skip to Main Content

মনোযতন I সৃজনে উপশম

আর্ট থেরাপি। সৃজনশীলতার মাধ্যমে মনোরোগ সারাইয়ের পরীক্ষিত কৌশল। ক্ষেত্রবিশেষে দেহরোগও। বিস্তারিত আশিক মুস্তাফার লেখায়

এই যে প্রবাহিত হচ্ছে দিন। আপনাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ঈদের আনন্দের দিকে। টেনে-হিঁচড়ে ফেলে দিচ্ছে রঙিন দুনিয়ায়। এর পেছনে কাজ করছে কী? মনের কানে বেজে ওঠা কোনো সুর? নাকি প্রিয় কোনো বইয়ের গল্প? আসলে সুর-সংগীত আর রঙের বড্ড ক্ষমতা। চাইলেই হুট করে যেকোনো কিছু করে ফেলতে পারে। ঘটিয়ে দিতে পারে অনেক কাণ্ড! সময়ের পিঠে বয়ে চলা শিল্প নানাভাবে আমাদের মাতাল করে তোলে!
ধরুন, অসময়ে গেয়ে উঠল কোকিল, আর অমনি আপনার মনের একান্ত গহিন গোপনের সব খেরোখাতা ফিরে পেল প্রাণ। আপনি ব্যাকুল হয়ে উঠলেন প্রিয় মানুষের সান্নিধ্য পেতে। মনের জানালার গ্রিলে হাত রেখে ফিরে গেলেন ফেলে আসা তারুণ্যে। আহা, কী যে দিন ছিল! একসময় আপনার মনে জাগ্রত হলো ভালোবাসার বুনো বুদ্‌বুদ। এই ভালোবাসা ফেরি করে বেড়ানো কোকিলের সুরে শাঁই-শাঁই ছুটে চলে ভালোবাসার পরিধি। বাড়ে আবেগ। মমতাও। এই সুরের দুনিয়ায় ঢুকতেই ভালোবাসায় যেন বুঁদ হয়ে যান আপনি!
এই যে বুঁদ হওয়া, এখান থেকেই শারীরিক ও মানসিক উপশম খুঁজে বের করেছেন চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্যাপকভাবে শিল্প ও সৃজনশীলতার ওপর ভিত্তি করে জনপ্রিয়তা পেয়েছে সৃজনশীল চিকিৎসা বা আর্ট থেরাপি। কীভাবে এটি আপনার ভেতর প্রাণচাঞ্চল্য ফিরিয়ে আনে এবং দোলা দিয়ে যায় মনে, তাই জেনে নেব আজ।
ইতিহাস কথা বলে
ইতিহাস ঘেঁটে আর্ট থেরাপি সম্পর্কে অনেক তথ্যই পাওয়া যায়। এ-ও জানা যায়, এর প্রধান হাতিয়ার শিল্প। জগৎখ্যাত অনেক শিল্পীই বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্নভাবে শিল্পের থেরাপিউটিক মাত্রা স্বীকার করেছেন। একটু পেছন ফিরে তাকালে দেখা যায়, প্রাচীনকালে সাহিত্য ও থিয়েটারকে মনে করা হতো দৈনন্দিন জীবনের সমস্যা মোকাবিলার দাওয়াই। তাই বুঝতেই পারছেন, আর্ট থেরাপির প্রচলন সেই প্রাচীনকাল থেকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই থেরাপি বিশেষ আলোচনায় আসে যুদ্ধাহত প্রবীণদের মানসিক হাসপাতালে চিকিৎসা সাপোর্ট দিয়ে। তবে আশির দশকে এর ব্যাপক প্রসার ঘটে। সেই থেকে আর্ট থেরাপি প্রতিনিয়ত মহাকাশযানের মতো ছুটে চলছে মানবজীবনের ভাঙা-গড়ার এবড়োখেবড়ো আকাশে! বলে রাখি, ব্রিটিশ শিক্ষাবিদ, আর্ট থেরাপিস্ট ও শিল্পী অ্যাড্রিয়ান হিলকে বলা হয় আর্ট থেরাপির জনক। চিকিৎসাবিজ্ঞানে প্রথম ‘আর্ট থেরাপি’ শব্দবন্ধন ব্যবহার করেছিলেন তিনিই।
আর্ট থেরাপি শুধু রোগীর জীবনযাত্রার মান উন্নয়নই করে না, দৈনন্দিন বিভিন্ন সমস্যা থেকেও তাকে মুক্ত রাখে। এ ছাড়া অজানাকে জানা যায়। নতুন করে নেওয়া যায় জীবনের পাঠ। জীবনমান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা এই থেরাপিকে চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা মোটা দাগে চার ভাগ করেছেন। মিউজিক বা সংগীত থেরাপি, বিবলিওথেরাপি, কোরিওথেরাপি এবং প্লাস্টিক থেরাপি।
মিউজিক থেরাপি
মন ভালো করার ক্ষেত্রে সংগীত ও সুরের যে প্রাকৃতিক ক্ষমতা, তা কাজে লাগিয়ে সার্বিক স্বাস্থ্যের উন্নয়ন নিশ্চিত করাই এই থেরাপির কাজ। মিউজিক থেরাপির প্রচলন অনেক আগে চালু হলেও ১৯৫০ সালে এই শব্দযুগল প্রথম যুক্ত হয় আর্ট থেরাপির সঙ্গে। ওষুধের পাশাপাশি সংগীতও মানুষের শরীরে মন্ত্রমুগ্ধের মতো কাজ করে। সত্তরের দশকে পোল্যান্ডে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় এই থেরাপি। শুধু তা-ই নয়, দেশটিতে মিউজিক থেরাপি ইনস্টিটিউটও গড়ে ওঠে ওই দশকে। এই জনপ্রিয়করণে বিশেষ ভূমিকা রাখেন ড. তাদেয়ুস নাতানসন এবং ড. আন্দ্রেই ইয়ানিকি।
খ্রিস্টধর্মগ্রন্থ বাইবেলেও মিউজিক থেরাপির ইঙ্গিত রয়েছে। আমাদের দেশের সাপের সিনেমাগুলোর কথা মনে করুন, বিন বাজিয়ে কেমন করে সাপ ডেকে এনে রোগীর ব্যথার উপশম ঘটানো হয়। তা ছাড়া ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অনুষ্ঠানগুলোতে চোখ রাখলেও বুঝতে পারবেন, সংগীত কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আদি জনপদে বেড়ে ওঠা এসব মানুষের শারীরিক ও মানসিক ব্যাধির চিকিৎসায়।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে রোগীদের হাসপাতালে থাকাকে আনন্দদায়ক করে তুলতে এবং মানসিক চাপ থেকে মুক্তি দিতে হাসপাতালে প্রথম মৃদু সংগীত চালু করেছিলেন ক্যানন হাওয়ার্ড। এরপর, বছরের পর বছর চলে আসে এই থেরাপি। মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ১৯৯৪ সালে প্রথম সংগীত থেরাপি বিভাগ চালু করা হয়। রোগের চিকিৎসায় সংগীতের ব্যবহার পাওয়া যায় অসংখ্য বইয়ে। এই সেদিনও কলকাতায় হাড়ভাঙা রোগীর অপারেশন করা হয়েছে কোনো রকম অ্যানেসথেসিয়া ছাড়াই; কেবল রবীন্দ্রনাথের ‘আকাশভরা সূর্যতারা’ কিংবা ‘আলোকের এই ঝর্ণাধারায়’ গানের সুরে। এই সুরে ‘মাতাল’ হয়ে মানুষ অস্ত্রোপচারের টেবিলে দিব্যি নিজেকে সঁপে দিচ্ছেন। ওপেন হার্ট সার্জারির মতো বড় অপারেশনের পরেও অসহ্য যন্ত্রণা রাগাশ্রয়ী সংগীতে ভর দিয়ে হেলায় সইছেন রোগী, নামমাত্র অ্যানালজেসিকে।
আমাদের দেশেও ক্রমে জনপ্রিয় হচ্ছে মিউজিক থেরাপি। চিকিৎসা ক্ষেত্রে সংগীতের মূর্ছনার কী জাদু, সারা দুনিয়ায় তা আগেই প্রমাণিত। বাংলাদেশও এখন এই পথে হাঁটছে।
 ব্যবহারের ধরন: মিউজিক থেরাপিতে মোটা দাগে যা যা থাকে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে সুর তৈরি করা, গান শোনা, গান লেখা, গান ও সুর-ছন্দ নিয়ে আলোচনা, সুরের সঙ্গে মেডিটেশন করা ইত্যাদি। এ ছাড়া বেশ কিছু জনপ্রিয় ও বহুল আলোচিত মিউজিক থেরাপির ধরন হচ্ছে—বিশ্লেষণধর্মী মিউজিক থেরাপি, বেনেনজোন মিউজিক থেরাপি, জ্ঞানধর্মী ও আচরণগত মিউজিক থেরাপি, কমিউনিটি মেথড, ভয়েস সিস্টেম প্রভৃতি। বর্তমানে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীদের মানসিক সুস্থতার পাশাপাশি বিষণ্নতা কাটাতেও এই থেরাপির ব্যাপক ব্যবহার ঘটছে। রিহ্যাব সেন্টারেও ব্যবহৃত হচ্ছে এই পদ্ধতি।
 যেসব রোগের গ্রিন সিগন্যাল: মিউজিক থেরাপি যেসব রোগের ক্ষেত্রে গ্রিন সিগন্যাল দেয় বা ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো বিষণ্নতা, অটিজম, হৃদ্‌রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, আচরণগত সমস্যা ও যোগাযোগবৈকল্য, হঠকারিতা, পিটিএসডি, মাদকাসক্তি, শ্বাসপ্রশ্বাসে সমস্যা, সিজোফ্রেনিয়া, ইনসোমনিয়া প্রভৃতি।
বিবলিওথেরাপি
বইয়ের সাহায্যে করানো চিকিৎসাকে বলা হয় বিবলিওথেরাপি। মনের সঙ্গে দেহের যে ঘনিষ্ঠ যোগ রয়েছে, এ কথা কম-বেশি সবারই জানা। কোনো কারণে মনের ভারসাম্য বিচলিত হলে দেহ অসুস্থ হয়ে পড়ে। একইভাবে, অসুস্থ দেহের প্রভাবে মন খারাপ হয়। দেহ ও মনের সম্পর্ক একান্ত নিবিড়। কোনো একটি অসুস্থ হলে অন্যটিও পুরোপুরি সুস্থ থাকতে পারে না। এ জন্য চিকিৎসকেরা রোগীর মন প্রফুল্ল রাখার পরামর্শ দেন। মনের প্রফুল্লতা দেহের রোগ দ্রুত উপশমে সহায়তা করে। বর্তমানে মনোচিকিৎসকদের পাশাপাশি শিক্ষাবিদেরাও বিবলিওথেরাপিকে নানাভাবে ব্যবহার করছেন। বিভিন্ন পেশাজীবী থেকে শুরু করে এমনকি বাবা-মায়েরাও সন্তান লালনপালনের উদ্দেশ্যে বিবলিওথেরাপির দীক্ষা নিচ্ছেন। আত্মোন্নয়নের ক্ষেত্রেও একটি বড় সহায়ক ভূমিকা পালন করছে এই থেরাপি। আধুনিক মনোচিকিৎসকেরা সাইকোথেরাপির অংশ হিসেবে কাজে লাগাচ্ছেন একে।
বিবলিওথেরাপি কথাটির প্রথম প্রচলন ঘটে ১৯১৬ সালে, স্যামুয়েল ক্রোদার্সের মাধ্যমে। কথাটি মূলত দুটি গ্রিক শব্দের সমন্বয়ে গঠিত। ‘বিবলিওন’ অর্থ বই এবং ‘থেরাপিয়া’ অর্থ নিরাময়। ক্রোদার্স বিবলিওথেরাপি কথাটির উল্লেখ করেছিলেন আটলান্টিক মান্থলিতে প্রকাশিত ‘আ লিটারারি ক্লিনিক’ শীর্ষক একটি আর্টিকেলে। সেখানে তিনি ব্যাগস্টার নামক এক উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তির কথা তুলে ধরেছিলেন, যিনি একটি ‘বিবলিওথেরাপি ইনস্টিটিউট’ চালাতেন। একটি চার্চের বেসমেন্টে বসে কাজটি করতেন ব্যাগস্টার। মানুষ এসে তার কাছে তাদের দৈনন্দিন জীবনের যেকোনো সমস্যা তুলে ধরত, যা তাদেরকে মানসিকভাবে পীড়া দিচ্ছে। সব শোনার পর ব্যাগস্টার তাদেরকে ওষুধ হিসেবে কিছু বই পড়ার উপদেশ দিতেন। তবে নিরাময়ের জন্য পড়ার ধারণাটি নতুন নয়। মিসরের রাজা দ্বিতীয় রামসেস তার সংগ্রহের বইগুলো রাখার জন্য ব্যবহার করতেন একটি বিশেষ প্রকোষ্ঠ। সেটির প্রবেশদ্বারের ওপর লেখা ছিল ‘আত্মা নিরাময়ের ঘর’। সিগমুন্ড ফ্রয়েডও ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে তার সাইকোঅ্যানালাইসিসে অন্তর্ভুক্তি ঘটিয়েছিলেন বইয়ের। বাংলা সাহিত্যেও বিবলিওথেরাপি নিয়ে লেখালেখি রয়েছে। এ ব্যাপারে অগ্রগণ্য চিত্তরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়।
 ব্যবহারের ধরন: একজন রোগীকে বই কীভাবে সাহায্য করে, চলুন তা জেনে নিই। প্রথমত, বই পড়া রোগীকে বাস্তবতা থেকে পলায়নে সাহায্য করে। রোগী যতই নিজের সমস্যা নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তা করেন, তার সমস্যার মাত্রা তত বাড়তে থাকে। কিন্তু যখন তিনি কোনো বই পড়তে শুরু করেন, তখন নিজ জীবন ছেড়ে প্রবেশ করেন অন্য কারও জীবনে, নিজের মস্তিষ্কে চলা অতি-চিন্তা থেকে বেরিয়ে এসে বইয়ের লেখকের চিন্তাভাবনার সঙ্গে হন যুক্ত। এর ফলে কিছু সময়ের জন্য হলেও তিনি নিজের বাস্তবতাকে ভুলে থাকতে পারেন।
দ্বিতীয়ত, রোগী নিজের সমস্যাগুলোকে অন্যের সঙ্গে মিলিয়ে নেন কিংবা তৃতীয় কারও জবানিতে বর্ণিত হতে দেখেন। ফলে রোগীও নিজের আমিত্ব থেকে বেরিয়ে এসে নিরপেক্ষভাবে বিষয়টি নিয়ে ভাবতে পারেন, যা তার দৃষ্টিভঙ্গিতে বড় ধরনের পরিবর্তন এনে দেয়।
তৃতীয়ত, বই বা গল্পে যখন রোগী নিজের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ সমস্যাগুলোর সমাধান হতে দেখেন, তার নিজের মনেও আশার আলো জ্বলে ওঠে। তিনি বিশ্বাস করতে শুরু করেন, বইয়ের চরিত্রটি যদি একই ধরনের সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পেতে পারে, তাহলে তার পক্ষেও সমস্যা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।
চতুর্থত, থেরাপিস্ট একজন রোগীকে অনেক কথাই বলেন, কিন্তু সেসব কথা রোগীর মাথায় দীর্ঘস্থায়ী না-ও হতে পারে। তাই অনেক সময় দেখা যায়, পূর্ববর্তী সেশনে রোগীকে যা যা বলা হয়েছিল, তিনি সেগুলো ভুলে গেছেন, কিংবা সেগুলো এখন আর তার ওপর কোনো ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে না। কিন্তু থেরাপিস্টের বলা কথাগুলো যখন রোগী বাসায় গল্পের ছলে পড়তে পারবেন, সেগুলো তার মনে গেঁথে যাবে এবং অবচেতন মনেই তাকে সাহায্য করবে। তাই অনেক বিবলিওথেরাপিস্ট দর্শন, কবিতা কিংবা নন-ফিকশনের বই পড়ার চেয়ে উপন্যাস কিংবা গল্পের বই পড়তে বেশি উৎসাহ দেন।
 যেসব রোগের গ্রিন সিগন্যাল: বিবলিওথেরাপি নির্দিষ্ট কিছু মানসিক রোগে ভালো কাজ করে; যেমন অবসাদ, উদ্বেগ, ইটিং ডিজঅর্ডার, সম্পর্কজনিত সমস্যা, অস্তিত্ব সংকটে ভোগা, মাদকাসক্তি প্রভৃতি। তবে কোনো শারীরিক সমস্যায় যে বিবলিওথেরাপি একেবারেই কাজে দেবে না, তা বলারও উপায় নেই। ‘ট্রেজার আইল্যান্ড’খ্যাত রবার্ট লুই স্টিভেনসন যেমন নিজ অভিজ্ঞতা থেকে বলেছিলেন, স্যার আর্থার কোনান ডয়েল রচিত ‘দ্য অ্যাডভেঞ্চার্স অব শার্লক হোমস’ বইটি পড়ে নাকি তার দাঁতের সমস্যা ও বুকের ব্যথা সাময়িকভাবে দূর হয়েছিল!
কোরিওথেরাপি
বিশেষ ধরনের নৃত্য থেরাপি এটি। কোরিওথেরাপির শুরু চল্লিশের দশকে, যুক্তরাষ্ট্রে। অবশ্য প্রাচীন গ্রিকদের কাছে নাচের থেরাপিউটিক বৈশিষ্ট্যের ধারণা ছিল। তারা নৃত্যশিল্পকে মানুষের ব্যক্তিত্বের উন্নতিতে সাহায্য করার হাতিয়ার হিসেবেও বিবেচনা করতেন। তবে সে সময়ের নৃত্যশিল্পীদেরও অন্যান্য শিল্পকলা এবং বৈজ্ঞানিক জ্ঞান থাকতে হতো। প্রাচীন গ্রিসের নৃত্যশিল্পীরা জ্যামিতি ও দর্শন অধ্যয়ন করতেন। সে যাক, কোরিওথেরাপি শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তিদের স্বাস্থ্য পুনর্বাসনে ব্যবহৃত হয়। কোরিওথেরাপিস্টদের মতে, এর সম্ভাব্যতা আবেগ, পেশিতন্ত্র এবং মোটর দক্ষতাকে প্রভাবিত করে। এটি একটি বহুমাত্রিক থেরাপি যা মানসিক, মোটর, নান্দনিক ও ইরোটিক গোলকের ওপর প্রভাব ফেলে। মোটা দাগে এই থেরাপিকে দুই ভাগ করা যায়—কাইনিসিওথেরাপি এবং মুভমেন্ট ইম্প্রোভাইজেশন।
 কাইনিসিওথেরাপি: এটি ফিজিওথেরাপির অংশ। এই আর্ট থেরাপিকে ক্লিনিক্যাল কোরিওথেরাপিও বলা হয়। কাইনিসিওথেরাপির লক্ষ্য হলো রোগীকে সম্পূর্ণ কিংবা আংশিকভাবে ফিটনেস ফিরে পেতে সাহায্য করা। এ ক্ষেত্রে রোগীর রোগের পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচন করা হয় ব্যায়াম।
 মুভমেন্ট ইম্প্রোভাইজেশন: এটি শরীরের চলনক্ষমতা ব্যবহার করে নিজেকে প্রকাশ করার একটি উপায়। এ ধরনের আর্ট থেরাপিতে অংশগ্রহণকারীরা আনন্দদায়ক ও কঠিন—উভয় ধরনের বিভিন্ন মানসিক অবস্থা প্রকাশ করতে পারেন। মিউজিক্যাল ইম্প্রোভাইজেশনও একধরনের বিনোদন, যা অংশগ্রহণকারীদের নিজেদের প্রকাশ করার সুযোগ করে দেয়।
 ব্যবহারের ধরন: সাইকোথেরাপিস্টদের মতে, কোরিওথেরাপি চাপা আবেগ থেকে নিজেকে মুক্ত করতে সাহায্য করে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঘরে একাকী নৃত্য বেশ উপকারী। তবে অভিজ্ঞ কোনো থেরাপিস্টের সঙ্গে নাচতে পারলে এ অভিজ্ঞতা আরও বেশি ফলপ্রসূ হতে পারে। এতে এমন লোকেরাও উপস্থিত থাকেন, যারা নিজেদের আরও ভালোভাবে বোঝেন। চাপ ও মানসিক অসুবিধা অনুভব করেন—এমন লাজুক ও স্নায়বিক লোকদের জন্য সহায়ক হতে পারে নাচের থেরাপিগুলো। নাচের ক্লাসগুলোতে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিরা রোগীকে অন্য ব্যক্তির কাছে নিজেকে উপস্থাপনের ক্ষেত্রে সাহায্য করেন। ফলে রোগী নিজের শরীরের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে চলতে শিখতে পারেন। বিভিন্ন কোরিওথেরাপিউটিক ব্যায়াম সঞ্চালন রোগীর ভাবনার বিকাশ ঘটায় এবং তা সিনক্রোনাইজ করতে শেখায়। কোরিওথেরাপি বিনোদনের পাশাপাশি অন্যান্য শারীরিক ব্যায়ামের মতো, পেশির টান দূর করে এবং মানসিক চাপ থেকে মুক্তি দেয়। এ ছাড়া এটি রক্তসঞ্চালন, শ্বাস-প্রশ্বাসের উন্নতি ঘটায়।
 যেসব রোগের গ্রিন সিগন্যাল: কোরিওথেরাপি কিছু মানসিক রোগের সমাধানে ভালো কাজ করে, যেগুলোর মধ্যে রয়েছে কার্ডিওভাসকুলার রোগ, স্নায়ুতন্ত্র, মেরুদণ্ডের পার্শ্বীয় বক্রতা, অবক্ষয়জনিত রোগ, মানসিক অবসাদ, উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা, দীর্ঘদিন ধরে ব্যথায় ভোগা, মস্তিষ্কের জটিল রোগ আলঝেইমার, সিজোফ্রেনিয়া প্রভৃতি।
প্লাস্টিক থেরাপি
এই থেরাপিতে ব্যবহৃত পদ্ধতিগুলো চারুকলার সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাই একে শিল্প-চিকিৎসাও বলা হয়। মূলত এটি এমন একধরনের থেরাপি, যার উপাদানে মিশে আছে রঙিন ভুবন। মানে রঙের ছড়াছড়ি। পাশ্চাত্যে মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতিতে শিল্প-চিকিৎসা বহুল জনপ্রিয় এক কৌশল। এ চিকিৎসায় রঙের দুনিয়া নিজের ভেতরে জমে থাকা চাপা অস্থিরতা ও দুশ্চিন্তাকে প্রশমিত করে। ১৭৯০ সালের শুরুর দিকে ফ্রান্সে প্রথম মনোবৈকল্য উপশমের লক্ষ্যে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে, যেখানে চিকিৎসা প্রক্রিয়া ছিল নৈতিক চিকিৎসাপদ্ধতির ভিত্তিতে। ১৯৪০ সালের দিকে শিল্প-চিকিৎসা একটি আলাদা ক্ষেত্র হিসেবে বিকশিত হয়। আশির দশকে তা উল্লেখযোগ্যভাবে প্রতিষ্ঠা পায় চিকিৎসাসেবা পরিমণ্ডলে। এ সময়ে শিল্প-চিকিৎসকেরা মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র, মেডিকেল সেন্টার, মাদক নিরাময় কেন্দ্র প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান তৈরিতে মনোযোগী হন। অ্যাড্রিয়ান হিল যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়ে ১৯৩৮ সালে একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তিনি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সময়ে অসুস্থদের জন্য শিল্পকলার চিকিৎসাসম্পর্কিত উপকারিতা বুঝতে পারেন। পরে সুস্থ হয়ে সেই হাসপাতালেই রোগীদের শুশ্রূষায় কাজ শুরু করেন এবং আমৃত্যু শিক্ষার সঙ্গে শিল্প-চিকিৎসার শ্রেণিবদ্ধকরণের চেষ্টা চালিয়ে যান।
 যত পদ্ধতিতে রাঙানো যায় ভুবন: প্লাস্টিক থেরাপির পেইন্টিং থেরাপি বা শিল্প-চিকিৎসায় ব্যবহৃত সরঞ্জামগুলো হতে পারে জলরং, তেলরং, অ্যাক্রিলিক পেইন্ট, অ্যারোসল পেইন্ট; গ্রাফিক থেরাপিতে কাঠকয়লা, চক এবং অন্যান্য বর্ডার কৌশল যেমন লিনোকাট; ভাস্কর্য থেরাপিতে অংশগ্রহণকারীরা বিভিন্ন ভাস্কর্য কৌশল ব্যবহার করেন। রং ছড়ানো এই ভুবনে আসতে হলে যেসব পদ্ধতি ধরে হাঁটা চাই, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে পেইন্টিং, গ্রাফিকস, ভাস্কর্য, স্থাপত্যকলা, শিল্প ও কারুশিল্প, ফটোগ্রাফি ও মাল্টিমিডিয়া।
 যাদের জন্য: প্লাস্টিক থেরাপি কাজ করে সবার ক্ষেত্রেই। তবু কাজের সুবিধার জন্য একে চার ভাগ করে নেওয়া হয়েছে—শিশুদের জন্য, কিশোর-কিশোরীদের জন্য, প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য এবং বয়োবৃদ্ধদের জন্য। এ ছাড়া বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদেরও যুক্ত করা হয়েছে এই থেরাপিতে। যেমন বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ও মানসিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য, অন্ধ ও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য, বধির ও শ্রবণশক্তিহীন ব্যক্তিদের জন্য, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ও বধির ব্যক্তি—উভয়ের জন্য, মানসিক ব্যাধি ও মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তিদের জন্য প্লাস্টিক থেরাপি।
 ব্যবহারের ধরন: প্লাস্টিক থেরাপি আর্ট থেরাপির আগের তিনটি ফর্মের চেয়ে কিছুটা আলাদা। এটি রোগীর অসুস্থতাকে ম্যানুয়ালি বা ধীরে ধীরে সারিয়ে তোলে; পাশাপাশি তার সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটায়। স্নায়বিক উত্তেজনা কমায়, কল্পনাশক্তি বাড়ায় এবং অ-মৌখিক যোগাযোগের ক্ষেত্রকে সক্রিয় করে তোলে। প্লাস্টিক থেরাপি নেওয়া রোগীরা তাদের অভিজ্ঞতার প্রকাশ ঘটিয়ে বিভিন্ন উপায়ে বিশ্বকে উপলব্ধি করতে শেখেন। এ ছাড়া তারা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজ সম্পাদনে মনোনিবেশ করতে শেখেন। এতে তাদের জীবনের ক্ষেত্রগুলো কার্যকর হয়ে ওঠে।
 যেসব রোগের গ্রিন সিগন্যাল: ওপরের আলোচনা থেকে নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন, কীসব রোগের ক্ষেত্রে কার্যকর এই থেরাপি। চাইলে আপনিও নিতে পারেন এই সান্নিধ্য। এতে আপনার উদ্বেগ কমে আসবে। অশান্ত মন প্রশমিত হবে। আপনাকে দূরে রাখবে মোবাইলের ক্ষতিকর ব্লু লাইট থেকে। নিয়মিত ৫০ মিনিট রং নিয়ে সময় কাটাতে পারলে মনোযোগ ধরে রাখতে পারবেন যেকোনো কাজে।
শরীর কিংবা মনে বয়ে বেড়ানো কষ্ট অনেকেই গুলিয়ে ফেলেন। আবেগাপ্লুত হয়ে কেউ কেউ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন আনুষ্ঠানিকভাবে। দেখান সবাইকে। পরিবারকেও ডেকে আনেন। বলি, একটু ভাবুন। সুরে বুঁদ হওয়া আপনার শরীরটাকে যেখানে-সেখানে না টেনে, নিয়ে যান আর্ট থেরাপিস্টের কাছে। যিনি আপনাকে ভাসিয়ে দেবেন সুরের ঢেউয়ে; রাঙিয়ে তুলবেন বর্ণিল রঙে!
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top