skip to Main Content

পাতে পরিমিতি I সবজিতে স্বাস্থ্যযোগ

শীতকাল মানেই টাটকা সবজির সমারোহ। আপাতদৃষ্টে স্বাস্থ্যকর হিসেবে বিবেচিত হলেও সবার জন্য কি সব সবজি উপকারী? রইল পুষ্টিবিদ নিশাত শারমিন নিশির দিকনির্দেশনা

কুয়াশার চাদরে ঢাকা শীতকাল আমাদের অনেকের খুব প্রিয় ঋতু। হিমশীতল এই ঋতুর আগমনীতে প্রকৃতিতে দেখা দেয় নানা পরিবর্তন। চারপাশের শুষ্কতা আর পাতা ঝরে যাওয়া ছাড়াও এ সময়ের থাকে কিছু বাড়তি আকর্ষণ। শীত শুধু আরাম বা উপভোগের জন্যই নয়, পুষ্টিগত দিক বিবেচনায়ও এ ঋতুতে পাওয়া যায় নানা রকম সবজি ও শাক। এ সময়ে মাইক্রো নিউট্রিয়েন্টের যেন অভাব নেই চারপাশে। শীতে হাঁচি-কাশির সমস্যা, ইনফ্লুয়েঞ্জা, নিউমোনিয়াসহ বিভিন্ন ধরনের ফ্লুজনিত রোগবালাই বেশি হতে দেখা যায়। তাই সুস্থ থাকতে চাই উন্নত পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ খাবার। সারা বছর আমাদের দেশে পাওয়া যায় না, এমন অনেক খাবার এই ঋতুতে হাতের নাগালেই মেলে। শীতের সবজি দিয়ে তৈরি করা যায় মজার মজার রেসিপি। অবশ্য শীতকালীন সব সবজির পুষ্টিগুণ এক রকম নয়; রয়েছে তারতম্য। স্বাস্থ্যকর সবজিগুলোর মধ্যে রয়েছে—
 ফুলকপি: ফুল নয়, সবজি হিসেবে বেশ সমাদৃত এটি। ফোলেট, ভিটামিন বি সিক্স, ভিটামিন সি-এর দারুণ উৎস। এতে আরও রয়েছে ভিটামিন কে। এক কাপ ফুলকপি থেকে প্রায় ২৭ কিলোক্যালরি পাওয়া যায়। তা ছাড়া এতে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার থাকায় কনস্টিপেশনের পাশাপাশি কোলন ক্যানসারের ঝুঁকি কমাতে বেশ উপকারী।
 ব্রকলি: শীতকালে এই সবজির দেখা মেলে প্রচুর। ভিটামিনের দারুণ উৎস হওয়ায়, ইদানীং এর চাহিদাও বেড়েছে খুব। ফুলকপির মতো ব্রকলিতেও রয়েছে ভিটামিন সি, ভিটামিন এ, ভিটামিন কে, আয়রন, ক্যালসিয়াম প্রভৃতি পুষ্টিগুণ। যারা অল্পতেই বেশ হাঁপিয়ে ওঠেন, শারীরিক দুর্বলতা অনুভব করেন—তাদের ডায়েটে থাকতে পারে ব্রকলির নানা রকম রেসিপি; তাতে উপকার মিলবে।
অনেকে ঋতুভিত্তিক বিভিন্ন ধরনের ডায়েট ফলো করে থাকেন; সে ক্ষেত্রে ওজন কমানোর জন্য যারা বেশ মরিয়া, তারা খেতে পারেন টমেটো। আজকাল সারা বছরই এই সবজি পাওয়া যায় বাজারে; তবে শীতের সিজনাল সবজি হিসেবে পাকা লাল টমেটোর পুষ্টিগুণ বেশ উন্নত। তাই তৈরি করে নিতে পারেই এই ডায়েট—
 টমেটো স্যুপ: লাইকোপেনে ভরপুর পাকা টসটসে লাল রঙের টমেটোগুলো এই শীতে হতে পারে আপনার বেস্ট চয়েস। এতে রয়েছে অ্যান্টি-ক্যানসারাস অ্যাজেন্ট। তা ছাড়া প্রচুর পরিমাণ অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট থাকায় রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বৃদ্ধিতে টমেটো কার্যকর ভূমিকা পালন করে। ওজন কমানোর জন্য এই শীতে হেলদি টমেটো স্যুপ হতে পারে আপনার ডিনার বা লাঞ্চের হেলদি অল্টার।
বলা হয়ে থাকে, সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে ত্বকের যত্ন নেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। আর সে ক্ষেত্রে যদি ভেতর থেকে নিজেকে পরিপুষ্ট রাখা যায়, তাহলে সৌন্দর্য ফুটে উঠবে দারুণভাবে। শীতে অনেকের ত্বক রুক্ষ বা খসখসে হওয়ার প্রবণতা থাকে। সে ক্ষেত্রে ত্বকের বাড়তি যত্ন নেওয়া প্রয়োজন। যদি কালারফুল সবজিগুলো ডায়েটে আনা যায়, তাহলে সহজেই নারিশড স্কিন পাওয়া সম্ভব। খেতে পারেন হালকা কমলা রঙের গাজর। যারা চোখ ও ত্বক নিয়ে নানা সমস্যায় ভুগছেন, তাদের মনে রাখা চাই, বিটা ক্যারোটিন সমৃদ্ধ এই সবজি হতে পারে আপনার বেস্ট রেমেডি। প্রতিদিন খাদ্যতালিকায় তাই গাজর রাখুন। এটি চোখ ও ত্বক ভালো রাখার পাশাপাশি রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়াতেও সাহায্য করে। এতে থাকা ভিটামিন সি ও অ্যান্টি-অক্সিডেন্টগুলো ক্যানসার প্রতিরোধে বেশ কার্যকর।
শীতে ওয়াটার রিকয়ারমেন্ট কম থাকায় অনেকের পানি পানের প্রবণতা বেশ কম থাকে। এ ক্ষেত্রে খেতে পারেন গাজরের জুস। তা ছাড়া বিকেলের হালকা স্ন্যাকস হিসেবে কালারফুল গাজর দিয়ে তৈরি করে নিতে পারেন গরম-গরম স্যুপ। ডিনার হিসেবে হালকা তেলে সেদ্ধ করে সটেড ভেজিটেবলসের সঙ্গে গাজর রাখতে পারেন সপ্তাহে প্রতিদিনই।
শীতকালে শুধু যে লাল বা কমলা রঙের সবজি পাওয়া যায়, তা নয়। এ সময় কিছু হালকা সবুজ সবজিও বাজারে উপস্থিত থাকে। পুষ্টিগত দিক বিবেচনায় এগুলো বেশ কাজের। এমনই এক সবজি—কাঁচা টমেটো। লাল রঙের টমেটোগুলো যেভাবে নজর কাড়ে, সেই তুলনায় কাঁচা টমেটো কিছুটা কম প্রাধান্য পেলেও, দুই ধরনের টমেটোতেই লাইকোপেন রয়েছে প্রচুর। এতে বেশ ভালো পরিমাণে মিনারেলস ও ভিটামিন কে পাওয়া যায়। বাতের রোগ কমাতে এবং বোন ডেনসিটি রক্ষায় কাঁচা টমেটো রাখতে পারেন খাদ্যতালিকায়। দুপুরের পাতে ছোট মাছের সঙ্গে কাঁচা টমেটো দিয়ে রান্না করা সবজি গরম ভাতের সঙ্গে যেন অমৃত! তবে অতিরিক্ত পরিমাণে কাঁচা টমেটো খাওয়া মোটেই ভালো নয়। কেননা, তাতে হজমে অসুবিধা হতে পারে।
শীতে সহজলভ্য আরেকটি সবজি অবশ্য কটু গন্ধের কারণে অনেকের অপ্রিয়। অথচ পুষ্টিগুণ বিবেচনায় এর অবস্থান মোটেই নিচে নয়। বলছি মুলার কথা। এটি লাল বা সাদা রঙের পাওয়া যায়। মুলায় ফোলেট, পটাশিয়াম, ফাইবার ও ভিটামিন কে-এর পাশাপাশি আরও রয়েছে অ্যান্টি-ক্যানসারাস উপাদান—গ্লুকোসিনোলেট। মুলা স্যালাদ হিসেবে কাঁচা খাওয়া যায়। তা ছাড়া ছোট মাছ, চিংড়ি যোগে রান্নায়ও বেশ স্বাদ মেলে। তাই অপছন্দ সত্ত্বেও, পুষ্টিগুণ বিবেচনায় সপ্তাহে অন্তত এক দিন হলেও মুলার একটি আইটেম থাকুক আপনার পাতে।
মনে রাখা চাই, শীতকালে যেসব সবজি পাওয়া যায়, অধিকাংশই ভিটামিন সি সমৃদ্ধ। তাই এই সবজিগুলোকে অতিরিক্ত তাপ দিয়ে এগুলোর অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট নষ্ট না করে বরং হালকা বা ভাঁপে সেদ্ধ করে খাওয়া উত্তম। এ ছাড়া যে ভিটামিনগুলো ফ্যাট সলিবল, বিশেষত ভিটামিন এ সমৃদ্ধ, সেগুলো অবশ্যই শুধু সেদ্ধ করে অথবা কাঁচা স্যালাদ হিসেবে না খেয়ে, হালকা তেলে সটে করে কিংবা অল্প তেলসমৃদ্ধ স্যুপ বানিয়ে খাওয়া গেলে এগুলোতে থাকা সম্পূর্ণ ভিটামিন শরীরে অ্যাবসার্ব করার সুযোগ থাকে।
আমাদের দেশে এখনো শীতকাল মানে পিঠাপুলির উৎসব। যাদের নানা রোগবালাই থাকে, এই শীতে এ ধরনের খাবার খাওয়ার ফলে অনেক সময় তাদের সমস্যা আরও বেড়ে যায়। তাই যাদের এমনিতেই শীতের পিঠা খাওয়ার ঝোঁক বেশি, তারা ভোগেন মনঃকষ্টে। ওজন বেশি বা ওবেসিটির সমস্যা কিংবা ডায়াবেটিস থাকলে তো কথাই নেই! এসব রোগী ডায়েট মেইনটেইন করতে গিয়ে আনন্দ হারিয়ে ফেলেন; এমনকি সঠিকভাবে ডায়েট সম্পন্ন করতে পারেন না অনেক সময়। তাদের বলছি, চাইলে আপনারা সবজি দিয়ে তৈরি করে নিতে পারেন নানা রকম পিঠা। খেতে পারেন বাঁধাকপির ডাম্পলিং, ভেজিটেবলের পুর দিয়ে বানানো পাটিসাপটা, গুড়ের পরিবর্তে মিক্সড ভেজিটেবলের পুরে তৈরি ভাপা পিঠা ইত্যাদি। এগুলোর কোনোটাতেই এক্সট্রা অয়েল কিংবা সুগার না থাকায় এই শীতে গরম-গরম ভিন্ন স্বাদের পিঠা খেতে পারেন নির্ভয়ে!
তবে খেয়াল রাখা চাই, সুস্থ থাকার জন্য কোনো কিছুই প্রয়োজনের অতিরিক্ত গ্রহণ করা চলবে না। আজকাল অনেকেই থাইরয়েড, হাইপার ইউরেসেমিয়া কিংবা কিডনি সমস্যায় ভোগেন। এসব গোইট্রোজেনিক ভেজিটেবল গ্রহণের ক্ষেত্রে তাদের জন্য রয়েছে নিষেধাজ্ঞা। তাই এই শীতে শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় এই ধরনের দারুণ সবজিগুলো ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে কি না, অবশ্যই আপনার চিকিৎসক কিংবা কোনো পুষ্টিবিদের শরণাপন্ন হয়ে ডায়েটারি মডিফিকেশন করে নিতে ভুলবেন না।

লেখক: প্রধান পুষ্টিবিদ ও বিভাগীয় প্রধান, পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top