ উদ্যোগে সামিল হতে সেবা নারী ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র এনজিও “সাসটেইনেবল এন্টারপ্রাইজ প্রজেক্ট” নামক একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এর অধীনে সংস্থাটি জামদানি তাঁতীদের নিয়ে ঢাকার গুলশানে “টানাপোড়েন” নামক একটি বিপননকেন্দ্র স্থাপন করেছে, যার মূল উদ্দেশ্য হলো জামদানি শিল্পের সাথে জড়িত তাঁতী ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তিতে সহায়তা করা এবং মার্কেট লিংকেজ স্থাপন করে উৎপাদিত পণ্য প্রিমিয়াম বাজারে তুলে ধরা। প্রকল্পটি বিশ্ব ব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় এবং পিকেএসএফ এর পার্টনারশিপের মাধ্যমে পরিচালিত।

“টানাপোড়েন” একটি সাসটেইনেবল জামদানি বুটিক যেখানে তাঁতীদের সরাসরি অংশগ্রহণে জামদানি শাড়ী ও বিভিন্ন জামদানি সামগ্রী প্রদর্শিত এবং প্রচারিত হচ্ছে। তাঁতে বসে টানা ও ভরনা বা পোড়েনের নিপুন কৌশলে নকশা ফুটিয়ে জামদানি বস্ত্র বয়ন করা হয়। বুননের এই ছন্দে অন্তমিল রেখেই এই “টানাপোড়েন” নামকরণ।

টানাপোড়েন প্রকল্পটি নিয়ে সেবা নারী ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সাইদা রোকসানা খান বলেন,

“‘টানাপোড়েন’ ঐতিহ্যবাহী জামদানি শাড়ির বৈচিত্রপূর্ণ রঙ ও নকশা সকলের সামনে তুলে ধরতে প্রয়াসী। সেবা’র সাসটেইনবল জামদানি প্রকল্পের প্রয়াস হলো এই প্রাচীন কারুশিল্পটিকে আরো উজ্জীবিত করে তোলা। টানাপোড়েন বুটিকে আমরা জামদানি শিল্পকে কয়েকটি ধাপ এগিয়ে নিয়ে জামদানি কারিগরদের জন্য একটি বিপননকেন্দ্র ও প্রচারমাধ্যমের আয়োজন করেছি। যেখানে শুধুমাত্র তাদের নৈপুণ্যের প্রদর্শনীই নয় বরং এসকল কারিগর এবং এই কারুশিল্প সম্পর্কে তথ্যের আধার হিসেবে প্রতীয়মান হবে। আমাদের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা হলো বিক্রয়কেন্দ্র হতে উদ্বৃত্তের একটি অংশ উদ্যোক্তাদের মধ্যে বন্টন করা হবে এবং ক্রমান্বয়ে উদ্যোক্তাদের মধ্যে আস্থা অর্জন করে ধীরে ধীরে ‘টানাপোড়েন’ এর পরিচালনায় তাঁতিরা অংশগ্রহণ করবেন।”

সেবা নারী ও শিশু কল্যান কেন্দ্র প্রান্তিক নারীদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে প্রায় ৩০ বছর ধরে মাইক্রো ফাইনান্স কার্যক্রম এবং দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে নারী অধিকার নিশ্চিতকরণের দৃঢ় অঙ্গীকার নিয়ে বিভিন্নমূখী কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top