skip to Main Content

স্বাদশেকড় I চিকেন টিক্কা মাসালা

এর উৎস ইতিহাস নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। তাই বলে থেমে নেই ভোজনরসিকদের আকর্ষণ

অনেকের হয়তো জানা নেই, পাঞ্জাবি ভাষায় ‘টিক্কা’ শব্দের অর্থ মাংসের ছোট টুকরো, আর ‘মাসালা’ মানে মিশ্রণ। মুরগির মাংসের ছোট টুকরোগুলো ঐতিহ্যগতভাবে মেরিনেট ও বেক করে তৈরি করা হয় সুস্বাদু চিকেন টিক্কা মাসালা। ভারতীয় উপমহাদেশে তুমুল জনপ্রিয় এক খাবার। এর উৎস ঘিরে রয়েছে বিভিন্ন তত্ত্ব ও তথ্য। একটি মত বিবেচনা করলে, এটি উপমহাদেশের ঐতিহাসিক খাবার হিসেবেও বিবেচিত। এই মতানুসারে, এটি আনুমানিক পাঁচ হাজার বছর আগে থেকেই ভারতীয় উপমহাদেশের খাদ্যসংস্কৃতির অংশ। মূলত মুরগির মাংসের বড় টুকরো দিয়ে রান্নার চল। শুরুর দিকে রান্না করা হতো তন্দুরে।
প্রচলিত আরেকটি মতবাদ হলো, হাজার বছর আগে নয়, বরং মঙ্গোলীয় সাম্রাজ্যে (১৩ ও ১৪ শতকে) এর স্বাদ প্রথম পেয়েছিলেন ভোজনরসিকেরা। কথিত আছে, মোগল শাসক বাবর (শাসনামল ১৫০৪-১৫২৬) হাড়যুক্ত খাবার খেতে পছন্দ করতেন না। তিনি তার শেফকে হাড়বিহীন চিকেন ছোট ছোট টুকরো করে রান্না করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। উপমহাদেশে চিকেন টিক্কা মাসালার আবির্ভাবে সেই নির্দেশনা ভূমিকা রেখেছে। এরপর থেকে যথারীতি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিবিধ বিবর্তনের ভেতর দিয়ে গেছে খাবারটি।
অবশ্য, উল্লেখ করা দুটি মতবাদের পক্ষে তেমন কোনো প্রামাণিক দলিল বা অকাট্য প্রমাণ মেলে না। এমনকি বেশির ভাগ ভারতীয় রান্নার বইয়ে এই দুই কথিত ইতিহাসকে স্বীকার করা হয়নি। লিজি কলিংহাম তার ‘কারি: আ টেল অব কুকস অ্যান্ড কনকিউররস’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন, খাদ্য সমালোচকদের মতে, চিকেন টিক্কা মাসালা মোটেই ‘ব্রিটিশ বহু সংস্কৃতিবাদের উজ্জ্বলতম উদাহরণ ছিল না; তবে এটি বেশির ভাগ বিদেশি খাবারের জনপ্রিয়তা ও চাহিদা কমিয়ে দিয়ে দুর্দান্ত দাপটে ব্রিটিশদের হেঁসেলে টিকে থাকে।’ অন্যদিকে, ‘মাল্টিকালচারাল হ্যান্ডবুক অব ফুড, নিউট্রিশন অ্যান্ড ডায়েটিকস’ অনুসারে, অনেক বাংলাদেশি শেফ গত শতকের ষাটের দশকে যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমান এবং ব্রিটিশ ভোজনরসিকদের খুশি করার জন্য চিকেন টিক্কা মসলাসহ তাদের নিজস্ব রেসিপি তৈরি করেন। আধুনিক খাদ্য ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, পাঁচ হাজার বছর কিংবা মঙ্গোলীয় সাম্রাজ্যকালে নয়, আলোচ্য খাবারটির আবির্ভাব মাত্র কয়েক দশক আগে। এর উদ্ভাবক গ্লাসগোর শীশ মহল রেস্তোরাঁর প্রশাসক ব্রিটিশ-বাংলাদেশি শেফ আলী আহমেদ আসলাম।
এবার আসা যাক আলী আহমেদের উদ্ভাবন গল্পে। ২০১৩ সালে বিবিসির রান্নাবিষয়ক টিভি সিরিজ ‘দ্য হেয়ারি বাইকার্স’-এ তার ছেলে আসিফ আলী জানান, ১৯৭১ সালের একদিন শীশ মহল রেস্তোরাঁয় চিকেন টিক্কা অর্ডার করেছিলেন জনৈক বাসচালক। সেই মতে, তার সামনে পরিবেশন করা হয়েছিল গ্রিল করা মসলাদার মুরগির মাংসের প্লেট। কিন্তু সেটির স্বাদ তার মনে ধরেনি। চিৎকার করে বলেছিলেন, ‘গ্রেভি কোথায়?’ শেফ আলী আহমেদের মাথায় তখন এক দারুণ আইডিয়া খেলে যায়। টমেটো স্যুপের একটি ক্যান বের করে মসলা ও দই যোগ করে এটিকে চিকেন টিক্কা মাসালা বলে চালিয়ে দেন! আর কাস্টমারের কাছ থেকে পান দারুণ সাড়া। পরে দই, টমেটো, ক্রিম ও মসলা দিয়ে একটি অভিনব সস তৈরি করেন ওই শেফ। সেটিই জন্ম দেয় চিকেন টিক্কা মাসালার। মুরগির মাংস, ক্রিমি সস ও নরম মসলার মিশ্রণে তৈরি খাবারটি ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা পেয়ে একটি ফেভারিট ব্রিটিশ ডিশে পরিণত হয়।
চিকেন টিক্কা মাসালায় দই, টমেটো স্যুপ যোগ করে দেওয়া হয় ভিন্ন রূপ। ব্রিটিশ ভোজনরসিকদের সাধ মেটাতে স্বাদ অনুযায়ী এই খাবারে যোগ করা হয় সস। দই ও বিভিন্ন উপাদানে মেরিনেট করা মুরগির মাংসের টুকরোগুলো বিভিন্ন সসের সঙ্গে ব্যবহার করা হয়। সসে সাধারণত পিউরি, নারকেল ক্রিম, ক্রিম ও মাসালার মিশ্রণ হিসেবে থাকে টমেটো। পরিবেশনের প্লেটটি কালারফুল করতে কোনো কোনো শেফ ব্যবহার করেন হলুদগুঁড়া। বলে রাখা ভালো, চিকেন টিক্কা মাসালার সঙ্গে বাটার চিকেনের কিছুটা মিল রয়েছে।
চিকেন টিক্কা মাসালার রয়েছে একটি রাজনৈতিক ইতিহাস। ২০০১ সালে এটি একটি রাজনৈতিক খাবারে পরিণত হয়। সে বছর ব্রিটিশমন্ত্রী রবিন কুক এটিকে ‘ট্রু ন্যাশনাল ব্রিটিশ ফুড’ হিসেবে ঘোষণা করেন। তার সেই ঘোষণাকে অনেকে মেনে নিয়েছিলেন; কেননা, এটি সত্যিকার অর্থেই যুক্তরাজ্যের অন্যতম জনপ্রিয় খাবার। তাতে প্রাণিত হয়ে ২০০৯ সালের জুলাইয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের প্রথম মুসলমান ও এশিয়ান সদস্য (১৯৯৭ সালে প্রথমবার নির্বাচিত) মোহাম্মদ সারওয়ার চিকেন টিক্কা মাসালাকে ব্রিটিশ ফুড হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিতে একটি বিশেষ প্রচারণায় গ্লাসগোর সমর্থন চেয়েছিলেন। খাবারটির ভৌগোলিক অবস্থান প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই ছিল সেই প্রচারণা। তবে সেটিকে দেশটির পার্লামেন্ট গুরুত্ব দেয়নি। ফলে এই খাবারের প্রকৃত উৎপত্তি কোথায়, সেই বিতর্কের অবসান ঘটেনি। তাতে অবশ্য জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েনি।
চিকেন টিক্কা মাসালায় সি-ফুড ও বিফের মতো একাধিক বিকল্প নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে অনেক রেস্তোরাঁ। আসল রেসিপি পরিবর্তন করে স্বাদের চাহিদা অনুসারে কিছু উপাদানের যোগ-বিয়োগ ঘটছে হরদম। এর মধ্যে সবজি যোগের ঘটনাও ঘটছে। বর্তমানে প্রায় সব বড় সুপারমার্কেটে রেডিমেড টিক্কা মাসালার সস পাওয়া যায়। প্যাকেটে লেখা থাকে উপাদানের ব্যবহারবিধিও। তাই চাইলে যে কেউ বাসায় বসে সহজে তৈরি করে নিতে পারেন এই সুস্বাদু খাবার। এ ছাড়া অনেক শেফ তাদের বই ও চ্যানেলের মাধ্যমে এটি রান্না করার জন্য বিভিন্ন সংস্করণের নির্দেশিকা দিয়ে থাকেন। সেখান থেকেও নেওয়া যায় পরামর্শ। বলে রাখি, এটি সুপারমার্কেট সেইন্সবারিতে একটি বেস্টসেলিং রেডিমেড ফুড, যেখানে প্রতিবছর ১ দশমিক ৬ মিলিয়ন চিকেন টিক্কা মাসালা বিক্রি হয়। এ ছাড়া পাস্তা সসসহ ১৬টি চিকেন টিক্কা মাসালাসংশ্লিষ্ট পণ্য স্টক রাখা হয়।
এমনিতে চিকেন টিক্কা রান্না করা খুব সহজ। শুরুতে মুরগির হাড়বিহীন মাংস মেরিনেট করে নেওয়া চাই, ৩০ মিনিট থেকে ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত। মসলার মিশ্রণ হিসেবে অনেকে গরমমসলা ও দই ব্যবহার করেন, যা চিকেনের সঙ্গে মিশে গিয়ে একে সুস্বাদু করে তোলে। মেরিনেটের সময় স্বাদ অনুসারে বিভিন্ন পাউডার ব্যবহার করা হয়। এ ক্ষেত্রে মরিচগুঁড়ার চল বেশি। কেউ কেউ অবশ্য টাটকা কাঁচা মরিচ ব্যবহার করেন, রং ও স্বাদে বৈচিত্র্য আনতে। ক্ষেত্রবিশেষে পেপরিকা আর লবঙ্গও ব্যবহার করা হয়।
এর পরিবেশনেও রয়েছে রকমফের। কেউ কেউ পরোটা, রুটি বা নানের সঙ্গে খেতে পছন্দ করেন। কেউবা গরম ভাতের সঙ্গে। কোনো কোনো কোম্পানি আবার রেডিমেড ফ্রোজেন টিক্কা মসলা বিক্রি করে।
ইতিহাস বা তর্ক-বিতর্ক যা-ই হোক, চিকেন টিক্কা কি শুধু ব্রিটেন আর ভারতীয় উপমহাদেশে জনপ্রিয়? মোটেই নয়। সারা দুনিয়ায় রয়েছে এর বিস্তার। আমাদের দেশেও এর দারুণ চল।

 ফুয়াদ রূহানী খান
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top