skip to Main Content

স্বাদশেকড় I শর্মা মর্ম

মুখরোচক ও অতুলনীয় স্বাদের ফাস্ট ফুড। নানা দেশে পরিচিত নানা নামে। দুনিয়াজুড়ে এর দারুণ চক্কর

শর্মা মূলত অটোমান স্ট্রিট ফুড। বোঝাই যাচ্ছে, খাবারটির উদ্ভব মধ্যপ্রাচ্যে। সুশি, বার্গার, ফালাফেলের মতো শর্মা বর্তমান বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় খাবার। ইউরোপে এর জনপ্রিয়তা সবচেয়ে বেশি। শুধু জার্মানিতেই শর্মা স্যান্ডউইচ তৈরিতে প্রতিদিন ৪০০ টন মাংস ব্যবহার করা হয়।
মসলাদার মাংস দিয়ে প্রস্তুত এ খাবার পিটা রুটি বা খামিরবিহীন দুরুম রুটিতে স্যান্ডউইচ হিসেবে পরিবেশন করা হয়। কোথাও কোথাও প্লেটে আলাদা মাংস ও সবজি যোগের চল রয়েছে। এই স্যান্ডউইচকে ইউরোপে সাধারণত কাবাব বলে।
তুর্কিদের প্রস্তুত করা শর্মার প্রাথমিক নাম ছিল ‘সেভারেম’, যার অর্থ ‘আগুনের সামনে শিক ঘোরানো’। শব্দটি তুর্কি শব্দ সেভির্মে থেকে আসা। চতুর্দশ শতাব্দীর একটি লেখায় প্রথম এই মাংসের রেসিপির উল্লেখ পাওয়া যায়, যদিও এর উৎস নিশ্চিত নয়।
জানা যায়, একসময় মধ্য এশিয়ার যাযাবর লোকেরা ব্রোচ বা তরবারিতে গেঁথে মাংস রান্না করতেন। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ওই মিট রেসিপি ভারতীয় রাজদরবারের সুলতানদের কাছে বিলাসবহুল খাবারের মর্যাদা পেয়েছিল। এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে শর্মার যাত্রা শুরুর গল্পও। অবশ্য স্যান্ডউইচ হিসেবে এ খাবারের প্রসার ঘটার জন্য ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল। ঐতিহ্যগতভাবে অটোমান সাম্রাজ্যের শহুরে রাস্তায় যেসব শর্মা পাওয়া যেত, সেগুলোর মাংস স্কিওয়ার বা শিকে গেথে হরাইজন্টালি রেখে প্রস্তুত করা হতো। একই সময়ে ভার্টিক্যাল বা খাড়া করে রাখা তরবারিতে গেঁথে মাংস রান্নার ধারণা সমাদর পায়। ১৮৩০ সালের দিকে সম্ভবত এ ধারণায় উদ্বুদ্ধ হয়েই তুরস্কের বুরসা শহরের বিখ্যাত ইস্কান্দার এফেন্দি রেস্তোরাঁ ভার্টিক্যাল ট্রান্সপোর্ট মেথড উদ্ভাবন করে, যাতে মাংস প্রস্তুতকরণের দণ্ড বা শিকটি ভার্টিক্যালি স্থাপনে সহায়ক। ১৮৭০ সালে আধুনিক ও সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য শর্মার উদ্ভাবন করেন ওই রেস্তোরাঁর শেফ মোহাম্মদ ইস্কান্দার। তার উদ্ভাবনই বিশ্বে ব্যাপকভাবে শর্মা বিস্তারের দরজা খুলে দেয়। বলে রাখি, বুরসাতে শর্মাকে বলা হয় ইস্কান্দার কাবাব।
খাদ্য ইতিহাসবিদেরা নিশ্চিত, তুরস্ক থেকেই সিরিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে শর্মা। ১৯০৬ সালে তুরস্কের এরজুরুম শহর থেকে দেশটিতে স্টক এক্সচেঞ্জের আবির্ভাব ঘটলে, বুরসার ইস্কান্দার এফেন্দি রেস্তোরাঁর চাকরি ছেড়ে দামেস্কের মারজা স্কয়ারে শর্মা রেস্তোরাঁ খোলেন সিদ্দিক আল-খাবাজ। হাজি মোহাম্মদ বিন ইস্কান্দার এফেন্দির রন্ধন পদ্ধতি ও প্রেসক্রিপশন সঙ্গী করেছিলেন তিনি। তারপর দামেস্কে ছড়িয়ে পড়ে সস এলাচির মটরশুঁটি যোগে তার বানানো বিখ্যাত সিরিয়ান শর্মা।
এদিকে ১৯৪৫ সালে ইস্তাম্বুলে একটি রেস্তোরাঁ খোলেন উজবেকিস্তানের এক শরণার্থীর সন্তান বেতি গুলার, যেটি ওই শহরে প্রথমবারের মতো এমন সব খাবার পরিবেশন করে, যেগুলোর মধ্যে ছিল রোমান প্রদেশ দোব্রুকা থেকে তার শিখে আসা ডোনার কাবাবের রেসিপিও। এটি ছিল তার রেস্তোরাঁয় ক্লায়েন্টদের দেওয়া বাকি সব কাবাবের চেয়ে একদম আলাদা।
রুটির স্লাইসে মোড়ানো শর্মা পরিবেশন করার চল তখন ছিল না। তবে শুরু থেকেই থালায় ভাপানো ভাত বেলাউভ (বেলাও) পরিবেশন করা হতো শর্মার সঙ্গে। দামেস্ক ও ইস্তাম্বুলে তাশরামাহ (খাসির মাংসের শর্মাবিশেষ) আসার আগ পর্যন্ত এ রেওয়াজের চল ছিল। আর তা পরিবেশন করা হয়েছিল ১৯৪০-এর দশকে দামেস্কে বেতি গুলারের এক বন্ধুর রেস্তোরাঁয়। এটি ছিল আরবের সাজ রুটি দিয়ে মুড়িয়ে স্লাইস করা শর্মার রূপ। শামি স্যালাদের পাশাপাশি খাওয়া হতো এটি। ১৯৬০ সালে মাস্টার পিটি নামে এক ব্যক্তি এ খাবার ইস্তাম্বুলে উপস্থাপন করেছিলেন। তাতে ডর্ম দুরুম নামক রুটিটি তুর্কি তনুর রুটি দিয়ে এক স্তরে মোড়ানো থাকত। এই পদ্ধতি ১৯৬০-এর দশকে ইস্তাম্বুলজুড়ে ব্যাপক সুনাম করে। এই ফাঁকে বলে রাখি, শর্মার মূল উপাদান হিসেবে শুরুর দিকে গরুর মাংসের চল থাকলেও সিরিয়ায় চিকেন শর্মার পথচলা শুরু বলে ধারণা করা হয়। এরপর তালিকায় নাম লেখায় তাশরামাহ।
শর্মার ইউরোপযাত্রায় ফ্রান্স ও জার্মানির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ওই মহাদেশে জার্মানিতেই এটি প্রথম রপ্তানি করা হয়েছিল। ইউরোপের যেসব দেশে খাবারটির চল রয়েছে, দেশভেদে রয়েছে আলাদা নামও। অবশ্য ফ্রান্সের শর্মার ইতিহাস একটু বিভ্রান্তিকর! তুর্কি খাবার হলেও প্যারিসে এটি প্রথম পরিবেশন করা হয় এক গ্রিক রেস্তোরাঁয়। তাই স্থানীয় ভোক্তারা সহসাই এই নতুন খাবারের নাম রাখেন ‘গ্রিক স্যান্ডউইচ’। এই ত্রুটিপূর্ণ নাম দ্রুতই দেশটির বাকি অংশে ছড়িয়ে পড়ে। যদিও খাবারটি ফ্রান্সের দক্ষিণাঞ্চলে ‘কাবাব’ এবং উত্তরাঞ্চলে ‘ডোনার’ নামে পরিচিত হতে থাকে; তবে এই নামকরণ নিয়ে এখনো তর্ক জারি রয়েছে, বিশেষত সোশ্যাল মিডিয়ায়।
গ্রিকের অধিবাসীরা অবশ্য শর্মাকে ‘গ্রিক স্যান্ডউইচ’ বলে ডাকেন না। রাতের এই প্রিয় খাবারকে এথেন্সের রাস্তায় বলা হয় ‘সুভলাকি’। তা ছাড়া নানা জায়গায় শর্মার আরও কিছু নাম রয়েছে; যেমন বান মি, আরব টাকোস, কেবাবনরস্ক, শিশ তাওক বা ডানার। মজার ব্যাপার হলো, দুনিয়ার প্রায় সব দেশেই এমন স্যান্ডউইচ খুঁজে পাবেন, যেটি সারা দিন কাজের পর আপনার বিরস বদনের সন্ধ্যাকে নিমেষেই ভালো করে দিতে সক্ষম!
এদিকে জার্মানিতে কাবাব রীতিমতো দৈনন্দিন জীবনের একটি অংশ। হ্যামবার্গার, পিৎজা এবং কারিওয়ার্স্ট ছাড়াও এজাতীয় খাবারের বিক্রয় সার্বিকভাবে বাড়ার কারণে সেখানে ফাস্ট ফুড সংস্কৃতি গড়ে ওঠা একধরনের প্রথায় পরিণত হয়। ডোনার কাবাব ও বার্লিন যেন একই সূত্রে গাঁথা। তবে এ দুটির রয়েছে এক দীর্ঘ ও জটিল ইতিহাস। ঊনবিংশ শতাব্দীতে তুরস্কে ঐতিহ্যবাহী খাবারটি ইতিমধ্যে বিদ্যমান থাকলেও অতিরিক্ত মসলাদার সসসহ রুটিতে মাংস, সবজিযোগে স্যান্ডউইচের এই বিকল্প সংস্করণ ১৯৭০-এর দশকের গোড়ার দিকে উদ্ভাবিত হয়। বার্লিনের ক্রুজবার্গ অঞ্চলে সেই সময়ে অনেক তুর্কি কাজ করতেন গেস্ট ওয়ার্কার হিসেবে। তেমনই একজনের হাত ধরে ফাস্ট ফুড পণ্য হিসেবে শহরটিতে শর্মার পথচলা শুরু। সেই প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে বলে রাখি, ওই দশকের গোড়ার দিকেই অনেক তুর্কি রেস্তোরাঁ ও স্ন্যাক বারের আবির্ভাব ঘটে বার্লিনে। তুর্কি পান্থশালার মালিকেরা ফাস্ট ফুডের এই প্রবণতায় ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখান এবং তাদের ঐতিহ্যবাহী গ্রিল করা মাংস রুটির মধ্যে পুরে বিক্রি শুরু করেন। এটি ছিল এমন এক হৃদয়গ্রাহী স্যান্ডউইচ, যা উষ্ণ, পুষ্টিকর এবং দ্রুত প্রস্তুতযোগ্য। ব্যস্ততায় ছুটে চলা শহরবাসীর জন্য এ ছিল এক নিখুঁত স্ন্যাকস। প্রচলিত আছে, ‘আবু শর্মা’ ও ‘আবু আল ডোনার’ নামে পরিচিতি পাওয়া এই কাবাব বা শর্মার উদ্ভাবক ছিলেন ক্রুজবার্গে কর্মরত তুর্কি নাগরিক কাদির নরমান, যিনি একটি স্ন্যাক বার চালাতেন। তার হাত ধরেই খাবারটি জার্মানিজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।
বাংলাদেশেও শর্মা বহুল প্রচলিত ফাস্টফুড। মূলত ২০০০ সালের পরেই এ দেশে এর ঘটেছে বিস্তার।

 ফুয়াদ রূহানী খান
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top