skip to Main Content

ফুড চেইন I পাড়া থেকে দুনিয়া মাত

ম্যাকডোনাল্ড’স। সবচেয়ে বড় ফাস্ট ফুড চেইন। চলতি বছর ব্র্যান্ড ফাইন্যান্স পরিচালিত জরিপে দুনিয়ার খ্যাতিমান ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে এর অবস্থান দ্বিতীয়

১৯৪০ সাল। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার সান বার্নার্ডিনোতে দুই ভাই রিচার্ড ও ম্যাভরিস ম্যাকডোনাল্ড একটি রেস্তোরাঁ দিলেন। নাম রাখলেন নিজেদের নামেই, ম্যাকডোনাল্ড’স। শুরুতে হ্যামবার্গার বিক্রি করতেন। সঙ্গে মিল্কশেকও অফার করা হতো সেই রেস্তোরাঁয়।
চলছিল কোনোরকমে। আট বছর পর ব্যবসাকে ঢেলে সাজানোর সিদ্ধান্ত নিলেন ম্যাকডোনাল্ড ভ্রাতৃদ্বয়। তিন মাস সংস্কারের পর নতুন পরিকল্পনা ও ভাবনার প্রয়োগ ঘটিয়ে খোলা হলো ম্যাকডোনাল্ড’স। ছোট রেস্তোরাঁটি কম দামে বেশি খাবার তৈরির ছক এঁকেছিল। তা অর্জনে দুই ভাই রেস্তোরাঁর মেনু সীমিত করেন। তাতে রাখেন শুধুই হ্যামবার্গার, পটেটো চিপস (পরে সেই জায়গা দখলে নেয় ফ্রেঞ্চ ফ্রাই), ড্রিংকস ও পাই। একটি সহজ ও দারুণ বিন্যাস তৈরি করে তারা নাম দেন স্পিডি সার্ভিস সিস্টেম। এর মধ্যে একটি সেলফ সার্ভিস কাউন্টার অন্তর্ভুক্ত ছিল, যা ওয়েটার এবং ওয়েট্রেসের প্রয়োজনীয়তা দূর করে। গ্রাহকেরা তাদের খাবার দ্রুততম সময়ে পেতে থাকেন। কেননা হ্যামবার্গারগুলো আগে থেকেই প্রস্তুত করে মুড়িয়ে রেখে তাপবাতির নিচে গরম করা হতো। এসব উদ্ভাবনের জন্যই মূলত ম্যাকডোনাল্ড ব্রাদার একটি বেসিক হ্যামবার্গারের জন্য মাত্র ১৫ সেন্ট চার্জ নিতেন, যা প্রতিদ্বন্দ্বী রেস্তোরাঁর মূল্যের প্রায় অর্ধেক। হয়তো সে কারণেই ম্যাকডোনাল্ড’স শুরুতেই আকাশচুম্বী সাফল্য পেয়ে যায়।
রে জাদু
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ছোট এই ব্যবসা বিশ্বব্যাপী ফ্র্যাঞ্চাইজিতে পরিণত হয়, তবে তা ১৯৫৫ সালে, রে ক্রোকের হাত ধরে। রে ক্রোক ছিলেন মূলত একজন বিক্রয়কর্মী, যিনি রেস্তোরাঁগুলোতে মিল্কশেক মিক্সার সাপ্লাই করতেন। ১৯৫৪ সালে ম্যাকডোনাল্ড ভাইদের রেস্তোরাঁয় খেতে গিয়ে সেটির জনপ্রিয়তা, ফাস্ট সার্ভিং ও সুস্বাদু খাবারে বেশ চমকে যান তিনি। এরপর প্রতিষ্ঠাতা ভাইদের কর্মপ্রক্রিয়া জানতে পেরে তাদের কাছে ফ্র্যাঞ্চাইজির প্রস্তাব রাখেন। হ্যামবার্গার ও মিল্কশেক দিয়ে যে ব্যবসার সূচনা ঘটেছিল, তারপর থেকেই সেটির বিস্তার ক্রমাগত বাড়তে থাকে। ১৯৫৫ সালের এপ্রিলে ডেস প্লেইনস, ইলিনয় অঙ্গরাজ্যে “ম্যাকডোনাল্ড’স সিস্টেমস, ইনক” চালু করেন রে ক্রোক, যা পরে ম্যাকডোনাল্ড’স করপোরেশন নামে পরিচিতি পায়। সেখানে মিসিসিপি নদীর তীরে প্রথম ম্যাকডোনাল্ড’স ফ্র্যাঞ্চাইজির সূচনাও তারই হাতে। এরপর ১৯৬১ সালে ম্যাকডোনাল্ড ভাইদের কাছ থেকে পুরো ব্যবসা কিনে নেন রে।
উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে, বর্তমানে শতাধিক দেশে রয়েছে ম্যাকডোনাল্ড’স ফ্র্যাঞ্চাইজি। গেল বছরের শেষ অবধি বিশ্বব্যাপী ৪০ হাজার ২৭৫ রেস্তোরাঁ রয়েছে এর; তাতে কাজ করেন প্রায় ২ লাখ কর্মী। ২০২১ সালের হিসাব অনুযায়ী, ম্যাকডোনাল্ড’স সে বছর প্রায় ২৪ বিলিয়ন ডলার আয় করেছিল। যদিও বাংলাদেশে এখনো ঘটেনি এই ফুড চেইনের আগমন।
ফ্র্যাঞ্চাইজি থেকে বিগ ম্যাক
কোম্পানির সাফল্যের জন্য ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পেরেছিলেন ক্রোক। খাদ্য তৈরি থেকে পরিষ্কার করা পর্যন্ত প্রতিটি কাজ ম্যাকডোনাল্ড’স-এর কীভাবে চালানো উচিত, সে জন্য একটি মান নির্ধারণ করেছিলেন তিনি। আউটলেটগুলোর মানসম্মত কর্মপরিচালনা নিশ্চিত করা এবং ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য ১৯৬১ সালে একটি প্রোগ্রাম চালু করেছিলেন, যা পরে হ্যামবার্গার ইউনিভার্সিটি নামে পরিচিতি লাভ করে। তা ছাড়া তিনি শেষ পর্যন্ত রেস্তোরাঁর বিন্যাসে পরিবর্তন ঘটান এবং অর্ডার নেওয়ার জন্য কাউন্টার স্টাফ যুক্ত করেন। ১৯৭৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনার একটি ম্যাকডোনাল্ড’স চেইনের প্রথম ড্রাইভ-থ্রু উইন্ডো চালু করেন ক্রোক। তা এতই জনপ্রিয়তা পায় যে সর্বব্যাপী দ্রুততম সময়ে ছড়িয়ে পড়ে।
এই সময়ের মধ্যে ম্যাকডোনাল্ড’স তিনটি ফিচার চালু করে, যেগুলো এর ব্র্যান্ডকে ভোক্তাদের কাছে আরও বেশি পরিচিতি এনে দেয়। প্রথমত, ১৯৬৩ সালে আবির্ভাব ঘটানো হয় রোনাল্ড ম্যাকডোনাল্ড নামে এক ক্লাউনের। তাতে অবশ্য বেশ ধাক্কা খেতে হয়। শিশুদের কাছে বিপণনের প্রক্রিয়া নিয়ে সমালোচনা এবং ক্লাউনদের ক্রমবর্ধমান নেতিবাচক ধারণার ফলে কোম্পানিটি একুশ শতকের প্রথম দিকে চরিত্রটিকে অনেকাংশে দূরে সরিয়ে দেয়। সম্ভবত সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সংযোজন ঘটেছিল ১৯৬৮ সালে, যখন ম্যাকডোনাল্ড’স তার ন্যাশনাল মেনুতে বিগ ম্যাক যুক্ত করে। এই আইকনিক হ্যামবার্গার বস্তুত ফ্রেঞ্চ ফ্রাইয়ের পরে কোম্পানির সর্বোচ্চ বিক্রীত আইটেম হয়ে ওঠে। তা ছাড়া ষাটের দশকে চেইনটি তার লোগো পরিমার্জন করে। অবশেষে বিখ্যাত এই ডাবল-আর্ক এম ডিজাইনের ঘটে আত্মপ্রকাশ, যা পরিণত হয় ম্যাকডোনাল্ড’স-এর স্থায়ী প্রতীক এবং বিশ্বের সবচেয়ে পরিচিত লোগোগুলোর একটিতে।
এসব পরিবর্তন ম্যাকডোনাল্ড’স-এর বিস্তারকে গতিশীল করেছে। রে ক্রোক এই কোম্পানির একমাত্র মালিক হওয়ার পর ১০ বছরের কম সময়ে চেইনটির আউটলেটের সংখ্যা হাজারের ওপর নিয়ে যান। এই বর্ধিত আউটলেটের কারণে কোম্পানিটি স্টক মার্কেটে ১৯৬৫ সালে সর্বজনীনভাবে ব্যবসা শুরু করে।
সম্প্রসারণ ও পণ্য সমাহার
১৯৬৭ সালে কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়ার রিচমন্ডে এর একটি ফ্র্যাঞ্চাইজি খোলা হয়েছিল, যা যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে ম্যাকডোনাল্ড’স-এর প্রথম আউটলেট। চলতি শতকের গোড়ার দিকে ১১৫টির বেশি দেশ ও অঞ্চলে প্রায় ৩৪ হাজার আউটলেট চালু করে এই ফুড চেইন। নব্বইয়ের দশকে এর প্রবৃদ্ধি এতই দ্রুত ছিল, বলা হয়ে থাকে, সে সময় প্রতি পাঁচ ঘণ্টায় বিশ্বের কোথাও না কোথাও ম্যাকডোনাল্ড’স-এর একটি আউটলেট খোলা হয়েছে! এটি কার্যকরভাবে সবচেয়ে জনপ্রিয় পারিবারিক রেস্তোরাঁয় পরিণত হয়েছে। এর পেছনে কাজ করেছে সাশ্রয়ী মূল্যে মজাদার ও সুস্বাদু খাবারের ওপর জোর দেওয়া, যা একই সঙ্গে সব বয়সী ভোক্তার কাছে সমান আবেদন তৈরি করেছে।
হ্যামবার্গার ব্যবসার বাইরে বিশ শতকের শেষ দিকে ম্যাকডোনাল্ড’স যুক্তরাষ্ট্রের চিপোটল মেক্সিকান গ্রিল (১৯৯৮), ডোনাটোস পিৎজা (১৯৯৯), বোস্টন মার্কেট (২০০০) এবং যুক্তরাজ্যের অ্যারোমা ক্যাফে (১৯৯৯) কিনে নিজের অধীনে নিয়ে আসে। এ ছাড়া স্যান্ডউইচ রেস্তোরাঁ চেইন প্রিট আ ম্যাঞ্জারও (২০০১) আয়ত্তে নিয়ে নেয়। অবশ্য ২০০৮ সালের শেষের দিকে সেসব কোম্পানিতে ম্যাকডোনাল্ড’স-এর মালিকানা কিংবা সেই কোম্পানিগুলোর মধ্যে কোনো অংশীদারত্ব ছিল না; বরং ম্যাকডোনাল্ড’স নিজস্ব ব্র্যান্ডের প্রতি মনোনিবেশ করেছিল।
সমালোচনার তীর
ক্রমাগত সাফল্যের পাশাপাশি তীব্র কিছু সমালোচনাও সইতে হয়েছে ম্যাকডোনাল্ড’সকে। স্থূলতা বা ওবিসিটির বৈশ্বিক বৃদ্ধি যে উদ্বেগ ছড়িয়েছে, তার জন্য এই ফুড চেইনকে দায়ী করেছেন অনেকে। চলতি শতকের গোড়ার দিকে যুক্তরাষ্ট্রে কোম্পানিটির বিরুদ্ধে বেশ কিছু মামলা হয়। তাতে অভিযোগ করা হয়, এর খাবারের কারণে জনস্বাস্থ্য মারাত্মক সমস্যার সম্মুখীন। অবশ্য বাদীদের কেউই মামলায় জেতেননি, উল্টো বেশ কয়েকটি রাজ্য এই ফাস্ট ফুড কোম্পানির বিরুদ্ধে ওবিসিটি মামলা নিষিদ্ধ করার বিল পাস করেছে। অন্যদিকে, জনপ্রিয় ডকুমেন্টারি ‘সুপার সাইজ মি’তে (২০০৪) এরপরও ম্যাকডোনাল্ড’স তীব্র এক নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার মুখে পড়ে, যেখানে চলচ্চিত্র নির্মাতা মরগান স্পার্লক শুধু ম্যাকডোনাল্ড’স-এর খাবার খাওয়ার কারণে মারাত্মক স্বাস্থ্যহানির শিকার হয়েছিলেন বলে অভিযোগ তোলেন।
ম্যাকডোনাল্ড’স তার মেনুতে স্বাস্থ্যকর আইটেম যোগ করে এই সমালোচনার জবাব দেয় এবং তারা ম্যাকভেগান, পিএলটি ও ম্যাকপ্ল্যান্টের ভেগান নামে হ্যামবার্গার তৈরি শুরু করে। ২০১৭ সালে কোম্পানিটি তার প্রথম প্ল্যান্ট বেইজ হ্যামবার্গার বাজারজাত করে, যদিও এটি শুধু নির্দিষ্ট আউটলেটে পাওয়া যায়। দুই বছর পর আরেকটি ভেগান হ্যামবার্গার বাজারে আনে এই কোম্পানি। তা ছাড়া ২০১৮ সালে ম্যাকডোনাল্ড’স ঘোষণা দেয়, তাদের উৎপাদিত বেশির ভাগ হ্যামবার্গারে প্রিজারভেটিভ ব্যবহার বন্ধ করা হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি সুপারসাইজড অংশগুলোও বাদ দেয় এবং এর আমেরিকান ও কানাডিয়ান রেস্তোরাঁগুলো বেশ কয়েকটি আইটেমে ট্রান্স ফ্যাট ব্যবহার বন্ধ করে দেয়। এ ধরনের পদক্ষেপ স্বাস্থ্য উদ্বেগ থামাতে সাহায্য করে।
বিশ্বের বৃহত্তম বেসরকারি নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের একটি হিসেবে ম্যাকডোনাল্ড’স-এর মজুরি বাড়ানোর দাবি উঠেছে বারবার। ‘ম্যাকজব’ শব্দটি মেরিয়াম-ওয়েবস্টার অভিধানে যোগ করা হয়েছিল এই কোম্পানির সূত্র ধরেই, যার অর্থ ‘কম বেতনের চাকরি’। পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাবের জন্যও সমালোচিত হতে হয়েছে ম্যাকডোনাল্ড’সকে। বিশেষ করে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের দায়ে। একুশ শতকের গোড়ার দিকে, ফ্র্যাঞ্চাইজিটি তার রেস্তোরাঁগুলোতে গ্যাস নির্গমন কমানোর কাজ শুরু করে। পাশাপাশি, কোম্পানির প্যাকেজিং পরিবেশের জন্য উদ্বেগের কারণ ছিল এবং এই সময়ে ম্যাকডোনাল্ড’স রিনিউয়েবল বা রিসাইকেলড ব্যাগ, পাত্র ও অন্যান্য আইটেমের দিকে অগ্রসর হওয়ার একটি প্রোগ্রাম চালু করে।
হাত বাড়িয়ে দাও
বিভিন্ন দাতব্য সংস্থায় ম্যাকডোনাল্ড’স-এর রয়েছে সক্রিয় অংশগ্রহণ, বহুদিন ধরেই। ১৯৭৪ সালে আমেরিকান ফুটবল ক্লাব ফিলাডেলফিয়া ঈগলসের খেলোয়াড় ফ্রেড হিলের সঙ্গে যোগ দিয়ে ফিলাডেলফিয়ায় রোনাল্ড ম্যাকডোনাল্ড’স হাউস প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয় এই কোম্পানি। বলে রাখা ভালো, ফ্রেড হিলের মেয়ে তখন লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিল। ওই উদ্যোগ এ ধরনের অসুখে আক্রান্ত সন্তানেরা যে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে, তাদের পরিবারগুলোকে সেটির কাছাকাছি বসবাস করার সুযোগ করে দেয়। চলতি শতকের গোড়ার দিকে বিশ্বজুড়ে ৩৬০টির বেশি এ ধরনের উদ্যোগ সক্রিয় ছিল। এ ছাড়া ১৯৮৭ সালে প্রতিষ্ঠিত রোনাল্ড ম্যাকডোনাল্ড’স হাউস চ্যারিটিস অন্যান্য চ্যারিটি উদ্যোগকে সমর্থন করে আসছে। বর্তমানে ম্যাকডোনাল্ড’স আরও বেশ কিছু উদ্যোগ চালিয়ে নিচ্ছে, যেগুলোর মধ্যে হিস্পানিক শিক্ষার্থীদের জন্য একটি কলেজ স্কলারশিপ প্রোগ্রামও রয়েছে।
 ফুয়াদ রূহানী খান
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top