skip to Main Content

কভারস্টোরি I আলোর প্রতীক্ষায়

বাংলাদেশের বাজার পরিস্থিতির প্রেক্ষাপট বড়ই গোলমেলে। জটিলও। সুস্থির আর অস্থির পরিবেশ যে কোনটা, তা অনুধাবন করা আদতেই মুশকিল। ফলে প্রকৃত চিত্র তুলে ধরা কঠিন হয়ে পড়ে। দেশের রিটেইল ফ্যাশন মার্কেটও এর বাইরে নয়। এই ইন্ডাস্ট্রির বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে লিখেছেন শেখ সাইফুর রহমান

গেল বছরের ২৭ ও ২৮ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হয় আর্কা ফ্যাশন উইক। ২৮ অক্টোবর যখন ঢাকা নগরীর এক প্রান্ত রাজনৈতিক কারণে অস্থির, আরেক প্রান্তের একটি ভেন্যুতে তখন মহাসমারোহে অনুষ্ঠিত হচ্ছিল ফ্যাশনের নানা কর্মকাণ্ড। সেখানকার উপস্থিতিতে চোখ রেখে বোঝার উপায় ছিল না নগরী কতটা উত্তাল। হাল প্রজন্মের উচ্ছলতা দৃষ্টিগোচরে মনে হয়নি এসব নিয়ে তাদের তিলমাত্র মাথাব্যথা আছে। এর জন্য কার দায় কতটুকু, সে হিসাবে আমরা নাই-বা গেলাম। কিন্তু তাদের মূল স্রোতে সম্পৃক্ত করতে না পারার দায় তো আমাদের নিতেই হবে। এই প্রজন্মের মধ্যে দেশ নিয়ে ঔদাসীন্যের ছাপ কিন্তু ফ্যাশনের রিটেইল মার্কেটে বেশ প্রতীয়মান। সে প্রসঙ্গে পরে আলো ফেলা যাচ্ছে।
সময়ে-অসময়ে, প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে মানুষ শপিং করে। শপিং করতে চায়। এটা একটা বিনোদন। এই বিনোদন মানুষের মন ভালো রাখে। চাঙা করে। এ জন্যই অভিনেত্রী রিয়া সেন শপিংকে বলেছেন রিটেইল থেরাপি। অন্যদিকে শপিংকে কার্ডিও ব্যায়ামের সঙ্গে তুলনা করেছেন হলিউডি নায়িকা সারা জেসিকা পার্কার।
প্রিয় পাঠক, বুঝতেই পারছেন শপিং মানুষের জীবনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু নিজেকে বিনোদিত করার পূর্বশর্তই হচ্ছে সবল রেস্ত। কিন্তু একটা শ্রেণির এখানেই সমস্যা। টান পড়েছে সেই সামর্থ্য।ে এ জন্যই শপিং করার মতো বিলাসিতা সবাই দেখাতে পারছে না। অন্তত একশ্রেণির মানুষ তো বটেই। এই শ্রেণিটা বলাই বাহুল্য বাঙালি মধ্যবিত্ত। পূর্বালোচিত কারণেই তারা বেশ অনেক দিন ধরে আছে একটা টানাপোড়েনের মধ্যে। তাদের জন্য শপিং এখন বিলাসের সমার্থক। এই রেশ যে কেটে গেছে তা কিন্তু নয়; বরং উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে কিছুটা সতর্ক অবস্থায় আছে সবাই। ব্যস্ত এখন জীবন বাঁচাতে, সংসার সামলাতেই বেশি। পরিস্থিতিই আসলে বাধ্য করেছে খরচে লাগাম টানতে। সেই প্রভাব পড়েছে ফ্যাশনের রিটেইল মার্কেটে।
এবার একটু ফ্যাশন রিটেইলের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা যাক। অক্টোবরে ছিল পূজা। এই সময়ে ফ্যাশন হাউসগুলো আশানুরূপ ব্যবসা করেছে। পূজার পর শীত আসার আগপর্যন্ত বাজার থাকে তুলনায় মন্দা। তারপর তাপমাত্রার পারদ নামার সঙ্গে বাজার উঠতে শুরু করে। কিন্তু গেল মাসের শুরুতে, শীতের সূচনালগ্নে ঘূর্ণিঝড় মিগজাউমও তাপমাত্রা সেই অর্থে কমাতে পারেনি। তাই বর্তমানে মিশ্র বাজার পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
ফ্যাশন রিটেইলারদের সঙ্গে কথা বলে সঠিক চিত্র মেলেনি। কারও ক্ষেত্রে নেতিবাচক তো কারও ক্ষেত্রে ইতিবাচক। তবে বেশির ভাগই একমত হয়েছেন একটা বিষয়ে; সেটা হলো রাজনৈতিক কর্মসূচি শুরুর পর কিছুদিন বাজার ছিল মন্দা। মানুষ কিছুটা সতর্ক থাকার চেষ্টা করেছে। তবে ধীরে ধীরে পরিস্থিতি গা সওয়া হয়ে উঠলে বলা যায়, ভোক্তারা খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসেছেন। তখন আবার তারা বাজারমুখী হয়েছেন। এর ইতিবাচক ফল দেখা গেছে বিজয় দিবসের কেনাকাটায়। কোনো কোনো ব্র্যান্ড তাদের বিক্রি নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে।
বাংলাদেশের মানুষের আর্থিক স্বচ্ছন্দের শ্রেণিবিন্যাস আগের মতো নেই। আগে যেমন তিনটা শ্রেণি ছিল, এখন বাস্তবতা সেটা নয়; বরং নানা ভাগে ভাগ হয়েছে। এই শ্রেণিবিভেদ প্রতীয়মান হয় কেনাকাটায়। এসব যেমন আমরা সুপারশপে গেলে টের পাই, স্পষ্ট হয় মলে ঢুকলেও। কারও শপিং যেমন বল্গাহীন, তেমনি কারও আবার স্রেফ প্রয়োজন।
যাহোক, এই সময়টায় কেবল শীত নয়, নানা উৎসব, অনুষ্ঠান আর বিয়েও লেগে থাকে। এসব অনুষ্ঠানের জন্যও অনেকে পোশাক-আশাক কিনে থাকেন। সেটা যেমন অনুষ্ঠানে পরার জন্য, তেমনি আবার উপহার দেওয়ার জন্যও। বাংলাদেশের রিটেইল ফ্যাশনে এথনিক ব্র্যান্ডগুলো এই সময়ে উৎসব পোশাকের বেশ ভালো একটা সংগ্রহ করে থাকে। বর্তমান পরিস্থিতিতে তারা আছে ব্যাকফুটে। এ ছাড়া এদের প্রত্যেকেই শীতসংগ্রহ তৈরি করে তাদের মতো করে। যেখানে ট্র্যাডিশনাল শীতপোশাকই থাকে সিংহভাগ। শীত জমে না ওঠায় তাদের বাজারটাও জমেনি এখনো। এই পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে বেশ বড় ধরনের ক্ষতির মুখে এসব ব্র্যান্ডকে পড়তে হবে। তবে আবার দেরিতে শীত পড়লে এবং জানুয়ারি মাসেও সেটা অব্যাহত থাকলে হয়তো তারা ক্ষতি অনেকাংশে পুষিয়ে নিতে সক্ষম হবে। অন্তত এই আশায় অনেকে এখন বুক বাঁধছেন।
তবে এথনিক ব্র্যান্ডগুলোর সবারই যে বিক্রি খারাপ, সেটা আবার বলা যাবে না। এদের অনেকে বলেছে, একেবারে মন্দ নয়। তবে এথনিক ব্র্যান্ডগুলোর সঙ্গে যুক্ত থাকেন অনেক কারুশিল্পী। ফলে ব্র্যান্ডগুলোর অবস্থা আশাব্যঞ্জক না হলে কারুশিল্পীদের অবস্থা ভালো থাকে না। তাদের টাকা পেতে যেমন সমস্যা হয়, তেমনি কাজ পেতেও। অথচ এসব প্রান্তিক মানুষকে সংসার চালাতে হয়। ফলে তারা বেশ বিপাকে পড়েন। এখন সেই অবস্থা হয়েছে। এর পাশাপাশি আছেন অনেক ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা। তারাও বিভিন্ন ফ্যাশন ব্র্যান্ডের জন্য কাজ করেন। চলমান পরিস্থিতিতে তাদের অবস্থাও তথৈবচ। এদের সবারই অপেক্ষা ভালোয় ভালোয় নির্বাচনকাল উতরে যাওয়া। তাহলে তারা হয়তো সুদিনের মুখ দেখতে পাবেন। কারণ, এ বছরের মার্চে শুরু হবে রোজা এবং এপ্রিলে ঈদ। এখন ব্র্যান্ডগুলোর প্রস্তুতি তুঙ্গে থাকার কথা থাকলেও কিছুটা হতাশায় আছেন তারাও। কী হবে, সেটা নিয়ে তারা বেশ সন্দিহান। যদিও ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলোর সবচেয়ে বেশি রাজস্ব আসে ঈদে। এমনিতেই বৈশাখের যে একটা উল্লেখযোগ্য বিক্রি ছিল, সেটা রোজা ও ঈদের কারণে কয়েক বছর ধরে কমেছে। এবারও সেটা হবে। এবং আগামী আরও অন্তত দুই বছর এই ধারা চলমান থাকবে। সে ক্ষেত্রে রাজস্ব আয়ের সম্ভাবনা কমবে, বলাই বাহুল্য। এ ক্ষেত্রে ফাল্গুন ও ভ্যালেন্টাইন একটা বিকল্প যেমন হয়েছে, তেমনি শীত রাজস্ব আয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপলক্ষ হয়ে উঠেছে করোনা অতিমারির আগে থেকেই। যদিও করোনা-পরবর্তী সময়ে গত বছর পরিস্থিতি অনেকটাই ইতিবাচক ছিল। কিন্তু বেশির ভাগ এথনিক হাউসের জন্য এ বছরটা সেই অর্থে আশাজাগানিয়া নয়।
অন্যদিকে, ওয়েস্টার্ন বা ফিউশন ব্র্যান্ডগুলোর সঙ্গে কথা বলে একেবারেই বিপ্রতীপ চিত্র পাওয়া গেল। তাদের সবারই অভিন্ন অভিমত। রাজনৈতিক অস্থিরতার শুরুর দিকে মানুষ একটু সতর্ক থাকলেও এখন সবকিছু স্বাভাবিক। ফলে শীতপোশাক কেনায় মানুষের আগ্রহ লক্ষ করা যাচ্ছে। যদিও কোনো সহিংসতা ঘটলে সেদিনের বিক্রিতে এর একটা প্রভাব পড়ে। ক্রেতারা সেদিন আর তেমন শপিংয়ে আগ্রহ দেখান না। এটা অবশ্যই নিরাপত্তা ও সুরক্ষার কথা বিবেচনায় রেখে।
কোনো কোনো ব্র্যান্ড জানিয়েছে, তাদের বিক্রি গতবারের মতোই। কারওবা গতবারের চেয়েও ভালো। শীর্ষ সারির কয়েকটি ব্র্যান্ডের তো শীতসংগ্রহের শুরুর দিককার পোশাক এরই মধ্যে শেষ হয়ে গেছে। অফলাইনের পাশাপাশি এসব ব্র্যান্ডের পণ্য অনলাইনেও বিক্রি হচ্ছে। অন্যদিকে এফ কমার্সভিত্তিক ব্র্যান্ড এবং ছোট ছোট ব্র্যান্ডের বিক্রিতে ঘটমান বর্তমানের প্রভাব সবার ক্ষেত্রে সমান নয়। কারণ, প্রত্যেকেরই নিজস্ব ক্লায়েন্টেল আছে। ফলে তাদের কথা মাথায় রেখেই এরা সংগ্রহ সাজায়। বাজার পরিস্থিতি হয়তো কারও কারও জন্য সমস্যা তৈরি করেছে। তবে সেটা সবার জন্য নয়।
কেন এই বৈপরীত্য, তা একটু দেখা যেতে পারে। বাংলাদেশের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি গড়ে উঠছিল দেশের মধ্য ও উচ্চ মধ্যবিত্তের পছন্দ, রুচি ও ক্রয়সামর্থ্য বিবেচনায় রেখে। সময়ের ধারায় এরই সমান্তরালে আন্তর্জাতিক ফ্যাশন ট্রেন্ডকে গুরুত্ব দিয়ে, তরুণদের রুচি ও পছন্দ আমলে নিয়ে নতুন ধারার ফ্যাশন হাউস প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এরা উদ্ভিন্ন ভোক্তাদের মতো করে ফ্যাশন প্রোডাক্ট বাজারে আনছে। এর একটা বড় অংশই বলতে হবে মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে। ফলে বর্তমান পরিস্থিতিতে মধ্যবিত্ত ভোক্তারা জীবন বাঁচানোর লড়াইয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় জীবন সাজানোর বিষয়কে গুরুত্ব দিতে পারছেন না। যার জন্য এথনিক হাউসগুলোর সমস্যা এ ক্ষেত্রে বেশি, ওয়েস্টার্ন ও ফিউশন হাউসগুলোর তুলনায়। পক্ষান্তরে আর্থিক সামর্থ্যের নিরিখে আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে অনেকগুলো ভাগের কথা আগেই বলেছি। এই বিভেদ কেবল রাজধানীতেই নয়, মফস্বল শহরেও লক্ষ করেছি। সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা থেকেই সেটা বলতে পারি। অতএব একশ্রেণির মানুষের পক্ষে শপিং যখন বিলাসিতা, অন্যদের জন্য সেটাই তখন বিনোদন। এটা যুগে যুগে, দেশে দেশে হয়ে আসছে। বাংলাদেশে এই পরিস্থিতি এতটা প্রকট ছিল না, যতটা হয়েছে সম্প্রতি।
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য গেল বছর অধিকাংশ ব্র্যান্ড কোরবানির ঈদের পর থেকে একটা লম্বা সময় ধরে ছাড় দিয়েছে। কিছুদিন বিরতি দিয়ে অনেক ব্র্যান্ড আবারও একই পথে হেঁটেছে। এখনো লক্ষ করলে দেখা যাবে, অনেক ব্র্যান্ডে ছাড় চলছে। কেবল হয়তো হাতে গোনা কয়েকটি ব্র্যান্ড এই পথ অনুসরণ করেনি। এ জন্য তাদের ব্যবসা খারাপ হয়েছে, তা অন্তত বলা যাবে না। বরং এর মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে তাদের ভোক্তাদের আত্মবিশ্বাস আর ব্র্যান্ডের প্রতি আনুগত্য। কোনো সন্দেহ নেই, এযাত্রায় তারা বেশ একটা কঠিন পরীক্ষা উতরে গেছে।
দীর্ঘ মেয়াদে ছাড়ের পক্ষে নন বিশেষজ্ঞরা। তারা মনে করেন, এতে করে ভোক্তাদের প্রত্যাশা বাড়িয়ে দেওয়া হয়। একটা অসুস্থ মনোভাবের জন্ম হয়। বাজার হয়ে পড়ে অস্থির। পরবর্তীকালে ছাড়া ছাড়া স্বাভাবিক সময়ে ভোক্তারা কিনতে আগ্রহী হন না। তারা অপেক্ষায় থাকেন পরবর্তী ছাড়ের। অন্যদিকে উদ্যোক্তাদের অভিমত হলো, বাজার মন্দা থাকার কারণে তারল্যসংকট ঠেকাতে এই পদ্ধতি অবলম্বন করতে তারা বাধ্য হয়েছেন, এই প্রক্রিয়া দীর্ঘ মেয়াদে সুফলদায়ক নয় জেনেও। কারণ, দৈনন্দিন খরচ জোগানোও একটা চ্যালেঞ্জ।
ক্রেতাদের আর্থিক সামর্থ্য, মনোভাব, ব্র্যান্ডগুলোর বৈশিষ্ট্য যেমন ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিকে প্রভাবিত করছে; তেমন আরও কিছু বিষয়ও আছে এই ইন্ডাস্ট্রির টার্নওভারকে প্রভাবিত করার জন্য। আমাদের দেশের সিংহভাগ জনসংখ্যাই এখন তরুণ। এরাই মূলত আমাদের ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলোর প্রকৃত ভোক্তা। যেকোনো পরিবারের কেনাকাটায় এরাই সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। এই মিলেনিয়াল, জেনজি, জেন আলাফারাই হালের নিয়ামক। ইন্ডাস্ট্রিতে তাদের কথা ভেবে যারা প্রোডাক্ট প্ল্যান করছে, তারাই সাফল্য পাচ্ছে।
এখানে একটা বিষয় বলা ভালো, এখনকার এই তরুণেরা সত্তর, আশি বা নব্বইয়ের দশকের মতো অভিভাবকনির্ভর নয়; বরং তারা অনেক বেশি স্বাবলম্বী। ছোটরাও কিছু না কিছু করে পড়াশোনার পাশাপাশি। ফলে তাদের হাতে টাকা থাকে। এ জন্য মাঝেমধ্যে তারা টুকটাক কেনাকাটা করে থাকে। এর সঙ্গে আবার রাজনৈতিক অস্থিরতা কিংবা নির্বাচনের ডামাডোলকে মেলালে চলবে না। এই ক্রেতাদের সংখ্যাও খুব এটা কম নয়। এরা সবাই যে কেবল ব্র্যান্ড থেকে কেনে, তেমন নয়। বরং বন্ধু বা সিনিয়র ভাইয়া-আপুদের উদ্যোগেও শামিল হয়; আবার গার্মেন্ট লেফটওভার থেকেও তারা খুঁজে নেয় পছন্দের পণ্য। আরও আছে থ্রিফট বা প্রি-লাভড পোশাক। সেটাও এদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়। এদেরই একটা উল্লেখযোগ্য অংশ ভারতীয় লেহেঙ্গা আর পাকিস্তানি লন নিয়ে মাথা ঘামায় না; বরং এরা শাড়ি, পাঞ্জাবিও কেনে।
থ্রিফট নিয়ে একটু পরে আলো ফেলা যাচ্ছে; বরং তার আগে বলে নেওয়া যাক এই যে প্রজন্ম, এরা একেবারেই আন্তর্জাতিক। ভুবনগ্রামের বাসিন্দা। তারা জানে, এই সময়ের ইউরোপ বা আমেরিকার স্ট্রিট ফ্যাশনের ট্রেন্ড কী, বা হাইস্ট্রিটে কী চলছে। তার মধ্যে কোনটা এখানে সুলভ। খুঁজে পেতে সেটা কেনার চেষ্টা করে। কখনো অরিজিনালটা পেয়ে যায়, কখনোবা কেনে কপি। যাদের ওয়ালেট আর পার্স পর্যন্ত তারা সরাসরি আনিয়ে নেয়। কিংবা কেউ এলে তাদের অনুরোধ করে। এভাবেই চলছে। তরুণদের মধ্যেও আছে নানা সেগমেন্ট। কেনাকাটার ক্ষেত্রেও সেটা স্পষ্ট। এই তরুণেরা যে কেবল ঢাকায় সীমাবদ্ধ, তা কিন্তু নয়; বরং ঢাকার বাইরের বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলোতে রয়েছে তাদের সরব উপস্থিতি।
ইন্ডাস্ট্রি ইনসাইডারদের অভিমত হলো, দেশের বেশির ভাগ এথনিক ব্র্যান্ডগুলোর ডিজাইন নিতান্তই একঘেয়ে। কাপড়ের ক্ষেত্রেও খুব একটা বৈচিত্র্য দেখা যায় না। পৃথিবী এগিয়েছে অনেক। অথচ এরা সে পথে হাঁটতে চায় না। চলে গতানুগতিক পথে। ফলে নতুন প্রজন্মের সঙ্গে তারা অনেক বেশি দূরত্ব তৈরি করে ফেলেছে। এই দূরত্ব ঘোচানোর চেষ্টাও তাদের জন্য দৃশ্যমান নয়। এটাও এথনিক হাউসগুলোকে ব্যাকফুটে ঠেলে দিচ্ছে। অথচ এই তরুণেরাই কিন্তু এসব হাউসের সাফল্যের অনুঘটক ছিল একটা সময়ে। তখন তারা কেবল নির্ভর করত দেশের পত্রপত্রিকার ওপর। কিন্তু সময় বদলেছে। ইন্টারনেটের বদৌলতে তারা এখন নিমেষেই পেয়ে যায় সব খবর। নিজেদের রাখে আপডেটেড। কিন্তু তাদের সঙ্গে তাল মেলানোর চেষ্টায় ঘাটতি লক্ষ করা যায় হাউসগুলোর। এভাবে তারা ভোক্তা হারাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে উত্তরণের পথ না খোঁজার কারণে অনেক হাউস বন্ধ হয়ে গেছে। বেশ কিছু আছে সেই পথে।
এবার আসা যাক থ্রিফট বা প্রি-লাভড ফ্যাশন প্রসঙ্গে। বিশ্বজুড়ে এখন স্লো ফ্যাশন আন্দোলন পালে বাতাস পাচ্ছে। এ জন্য নতুন কাপড় কম কিনে পুরোনো কাপড়ের পুনর্ব্যবহারে জোর দিচ্ছে সবাই। আমাদের দেশেও রয়েছে এমন অনেক থ্রিফট ব্র্যান্ড। তারা পুরোনো নয়, বরং লেফটওভারকে ভ্যালু অ্যাড করে উপস্থাপন করছে। তরুণদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়ও হয়েছে।
আমাদের প্রজন্মের ভুলে যাওয়ার কথা নয় বঙ্গবাজার, নিক্সন মার্কেট, সিঙ্গাপুর মার্কেটের কথা। সেখানে বিদেশ থেকে আসা পুরোনো কাপড় কিনেছি আমরা। পুরোনো কাপড় বাইরে থেকে আসা ও বিক্রি অব্যাহত আছে এখনো। কিন্তু মধ্যবিত্ত আর উচ্চবিত্তরা সেটা কিনত না। এখন আবার সেই ট্রেন্ড শুরু হয়েছে। আমাদের ছেলেমেয়েরা জানে, কোথায় কোথায় এমন থ্রিফট বা প্রি-লাভড কাপড় পাওয়া যায়। অনেকে আবার বদলাবদলিও করে বন্ধু বা আত্মীয়দের সঙ্গে। ঢাকায় থ্রিফট বিক্রির জন্য মেলাও হয়। তরুণেরা সেখানে গিয়ে চমৎকার সব পোশাক কম দামে পেয়ে যায়। এখানে কেবল দেশিরা নন, ঢাকায় থাকা বিদেশিরাও অংশ নেন।
উপরন্তু, মানুষ এখন আর যক্ষের ধনের মতো সবকিছু আগলে রাখতে চায় না; বিশেষ করে তরুণেরা। ফলে তারা সারা বছর যা কেনে, তা ডিক্লাটার করে বছরের একটা সময়ে। সেখানেও মেলে চমৎকার সব পোশাক। ঢাকায় ডিক্লাটারিং ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এই জগৎটা আমাদের কাছে নতুন। কিন্তু আমাদের ছেলেমেয়েদের কাছে নয়। তারা নানাভাবেই নিজেদের সাজাতে পছন্দ করে।
হাতের পাঁচ আঙুল সমান যেমন নয়, তেমনি এদের সবাই যে একই রকম হবে, সেটা ভাবারও কারণ নেই। কেউ কেউ অমিতব্যয়ী হয়তো আছে, তবে বুঝদারের সংখ্যাটাও যথেষ্ট। এরা সত্যিই অনেক সচেতন। অনেক সমঝদার। আর বলার অপেক্ষা রাখে না ফ্যাশনেবলও। ফলে তারা ঠিকই খুঁজে নেয় তাদের কাঙ্ক্ষিত পোশাক ও অনুষঙ্গ নিজ নিজ সংগতি অনুযায়ী।
সব কথার শেষ কথা হলো, ফ্যাশনে এখন আর পুরোনো বলে কিছু নেই। সবই ইন ট্রেন্ড। ফলে ওয়্যারড্রোবে পুরোনো যা আছে, তার সঙ্গে নতুনকে মিলিয়ে ট্রেন্ড সেট করাই তো হ্যাপেনিং। সেটা করতে পারে আমাদের নবীন প্রজন্ম। তাই আমরাও ঢাকার রাস্তায় দেখি বৈচিত্র্য। এই চল আমাদের ইন্ডাস্ট্রির জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
সমাপনীতে পৌঁছে যেটা বলা প্রয়োজন, তা হলো সময়ের সঙ্গে থাকাটাই বড় কথা। যারা থাকতে চায় তাদের কথা ভেবে, তাদেরকে আমল দিয়েই পণ্য পরিকল্পনা করতে পারলে পরিস্থিতির সংকট উতরানো সম্ভব।
উদ্ভূত পরিস্থিতি স্থানীয় ফ্যাশন বাজারকে কিছুটা হলেও সংকটে ফেলেছে। তাই নির্বাচন-পরবর্তী সুস্থির সময়ে আবার সবকিছু স্বাভাবিক হবে, মধ্যবিত্ত মন খুলে শপিং করতে পারবে বলেই আমাদের বিশ্বাস। করোনার সময় দীর্ঘদিন আবদ্ধ থাকার পর মানুষ মুক্তির আনন্দে মেতে উঠেছিল শপিংয়ে; এই পরিস্থিতির নাম দেওয়া হয়েছিল রিভেঞ্জ শপিং বা প্রতিশোধের কেনাকাটা। কে বলতে পারে, এখানেও সেটা হবে না! তখন আবার এই ইন্ডাস্ট্রিতে ফিরবে প্রাণ। হয়ে উঠবে মুখর। আমরাও সেই সুদিনের প্রতীক্ষায়।

মডেল: তাসনিয়া ফারিণ
মেকওভার: পারসোনা
ওয়্যারড্রোব: সানায়া কুটর বাই সানায়া চৌধুরী
জুয়েলারি: আমিসে
ছবি: কৌশিক ইকবাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top