skip to Main Content

মনোযতন I মহাবিদ্যা মুসিবত

বলা হয়, ‘চুরি বিদ্যা মহাবিদ্যা, যদি না পড়ে ধরা!’ আসলেই কি তাই? চুরির কোনো মাহাত্ম্য নেই, বরং নিন্দনীয়। তবু অভাবের তাড়নাকে এর পেছনে দায়ী করে কেউ কেউ চুরির প্রতি সহানুভূতি অনুভব করেন। সে ভিন্ন প্রসঙ্গ! তবে সব চুরিই যে অভাবের কারণে করা হয়, তা নয়। স্বভাবের দোষেও করেন কেউ কেউ। মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের ভাষায় এটি ক্লেপটোম্যানিয়া

ধরুন, শহর ছেড়ে কোনো এক প্রত্যন্ত গ্রামে আপনার বসবাস। ভোরের সূর্যটা আলোর প্রথম রেখা টেনে যায় আপনার উঠোন ধরে। সেই নতুন আলোয় রোজ একটি মাছরাঙাকে দেখেন আপনি। বড্ড তাড়া মাছরাঙাটার। ছোট গন্ধরাজগাছের ডালে বসেই চোখে চোখ রাখে। চিরিক-পিরিক পাখা ঝাঁকিয়ে কী যেন বোঝাতে চায়! তারপর উড়াল দিয়ে হাওয়া। আপনার চোখে ভেলকিওয়ালার মতো একটা ঘোর লেগে থাকে। গ্রামের সহজ-সরল আর বোকাটে আপনি সেই ঘোরের তাল কাটিয়ে উঠতে পারেন না। মাছরাঙার ডানার মতো রঙিন স্বপ্ন আপনাকে হাতছানি দেয়। ডেকে নিয়ে যায় সত্যজিৎ রায়ের গল্পের সেই বারীন ভৌমিকের কাছে। বারীনবাবুকে একটা বয়স পর্যন্ত বেশ ভুগিয়ে ছাড়ে যে ব্যারাম, সেটি আপনাকেও ভোগায়। এর জন্য আশপাশের মানুষও কম ভোগান্তিতে পড়ে না। বারীন ভৌমিকের মতো যেকোনো উপায়ে পরের জিনিস আত্মসাৎ করে নিজের কাছে এনে রাখতে থাকেন আপনি। এই এনে রাখাকে সমাজের চোখে চুরি ছাড়া আর কীই-বা বলা যায়? চোরের সঙ্গে তফাত শুধু এই যে, চোর চুরি করে অভাবের তাড়নায়, আর বারীনবাবুর মতো আপনি চুরি করেন নিতান্ত অভ্যাসের বশে। কেবল এই এক অভ্যাস ছাড়া পরিপক্বতার দৌড়ে আপনি পাক্কা ১০০ তে ১০০! এই নাম্বারিং আপনার নয়; পরিবার কিংবা কাছের মানুষদের।
এই যে আপনার অভ্যাস বা স্বভাবদোষ, চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় একে বলে ক্লেপটোম্যানিয়া। বাংলায়, চৌর্যোন্মাদনা। মনস্তাত্ত্বিক রোগব্যাধির মধ্যে এটি আইসিডি তথা ইমপালস কনট্রোল ডিসঅর্ডারের অন্তর্ভুক্ত। নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা থেকে এই সমস্যার আবির্ভাব। সাধারণত কমবয়সীদের মধ্যে এই ব্যাধির জন্ম হলেও মাঝেমধ্যে বেশি বয়সে গিয়েও কেউ কেউ ক্লেপটোম্যানিয়াক হয়ে উঠতে পারেন, এমনকি আগে চুরির ইতিহাস না থাকলেও।
কারে বলে
মানসিক স্বাস্থ্যবিজ্ঞানে দেখা যায়, এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি চুরির জন্য নিজের মধ্যে একধরনের অপ্রতিরোধ্য তাড়না অনুভব করেন বা বাধ্য হন। এ সমস্যা যার থাকে, তিনি যখন-তখন দোকান, বিমানবন্দর বা হোটেল-রেস্তোরাঁ এমনকি কারও বাসা থেকে বিভিন্ন জিনিস চুরি করে নিয়ে আসেন। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, যা তিনি নিয়ে আসেন, তা তার ব্যক্তিগত কোনো প্রয়োজনে লাগে না কিংবা টাকার জন্য তিনি সেটি বিক্রিও করেন না। সাধারণ চুরির সঙ্গে এখানেই পার্থক্য। এই আচরণ বারবার করে থাকেন এবং জিনিসটি নেওয়ার আগে তার মধ্যে এক তীব্র উৎকণ্ঠা বা দুশ্চিন্তা তৈরি হয়। সফলভাবে জিনিসটি নেওয়ার পর তিনি স্বস্তি বা আরাম অনুভব করেন। যতক্ষণ সেটি কবজায় না আসে, মানসিক চাপ কমে না তার। জিনিসটি হতে পারে কলম, ইরেজার কিংবা তোয়ালে। আবার হতে পারে গয়না, টাকা কিংবা মুঠোফোন। কিন্তু মূল কথা হচ্ছে উদ্দেশ্য। যে সাধারণ চোর, তার উদ্দেশ্যই থাকে লোভে পড়ে কিংবা টাকা কামাতে চুরি করা। আর যার ক্লেপটোম্যানিয়া রয়েছে, তিনি নিজের টেনশন কমাতে চুরি করেন। কাউকে ক্ষতিগ্রস্ত করা, প্রতিশোধ নেওয়া বা বিক্ষুব্ধ হওয়া থেকে কাজটি তিনি করেন না। লুকিয়ে নিয়ে আসা জিনিসটি তিনি কখনো ফেলে দেন কিংবা লুকিয়ে রাখেন, অথবা মালিকের অগোচরে জায়গামতো ফিরিয়ে দিয়ে আসেন।
কারণ নির্ণয়
ক্লেপটোম্যানিয়ার সঠিক কারণ এখনো চিহ্নিত হয়নি। তবে মনোবিজ্ঞানীদের মতে, এই রোগ জেনেটিক্যালি হতে পারে এবং মস্তিষ্কের রিওয়ার্ড পাথওয়ের ওপরে প্রভাব ফেলে। রিওয়ার্ড পাথওয়েকে নিয়ন্ত্রণ করে ডোপামিন। কারও যদি ক্লেপটোম্যানিয়া থাকে, তার ফার্স্ট ডিগ্রি রিলেটিভের মধ্যে অবসেসিভ কমপালসিভ ডিসঅর্ডার কিংবা সাবস্ট্যান্স-ইউজ ডিসঅর্ডার অর্থাৎ বিভিন্ন নেশায় আসক্ত হওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। আবার ক্লেপটোম্যানিয়ায় ভুগছেন এমন অনেক রোগীর মধ্যে চুরির কারণে অপরাধবোধ, অবসাদ কিংবা নেশা করার প্রবণতা তৈরি হয়।
 সেরোটোনিন হরমোন মানুষের মন-মেজাজ এবং আবেগ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। দেহে এর মাত্রা কম হলে অনেক সময় ব্যক্তির মধ্যে চুরির তাড়না অনুভব করার মতো চূড়ান্ত আবেগীয় আচরণের দেখা মেলে।
 চুরি করার সময় তৎক্ষণাৎ যে রোমাঞ্চ বা অভিযানের অনুভূতি হয়, সেটি ডোপামিন নিঃসরণের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। ফলে ক্লেপটোম্যানিয়া শুরু হতে পারে এবং একই চাহিদার ফলে ব্যক্তি একই কাজের পুনরাবৃত্তি করেন।
 মস্তিষ্কের অপিওয়েড সিস্টেমের মাধ্যমে ব্যক্তির আবেগীয় চাহিদাগুলো নিয়ন্ত্রিত হয়। ফলে যেকোনো ধরনের ভারসাম্যহীনতায় এই ডিসঅর্ডার জন্ম নেওয়ার ঝুঁকি থাকে।
 মানুষ অভ্যাসের চক্রে বারবার জড়িয়ে যায় এবং একবার চুরি করার পর যে আনন্দ পায়, সেটি বারবার পাওয়ার জন্য চুরির অভ্যাস জন্ম নেয়; যার চূড়ান্ত ফল ক্লেপটোম্যানিয়া।
তবে যেমনটা আগেই বলেছি, ক্লেপটোম্যানিয়া কিন্তু প্রচলিত চুরি নয়। কারণ, যারা চুরি করে স্বেচ্ছায় ও প্রয়োজনে, তাদের মধ্যে সাধারণত অপরাধবোধ থাকে না। এরা সোসিয়োপ্যাথিক অপরাধী বা অপরাধমনস্ক। কিন্তু ক্লেপটোম্যানিয়ায় যারা ভুগছেন, তারা চুরি করেন শুধু একটি চাঞ্চল্য নিরসন এবং তার মাধ্যমে আনন্দ পাওয়ার জন্য। বাস্তব প্রয়োজনের জন্য নয়। সে কারণে তাদের মধ্যে অপরাধবোধ তৈরি হয়।
লক্ষণ চেনা
সাধারণ কিছু উপসর্গ বা লক্ষণ দেখে ধরে নিতে পারবেন কেউ ক্লেপটোম্যানিয়ায় আক্রান্ত কি না।
 অন্যের বাসা বা দোকানের এমন কোনো জিনিস যা নিজের প্রয়োজন নেই, তা নিয়ে নেওয়ার একটি অদম্য আগ্রহ বোধ কাজ করা।
 যেকোনো সময় চুরির কথা ভেবেই নিজের মধ্যে একধরনের অস্থিরতা এবং একই সঙ্গে ভালো লাগা কিংবা অন্য রকম আনন্দ অনুভূত হওয়া।
 চুরির পর অপরাধবোধ, অনুশোচনা, লজ্জা, এমনকি নিজের প্রতি ঘৃণা অনুভব করা।
 ঘৃণা বা অপরাধবোধ কাজ করার পরও বারবার একইভাবে চুরির প্রতি হাঁটা।
বেশি বশ
সাধারণত পুরুষদের চেয়ে নারীদের এই সমস্যা বেশি, আর প্রতি এক হাজার মানুষের মধ্যে প্রায় ছয়জনের এই সমস্যা রয়েছে বলে গবেষকেরা মনে করেন। শিশু-কিশোরেরাও এ রোগে আক্রান্ত হয়। তবে গবেষকদের মতে, অনেক সময় কন্ডাক্ট ডিসঅর্ডার বা আচরণজনিত মানসিক সমস্যায় চুরি করে শিশু-কিশোরেরা, যা ক্লেপটোম্যানিয়া থেকে আলাদা।
ওসিডির সঙ্গে দ্বন্দ্ব
মানসিক সমস্যার ক্ষেত্রে ওসিডি বা অবসেসিভ কমপালসিভ ডিসঅর্ডারের কথা হরদম শোনা যায়। এর সঙ্গে ক্লেপটোম্যানিয়াকে অনেকে গুলিয়ে ফেলেন। কিন্তু গবেষকদের মতে, ওসিডির একটি নির্দিষ্ট প্যাটার্ন আছে; ক্লেপটোম্যানিয়ার তা নেই। ওসিডির ক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তি বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় কিছুতেই মনে করতে পারেন না ঘরের আলো-পাখার সুইচ বন্ধ করেছেন কি না; তাই আবার তালা খুলে সব চেক করেন। এমনটা ওই ব্যক্তি যতবার বাইরে বের হন, প্রায় প্রতিবারই ঘটে। অন্যদিকে ক্লেপটোম্যানিয়ার ক্ষেত্রে কিন্তু কেউ দশবার শপিং মলে গেলেও প্রতিবারই চুরি করবেন না। হয়তো দশবারে একবার করবেন, কিংবা একবারও না; এটি নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। তাই ক্লেপটোম্যানিয়া কোনোভাবেই ওসিডির পর্যায়ে পড়ে না।
সহজ সমাধানে
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, লেখক ও অধ্যাপক ডা. আনোয়ারা সৈয়দ হক বলেন, ‘ক্লেপটোম্যানিয়াক লোকজনের জীবন অনেকটা লুকোচুরির মধ্যে কাটে। তারা অন্য সমস্যার মতো এটির জন্য কারও কাছে সাহায্য চাইতে পারেন না। এ রোগের সেভাবে কোনো চিকিৎসা নেই ঠিকই; তবে আক্রান্ত ব্যক্তি যদি দৃঢ়সংকল্প হন, তাহলে নিয়মিত সাইকোথেরাপি ও কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে এই চক্রাকার মনস্তাত্ত্বিক জট ছাড়ানো সম্ভব।’
তবে কেন এই ইমপালস কনট্রোল ডিসঅর্ডার হয়ে থাকে, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে; চলছে গবেষণা। প্রচলিত মতবাদগুলো হচ্ছে, একজন মানুষের বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় ধারণাগত ও আচরণের বিবর্তন এবং মস্তিষ্কের কিছু রাসায়নিক পদার্থের তারতম্য হওয়ার কারণে এই সমস্যা হয়। সমাজ ও আইন একে কীভাবে দেখবে, তা নিয়েও আছে মতভেদ। কোনো আইনে এগুলো রোগ হিসেবে বিবেচিত হলে শাস্তি কম দেওয়া হয়; আবার কোনো দেশের আইনে শাস্তি দেওয়ার সময় এটিকে রোগ হিসেবে বিবেচনায় নেওয়া হয় না। তাই বলা যায়, ক্লেপটোম্যানিয়া খুব সাধারণ কোনো অসুখ নয়। এটি মেনে নেওয়া যদিও ব্যক্তির জন্য বিশেষ একটি চ্যালেঞ্জ। তাই কাছের কেউ যদি ক্লেপটোম্যানিয়াক হন এবং সেটি বোঝা যায়, তবে তাকে অপমানসূচক কথাবার্তা বলে তার অপরাধবোধ না বাড়ানোই শ্রেয়। এ ধরনের কথাবার্তাকে আপাতদৃষ্টে সমাধান মনে হলেও এতে হিতে বিপরীত হতে পারে। মনে রাখা চাই, ক্লেপটোম্যানিয়া একটি মানসিক ব্যাধি; কোনো চারিত্রিক দোষ নয়। তাই এই সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে নিজেকে বা অন্যকে দোষারোপের মনোভাব দূরে সরিয়ে রেখে যৌক্তিকভাবে এগোনো চাই।
তা ছাড়া কিছু চিকিৎসার মাধ্যমে এই সমস্যা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। যেমন সাইকোথেরাপি, বিশেষ করে কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি এবং কিছু ওষুধ সেবনের প্রয়োজন হতে পারে। তাই কারও যদি এ ধরনের সমস্যা থাকে, তবে বড় ধরনের আইনি ঝামেলায় পড়ার আগেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
চিকিৎসার পাশাপাশি আরও যা করতে পারেনÑ
 পরিবার ও কাছের মানুষদের কাছে বিষয়টি খুলে বলুন। এতে ঝুঁকিপূর্ণ সময়ে তারা বিপদ থেকে রক্ষা করবেন এবং প্রয়োজনে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে পারবেন।
 তাড়না নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার বিষয়টি নোট বা ডায়েরিতে লিখে রাখুন। এতে চিকিৎসায় উন্নতি ক্রমান্বয়ে পর্যবেক্ষণ করা সহজ হবে।
 একই সমস্যায় আক্রান্তরা কেমন চিকিৎসা নিয়ে রোগটি নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন, তাদের সঙ্গে পরামর্শের মাধ্যমে পরস্পরকে সহায়তা করুন।
 যেসব পরিস্থিতিতে এমন ঘটনা ঘটাতে পারেন, সেগুলো এড়িয়ে চলুন।
 মার্কেট কিংবা অন্যের বাসাÑ যেখানেই যান না কেন, সব সময় কাছের মানুষদের আশপাশেই থাকুন।
 চুরির তাড়না নিয়ন্ত্রণে রাখতে চিন্তাকে অন্যদিকে সরিয়ে নিন। এ ক্ষেত্রে থট ডাইভারশন জাতীয় বিহেভিয়ার থেরাপি যেমন হাতে রাবার ব্যান্ড লাগিয়ে আস্তে আস্তে বারবার টানা, উল্টো দিক থেকে সংখ্যা গণনা ইত্যাদি করতে পারেন।
এই সমস্যা যে কারও থাকতে পারে। আপনার আশপাশে কারও তা থাকলে রাগারাগি না করে সহানুভূতির সঙ্গে ভাবুন। প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে বলুন। মনে রাখা চাই, এই সমস্যা ফেলে রাখলে শুধু ব্যক্তির নয়, তার পরিবারেরও অসম্মানের কারণ হয়ে পড়ে। তাই সিদ্ধান্ত নিতে দেরি না করাই উত্তম।
 আশিক মুস্তাফা
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top