skip to Main Content

পাতে পরিমিতি I হৃদ্‌রোগীর ঈদ

ঈদ উৎসবে খাওয়া-দাওয়া ও ঘোরাঘুরিতে বাঁধ মানে না মন। আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে অনেকে এমন খাবার খেয়ে ফেলেন, যা তার শরীরের জন্য ক্ষতিকর। হৃদ্‌রোগীর বেলায় তো বলাই বাহুল্য। তাদের জন্য নিশাত শারমিন নিশির পরামর্শ

হৃদ্‌রোগ অন্য যেকোনো রোগের চেয়ে একটু ভিন্ন। নানা কারণে হানা দিতে পারে এই ব্যাধি। যেমন কারও যদি দীর্ঘদিন অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, রক্তে অতিরিক্ত চর্বি, ফ্যাটি লিভার প্রভৃতি সমস্যা থাকে, সে ক্ষেত্রে হার্টের অসুখ দেখা দিতে পারে। তা ছাড়া ব্যক্তির বয়স ও জেন্ডারের ওপরও অনেক ক্ষেত্রে এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি নির্ভর করে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি সতর্ক থাকতে হয় ওজন নিয়ে। কেননা কাঙ্ক্ষিত মাত্রার চেয়ে অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা থাকলে হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
নানা খাবারে এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির নিষেধাজ্ঞা থাকে। চলুন, শুরুতেই এমন কিছু খাবারে নজর দেওয়া যাক—
 লবণ: পাতে বাড়তি লবণ নেওয়া, অতিরিক্ত লবণ যোগে তরকারি রান্না করা, লবণাক্ত খাবার যেমন শুঁটকি, চিপস ইত্যাদি রক্তচাপ বৃদ্ধিতে নেতিবাচক ভূমিকা রাখে। হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির সব সময়ই রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখা প্রয়োজন। কেননা রক্তচাপ বাড়লে চাপ পড়ে হৃদ্‌যন্ত্রে; আর তা পরবর্তীকালে হৃদ্‌পিণ্ডের নানা সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাই অবশ্যই অতিরিক্ত লবণ ও লবণজাত খাবার এখনই খাদ্যতালিকা থেকে বাদ দেওয়া চাই।
 মিষ্টিজাতীয় খাবার: অনেকেই মনে করেন, ডায়াবেটিস না হলে মিষ্টিজাতীয় খাবার যত ইচ্ছা গ্রহণ করা যেতে পারে। অথচ ডায়াবেটিস ছাড়াও ওজন নিয়ন্ত্রণ, হৃদ্‌পিণ্ডের সুস্থতা, লিভারের সুস্থতা, এমনকি হাড়ের যত্নে একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির মিষ্টিজাতীয় খাবার কম গ্রহণ করা ভালো। ডায়াবেটিস থাকলে তো কথাই নেই।
 চর্বিজাতীয় খাবার: হৃদ্‌পিণ্ডের সুস্থতায় প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির খাদ্যতালিকা থাকা চাই চর্বিমুক্ত। অতিরিক্ত তেল কিংবা চর্বি হৃদ্‌পিণ্ডের সুস্থতা ধরে রাখতে দেয় না। তাই বাদ দেওয়া চাই অতিরিক্ত চর্বিজাতীয় খাবার; যেমন গরুর মাংস, খাসির মাংস, অতিরিক্ত তেলে ভাজা খাবার প্রভৃতি।
কিছু শারীরিক অসুস্থতা যেমন বুকের বাম পাশে চিনচিন ব্যথা, বারবার রক্তচাপ ওঠানামা করা, অতিরিক্ত ঘাম হওয়া, মাথা ঘোরানো, মাথাব্যথা, দুর্বলতা অনুভব করা প্রভৃতি দেখা দিলে অবশ্যই চিকিৎসকের সঙ্গে দ্রুততম সময়ে যোগাযোগ করা প্রয়োজন। বুকের ব্যথা অনেকে এড়িয়ে যান। কেউ কেউ মনে করেন, অ্যাসিডিটি বা গ্যাসের সমস্যার কারণে হয়তো বুকব্যথা করছে। এমন ধরনের অবহেলা জটিলতা আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে। হৃদ্‌রোগীদের ক্ষেত্রে এ ধরনের হালকা ব্যথাও অবহেলাযোগ্য নয়। হৃদ্‌যন্ত্রের সুস্থতায় তাই মানা যেতে পারে কিছু পরামর্শ—
 দুশ্চিন্তা: অতিরিক্ত টেনশন বা স্ট্রেস থাকলে নানা সমস্যার ভেতরে সবার আগে দেখা দেয় বাড়তি রক্তচাপ। অথচ একজন হৃদ্‌রোগীর রক্তচাপ বৃদ্ধি কখনোই কাম্য নয়। সে ক্ষেত্রে যতটা সম্ভব স্ট্রেস রিলিফ রাখতে হবে নিজেকে। তাই প্রতিদিন অন্তত ৫ মিনিট শিথিলায়ন বা মেডিটেশন করে শরীরকে রিল্যাক্স হতে সাহায্য করুন। সেটি ঈদ বা যেকোনো ফেস্টিভ্যালেও বজায় রাখা চাই।
 ঘুম: পর্যাপ্ত ঘুম না হলে যেকোনো মানুষেরই শরীর খারাপ লাগে। একজন হৃদ্‌রোগীর যথাযথ ঘুম হওয়া বিশেষভাবে জরুরি। তার জন্য অবশ্যই দৈনিক ছয় থেকে সাত ঘণ্টা নির্বিঘ্ন ঘুম প্রয়োজন। তাতে হৃদ্‌পিণ্ড যথাযথ বিশ্রাম পাবে এবং হৃদ্‌যন্ত্র তুলনামূলক সুস্থ থাকবে।
 ব্যায়াম: হৃদ্‌রোগীদের জন্য হাঁটা সবচেয়ে উৎকৃষ্ট ব্যায়াম। প্রতিদিন ৩৫ থেকে ৪০ মিনিট হাঁটা স্বাস্থ্যসম্মত। তবে হৃদ্‌পিণ্ডে বাইপাস কিংবা অন্য কোনো সার্জারি করা থাকলে কতটুকু হাঁটা যেতে পারে, সেটি অবশ্যই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে নির্ধারণ করা চাই।
বলা হয়ে থাকে, হৃদ্‌পিণ্ড বা হার্ট হলো দেহঘড়ি। তাই হৃদ্‌পিণ্ডের সুস্থতায় খাদ্যতালিকায় যা রাখতে পারেন—
 শাকসবজি: হৃদ্‌রোগীদের জন্য প্রতিদিন শাকসবজি গ্রহণ করা স্বাস্থ্যসম্মত। সুস্থ থাকার জন্য এমন রোগীর খাদ্যতালিকায় তিন থেকে পাঁচ সার্ভিং শাকসবজি থাকা প্রয়োজন। সে ক্ষেত্রে খাওয়া যেতে পারে পালংশাক, লালশাক, গাঢ় সবুজ শাক প্রভৃতি। ঈদে শাক দিয়েই তৈরি করতে পারেন পালং পনির, যা লবণমুক্ত টফু দিয়েও তৈরি করা যায়।
 স্যালাদ: বর্তমানে নানা রকম স্যালাদের মেনু পাওয়া যায় ইন্টারনেটে। সে ক্ষেত্রে প্রতিদিন খাদ্যতালিকায় রাখতে পারেন স্যালাদ। তবে অবশ্যই খেয়াল রাখা চাই, অতিরিক্ত তেল কিংবা ড্রেসিং যেন না থাকে তাতে। অনেকে টেস্টি করার জন্য মেয়োনিজ, বাটার প্রভৃতি দিয়ে স্যালাদ ড্রেসিং করতে পছন্দ করেন। অথচ এই ধরনের অতিরিক্ত চর্বিজাতীয় উপাদান যোগ করার ফলে স্যালাদ হয়ে যেতে পারে অস্বাস্থ্যকর। তাই এ বিষয়ে অবশ্যই খেয়াল রাখা চাই এই ঈদেও।
 অলিভ অয়েল: হৃদ্‌রোগীর জন্য অন্যান্য তেলের তুলনায় অলিভ অয়েল হেলদি। তবে যেকোনো তেলই নির্দিষ্ট তাপমাত্রা বজায় রেখে রান্না করলে হেলদি থাকে। অলিভ অয়েল ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবশ্যই কিছু সতর্কতায় নজর রাখা চাই। অতি উচ্চতাপে অলিভ অয়েলের পুষ্টিগুণ নষ্ট হয়। তাই অলিভ অয়েল খাওয়া যেতে পারে স্যালাদে কিংবা হালকা সঁতে করা সবজিতে।
 বাদাম: বাদামে রয়েছে ভিটামিন ই এবং ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড, যা হৃদ্‌রোগের সুস্বাস্থ্য রক্ষায় উপকারী। একজন হৃদ্‌রোগী বিকেলের স্ন্যাকস হিসেবে খেতে পারেন মিক্সড নাট। তা একটু ইয়োগার্টের সঙ্গে মিশিয়ে নিলে ক্যালসিয়াম রিচ হবে।
হৃদ্‌পিণ্ডের সুস্থতায় ঈদে যেন অতিরিক্ত চর্বিজাতীয় খাবার না খাওয়া হয়, সেটি হৃদ্‌রোগীদের মাথায় রাখা দরকার। ঈদে কোনো বেলায় ভারী খাবার খেয়ে ফেললে পরবর্তী খাবার বা স্ন্যাকস অবশ্যই নিতে হবে একটু হালকা। এ ক্ষেত্রে রাখতে পারেন এই রেসিপিগুলো—
 প্রোবায়োটিক ফ্রুট স্যালাদ: বিভিন্ন রঙের ফল নিয়ে ছোট কিউব করে কাটতে হবে সবার প্রথমে। এরপর প্রোবায়োটিক হিসেবে টক দই দুই থেকে তিন টেবিল চামচ মিক্স করে নিন ফলের সঙ্গে। স্বাদের জন্য খানিকটা গোলমরিচের গুঁড়া ও লেবুর রস যোগ করে নিলেই স্ন্যাকস হিসেবে দারুণ সুস্বাদু একটি রেসিপি রেডি।
 ফিশ কাটলেট: প্রথমে এক বা দুই টুকরো মাছ সেদ্ধ করে বাটিতে নিন। এরপর পরিমাণমতো লবণ, অল্প ধনেপাতাকুচি, পেঁয়াজকুচি, রসুনকুচি এবং অল্প সেদ্ধ আলু দিয়ে চটকে নিয়ে ফ্রাই প্যানে হালকা অয়েল ব্রাশ করে তারপর কাটলেট তৈরি করে নিন।
হৃদ্‌রোগীদের ক্ষেত্রে নানা ধরনের মুখরোচক খাবারের নিষেধাজ্ঞা থাকায় মেনে চলা অনেকের পক্ষে মুশকিল। তবে একটু কষ্ট করে নিয়মগুলো মানলে পরবর্তীকালে বড় ধরনের জটিলতায় পড়া থেকে অনেকটাই সুরক্ষা মেলে। তাই ঈদ কিংবা যেকোনো ফেস্টিভ্যালেও অতিরিক্ত মসলা ও তেলযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলে কীভাবে একজন হৃদ্‌রোগী ভিন্ন ভিন্ন রেসিপির খাবার গ্রহণ করতে পারবেন, তা জানার জন্য কোনো পুষ্টিবিদের পরামর্শ গ্রহণ করতে পারেন।

লেখক: প্রধান পুষ্টিবিদ ও বিভাগীয় প্রধান, পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top