skip to Main Content

ফিচার I মহাশূন্যে আহার

মহাকাশ নিয়ে রোমাঞ্চকর কৌতূহলের কমতি নেই। জানি কি, নভোচারীরা কী খান, কীভাবে খান?

ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনের (আইএসএস) মেনুতে রয়েছে শতাধিক আইটেম। শাকসবজি, ফল থেকে শুরু করে প্রাক-প্রস্তুত খাবার ও ডেজার্ট পর্যন্ত অনেক কিছুই। এমনকি কেচাপ ও সরিষার মতো মসলাও পাওয়া যায়। মেনুতে প্রতিদিন মূল খাবার তিনবার—সকাল, দুপুর ও সন্ধ্যা। সেই সঙ্গে স্ন্যাকস খাওয়া যেতে পারে যেকোনো সময়। এর ফলে নিশ্চিত করতে হয়, মহাকাশচারীরা প্রতিদিন যেন কমপক্ষে ২৫০০ ক্যালরি খাবার গ্রহণ করেন।
মহাকাশে নিয়ে যাওয়া খাবার মিশন দল আগে থেকেই ঠিক করে রাখে। এ ক্ষেত্রে মহাকাশচারীদের পছন্দকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। সাধারণত দীর্ঘ সময়ের জন্য মহাকাশে থাকতে হয় তাদের। তাই বিজ্ঞানীরা খাবার প্যাকেজিং ও প্রস্তুত করার অসাধারণ উপায় আবিষ্কার করেছেন। কোন খাবার পাঠানো হবে, তা নির্ধারণের সময় বিজ্ঞানীরা ও মিশন কন্ট্রোল এমন উপাদানগুলো বেছে নেন, যা ওজনে হালকা, পুষ্টিকর এবং খেতে সহজ ও সুস্বাদু।
নভোচারীর খাবার
নভোচারীদের খাদ্য গ্রহণে রয়েছে অনেক চ্যালেঞ্জ। তাতে স্বাস্থ্য বিবেচনাকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। মহাকাশে দীর্ঘ সময় ধরে অবস্থান করলে পেশি ও হাড়ের ঘনত্ব ২০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে। এই ক্ষতি কক্ষপথে থাকার সময় মহাকাশচারীদের দেহে প্রভাব না-ও ফেলতে পারে। তবে তারা পৃথিবীতে ফেরার পর তাদের দুর্বল হাড়গুলো ভঙ্গুর হিসেবে অনুভূত ও দৃশ্যমান হতে পারে, যা হাড়ে ফ্র্যাকচারের ঝুঁকি বাড়ায়। তাই পর্যাপ্ত ব্যায়াম এবং ক্যালসিয়ামসমৃদ্ধ খাবার তাদের জন্য অপরিহার্য।
মহাকাশে যেহেতু বডি ফ্লুইড ভিন্নভাবে কাজ করে, তাই নভোচারীর স্বাদ-অনুভূতি বদলে যায়। পৃথিবীতে বডি ফ্লুইড সাধারণত পায়ের দিকে স্থির থাকে। মহাকাশে, কম মাধ্যাকর্ষণে, এই ফ্লুইড আমাদের দেহে অবাধে চলাচল করে। ফলে মাথা ঠান্ডা কিংবা সাইনাসের মতো অনুভূতি তৈরি করে এবং অনেক খাবারের স্বাদ কমিয়ে দেয়। জিহ্বায় স্বাদ ফিরে পাওয়ার শক্তি সক্রিয় করার জন্য অনেক নভোচারী মরিচ ও মসলাযুক্ত খাবার পছন্দ করেন।
মহাকাশে খাবার ও পানীয় প্যাকেজ পদ্ধতি অনুসরণ করা হয় দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রার পদ্ধতি মেনে; আর তা পরিচালনা করে সামরিক বাহিনী। ওজনে হালকা, আকারে আঁটোসাঁটো এবং বায়ুরোধী সিলের কারণে জিপ লক ব্যাগ, রিটরট পাউচ ও ক্যান ব্যবহার করা হয়। তাতে খাবারগুলো নষ্ট হওয়ার কিংবা ছিটকে পড়ার ঝুঁকি কমে।
খাদ্য প্রক্রিয়া
মহাকাশে প্রথমবারের মতো কুকি বেক করা হয়েছিল ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে। কুকির ময়দা সরবরাহ করেছিল আমেরিকান হসপিটালিটি কোম্পানি ডাবলট্রি। আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে চুলায় ওই বেক করতে সময় লেগেছিল দুই ঘণ্টা।
মহাকাশে খাদ্য প্রস্তুতে ব্যবহার করা হয় মাইক্রোওয়েভ এবং কনভেকশন ওভেন। ওয়াটার স্টেশনগুলোতে ওয়াটার গান দিয়ে শুকনা ও পানিশূন্য খাবারকে পানিযুক্ত করা হয়। পছন্দের খাবার পেতে সেই খাবারের পেছনে বারকোড স্ক্যান করা সেখানে অপরিহার্য। এর ফলে কোন নভোচারী কী খাচ্ছেন, সেই তথ্য সংগ্রহ করতে পারে মিশন দল।
ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনের ভেতর মেঝেতে স্থির টেবিল ও চেয়ারে সুসজ্জিত ডাইনিং রুম নভোচারীদের খাদ্য গ্রহণে এক অনন্য অভিজ্ঞতা এনে দেয়। তারা চেয়ারের সঙ্গে নিজ নিজ পা ও ঊরু বেঁধে, কাঁটাচামচ, ছুরি ও চামচ ব্যবহার করে চুম্বকীয় ট্রে থেকে খাবার নিয়ে খান। ব্যাকটেরিয়ার বিস্তার রোধে কক্ষের দেয়ালে থাকে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল উপাদান।
খাদ্যতালিকা
প্রাথমিকভাবে স্পেস ফুড সাধারণত ডিহাইড্রেটেড হয়ে থাকত, যা পেস্টে সরবরাহ করে টিউব থেকে খাওয়া হতো। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতি যেহেতু আমাদের খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, প্যাকেজিং ও উপাদানে নতুন ফর্ম হাজির করেছে, তাই নভোচারীদের খাদ্যগুলোও এখন অনেকটাই পৃথিবীর খাবারের মতো। তবে মহাকাশে পাঠানো খাবারগুলোকে কয়েক ভাগ করা হয়:
 ফ্রেশ ফুড: দুই দিনের শেলফ লাইফসহ ফল ও শাকসবজি মহাকাশযানের ফ্রিজে রাখা হয়। নভোচারীদের মনোবল চাঙা রাখার জন্য পাঠানো হয় এ ধরনের খাবার। নষ্ট হওয়া এড়াতে এগুলো দ্রুত গ্রহণ করা অনিবার্য।
 বিকিরণিত খাদ্য: প্যাকেজিংয়ের আগে মাংস ও দুগ্ধজাত পণ্যে বিকিরণ প্রয়োগ করা হয়। এর ফলে এই খাদ্যপণ্যগুলোর স্থায়িত্ব বাড়ে এবং মাইক্রোবিয়াল দূষণের ঝুঁকি কমে।
 ইন্টারমিডিয়েট ময়শ্চার: এই খাবারগুলোতে অল্প পরিমাণে পানি থাকে এবং প্রায়শই গঠনগতভাবে নরম হয়। এগুলো তৈরিতে লবণাক্তকরণ বা রোদে শুকানোর মতো প্রক্রিয়া ব্যবহার করা হয়। এর বাইরে অন্য কোনো প্রস্তুতির প্রয়োজন পড়ে না।
 প্রাকৃতিক খাবার: সহজভাবে প্যাকেজ করা এবং খাওয়ার জন্য প্রস্তুত বাদাম, বিস্কুট ও চকোলেট বার—এই ধরনের খাবারের অন্তর্ভুক্ত।
 রিহাইড্রেটযোগ্য খাবার ও পানীয়: স্পেসে খাদ্য প্রস্তুত করার ক্ষেত্রে বহুদিন ধরে এটি আদর্শ পদ্ধতি। খাদ্য বা পানীয় থেকে পানি অপসারণ করার ফলে ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা বৃদ্ধি কঠিন হয়ে পড়ে এবং নাটকীয়ভাবে খাবারের স্থায়িত্ব বাড়ে ও নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা কমে। মহাকাশচারীরা খাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলে এই খাবারগুলোতে পানি ফিরে আসে।
 তাপস্থাপিত খাবার: বেশ কিছু রেডিমেড খাবার প্রস্তুত করতে হিট ট্রিটিং ব্যবহার করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় তাপ প্রয়োগ এবং তারপর দ্রুত বায়ুনিরোধক প্যাকেজিংয়ে পণ্যটি সিল করে ব্যাকটেরিয়া নির্মূল করা হয়।
খাদ্যসংযোগ
প্রতি দু-তিন মাস পর একটি স্বয়ংক্রিয় মহাকাশযান, যেমন ইউরোপীয় স্পেস এজেন্সির ‘অটোমেটেড ট্রান্সফার ভেহিকল’ কিংবা রাশিয়ার ‘প্রগ্রেস’ মহাকাশযান তাজা ফল, পানি ও আগে থেকে প্যাকেজ করা খাবার নিয়ে ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনের সঙ্গে সংযুক্ত হয়।
আইএসএসে থাকা বিভিন্ন ন্যাশনালিটির মধ্যে কমরেডশিপ তৈরি করতে নভোচারীরা তাদের দেশের খাবারের একটি বিশদ মেনু সতীর্থদের সঙ্গে ভাগ করে নেন। ধরা যাক, জাপানিজ অ্যারোস্পেস এক্সপ্লোরেশন এজেন্সি (জেএএক্সএ) একটি রিহাইড্রেটযোগ্য নুডল উদ্ভাবন করেছে, অন্যদিকে চীন তৈরি করেছে বিশেষভাবে প্রক্রিয়াজাত কুং পাও মুরগির মাংস। এসব খাবার তারা সবার সঙ্গে ভাগ করে খান।
২০১৪ সালে ইতালীয় স্পেস এজেন্সি (এএসআই) আইএসএসপ্রেসসো নামক একটি কফি মেশিন আবিষ্কার করে, যেটি বিশেষ স্থান এবং কম মাধ্যাকর্ষণে কাজ করতে সক্ষম। এর পরের বছরের ৩ মে ইতালীয় মহাকাশচারী সামান্থা ক্রিস্তোফোরেত্তি মহাকাশে প্রথম এসপ্রেসো কফি পান করেছিলেন।
মহাকাশচারীদের প্রথম খাবার
মহাকাশে যাওয়া প্রথম নভোচারী ছিলেন ইউরি গ্যাগারিন। ১৯৬১ সালের ১২ এপ্রিল ‘ভোস্তক ওয়ান’ স্পেসফ্লাইটে চড়ে একটি কক্ষপথ চক্কর দেওয়ার মাধ্যমে ইতিহাসে নাম লেখান এই কিংবদন্তি রুশ নভোচারী। সেই যাত্রায় একটি অ্যালুমিনিয়াম টিউব থেকে গরুর মাংস ও যকৃতের পেস্ট খেয়েছিলেন তিনি। ফলে মহাকাশে প্রথম খাদ্য গ্রহণকারীও গ্যাগারিন। একই পদ্ধতি অনুসরণ করে প্রথমবারের মতো ডেজার্ট হিসেবে চকোলেট সস খেয়েছিলেন এই নভোচারী।
পান-সমাহার
মহাকাশে মাইক্রোগ্র্যাভিটিতে যেহেতু পানি পাত্র থেকে দূরে ছিটকে ও ভেসে যায়, তাই স্ট্রয়ের মাধ্যমে ব্যাগ থেকে তরল চুষে খেতে হয় নভোচারীদের। এই ব্যাগগুলো পায়ের মোজাবিশেষের মাধ্যমে পানির স্টেশনে রিফিল করা হয়।
নভোচারীরা সাধারণ পানি পান করেন; সঙ্গে স্বাদযুক্ত বিভিন্ন পানীয়ও থাকে। রেফ্রিজারেটর ড্রাইড পানীয়ের মিশ্রণ, যেমন কফি বা চা, লেমনেড ও কমলার রস ভ্যাকুয়াম সিল করা ছোট্ট থলের মাধ্যমে সরবরাহ করা হয়।
চাঁদের বুকে পা রাখা প্রথম মানুষ হিসেবে ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছেন আমেরিকান দুই নভোচারী এডউইন অলড্রিন (বাজ অলড্রিন নামেও পরিচিত) ও নিল আর্মস্ট্রং, এ কথা অনেকেরই জানা। জানেন কি, এই অলড্রিনই একমাত্র নভোচারী, যিনি মহাকাশে অ্যালকোহল পান করেছিলেন; এমনকি চাঁদেও! চাঁদের বুকে বসে এই ‘হলি কমিউনিয়ন’ সম্পন্ন করেছিলেন তিনি। এরপর থেকেই মহাকাশ অভিযানে অ্যালকোহল পান নিষিদ্ধ করেছে নাসা। মহাকাশযান চালনাকারী নভোচারীদের জন্য সদা সতর্ক এবং যেকোনো জরুরি পরিস্থিতিতে দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানাতে সক্ষম থাকতে পারাই এর কারণ।
বর্জ্য সমাধান
কম মাধ্যাকর্ষণে ব্যাকটেরিয়া দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে। তাই মহাকাশ ভ্রমণকালে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। খাওয়ার পর নভোচারীরা শাটল মেঝেতে একটি ট্রাশ কমপ্যাক্টরে খাবারের প্যাকেজ ও বর্জ্য ফেলে দেন। তারা ভেজা টিস্যু দিয়ে কাটলারি ও ট্রে পরিষ্কার করেন।
স্বভাবতই স্পেস স্টেশনে পৃথিবীর মতো সেপটিক ট্যাঙ্ক বা স্যুয়ারেজ ব্যবস্থা নেই। কম মাধ্যাকর্ষণের কারণে নভোযানের টয়লেটগুলোতে ফ্লাশ করার জন্য পানির বদলে বাতাস ব্যবহার করা হয়। টয়লেটের বাতাস মূলত ব্যাকটেরিয়া ও গন্ধ দূর করার জন্য ফিল্টার করা হয়। শাটল অবতরণ না হওয়া পর্যন্ত কঠিন বর্জ্য নভোযানেই সংরক্ষণ করা হয়; অন্যদিকে, তরল বর্জ্য নিষ্কাশন করা হয় মহাকাশেই।

 ফুয়াদ রূহানী খান
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top