skip to Main Content

রম্যরস I রাকিব-লাবণী ঈদ শপিংয়ে সঙ্গে আছেন শার্লক হোমস: সুমন্ত আসলাম

রাকিব মুৎসুদ্দী বললেন, ‘না, আমি আজ শপিংয়ে যেতে পারব না। সময় নেই। জরুরি কাজ আছে আমার।’
ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে শাড়ির কুঁচিটা ঠিক করছিলেন লাবণী প্রিয়দর্শিনী। লম্বাটে বড় আয়নার ভেতর থেকেই স্বামীকে দেখলেন, বিছানায় বসে আছেন একগাদা কাগজ নিয়ে—দেখছেন, পড়ছেন, কলম দিয়ে কাটাকাটি করছেন। আলতো ঘুরে দাঁড়ালেন তিনি বিছানার দিকে, ‘ঈদের আর মাত্র কয়টা দিন বাকি। অনেকগুলো জিনিস কিনতে হবে আমাদের।’
‘তুমি একাই যাও। গাড়ি তো আছে, গাড়ি নিয়ে যাও।’ কাগজে চোখ রেখেই উত্তর দিলেন রাকিব মুৎসুদ্দী।
শাড়ির শেষ কুঁচিটা ঠিক করে এবার পুরোপুরি ঘুুরে দাঁড়ালেন লাবণী প্রিয়দর্শিনী। কোনো ভাঁজ যেন ভেঙে না যায়, শাড়িটায় সেভাবে হাত দিয়ে বিছানায় বসলেন তিনি, স্বামীর কাছেই, পাশেই, ‘একজন নিখুঁত মানুষ হিসেবে নিজেকে দাবি করেছিলে তুমি!’ একটু থেমে বললেন, ‘মনে আছে তোমার?’
‘আছে।’ যথারীতি হাতের আর বিছানার কাগজে চোখ ঠেসে রেখেছেন রাকিব মুৎসুদ্দী, ‘দাবিটা কিন্তু তুমিও করেছিলে!’
‘বিয়ের আগে যারা ভালোবাসা-টালোবাসা করে, প্রেমে মজে, তারা সবাই এ রকম বলে—তুমি বলেছ, আমি বলেছি। সম্ভবত সাজিদ ভাইয়া-মিতু ভাবি বলেছেন, উৎপলদা-রাধা বৌদি বলেছেন, আমাদের চারতলায় নতুন যে ভাড়াটে এসেছেন আলফ্রেড গোমেজ আর ঊর্মি গোমেজ, তারাও বলেছেন।’ চোখ দুটো বিশেষ ভঙ্গিমা করে রাকিবের দিকে তাকালেন লাবণী, ‘আমি এখনো বলছি, দাবি করছি—আমি একজন নিখুঁত মানুষ।’
‘নিখুঁত মানুষের সংজ্ঞাটা কী আসলে?’ চোখ তুলে তাকালেন এবার রাকিব, ঠোঁটের কোণে হাসি, দু চোখেরও।
‘যারা বিয়ের আগের যেসব প্রতিশ্রুতি দেয় এবং বিয়ের পর পুরোপুরি পালন করে তা, তারাই নিখুঁত মানুষ।’
‘প্রতিদিন প্রতিটি প্রতিশ্রুতিই সম্ভবত পালন করেছি আমি।’
‘কেবল যথাসময়ে, প্রয়োজনের মুহূর্তে শপিংয়ে যাওয়া ছাড়া। মাঝে মাঝে গেলেও পায়ে ব্যথা শুরু হয় তোমার। পকেট থেকে টাকা বের করে দিয়েই তুমি খালাস! অথচ…।’
থেমে গেলেন লাবণী প্রিয়দর্শিনী। রাকিব মুৎসুদ্দী আরও একবার ফিরে তাকালেন স্ত্রীর দিকে, ‘অথচ?’
‘অথচ বিয়ের আগে আমি যেখানে নিয়ে যেতে চাইতাম তোমাকে, তুমি যেতে; আমি যেখানে যেতাম, না বললেও তুমি যেতে। কী অদ্ভুত!’
বিছানার কাগজ বিছানায় রইল, হাতের কাগজগুলোও সেখানে রাখলেন রাকিব। তারপর বিছানা থেকে নামতে নামতে বললেন, ‘চলো।’


নিজেদের নিখুঁত দাবি করা দম্পতি রাকিব মুৎসুদ্দী আর লাবণী প্রিয়দর্শিনী বাসার বাইরে বের হলেন, গাড়িতে চড়লেন, শপিংয়ের জন্য এগোতে লাগলেন মার্কেটের রাস্তায়।
কিছুদূর যাওয়ার পর হঠাৎ তারা লক্ষ করলেন—রাস্তার পাশে স্বয়ং শার্লক হোমস দাঁড়িয়ে আছেন, একা; বাম হাতটা তুলে তিনি লিফট চাইছেন গাড়ির।
গাড়ি থামালেন তারা। রাকিব কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই লাবণী কথা বলে উঠলেন, ‘আমরা ভুল দেখছি না তো!’
‘না, আপনারা ভুল দেখছেন না।’
‘আপনি সত্যি সত্যি শার্লক হোমসই তো?’
‘জি, আমি শার্লক হোমস।’
‘কোথায় যাবেন আপনি?’
‘৪-৫ কিলোমিটার দূরে যে একটা শপিং সেন্টার আছে, সেখানে যাচ্ছি আমি।’
‘আরে, আমরাও তো ওখানেই যাচ্ছি।’ আনন্দে গদগদ হয়ে লাবণী বললেন, ‘আমরা ওখানে ঈদের শপিং করতে যাচ্ছি। আপনি?’
প্রশ্নটা বুঝতে পারেননি, এমন ভঙ্গিতে হোমস বললেন, ‘আমি কেন যেতে চাচ্ছি?’
‘জি।’
মুচকি একটা হাসি দিলেন শার্লক হোমস, হাতের পাইপটা পকেটে ঢোকালেন আনমনে। কিছুটা কুঁজো হয়ে লাবণীর দিকে ঝুঁকে দাঁড়ালেন তারপর, ‘ইয়াং লেডি, ঠিক শপিং করতে নয়, গুরুত্বপূর্ণ দুটো কাজ আছে আমার ওখানে।’
‘গুরুত্বপূর্ণ কাজ দুটো কী—বলা যাবে আমাদের?’ কথাটা রাকিব জিজ্ঞেস করলেন এবার।
রাকিবের দিকে চোখ ফেরালেন শার্লক হোমস, ‘যাবে, তবে দুটো না, একটা। আমি দেখতে চাই—মানুষের প্রকৃত প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো কী, এর বাইরে কত রকমের অপ্রয়োজনীয় জিনিস কেনাকাটা করে তারা ইচ্ছে হলেই।’ শার্লক হাসলেন, রহস্যের হাসি, ‘দ্বিতীয়টা বলতে না পারার অপারগতার জন্য আন্তরিকভাবে দুঃখিত আমি। তবে কাল অথবা পরশু জানতে পারবেন, পেপারে-টিভিতে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখতে পাবেন, মানুষের মুখে মুখে শুনতে পাবেন।’ রহস্যময় হাসিটা বাড়িয়ে দিলেন হোমস, ‘জানার পর খুব চমকে উঠবেন আপনারা।’
‘আপনি সারা জীবন আমাদের সবাইকে চমকে দিয়েই আসছেন। প্লিজ, উঠে পড়ুন গাড়িতে।’


শার্লক হোমস গাড়িতে উঠলেন। লাবণী মিহি গলায় বললেন, ‘গান শুনবেন, মিস্টার হোমস?’
‘জি, লালন নামে একজন আছেন আপনাদের, তার একটা গান শুনতে চাই আমি।’
‘কোন গানটা?’
‘সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে…।’
গান বাজছে। দুচোখ বুজে ফেলেছেন হোমস। হঠাৎ কিসের সঙ্গে যেন ধাক্কা গেল গাড়িটা। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই উল্টে গেল, পাল্টে গেল, বেশ কয়েকবার। শেষে ফুটপাতের এক কোনায় থামল, থেমে গেল সবকিছু। আশপাশের মানুষজন দৌড়ে এলেন গাড়ির কাছে, তারা দেখলেন—গাড়ির ভেতরে তিনজন মানুষ, দুজন মারা গেছেন, বেঁচে আছেন একজন।
কাহিনি শেষ, এবার বলুন তো ভাই-বোনেরা, দুর্ধর্ষ এই দুর্ঘটনার পর বেঁচে ছিলেন আসলে কে?
উত্তরের জন্য নিচের অংশটি পড়ুন, প্লিজ:
লাবণী প্রিয়দর্শিনী বেঁচে ছিলেন, তিনি একজন ‘নিখুঁত নারী’। গাড়ির তিনজনের মধ্যে কেবল তারই অস্তিত্ব আছে, কোনো ‘নিখুঁত পুরুষ’ কিংবা শার্লক হোমস বলে কেউ নেই আসলে বাস্তবে!
ভদ্রমহিলাগণ, আপনারা পড়া বন্ধ করুন এখানেই। একজন পুরুষ হয়ে আমি সত্যি সত্যি বলছি—নিখুঁত কোনো পুরুষ নেই এ দুনিয়ায়, নিখুঁত নারী আছে। আর এসব হাবিজাবি না পড়ে আপনারা বরং শপিংয়ে যান, সবার জন্য মন ভরে কিনতে থাকুন।

পুরুষগণ পড়তে থাকুন নিচের অংশটুকু:
বলুন তো বাস্তবে যদি ‘নিখুঁত পুরুষ’ আর শার্লক হোমস না-ই থাকে, তাহলে কে চালাচ্ছিল গাড়িটা? বাস্তবে যে আছে, মানে ওই ‘নিখুঁত নারী’টি। সঙ্গে এটাও জেনে গেলাম বা বুঝে গেলাম—গাড়িটা কেন অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল কিছুক্ষণ আগে।
হা হা হা!
এবার একটি গল্প
রাকিব মুৎসুদ্দী আর লাবণী প্রিয়দর্শিনী ঈদের শপিংয়ে যাবেন। কিন্তু কী একটা কারণে ঝগড়া লেগে গেল তাদের মাঝে। এ রকম আগেও হয়েছে। তাদের পারিবারিক ডাক্তার মনোবিজ্ঞানী সাহজিদ মোক্তাদির বলেছিলেন, এ রকম ঝগড়া শুরু হলে তাকে যেন ফোন দেন তারা।
সাহজিদ মোক্তাদিরকে ফোন দিলেন রাকিব। ফোনটা রিসিভ করেই ডাক্তার বললেন, ‘কী, আজও ঝগড়া হয়েছে?’
মিউমিউ করে রাকিব বললেন, ‘জি।’
‘শপিংয়ে যাচ্ছিলেন নাকি?’
‘জি।’
‘ঈদ এলে, শপিংয়ের সময় হলে, এ রকম হয়। তা মারামারি হয় নাই তো আপনাদের মাঝে?’ ডাক্তার সাহজিদ মোক্তাদির জিজ্ঞেস করলেন রাকিবকে।
‘তা হয় নাই।’ রাকিব চোখ দুটো সামান্য সংকুচিত করে ফেললেন, ‘ডাক্তার সাহেব, আপনার কথা যেন কেমন বেজে বেজে আসছে! এমন গলার স্বর তো শুনিনি কখনো আপনার। ঠোঁট-মুখে কিছু হয়েছে নাকি আপনার? কিংবা জিহ্বায়?’
‘না, তেমন কিছু না। ঠোঁটের কোনাটা বেশ কেটে গেছে সকালে।’
‘কীভাবে?’
‘না, কিছু না, সময়টা শপিং করার তো। আপনার ভাবি…।’ ডাক্তার সাহজিদ কিছুটা বিব্রত হয়ে বললেন, ‘তা আপনার সমস্যা কী?’
‘ঝগড়া হয়েছে আমাদের।’ রাকিব মুৎসুদ্দীর অকপট স্বীকার।
‘সপ্তাহে অন্তত দুবার বাইরে কোথাও খেতে যেতে বলেছি আপনাদের। যান তো?’
‘যাই। লাবণী যায় বুধবারে, আমি শনিবারে।’
‘দুজনকে তো একসাথে যেতে বলেছি।’ সাহজিদ মোক্তাদির উৎসাহ নিয়ে বললেন, ‘তা, একটা কাজ করুন—আপনার বউকে একা কোথাও পাঠান, যেখানে তিনি অনেক বছর যান না। মন-মাইন্ড চেইঞ্জ হবে, ভালো থাকবেন আপনারা।’
‘পাঠানোর চেষ্টা করেছি, এবং ফেল করেছি।’ কষ্ট কষ্ট গলা রাকিব মুৎসুদ্দীর, স্বরটা হতাশারও।
‘কোথায় পাঠানোর চেষ্টা করেছেন?’ প্রচণ্ড আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন ডাক্তার।
রাকিবের নির্মোহ গলা, ‘রান্নাঘরে।’
‘ধুর, এটা কী বললেন! আপনারা সব সময় হাত ধরাধরি করে থাকার চেষ্টা করবেন। এতে আপনাদের মাঝে রোমান্টিকতা বাড়বে, পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা জন্মাবে, হাসি-খুশি থাকবেন সব সময়।’
‘এই কাজটা আমি যথাসাধ্য করার চেষ্টা করি, ডাক্তার।’
‘তাই নাকি? তা রেজাল্ট কেমন পাচ্ছেন?’
‘মোটামুটি। কিন্তু মুশকিল হলো, আমি তো সব সময় ওর হাত ধরে রাখতে পারি না। কাজ-কাম আছে না আমার? যখনই হাতটা ছেড়ে দিই, ও সোজা মার্কেটে চলে যায়, শপিং করতে থাকে আনন্দ নিয়ে, গুনগুন করে গানও গায় কিছুটা শব্দ করে!’
এবার শেষ কুইজ
লিস্ট করার কাগজ আর কলমটা হাতে নিয়েই লাবণী প্রিয়দর্শিনী যে দুটো নাম প্রথম লেখেন—০১. মা-১ (আমার শাশুড়ি); ০২. মা-২ (রাকিবের শাশুড়ি); ৩ নম্বর নামটা লেখেন—রাকিব, যার পুরো নাম আমরা জানি রাকিব মুৎসুদ্দী।
এবার শেষ কুইজ
মা কিংবা স্ত্রী যখন কোনো কিছুর তালিকা করেন, তখন তাদের নিজের নামটা কখনো প্রথমে লিখেছেন? দেখেছেন আপনারা? কিংবা শুনেছেন?
কুইজের উত্তরটি আমাদের সবার জানা। তারা শপিংয়ে যান প্রথমে অন্যের জন্য—মা-বাবা, স্বামী, সন্তানের জন্য। সব শেষে নিজের জন্য। তাই তো দোয়েল এখনো গান শোনায় ভোরের জানালায়, মাধবী গন্ধ বিলায় রাত-বিরাতে, বৃষ্টি ধুয়ে দেয় ধূসর ধুলো, সমবণ্টনের আলো নিয়ে চাঁদ উঁকি দেয় বস্তির ভাঙা চালেও।
রোগে কাতর হলেই আমরা ডেকে উঠি—মা… মা…; আঁচল বিছিয়ে নিই চোখের উপরে। আর ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরেই পরশ খুঁজি এক শীতল হাতের। মায়া-স্পর্শের-স্ত্রীর ছাড়া কার আছে সেই মুগ্ধকর হাত, সুখজাগানিয়া পরশ!

ইলাস্ট্রেশন: দিদারুল দিপু

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top