ফিচার I হাতছাপার হাতছানি
কখনো রং ওঠে কাঠের ব্লকে তো কখনো বাঁশের কঞ্চির কলমে। সঙ্গে মেশে কারিগরের মনের রং। কাপড়ের ক্যানভাসে জীবন্ত হয়ে ওঠে নানান নকশা। এতে মেশিনের কোনো মুনশিয়ানা নেই, পুরোটাই কামাল দু হাতের
কাঠের ব্লকের বিবর্তন
ছোট-বড়-মাঝারি। কোনোটা লম্বা, কোনোটা গোল তো কোনোটা চৌক। আছে কলকা, ফ্লোরাল, পেইজলির মতো আউট অব দ্য বক্স মোটিফও। প্রতিটিই কাঠের ব্লক। তার ওপর খোদাই করা নকশা। যাতে রকমারি রং মাখিয়ে কাপড়ের ওপর চেপে ধরে সেই ছাপ ফুটিয়ে তোলা হয় হুবহু। এরই পুঁথিগত নাম ব্লকপ্রিন্ট। উৎস বাংলায় নয়, পুরোপুরি মেইড ইন চায়না। কিন্তু বাঙালি হস্তশিল্পের তালিকায় এর নাম থাকবে না—তা হবে না, তা হবে না…! কোনো রিপিট মার্ক না রেখেই প্রতিটি ব্লক ধরে ধরে কাপড়ে তার ছাপ ফেলা, কাজটি কিন্তু সহজ নয়। সময়সাপেক্ষ তো বটেই, পরিশ্রমও কোনো অংশে কম লাগে না। ফলে মেশিনে ব্লক প্রিন্টিংয়ের চাহিদা ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী। কিন্তু দেশে এখনো পুরোনো পদ্ধতি মেনেই ব্লক প্রিন্ট করতে দেখা যায় বেশির ভাগ কারিগরকে। দক্ষ ও সুনিপুণ হাতের ছোঁয়া থাকে বলে ব্লক প্রিন্টের চিরন্তন এই কৌশল আজও আবেদন হারায়নি।
কথিত আছে, প্রায় ৪ হাজার বছর আগে চীনে প্রথম এই ধরনের ছাপার প্রচলন শুরু হয়। কাঠের ব্লক দিয়ে তারা মূলত সিল্কের ওপর অক্ষরের ছাপ ফেলতেন। মাত্র তিনটি রং ব্যবহার করা হতো তখন। ধীরে ধীরে তাতে যুক্ত হয় ফুল, লতা, পাতার মোটিফ। পরে হানদের রাজত্বকালে চীনে ব্লক প্রিন্টের প্রসার ঘটে। ক্রমশ এটি প্রবেশ করে ভারতীয় উপমহাদেশে। সিন্ধু সভ্যতাতেও ব্লক প্রিন্টের প্রচলন ছিল বলে ধারণা করা হয়। তবে ষোড়শ শতাব্দী নাগাদ অর্থাৎ মোগলদের শাসনামলে ব্লক প্রিন্টের শিল্প নতুন মাত্রায় পৌঁছায়। সম্রাট শাহজাহানের রাজত্বকালে যেসব শিল্পের বিকাশ ঘটেছিল, ব্লক প্রিন্ট সেগুলোর মধ্যে অন্যতম। মোগলদের হাত ধরেই ফুল-পাতার মোটিফের সঙ্গে নানা জ্যামিতিক নকশার প্রচলন শুরু ব্লক প্রিন্টিংয়ে। গুজরাট ও রাজস্থানে গড়ে ওঠে উপমহাদেশের প্রথম ব্লক প্রিন্টিং সেন্টার। এরপর ব্রিটিশদের আগমন ঘটে। দেশের নানা জিনিস বিদেশে রপ্তানি হতে শুরু করে। এভাবেই ক্রমশ দেশের বাইরে ছড়িয়ে পড়তে থাকে প্রিন্টিংয়ের সনাতনী এ প্রক্রিয়া। তত দিনে তিন রঙের সীমা অতিক্রম করে ব্লক পুরোদস্তুর রঙিন হয়ে উঠেছে। ওপার বাংলায় এই শিল্পের প্রচলন ঘটে ১৯৪০ সাল নাগাদ। স্থানীয় শিল্প না হওয়া সত্ত্বেও হুগলির শ্রীরমপুর খুব অল্প সময়ে ব্লক প্রিন্টের কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়। পরবর্তীকালে বর্ধমানেও এই প্রিন্টের বিকাশ ঘটে। বাংলাদেশে আশির দশকের শেষের দিকে এর আগমন।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, ব্লক প্রিন্টিং যখন যেখানে পৌঁছেছে, সেখানকার সুদক্ষ, স্থানীয় শিল্পীরা দ্রুত এ শিল্পে পারদর্শী হয়ে উঠেছেন। ব্লক প্রিন্টিংয়ের বেসিক কৌশলগুলো রপ্ত করলেও প্রচলিত মোটিফ বা নকশার হুবহু অনুকরণ করার পরিবর্তে নিজেদের সৃজনশীলতা আর শৈল্পিক জ্ঞানের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে তাদের নকশায়। মূলত শিশুগাছের কাঠ দিয়ে ব্লক তৈরি করে তাতে বিভিন্ন ধরনের নকশা খোদাই করা হয়। এর জন্য প্রয়োজন পড়ে দক্ষ কারিগরের। কারণ, ব্লকই এই প্রিন্টের প্রধান উপকরণ। এর নকশায় খুঁত থাকলে ছাপা ভালো হয় না। ব্লক তৈরি করা বেশ সময়সাপেক্ষ, নকশাবিশেষে পনেরো দিনও লেগে যেতে পারে। প্রথমে কাগজে এঁকে নেওয়া হয় মনপসন্দ নকশা। কার্বন পেপারের সাহায্যে কাঠের ব্লকের ওপর ছাপানো হয় তা। তারপর নিপুণ হাতে খোদাই করা হয়। যে কাপড়ে ছাপা হবে, তা অন্য কোনো সাদা কাপড়ের ওপর টান টান করে বিছিয়ে নেওয়া হয়। এতে ছাপার সময় অন্য কাপড় থেকে রং ওঠার শঙ্কা কমে যায়। এরপর এক বা একাধিক রং মিশিয়ে তাতে ব্লক ডুবিয়ে কাপড়ের ওপর ছাপ ফেলা হয়। তারপর রোদে কাপড় শুকিয়ে রং পাকা করে নেওয়া। সুতি সিল্ক, মসলিন—সবেতেই ব্লক প্রিন্টিং সম্ভব। তবে খুব পাতলা ফ্যাব্রিক ব্যবহার না করাই ভালো।
কলমকারির কলা
এর উৎপত্তিও বাংলায় নয়। সুদূর অন্ধ্র প্রদেশ ও ইরানে। কলমকারি—শব্দটি ফার্সি। কলম বা ঘলম হচ্ছে সেই বস্তু, যা দিয়ে লেখা হয়। আর কারি অর্থ কারিগরি। হাতে এঁকে অথবা ব্লক প্রিন্টিংয়ের সাহায্যে কলমকারি করা হয়। অন্ধ্র প্রদেশের শ্রীকলাহস্তি ও মৌসলিপত্তনমে বা মছলিপত্তনমে এ শিল্পের প্রচলন রয়েছে; যা প্রথম উদ্ভব হয়েছিল অন্ধ্র প্রদেশ বা তেলেঙ্গানাতেই। পরে মোগল সম্রাট আর গোলকুন্ডা সুলতানদের পৃষ্ঠপোষকতায় বিস্তার লাভ করে। হাতে আঁকা কলমকারির কলা যে কত প্রাচীন, তা বানভট্টের লেখায় পাওয়া যায়। বর্ণিত আছে, সে সময় বিয়ের কনের পোশাক হাতে এঁকে তৈরি হতো। এ ছাড়া খ্রিস্টপূর্ব ৭৭৮-৭৯ অব্দে উদয় তানসুরি নামে একজন লেখকের প্রাকৃত ভাষায় লেখা কুভালয়ামালা গ্রন্থে কাপড়ে হাতে আঁকার বিভিন্ন পদ্ধতি ও কারিগরি নিয়ে বিস্তারিত বিবরণ মেলে।
প্রাচীনকালে লোকগায়ক ও চিত্রকরেরা গ্রামে গ্রামে ঘুরে পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারত ইত্যাদির গল্পকথা এঁকে এঁকে গান গেয়ে বা কথকতার মাধ্যমে বর্ণনা করতেন। পরবর্তী সময়ে কাপড়ের পটে বা ক্যানভাসে এঁকে চিত্রকরেরা তা বর্ণনা করতেন। পটচিত্রের মাধ্যমে এই বর্ণনা করাকে বলা হতো পটকথা। এভাবেই কলমকারি শিল্প পটচিত্রের মাধ্যমে সবার চোখের সামনে ধরা দিয়েছিল। কাপড়ের ওপরে এই রঙিন চিত্রগুলোই পরবর্তীকালে কলমকারি হয়ে ওঠে। এই রঙিন শিল্প খ্রিস্টবর্ষ শুরুর প্রায় ৩ হাজার বছর আগেই দেখা গিয়েছিল, মহেঞ্জোদারো আবিষ্কৃত হওয়ার পর। তবে মোগল যুগেই প্রথম ব্যাপকভাবে পরিচিতি লাভ করে। অন্যদিকে গোলকুন্ডার নিজামদের পৃষ্ঠপোষকতায় অন্ধ্র প্রদেশের কৃষ্ণা জেলার মৌসলিপত্তনমে এ কলা বিস্তার লাভ করে। ব্রিটিশ যুগে এর আরও শ্রীবৃদ্ধি ঘটে।
কলমকারি দুটি নির্দিষ্ট ধরনে তৈরি হয়। একটি হাতে এঁকে এবং অন্যটি ব্লক প্রিন্টে। হাতে আঁকা পদ্ধতিতে একটি বাঁশের ডগাকে তীক্ষè করে নিয়ে কলমের মতো ব্যবহার করা হয়। যাতে রং ভরিয়ে নকশা এঁকে নেওয়া যায় কাপড়ে। এই পদ্ধতি প্রচলিত অন্ধ্র প্রদেশের শ্রীকলাহস্তি নামক স্থানে। তাই এর নাম শ্রীকলাহস্তি স্টাইল। আরেকটি হচ্ছে মছলিপত্তনম স্টাইল, যেখানে প্রথমে নকশা ব্লক প্রিন্ট করে নেওয়া হয় কাপড়ে। তারপর কলম দিয়ে বর্ডার টানা হয়।
প্রায় সতেরোটি ধাপ থাকে কলমকারির। ব্যবহৃত হয় মূলত প্রাকৃতিক রং। যে কাপড়ে কলমকারি করা হবে, সেটিও অত্যন্ত উন্নত মানের হওয়া দরকার। কারণ, বিভিন্ন ধাপে প্রায় বিশবার কাপড়টি ধুয়ে পরিষ্কার করে নিতে হয়। দুই ধরনের কলমকারিতেই কাপড় প্রথমে খুব ভালো করে কেচে পরিষ্কার করে রোদে শুকাতে হয়। তারপর মহিষের দুধে হরীতকীর গুঁড়া মিশিয়ে নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ ভিজিয়ে রাখা হয়। ভালোভাবে চিপে আবার রোদে শুকানো হয়। তেঁতুলগাছের শাখার সরু ডগা দিয়ে প্রাথমিকভাবে কাপড়টির ওপর নকশা আঁকা হয়। তারপর বাঁশ দিয়ে তৈরি তীক্ষ্ণ সরু কঞ্চি দিয়ে কলম বানিয়ে আঁকার কাজে ব্যবহার করা হয়। কলমের নিবের তীক্ষ্ণ ডগায় এক টুকরা কাপড় তুলির মতো করে বেঁধে দেওয়া হয় সুতা দিয়ে। তারপর তৈরি করা হয় ‘ফাইস’। এটি মূল নকশা আঁকার জন্য বিশেষ এক মিশ্রণ; যা তৈরি হয় পাঁচ শ গ্রাম আখের রসের ক্বাথ, এক শ গ্রাম পাম ফলের ক্বাথ এবং এক কেজির মতো মরচে ধরা লোহা প্রায় দশ লিটার পানিতে মিশিয়ে।
ফ্যাশন ডেস্ক
মডেল: ফাবলিহা
মেকওভার: পারসোনা
ওয়্যারড্রোব: রঙ বাংলাদেশ
ছবি: কৌশিক ইকবাল