skip to Main Content

ফিচার I সিম্পলের মধ্যে গর্জাস

নকশার বাহুল্য বদলে গেছে মিনিংফুল মিনিমালিজমে। যেন মোটিফের মাঝে নকশার আঁকিবুঁকিতে গল্পের লুকোচুরি

মেহেদির কথা শুনলেই যেন আনন্দঘন আমেজের সুঘ্রাণ পাওয়া যায়। এ দিয়ে হাত রাঙানো ছাড়া উৎসব, পার্বণ, অনুষ্ঠান, আয়োজন—কোনো আনন্দ উদ্‌যাপনই যেন পূর্ণতা পায় না। সভ্যতার সূত্রপাত থেকে যেকোনো ধর্মীয় উৎসব, আনন্দ আয়োজনসহ সবকিছুর সঙ্গেই জড়িয়ে আছে মেহেদি পাতার রং। এর প্রথম ব্যবহার দেখা যায় উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে। প্রায় ৯ হাজার বছর আগে মরুভূমির বাসিন্দারা প্রচণ্ড গরম থেকে বাঁচার জন্য গোটা শরীর বাটা মেহেদি দিয়ে আবৃত করে রাখতেন। যা শরীর শীতল রাখতে সহায়ক ছিল। মূলত যোদ্ধাদের দিয়ে প্রচলন শুরু হলেও ধীরে ধীরে সাধারণের মাঝেও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এ পদ্ধতি। বিশেষ কিছু ক্ষেত্র ছাড়া মেহেদি পাতার কোনো ক্ষতিকর দিক নেই বলে এর ব্যবহার বাড়ে। ধীরে ধীরে সৌন্দর্যচর্চা ও অঙ্গসজ্জার বিশেষ উপকরণ হয়ে ওঠে।
শুরুতেই বলতে হয় মিসরের রানি নেফারতিতি ও ক্লিওপেট্রার কথা। তাদের রূপসজ্জার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ছিল এটি। হাতে বিভিন্ন নকশার পাশাপাশি চুল এবং কাপড় রাঙাতেও মেহেদি পাতা ব্যবহৃত হতো। গবেষণায় দেখা গেছে, বিভিন্ন দেশের মমিতে ব্যবহৃত উপাদানের মধ্যে এর উপস্থিতি রয়েছে। তা ছাড়া পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আয়ুর্বেদীয়, ইউনানি ও বিভিন্ন ধরনের অর্গানিক চিকিৎসায় মেহেদির ব্যবহার হয়ে আসছে। মধ্যযুগের বেশ কিছু চিত্রকলায় নারীদের হাতে ও পায়ের সজ্জায় মেহেদির ব্যবহার দেখা গেছে। শ্রীলঙ্কার সিগিরিয়া ও ভারতের অজন্তা গুহাচিত্রের অঙ্গসজ্জায় এর ব্যবহার দেখা গেছে। উপমহাদেশে মোগল আমল থেকে মূলত প্রাকৃতিক প্রসাধনী হিসেবে মেহেদির জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। মোগল সম্রাজ্ঞী মমতাজকে মিসর থেকে রাষ্ট্রীয় উপহার হিসেবে মেহেদিগাছের চারা পাঠানো হয়েছিল বলে জানা যায়। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ১ হাজার ৫০০ বছর ধরে মুসলিম নারীরা এর ব্যবহার করে আসছেন।
মুসলিম বিশ্বের খেলাফতের সময় থেকে বিভিন্ন উৎসবে এবং অনুষ্ঠানে মেহেদির ব্যবহার ধর্মীয় রীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। এ দেশে তথা ভারতীয় উপমহাদেশে এর ব্যবহার কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা ঈদ, পূজা, গায়েহলুদ, মেহেদি অনুষ্ঠান, নববর্ষ উদ্‌যাপনের সময় ধারণা করা সম্ভব। পৃথিবীর বহু দেশে এটি উৎসবের অবিচ্ছেদ্য অংশ। মেহেদি অনুষ্ঠান ঘিরে নানান রীতিনীতি, আচার ও প্রথা প্রচলিত রয়েছে। যদিও শুরুতে আরব সংস্কৃতি থেকে বিয়ের অনুষ্ঠানের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল ‘মেহেদি সন্ধ্যা’, বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতেও দারুণ জনপ্রিয়। এমনকি অন্য ধর্মের বিয়ের অনুষ্ঠানগুলোতেও সাড়ম্বরে উদ্‌যাপিত হচ্ছে মেহেদি উৎসব। শুধু কনেই নয়, আত্মীয়স্বজনও এদিন নিজেদের হাত রাঙিয়ে নেন। বিভিন্ন ধর্মে, গোত্রে, ভৌগোলিক অবস্থানভেদে ঐতিহাসিকভাবে এটি পবিত্রতা ও আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে যুক্ত। পৃথিবীর নানা জাতি, বিশেষ করে আদিবাসী সমাজে সুস্বাস্থ্য, উর্বরতা, জ্ঞান, সুরক্ষা ও আধ্যাত্মিকতার প্রতীক মানা হয় মেহেদিতে আঁকা নকশাকে। সংস্কৃতিভেদে বিভিন্ন ডিজাইন আলাদা অর্থ বহন করে। তাই নকশার ক্ষেত্রেও রয়েছে নানান বিধিনিষেধ। ভারতীয় উপমহাদেশের মেয়েরা ফুলেল নকশা, দীর্ঘ কারুকার্যময় সূক্ষ্ম নকশা পছন্দ করেন। বিয়েতে কন্যার বাহুর গোড়া থেকে আঙুলের নখ পর্যন্ত মেহেদির সজ্জা দেখা যায়। নব্বইয়ের দশকে এর সঙ্গে গ্লিটার ও স্টোনের ব্যবহারও লক্ষণীয় ছিল। আফ্রিকান নকশায় জ্যামিতিক আকার বেশি প্রাধান্য পায়। নানা আকৃতির রেখা, গোলাকৃতি নকশা মোটা দাগে করা হয়। হাত-পা ছাড়াও মুখমণ্ডলসহ শরীরের অন্যান্য স্থানে তারা ডিজাইন করে থাকেন।
বর্তমানে মেহেদিতে মিনিমাল নকশা ট্রেন্ডি। বাহুল্যে নয়, বরং সুগঠিত নকশার প্রতি আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। এর মধ্যে বোহিমিয়ান ধারা এগিয়ে আছে। মরুর তথা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে সহজ নকশার ব্যবহার বেশি দেখা যায়। আরবি ক্যালিগ্রাফির প্রভাবও রয়েছে মেহেদির নকশায়। অ্যাবস্ট্রাক্ট নকশার প্রতিফলনের সুস্পষ্টতা মেলে এ ধরনের নকশায়; মূলত আরবের বেদুইন জীবনযাপনের অনুপ্রেরণায়। হাতের তালুর পাশাপাশি ওপরের পাতায়ও বোহো স্টাইলে মেহেদির নকশা করতে দেখা যাচ্ছে এখন। জ্যামিতিক আকারগুলোর পাশাপাশি, বিভিন্ন স্থাপনা ও প্রাকৃতিক উপাদানের চিত্রও জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। প্রকৃতিপ্রাণিত যেমন, ফুলের মোটিফের অলংকরণ, চাঁদ, তারা, পাতার ব্যবহারই এখন বেশি। হাতের ওপরের অংশে আঙুল থেকে কবজি পর্যন্ত নেমে আসা অলংকরণেও আগ্রহী হচ্ছেন অনেকে। জ্যামিতিক সরলরেখার সঙ্গে পাতার লহরের সন্ধিও দেখা যাচ্ছে কখনো কখনো। আবার পুরো হাত না ভরে একটুখানি ছোট্ট মোটিফ তালুর দু-এক জায়গায় করে নিচ্ছেন কেউ কেউ।
শিল্পায়নের প্রসার শুরুর আগপর্যন্ত মেহেদি পাতা বেটে তা হাত-পায়ের নখ, হাতের তালুতে লাগানো হতো। টিউব মেহেদির সহজলভ্যতায় যেন নতুন করে প্রাণ ফিরে পেয়েছে পুরোনো এ ট্রেন্ড। যদিও বেশির ভাগই ক্ষতিকর কেমিক্যালযুক্ত, তবু বেশ কিছু অর্গানিক বা প্রাকৃতিক মেহেদিও বাজারে টিউব আকারে পাওয়া যাচ্ছে এখন। উৎসবে, আয়োজনে এগুলো যেমন নিরাপদ, তেমনি দীর্ঘস্থায়ী রঙেরও নিশ্চয়তা দেয়।

 নাইমা তাসনিম
মডেল: জেনি
মেকওভার: পারসোনা
ওয়্যারড্রোব: জে কে ফরেন ব্র্যান্ডস
ছবি: কৌশিক ইকবাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top