skip to Main Content

দেহযতন I পিরিয়ডে প্র্যাকটিস

যেকোনো সুস্থ, স্বাভাবিক ঋতুবতী নারীর জীবনে নির্দিষ্ট চক্রে ফিরে ফিরে আসে ঋতুস্রাবের দিনগুলো। আর তা স্বভাবতই দেহ-মনে এনে দেয় বিবিধ যন্ত্রণা! তাই বলে জীবন থেমে থাকে না। থামানো অনুচিত শরীরচর্চাও

একজন নারীর জন্য পিরিয়ড বা রজঃস্রাব সামলানো মোটেই সহজ নয়, বিশেষ করে যদি সঙ্গী হয় যন্ত্রণাদায়ক ক্র্যাম্প। অনেকে চান সময়টি বিছানায় একটি গরম পানির ব্যাগ নিয়ে, শুয়ে থেকে কোনোমতে কাটিয়ে দিতে। অবশ্য বিশেষজ্ঞ মত, শারীরিক কার্যকলাপ কম করলেও পিরিয়ড চলাকালে ব্যায়াম থামানো ঠিক নয়। তবে নিঃসন্দেহে তা বিশেষ ব্যায়াম হওয়া চাই। অবশ্য এ সময়কার ব্যায়াম নিয়ে রয়েছে হরেক কল্পকাহিনি। সে যা-ই হোক, ব্যায়াম যে এই চক্রের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন উপসর্গ উপশম করতে উপকারী, তা প্রমাণিত।
ইন্টারন্যাশনাল সার্টিফাইড ইয়োগা অ্যান্ড মেডিটেশন কোচ এবং নাতজেন ইয়োগার প্রতিষ্ঠাতা নাতাশা সানজিদা পিরিয়ডকালীন কিছু সাধারণ উপসর্গের কথা বলেছেন। যেগুলোর মধ্যে রয়েছে অ্যাবডোমিনাল ক্র্যাম্পস; পেটজনিত সমস্যা যেমন ডায়রিয়া, বমি বমি ভাব এবং বমি হওয়া, মাথাব্যথা, শরীরের বিভিন্ন অংশ ফুলে যাওয়া, মুড সুইং, বিরক্তি ভাব, ক্লান্তি ইত্যাদি। গবেষণায় জানা গেছে, নারীর শরীরে বিভিন্ন হরমোনের পরিবর্তনের কারণে এই উপসর্গগুলো দেখা দেয়। তবু সঠিক ব্যায়াম দেহ ও মনে ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে এবং এন্ডোরফিন (ফিল গুড হরমোন) উৎপাদন বাড়াতে সাহায্য করে। এর ফলে বিরক্তি, ব্যথা কমাতে পারে; সেই সঙ্গে মন-মেজাজে উন্নতি আসে।
ব্যায়ামের গুণ
নাতাশা বলেন, পিরিয়ডের সময় ব্যায়াম করা মানে এই নয়, এটি ব্যথা বাড়াবে; বরং একটি নিয়মিত ব্যায়াম করার মানসিক ও শারীরিক সুবিধাগুলো পিরিয়ড-সংক্রান্ত ব্যথা কমাতে বেশ উপকারী হতে পারে। এই বিশেষজ্ঞের মতে, ব্যায়াম করলে যেসব সুবিধা পাওয়া যায়, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে—
 প্রিমেন্সট্রুয়াল সিনড্রোম (পিএমএস) উপসর্গ কমানো: পিরিয়ড শুরু হওয়ার আগের দিনগুলোতে ক্লান্তি ও ব্যথা অনুভব করা খুবই সাধারণ উপসর্গ। নিয়মিত অ্যারোবিক ব্যায়াম চর্চা এই ব্যথা কমাতে কাজে দিতে পারে।
 এন্ডোরফিন নিঃসরণ: বিভিন্ন গবেষণার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, এন্ডোরফিন রিলিজ করতে ব্যায়াম বেশ সাহায্য করে। এই বিশেষ হরমোন শুধু মন-মেজাজ ভালো রাখতেই নয়, প্রাকৃতিকভাবে ব্যথানাশক হিসেবে কার্যকর।
 শক্তি অর্জন: গবেষণা বলছে, যেসব নারীর শরীরে মাসিক চক্রের প্রথম দুই সপ্তাহে ফিমেল হরমোন কম থাকে, তাদের এনার্জি বাড়তে পারে। আর তা এনে দিতে পারে ব্যায়াম।
 মেজাজের উন্নতি: পিরিয়ড চলুক বা না চলুক, ব্যায়াম সব সময় মেজাজ ভালো রাখতে কাজে দেয়।
 ব্যথার সঙ্গে লড়াই: নিয়ম মেনে হাঁটাচলার মতো হালকা ব্যায়ামও পিরিয়ডের বিরক্তিকর ব্যথার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সাহায্য করতে সক্ষম।
শরীরচর্চার সহজ পাঠ
নাতাশা বলেন, পিরিয়ডের প্রথম কয়েক দিন পেটে খিঁচুনি ও অতিরিক্ত রক্তপাতের কারণে ব্যায়াম করা চ্যালেঞ্জিং হতে পারে। তবে ভড়কে না গিয়ে, এই কঠিন দিনগুলোতে ব্যায়ামকে ত্রাণকর্তা ভাবতে পারা মঙ্গল! এ সময় নিজেকে সুস্থ ও উৎফুল্ল রাখার উপযোগী কয়েকটি সাধারণ ওয়ার্কআউটের মধ্যে রয়েছে—
 হাঁটা: খুব সাধারণভাবে হাঁটাচলা হলো পিরিয়ডকালের অন্যতম সেরা ব্যায়াম। এই হালকা অ্যারোবিক ব্যায়াম চক্র ফুসফুসকে সঠিকভাবে কাজ করতে সাহায্য করে। তাই প্রিয় স্নিকার্স লেইস-আপ করুন এবং দ্রুত হাঁটার জন্য রাস্তায় নেমে পড়ুন! এতে আপনার ক্যালরি বার্ন হবে; মেজাজও থাকবে ভালো। তা ছাড়া হাঁটা বরাবরই এন্ডোরফিনের নিঃসরণ বাড়ায়।
 দৌড়: পিরিয়ড-পরবর্তী দিনগুলোতে কিংবা যখন এর উপসর্গগুলো মৃদু হতে থাকে, তখন আপনি দৌড়াতে পারেন। ধীরগতিতে দৌড়ান। অস্বস্তি বোধ করলে মাঝেমধ্যে নিন সামান্য বিরতি। দৌড়ানো আপনার ব্যথা এবং বিরক্তিভাব তাৎক্ষণিকভাবে কমাতে কাজে দেবে। এ সময় নিজেকে হাইড্রেটেড রাখার বিষয়টি মনে রাখা চাই।
 যোগব্যায়াম: স্রেফ স্ট্রেচিং ও শ্বাস-প্রশ্বাসের এই ব্যায়াম খিটখিটে মেজাজে এনে দিতে পারে শিথিলতা। অনেক যোগব্যায়াম রক্তসঞ্চালন বাড়াতে কাজে দেবে। যোগব্যায়াম যে শরীরকে শিথিল করতে এবং পিরিয়ডের উপসর্গ যেমন ক্র্যাম্প ও ফোলা ভাব দূরীকরণে সাহায্য করে, তা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত ও পরীক্ষিত।
এ সময়ের উপযোগী এমন কিছু যোগব্যায়ামের ক্ষেত্রে নাতাশা সানজিদার হাজির করা তালিকার দিকে নজর দেওয়া যাক:
 বালাসন: শুরুতে ইয়োগা ম্যাটে ভারসাম্যের সঙ্গে টেবিলটপ ভঙ্গিতে বসুন, শ্বাস নিন ও ছাড়ুন এবং নিতম্বকে পায়ের ওপর আনুন। এবার পায়ের আঙুলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক স্পর্শ ঘটান; তবে হাঁটু আলাদা রাখা চাই। তারপর গভীরভাবে, ধীরে ধীরে শ্বাস নিন। চোখ বন্ধ করে শ্বাস অনুভব করুন। মেরুদণ্ড সোজা রেখে শরীর যতটা সমর্থন করে, ততটুকু প্রসার করুন। নিশ্বাস ছাড়ুন এবং ধীরে ধীরে নিতম্ব থেকে সামনের দিকে বাঁকুন। এ পর্যায়ে পেট আপনার হাঁটুর মধ্যে থাকা উচিত, যা একটি আরামদায়ক অবস্থান। বাহু সামনে অথবা পাশে রাখুন। শিথিল থাকুন। কাঁধ ও ঘাড়কে শিথিল হতে দিন। কপাল মাদুরের ওপর স্থাপন করুন। ব্যথা অনুভব করলে কপালের নিচে নরম কুশন অথবা ভাঁজ করা কম্বল রাখুন। ভঙ্গিটি উপভোগ করুন। চোখ বন্ধ করে, ধীরে ধীরে শ্বাস নিন এবং শ্বাস অনুভব করুন। শরীরের পাশাপাশি মনকেও শিথিল করুন। যতটা সম্ভব এই ভঙ্গিতে থাকুন। তারপর ধীরে ধীরে চোখ খুলুন এবং পার্থিব জগতে ফিরে আসুন। এবার শ্বাস নিন আর শরীর পায়ের ওপরে রাখুন। হাতের তালু মেঝেতে রাখুন এবং টেবিলটপ ভঙ্গিতে ফিরে আসুন। সম্ভব হলে দ্বিতীয় রাউন্ডের জন্য এই ভঙ্গির চর্চা চালিয়ে যান।
 ক্যাট টু কাউ পোজ: হাত ও হাঁটুর ওপর ভর দিন। শরীরের ওজন কাঁধের ওপর ছেড়ে দিন। শরীরকে প্রসারিত করুন। গভীর শ্বাস নিন এবং পেট মাটির দিকে ঠেলে দিন। পুশ করার সময় মাথা প্রসারিত করুন (ক্যাট পোজ)। পিঠ বিপরীত দিকে প্রসারিত করার সময় হালকা শ্বাস ছাড়ুন এবং পিঠকে ভেতরের দিকে বাঁকাতে থাকুন (কাউ পোজ)। ধীরে ধীরে, গভীর শ্বাস নিয়ে যতবার সম্ভব এই চর্চার পুনরাবৃত্তি করুন।
 বদ্ধ কোনাসন: মাদুরে বসে পা প্রসারণের মাধ্যমে শুরু করুন। পায়ের তালুগুলো এমনভাবে রাখুন যেন সেগুলো মুখোমুখি থাকে। এ সময়ে খেয়াল রাখা চাই, যেন হাঁটুর ওপরের অংশের সঙ্গে নিচের অংশ পুরোপুরি লেগে না যায়; বরং একটু ফাঁকা থাকে। দুই হাত দিয়ে পায়ের তল ধরে শরীর সামনের দিকে প্রসারিত করুন। এবার পা আলতো করে ছেড়ে দিন এবং সামনের দিকে প্রসারিত করুন।
 পাইলেটস: এটি সবচেয়ে ট্রেন্ডিং ওয়ার্কআউটগুলোর একটি। শরীরকে শিথিল, শান্ত ও সুস্থ রাখতে কাজে দেয়। পাইলেটস মুভ নির্দিষ্ট পেশিগুলোকে লক্ষ করে করা হয়; তাই প্রয়োজন অনুসারে ওয়ার্কআউট প্ল্যান তৈরি করা সম্ভব। এই ব্যায়াম শরীরে শক্তি তৈরি করে, যা ক্র্যাম্পের তীব্রতা কমাতে সহায়ক।
 হালকা ওজন উত্তোলন: যদি হাঁটার কিংবা জিমে যাওয়ার মতো অবস্থা না থাকে, তাহলে বাড়িতে অন্তত হালকা ওজন উত্তোলন করতে পারেন। হালকা ওজন উত্তোলন এবং শক্তিভিত্তিক পদক্ষেপগুলো চর্চার চেষ্টা করুন, যার ফলে পেশির নমনীয়তা ও শক্তি বৃদ্ধি পাবে।
 স্ট্রেচিং: বিছানায় শুয়ে থাকার চেয়ে বাড়িতে স্ট্রেচিং করা উপকারী হতে পারে। অন্যান্য ব্যায়ামে বেশি অস্বস্তি হলে এর চর্চা চেষ্টা করুন। কীভাবে? শরীরের পেশিগুলোকে শিথিল করতে নিন গভীর শ্বাস।
 নাচ: এটি একই সঙ্গে আনন্দের এবং অতিরিক্ত ক্যালরি বার্নেও কার্যকর। তাই জুম্বা ক্লাসের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে নিতে পারেন।
 সাঁতার: সবচেয়ে আরামদায়ক ও মৃদু ব্যায়ামগুলোর অন্যতম। পিরিয়ডের সময়ও নির্দ্বিধায় এর চর্চা করতে পারেন। পানির স্রোতের বিপরীত চাপ হালকা হলে রক্তপাতের শঙ্কা থাকে না। সুরক্ষার জন্য ট্যাম্পন (স্যানিটারি প্যাডবিশেষ) ব্যবহার করতে পারেন। নারীরা ঠান্ডা পানিতে থাকলে রক্তপাত কম হয় বলে অভিমত অনেক চিকিৎসাবিজ্ঞানীর; কারণ, পানির শীতলতা রক্তনালির প্রক্রিয়া কিছুটা মন্থর করে।
রেড অ্যালার্ট
নাতাশার মতে, পিরিয়ডকালে ব্যায়ামের সময় শরীরের ওপর যেন অতিরিক্ত চাপ না পড়ে, সেদিকে খেয়াল রাখা চাই। এ সময়ে কিছু বিষয় এড়িয়ে চলা মঙ্গল; যেমন কঠোর ব্যায়াম, টানা দীর্ঘ সময় ধরে ব্যায়াম, যোগব্যায়ামের বিপরীত ভঙ্গি প্রভৃতি। তা ছাড়া শরীরের ওপর জোর খাটানো উচিত নয়।
এই বিশেষজ্ঞের মতে, নিয়মিত ব্যায়াম করা স্বাস্থ্য ও মনের জন্য উপকারী। পিরিয়ডের সময় প্রাত্যহিক ওয়ার্কআউট এড়িয়ে যাওয়ার কোনো বৈজ্ঞানিক কারণ নেই। তবে গুরুতর উপসর্গ থাকলে ভিন্ন কথা। অন্যদিকে, ব্যায়াম যদিও বিভিন্ন সুবিধা এনে দেয়; তবে অতিরিক্ত হলে পড়তে পারে ক্ষতিকর প্রভাব। এমনকি কখনো কখনো পিরিয়ড বন্ধের কারণও হতে পারে। এমনটা ঘটলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া শ্রেয়। একই সঙ্গে ব্যায়াম কমানো দরকার। সে ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ পরামর্শ জরুরি।

 ফুয়াদ রূহানী খান
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top