skip to Main Content

পাতে পরিমিতি I কর্মজীবী নারীর মধ্যাহ্নভোজ

পরিবারে নারীর যেন বিরাম নেই! আর তিনি যদি হন কর্মজীবী, তাহলে তো দ্বিগুণ চাপ। ঘরে ও কর্মক্ষেত্রে। এত ব্যস্ততার ভিড়ে নিজের খাদ্যাভ্যাস ঠিক রাখা তার জন্য বিশেষভাবে জরুরি। যেহেতু সপ্তাহান্ত বাদ দিলে, মধ্যাহ্নভোজের সময়টি সাধারণত অফিসেই কাটাতে হয়; তাই তার লাঞ্চবক্সও হওয়া চাই সঠিক খাদ্য উপাদানে ভরপুর। রইল পুষ্টিবিদ নিশাত শারমিন নিশির পরামর্শ

স্বভাবতই কর্মজীবী নারী মানে প্রাপ্তবয়স্ক। এমন নারীর প্রাত্যহিক খাদ্যতালিকায় যে ধরনের পুষ্টি উপাদান রাখা জরুরি:
 ক্যালসিয়াম: দেহে ক্যালসিয়ামের অভাব হলে হাড়ের ভঙ্গুরতা দেখা দেয়। আর বোন ডেনসিটি কমে গেলে মাংসপেশিতে ব্যথা, এমনকি ক্র্যাম্প বা খিঁচুনিও শুরু হতে পারে। এ ছাড়া হাঁটার সময় হাঁটুতে ব্যথা হাওয়ায় স্বাভাবিকভাবে মুভ করা কঠিন হয়ে পড়ে। তাই প্রাপ্তবয়স্ক নারীর ডায়েটে ক্যালসিয়াম জাতীয় খাবার রাখা চাই। এ ক্ষেত্রে সেরা উৎস দুধ। যারা ল্যাকটোজ ইনটলারেন্সে ভোগেন, তাদের জন্য দুধের বিকল্প হতে পারে সয়া মিল্ক, ইয়োগার্ট, আমন্ড মিল্ক প্রভৃতি।
 ভিটামিন ডি: সূর্যরশ্মি ভিটামিন ডি শোষণে সাহায্য করে আর খাদ্যে এই ভিটামিনের ঘাটতি থাকলে শোষণ হওয়ার মতো কোনো বিষয় থাকে না। তাই খাদ্যতালিকায় রাখা চাই ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাবার; যেমন মাশরুম, ডিমের কুসুম, মাছ ইত্যাদি। কর্মজীবী নারীর লাঞ্চে এ ধরনের পুষ্টি উপাদানগুলো থাকা জরুরি। সে ক্ষেত্রে তারা গ্রহণ করতে পারেন সটেড মাশরুম অথবা মাশরুমের স্যালাদ।
 ভিটামিন ই: অন্যান্য পুষ্টি উপাদানের পাশাপাশি ভিটামিন ই-এর ঘাটতি যেন না হয়, সেদিকেও খেয়াল রাখা চাই। আজকাল নারীদের রিপ্রোডাকটিভ সিস্টেম বা জরায়ুর নানা ধরনের সমস্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এর পাশাপাশি চুল ও ত্বকের ক্ষতি হওয়ারও ঝুঁকি থাকে। তাই কর্মজীবী নারী তার মধ্যাহ্নভোজে গ্রহণ করতে পারেন পামকিন সিড কিংবা মিক্সড নাট দিয়ে তৈরি একটি রেসিপি। কোলেস্টেরল লেভেল ভালো থাকলে প্রতিদিন একটি কুসুমসহ ডিম সেদ্ধও খেতে পারেন। এ ছাড়া তিল হলো ভিটামিন ই-এর একটি ভালো উৎস। মধ্যাহ্নভোজে ভাত ছাড়া যাদের চলে না, তারা সঙ্গে পাতে রাখতে পারেন তিলের ভর্তা। স্যালাদ ড্রেসিংয়ে ব্যবহার করতে পারেন তিলের তেল। এ ছাড়া লাঞ্চবক্সে জায়গা দিতে পারেন অ্যাভোকাডো স্লাইসকে।
 আয়রন: এর ঘাটতি নানাবিধ শারীরিক সমস্যার কারণ। আয়রনের অভাবে এনিমিয়া বা রক্তস্বল্পতা দেখা দেয়; যার ফলে অল্পতেই ক্লান্তি ভাব, দুর্বল লাগা, মাথা ঘোরানো ইত্যাদি সমস্যার আবির্ভাব ঘটে। পিরিয়ড চলাকালে অতিরিক্ত রক্তপাতের সমস্যায় যারা ভোগেন, তাদের রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কমে যায়। সে ক্ষেত্রে দেহে আয়রনের ঘাটতি যেন না হয়, তাই একজন কর্মজীবী নারীর দুপুরের খাবারে অবশ্যই এ ধরনের খাদ্যগুলো রাখা দরকার: স্পিনাচ বা পালংশাকের স্যুপ, চিজ দিয়ে রান্না পালংশাক, বিফ লিভার কিংবা শুধু বিফ দিয়ে তৈরি কাটলেট, গ্রিন অ্যাপেল স্লাইস, পমেগ্রেনেট জুস ইত্যাদি।
 জিংক: রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়াতে এর গুরুত্ব অনেক। কর্মজীবী নারী অফিস ও ঘর—দুটোই একত্রে সামলাতে গিয়ে অনেক সময় নিজের সঠিক যত্ন নেওয়ার সুযোগ পান না। সে ক্ষেত্রে অনেকের ঘন ঘন অসুস্থ থাকা, সর্দি-কাশির সমস্যা ইত্যাদি প্রায়ই হতে দেখা যায়। অনেকে বুঝতে পারেন না, শুধু যত্নের অভাবে নয়, বরং খাদ্য উপাদানের কোনো ঘাটতি থেকেই হয়তো এ ধরনের সমস্যা বারবার হচ্ছে। প্রকৃত অর্থে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বৃদ্ধি করার মতো সঠিক পুষ্টি উপাদান শরীরে না থাকলে ধীরে ধীরে তা কমে যেতে থাকে। তাই সুস্থ থাকতে জিংকের অভাব যেন দেহে না তৈরি হয়, অবশ্যই খেয়াল রাখা চাই। এ ক্ষেত্রে একজন কর্মজীবী নারীর লাঞ্চবক্সে থাকতে পারে দুধ ও দুধজাতীয় খাবার, মিক্সড নাট উইদ এগ, সি-ফুড, সি-ফিশ ইত্যাদি।
সময়ের প্রবাহে আমাদের দেশে অনেক কিছুতেই পরিবর্তন এসেছে; আসছে আরও। সেই তালে বদলে যাচ্ছে চিরচেনা খাবারের ধরন। আর চলমান স্রোতে তাল মিলিয়ে অনেকে খাবারেও আনতে চান নতুনত্ব। যারা একটু আলাদা কুজিন গ্রহণ করতে পছন্দ করেন, তাদের লাঞ্চবক্সে থাকতে পারে এ ধরনের লাইট অ্যান্ড ডেলিসিয়াস রেসিপি:
ক্যাবেজ-টর্টিলা র‌্যাপস
 উপকরণ: পার্পেল অ্যান্ড গ্রিন ক্যাবেজ, ক্যারট, ইয়োগার্ট, পুদিনাপাতা, ব্ল্যাক পিপার, গ্রিন চিলি পেস্ট অথবা চিলি ফ্লেক্স, কর্নফ্লাওয়ার।
 প্রণালি: কর্নফ্লাওয়ার বাদে বাকি সব উপকরণ একটি পাত্রে মিক্স করে নিন। এরপর কর্নফ্লাওয়ার দিয়ে তৈরি করে নিন টর্টিলা বা পাতলা রুটি। এতে বাকি উপাদানগুলোর মিশ্রণটি র‌্যাপিং বা মুড়িয়ে নিলেই দারুণ সুস্বাদু লাঞ্চ প্রস্তুত!
 উপকারিতা: এতে রয়েছে ক্যালসিয়াম, আয়রন এবং ফলিক অ্যাসিডসহ ভিটামিন এ, ভিটামিন সি, ভিটামিন ডি ইত্যাদি। এটি ওজন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে, ব্লাড কোলেস্টেরল ভালো রাখে এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণেও যথেষ্ট কার্যকরী।
কর্মজীবী নারীর খাদ্যতালিকায় আর যা-ই থাকুক না কেন, মধ্যাহ্নভোজ হওয়া চাই একটু ভিন্ন। সারা দিন অফিসে কাজ করতে হয় বলে এ সময়ে বাইরের খাবারের প্রতি অনেকের ঝোঁক থাকে। যার ফলে লিপিড প্রোফাইল খারাপ হওয়া, ওজন বেড়ে যাওয়া, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়াসহ নানা শারীরিক সমস্যা হানা দিতে পারে। এ ছাড়া বাইরে খাওয়ার ঝামেলা এড়াতে কেউ কেউ লাঞ্চই স্কিপ করে ফেলেন। যার ফলে দেখা দিতে পারে অ্যাসিডিটি; এমনকি দীর্ঘ মেয়াদে এই অ্যাসিডিটির কারণে আক্রান্ত করতে পারে আলসার। যারা বাড়ি থেকে না এনে, অফিসে সরবরাহকারীর খাবারের ওপর নির্ভর করেন, তাদের খেয়াল রাখা চাই:
 ভাত অথবা রুটি—দুটি অপশন থাকলে ভাতের ওপর পুরোপুরি না ঝুঁকে, সপ্তাহে অন্তত দুদিন রুটি খাওয়া ভালো। এতে ওবিসিটি বা স্থূলতাব্যাধির ঝুঁকি হ্রাস পাবে।
 প্রোটিনের উৎস হিসেবে বিফ, মাটন অথবা চিকেন গ্রহণের অপশন থাকলে প্রতিদিন গরু-খাসি পাতে না নিয়ে মাঝেমধ্যে মুরগির আইটেম সিলেক্ট করুন। এ ক্ষেত্রে বাড়তি ঝোল না নেওয়াই ভালো।
 দুপুরের পাতে পরিমিত স্যালাদ রাখুন। কেননা, যারা অফিসে বসে কাজ করেন, তাদের খুব বেশি শারীরিক পরিশ্রম করতে হয় না বলে ক্যালরির চাহিদাও বেশ কম।
 যেসব অফিসে বুফে সুবিধা রয়েছে, সেখানে লাঞ্চে সাধারণত কোনো না কোনো ডেজার্ট আইটেম থাকে। সে ক্ষেত্রে সুযোগ থাকলে মিষ্টি বা লাড্ডুর পরিবর্তে দইয়ের অপশন বেছে নিন। এতে থাকা প্রোবায়োটিক ফিটনেসের পাশাপাশি ডাইজেস্টেশনেও সাহায্য করবে।
 ভিটামিন সি আমাদের দেহে আয়রন শোষণে কাজে দেয়। তাই লাঞ্চে যে খাবারই গ্রহণ করেন না কেন, সঙ্গে লেমন স্লাইস অথবা সবশেষে লেবু-পানি গ্রহণ করতে পারেন।
মনে রাখা চাই, শরীর ভালো না থাকলে কোনো কিছু করতেই ভালো লাগে না। যারা ক্যারিয়ার নিয়ে অনেক বেশি সচেতন, তাদের প্রথমেই মাথায় রাখা চাই সুস্থতার কথা। অনেকের দীর্ঘ সময় ধরে অফিসে কাজ করতে হয়; সে ক্ষেত্রে সূর্যের তাপ থেকে বাদ পড়ে যান তারা। আর তাতে নানা রোগ হানা দেওয়ার পাশাপাশি ত্বকও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কা বাড়ে। তাই অফিস শেষে অবশ্যই বাড়িতে কিছুটা ত্বকের যত্ন নেওয়া চাই। এ ক্ষেত্রে ন্যাচারাল প্যাক ব্যবহার করতে পারেন। ফিটনেস ধরে রাখতে ডায়েটারি মোডিফিকেশনের পাশাপাশি প্রয়োজন এক্সারসাইজ। তাই সপ্তাহে অন্তত এক দিন যেতে পারেন জিমে। আর প্রতিদিনের এক্সারসাইজ হিসেবে ২৫-৩০ মিনিট রাখা চাই নিজের সুস্থতার কথা ভেবে। এই সময়ব্যাপ্তিতে হাঁটা ও ব্যায়াম করার পেছনে ভাগ করে নেওয়া ভালো। এতে জমে থাকা ফ্যাট কমার পাশাপাশি বডিতে পারফেক্ট টোন ধরা দেবে দারুণভাবে।

লেখক: প্রধান পুষ্টিবিদ ও বিভাগীয় প্রধান, পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top