skip to Main Content

কভারস্টোরি I নূর এ জাহান

এক যে ছিল রাজা। আর এক যে ছিল রানি। গল্পের শুরুয়াত তো বরাবর এমনটাই। রাজাকে ঘিরে ঘোরে কেচ্ছার কাঁটা। রানি এতে সাপোর্টিং ক্যারেক্টার মাত্র। কিন্তু এ যেন উলটপুরাণ। রূপকথার গল্পকে হার মানানো। যেখানে ক্ষমতার টক্করে রাজাকে পেছনে ফেলে রানি এগিয়ে গেছেন দোর্দণ্ডপ্রতাপে। তা নিয়ে চর্চায় এখনো ঝড় ওঠে চায়ের কাপে। এমনকি বাড়ায় নারীবাদের বাদ-বিবাদ। ফ্যাশনের দারুণ সমঝদার এই মোগল সম্রাজ্ঞী সেখানেও ফেলেছেন ছকভাঙার ছাপ। ইতিহাস সাক্ষী। সেই আখ্যানের কিয়দংশ ক্যানভাসের পাঠকদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার প্রয়াস। জাহেরা শিরীনের লেখনীতে

সময়টা বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি। রাজনৈতিকভাবে সচেতন নারীদের হাত ধরে জন্ম নারীবাদের। কিন্তু নূরজাহান তো তখন নারীবাদীদের নেটওয়ার্ক থেকে একেবারেই বাইরে। মোগল এ সমাজ্ঞীর গল্প আরও পেছনের, প্রায় চার শতক পুরোনো। তবু তার গায়ে কেন নারীবাদের তকমা!
জটিল নয়, হিসাব মিলে যায় ইতিহাসের পাতা ঘাঁটলেই। নারীবাদের কিছু সুনির্দিষ্ট নীতি রয়েছে। স্থান-কাল-পাত্রভেদে যা অপরিবর্তনীয়। তবে তা প্রকাশের সৃজন, উদ্যোগ ও ভঙ্গিমা ভিন্ন হলেও তো হতে পারে। নূরজাহানের ক্ষেত্রেও ঠিক সেটাই ঘটেছে। মোগল এই সম্রাজ্ঞী রাজনৈতিকভাবে, নান্দনিকতা প্রকাশে, নিজের জীবন গড়ার ক্ষেত্রে কিংবা সাম্রাজ্য সামলাতে গিয়ে যা যা করেছেন—সবকিছুর সঙ্গেই নারীবাদের নিগূঢ় সম্পর্ক ছিল। আজীবন তিনি যা করেছেন, তা বরাবরই ছিল স্বতঃস্ফূর্ত ও সরাসরি। প্রতিটি সিদ্ধান্তে বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন। সহজে হার মানেননি। বরাবরই ছিলেন অবিচল, বুদ্ধিদীপ্ত। কিছু ঘটনার বয়ানে হয়তো ব্যাপারটা বুঝতে আরও সহজ হবে।
সপ্তদশ শতাব্দীর মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের আত্মজীবনী ঘাঁটলেই দেখা যায়, তা নূরে পরিপূর্ণ। নূরজাহান। তার সবচেয়ে প্রিয় বেগম। যদিও সংখ্যায় তার স্থান বিশ থেকে পঁচিশের মাঝামাঝি কোথাও। এ নিয়ে দ্বন্দ্ব রয়েছে। সম্রাটের স্মৃতিকথায় অনেকবার উঠে এসেছে সম্রাজ্ঞী নূরজাহানের শিকার করার নানা কীর্তি। আরেব্বাস! সে তো রাজাদের কাজ। অবসর যাপন; আবার কারও কারও কাছে নিতান্তই শখ। কিন্তু আদতে বিবেচিত হতো সাম্রাজ্যে আধিপত্য বিস্তারে কে কতটুকু যোগ্য, তার নির্দেশক হিসেবে। পুরুষত্বের মাপকাঠি আর সাহসিকতার পরিচায়ক। আর সে সময় নূরজাহানের শিকারের দক্ষতা নিমেষেই তাকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করে দেয়। ইতিহাসে উল্লেখ আছে, মাথুরার সাধারণ লোকজন যখন বাঘ-আতঙ্কে অতিষ্ঠ, তখন নূরজাহানই তা শিকার করেন, হয়ে ওঠেন তাদের উদ্ধারক।
বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, বংশানুক্রমে মোগল ছিলেন না এই সম্রাজ্ঞী। ১৫৭৫ সালে (মতান্তরে ১৫৭৭) জন্ম নেওয়া নূরজাহানের আসল নাম ছিল মেহের-উন-নিসা। বাবা পারস্যের অভিজাতবংশীয় মির্জা গিয়াস বেগ। দুর্দিনে ভারতবর্ষে পাড়ি জমান। কাজ মিলে যায় সম্রাট জাহাঙ্গীরের পিতা সম্রাট আকবরের দরবারে। মেধার জোরে উচ্চপদস্থ হতেও খুব বেশি সময় লাগেনি। একসময় মির্জা গিয়াসের কন্যা তরুণী মেহের-উন-নিসার প্রেমে পড়েন শাহজাদা সেলিম অর্থাৎ জাহাঙ্গীর। তাতে বাদ সাধেন সম্রাট আকবর। তড়িঘড়ি করে ১৭ বছর বয়সে মেহের-উন-নিসার বিয়ে ঠিক করা হয়; পাত্র মোগল বাহিনীতে কর্মরত ইরানি সমরনায়ক শের আফগান আলি কুলি খান ইসতাজলুর। তাদের বর্ধমান পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু জাহাঙ্গীর সম্রাট হওয়ার কিছুদিন পরে শের আফগান রাষ্ট্রবিরোধী ও বিদ্রোহমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার দায়ে সম্রাটের বাহিনীর হাতে নিহত হন। কথিত আছে, এককালের প্রেমিকাকে পাবার জন্যই শের আফগানকে হত্যা করেন জাহাঙ্গীর। যদিও এর পষ্ট দলিল-দস্তাবেজ নেই। স্বামী মারা যাওয়ার পর আবার আগ্রায় ফেরেন মেহের-উন-নিসা। মূলত মৃত স্বামীর জীবদ্দশায় সৃষ্ট রাজনৈতিক শত্রুদের কাছ থেকে নিরাপত্তার জন্য এই সিদ্ধান্ত। জায়গা হয় মোগল হারেমে। সম্রাট আকবরের প্রধান স্ত্রী এবং সম্রাট জাহাঙ্গীরের সৎমা রুকাইয়া বেগমের সেবিকা হিসেবে। বিচক্ষণ মেহের-উন-নিসা অল্প সময়েই তার সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন।

জ্যাকেট: পৌষী

ফলাফল—স্বামী রাজদ্রোহী হওয়া সত্ত্বেও মেহের-উন-নিসা আর তার মেয়ে মোগল দরবারে দারুণ সম্মান পেতে শুরু করেন। আর সম্রাট জাহাঙ্গীর তো আগে থেকেই মেহের-উন-নিসায় মগ্ন ছিলেন। জাহাঙ্গীরের রাজত্বের ছয় বছর চলছে তখন। ১৬১১ সালের ২১ মে। সন্ধ্যায় শাহি মহলের মীনা বাজারে নওরোজের উৎসব দেখতে বের হওয়া সম্রাটের চোখ আটকে যায় পোশাকের দোকানি রূপসী ইরানি কন্যাকে দেখে। এত বছর পরেও মেহের-উন-নিসাকে দেখেই চিনে ফেলেন তিনি। তৎক্ষণাৎ দিয়ে বসেন বিয়ের প্রস্তাব। সেই মাসেরই ২৫ তারিখে, ১২ রবিউল আউয়াল ১০২০ হিজরি, মেহের-উন-নিসাকে বিয়ে করে মহলে নিয়ে আসেন জাহাঙ্গীর। কনের বয়স তখন ৩৪। স্ত্রীর রূপে মুগ্ধ হয়ে সম্রাট তার নাম দেন নূর মহল (মহলের আলো)। শিল্পানুরাগী, পরিসংখ্যানে পারদর্শী এবং ভ্রমণপিয়াসি সম্রাট জাহাঙ্গীর ক্রমেই স্ত্রী নূরের রাজনৈতিক বুদ্ধিমত্তায় প্রভাবিত হতে শুরু করেন। অনেকটা প্রথার বিরুদ্ধে গিয়েই ধীরে ধীরে তার ক্ষমতা আর দায়িত্ব স্ত্রীর সক্ষম হাতে হস্তান্তর করতে শুরু করেন। সম্রাট জাহাঙ্গীর স্বয়ং একদা বলেছিলেন, ‘আমার রাজ্য আমি এক পেয়ালা মদ আর এক বাটি সুরুয়ার বিনিময়ে আমার প্রিয় রানির কাছে বেচে দিয়েছি।’ এই রানি আর কেউ নন, নূর। ১৬১৩ সালের প্রথম দিকে, উত্তর-পশ্চিম ভারতের প্রায় তিন মাইল বিস্তৃত রাজশিবিরে সার্বভৌম সম্রাজ্ঞী হিসেবে নূর তার প্রথম আইনি নথি জারি করেন। এরপরে পরিবর্তিত হতে শুরু করে দৃশ্যপট। নূর হয়ে ওঠেন মোগল সাম্রাজ্যের একমাত্র নারী, যিনি প্রকাশ্যে ও সক্রিয়ভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করেছিলেন। তার ব্যক্তিত্বের শক্তিতে সম্রাট জাহাঙ্গীর এতই মুগ্ধ ছিলেন, সে সময় একজন দরবারি বলেছিলেন, নূরের সামনে কল্পিত মুসলিম প্রেমিক জুটি মাজনুন-খুসরোও কিছুই নয়। এই প্রভাব শুধু তার স্বামীর ওপরই সীমাবদ্ধ ছিল না, ছড়িয়ে পড়ে হারেম থেকে মহলে, মহল থেকে মোগল সাম্রাজ্যের গোটা শাসনব্যবস্থায়। ফলাফল—আবার নামবদল। সম্রাট জাহাঙ্গীর খোদ করেন সেই নামকরণ। নূর মহল হয়ে ওঠেন নূরজাহান। জগতের আলো।
প্রথম থেকে প্রথায় আটকে রাখা যায়নি নূরজাহানকে। ফলাফল—অন্যান্য রাজবংশীয় নারীর মতো হারেমের চারদেয়ালেও আটকে রাখা যায়নি তাকে। মোগল দরবারের ইতিহাসবিদদের উল্লেখ অনুসারে নূরজাহান প্রায়শই দেবীরূপে মহলের বারান্দায় এসে বসতেন। জনসাধারণের সামনে সম্রাজ্ঞীর নিজেকে উপস্থাপনের এমন সাহসী পদক্ষেপও ছিল প্রথাছুট। এমনতর কার্যকলাপের স্বত্ব শুধু সম্রাটদের জন্য সংরক্ষিত ছিল। অভূতপূর্বভাবে নূরজাহানই একমাত্র মোগল সম্রাজ্ঞী, যিনি রাজ্যের সার্বভৌমত্বের চিহ্ন অর্থাৎ মুদ্রায় সম্রাটের নামের পাশাপাশি নিজের নামও মুদ্রিত করেছিলেন।
শুধু কি শিকারি আর সফল শাসক? নূরজাহান ছিলেন বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ আর নারী অধিকার নিয়ে সোচ্চার। সাম্রাজ্য সামলানোর প্রথম বছরগুলোতে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন রাজনৈতিক জোট গঠন আর রাষ্ট্রীয় নানা বিষয়কে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করার জন্য। ভীষণ জনপ্রিয় ছিলেন তার অগাধ উদারতার জন্য। তিনি রাজবংশীয় নারী ও পুরুষদের মাঝে নিয়মিত গয়না, ঘোড়া, হাতি আর নগদ অর্থ বিতরণ করতেন। তার সময় একসঙ্গে প্রায় পাঁচ শ অনাথ মেয়ের বিয়েতে সহায়তা করতে গিয়ে দারুণ সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন এ সম্রাজ্ঞী। সস্তায় নকশা করে দিয়েছিলেন বিয়ের পোশাক। আগ্রার ট্যুর গাইডদের মতে, সেই পোশাক আরও বিকোয় সেখানে। দরিদ্র পরিবারের কনেদের কাছে এখনো এর কদর আকাশচুম্বী। নূরজাহান তার চল্লিশ বছরের কম বয়সী নারী সহচরীদের সঙ্গে জাহাঙ্গীরের সৈন্য ও পরিচারকদের বিয়ের ব্যবস্থার সূচনা করেছিলেন। এ ছাড়া চল্লিশ থেকে সত্তর বছর বয়সীরা হয় স্বামীর সন্ধানে প্রাসাদ ত্যাগ করার সুযোগ পেতেন, অথবা আমৃত্যু সম্রাজ্ঞীর সঙ্গে থেকে যাওয়ার সুবিধা। হারেমের সবচেয়ে সুবিধাবঞ্চিত এবং দুর্বল এই শ্রেণিকে এমন প্রস্তাব থেকে পছন্দসইটি বেছে নেওয়ার সুযোগ তৈরি করে দেওয়া এই সম্রাজ্ঞী আজকের নারীবাদীদের চেয়ে কম কিসের!
পোশাকে নূর প্রভাব
নতুন যেকোনো জিনিসকে সাদরে গ্রহণ করার মতো উদার মন আর সুন্দরকে চিনে নেওয়ার মতো শিল্পসম্মত দৃষ্টি—এ দুই দিয়ে নূরজাহান ভারতীয় নারী পোশাকেও নিয়ে এসেছিলেন নতুনত্ব। এর আগে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে মুসলিমরা যে পোশাক পরতেন, তা ছিল সাদাসিধে, ঘোর রঙের মোটা সুতি কাপড়। তাতে না ছিল নকশা, না রং। যুদ্ধক্ষেত্রে পরার উপযোগী হলেও, সৌন্দর্যসাধনে অনেক পিছিয়ে। মুসলমান শাসকেরা ভারতে আসার আগেই চীন আর পারস্যের বস্ত্রশিল্পের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। এই দুই দেশের বয়নের সমাদর বহু আগে থেকেই সমাদৃত হয় বিশ্বজুড়ে, যা নজর এড়ায়নি মোগল সম্রাজ্ঞীর। নূরজাহানের পারস্য প্রেম পষ্টভাবে প্রতিফলিত হতে শুরু করে মুসলিম অন্তঃপুর অর্থাৎ হারেমে। পারসি প্রভাবকে পুরোমাত্রায় বজায় রাখার সব রকম প্রচেষ্টা চলতে থাকে, তবে পরিবর্তিত সব পন্থায়। সে এলাকার নানা অঞ্চলের মানুষ তখন ডোরা দেওয়া কাপড়ের জামা আর পাজামা তৈরি করতেন। নূরজাহানের আমলে ইসলাম ধর্মাবলম্বী বেগমদের পোশাকে তাই ডোরাকাটা সিল্ক আর মসলিনের প্রাধান্য বাড়তে শুরু করে। সে সময়কার আঁকা ছবিগুলো যেন এর একেকটি জলজ্যান্ত প্রমাণ। যেখানে চোখ আটকে যায় হারেমের মেয়েদের পরনে সাদা পাজামা আর আঁটসাঁট কুর্তায়। যে কুর্তার নিচের দিকটা আধুনিক কামিজের মতো সমান নয়। চারটা বা ছয়টা কোণ থাকত তাতে। অনেকটা ত্রিভুজের মতো দেখাতে। মোগল বেগমদের দেখাদেখি একই ঘরানার সাধারণ মেয়েদের মাঝেও এই পোশাকের চল বাড়তে থাকে। আবারও প্রমাণ, সে সময়কার আঁকা ছবি। মোগল পরিচারিকাদের একই রকম কুর্তা পরে সুরা পরিবেশন করতে দেখা যায় তাতে। কুর্তার কোণের সঙ্গে মিলিয়ে গলা রাখা হতো ভি-শেপের, সেখানে জরি বা সামান্য সুতার কাজ। যেন মোগল আর পারসিক রীতির রাজযোটক। প্রতিনিয়ত নতুনের অন্বেষণে মেতে থাকা নূরজাহানের বদৌলতে বেগমদের পোশাক বদলাতে থাকে দ্রুত। সে সময় থেকেই যেন বস্ত্রশিল্পের প্রভূত উন্নতি হতে শুরু করে। যে তালিকায় সবার প্রথমে নাম আসবে কিংখাবের। খানদানি এই ফ্যাব্রিক ছিল ব্রোকেডের অভিজাত রূপ। সোনা, রুপা আর সিল্কের সূক্ষ্ম বয়নে তৈরি স্বপ্ন যেন। যা আজ অব্দি প্রভাবিত করে চলছে বেনারসি জগৎকে। তাই এখনো ঘুরেফিরে আসে তসবীর, লহরিয়া, চারখানা, খানজুরি, ডোরিয়া, সালাইদার, মোটরা, ইলায়েচা, সঙ্গী, বুলবুলচশম, চশমানকশা, আড়িবেল, খাজুরিবেল, পাটবুটি, ফুলবুটি, কলগাবুটা, শিকারদাহ, গুলদাউদি, চিনিয়াপট মখমলী, বুটি মানতাশি, জামেয়ার বুটি, ফর্দি বুটি, পাংখা বুটি, আসরফি বুটি, জালি কি তুরঞ্চ বুটি, বুটি ঝাড়দার, মেহরাব, তনছই, ভাসকট, আড়াগুজর, গুলবদন, বেলদার, কাঙ্গুরী, ফুলোয়ার প্রভৃতি নাম। এই নামগুলো মনে করিয়ে দেয় বস্ত্রশিল্পের বিশেষ একটা জগৎকে; যা শুধু নকশার নয়, এই শিল্পের প্রতি আগ্রহী ব্যক্তিদের জগৎ। মোগল সম্রাজ্ঞী নূরজাহান শিল্পানুরাগী তো বটেই, ছিলেন শিল্পীও। সূক্ষ্ম কারুকাজ করতে পারতেন কাপড়ের ওপর। সেই দক্ষতা কাজে লাগিয়েই তৈরি করে ফেলেন কিংখাবের এক অন্যতর ধরন। নাম নূরমহালী কিংখাব। প্রথম দিকে হারেমের মেয়েরা কিংখাব ব্যবহার করতেন না। একরঙা বা ডোরাকাটা জামা ও পাজামার ওপরে পরতেন মাকড়সার জালের মতো সূক্ষ্ম মসলিনের পেশওয়াজ। মূলত ভারতীয় উপমহাদেশের উষ্ণ আবহাওয়ার জন্য পাতলা কাপড় পরতে বেশি স্বচ্ছন্দ ছিলেন বেশির ভাগ মানুষ। মোগলেরাও এর বাইরে ছিলেন না। অন্যদিকে সে সময় যে কিংখাব প্রচলিত ছিল, তা নারীদের পোশাকের জন্য ছিল বেমানান। ভারী এবং জরির কাজের হওয়ায় ত্বকে বেশ কর্কশ অনুভূত হতো। এর ওপর মোগল মেয়েরা এমনিতেই গা ভর্তি করে সোনা-রুপার অলংকার পরতেন। তাদের পোশাকেও সোনার ফুল রুপার পাতার বাহার চোখের জ্বালাই বটে। দুইয়ে মিলে রূপ খোলে না। গয়না-পোশাক—দুইয়ের সৌন্দর্যই মাঠে মারা যায়। তাই সব সময়ের জন্য নয়, মোগল বেগমদের বিয়ের সাজ তৈরি হতো জমকালো কিংখাব দিয়ে। ভারতবর্ষে নারীদের মধ্যে জুতা পরার প্রচলন ছিল না। কিন্তু মোগল মহলে সবাই জুতা পরতেন। সামনের অংশ কারুকাজ করা, ঢাকা আর পেছনের অংশ কোনোটার ঢাকা তো কোনোটার চটির মতো খোলা। বিয়েতে তো বটেই, সব সময়ের ব্যবহৃত জুতাতেও জমকালো কারুকাজ করা অংশে কিংখাবের ব্যবহার শুরু হয় একসময়।

নূরজাহানের আমলে তিনি মনস্থির করেন, বিয়ের সময় সবাই জমকালো জরির পোশাক পরবে। ধনী-গরিব, বেগম-দাসী থেকে সাধারণ মানুষ—সবাই। সম্রাজ্ঞীর খেয়াল বলে কথা! কিন্তু কিংখাবের পোশাকের দাম! সে তো আকাশচুম্বী। সাধারণের নাগালের বাইরে। গরিবদের গায়ে উঠবে কী করে? আর বেগমদের যারা প্রতিদিন সাজিয়ে দিতেন, সেই দাসীরা, তাদের কি ইচ্ছা হয় না এক দিনের জন্য বেগম হতে? কিন্তু সামর্থ্য! নানা কিছু ভেবেচিন্তে নূরজাহান নিজেই কিংখাবের নকশা তৈরির কাজে লেগে গেলেন। ফাঁকার ওপর জমকালো। সেসব নকশা খুব সূক্ষ্ম না হলেও পুরো জমিনটা ভরে থাকে। নাম ফাঁকার কাজ। নূরজাহানের পরিকল্পনামতো এ কাপড় বুনতে সময় কম লাগে, দেখতে ঝলমলে হলেও পরিশ্রম কম বলে দামও কম। এই নতুন জরির পোশাকের নাম দেওয়া হয় নূরমহালী। নূরজাহান নিজের পরিচারিকা আর তাদের কন্যাদের বিয়েতে উপহার দিতেন বিশেষ এই পোশাক; যা তৈরি করতে তখনকার দিনে খরচ পড়ত পঁচিশ টাকা, মতান্তরে পঁচিশ মোহর বা এক শ টাকা। নূরমহালী কিংখাব যেন ভারতীয় নারীর পোশাকে নিয়ে এসেছিল নতুন দিগন্ত। এর আগে বিয়ের সাজ বলে আলাদা কিছু ছিল না বলেই মত ইতিহাসবিদদের। ভারতবর্ষের সপ্তম শতাব্দীর সংস্কৃত লেখক বানভট্টের লেখায় থানেশ্বরের পুষ্যভূতি বংশের প্রভাবশালী মহারাজ প্রভাকরবর্ধনের মেয়ে রাজ্যশ্রীর বিয়ের রাজসিক আয়োজনের বর্ণনা মেলে। তার বর্ণনা অনুসারে, সাজপোশাকের স্তূপ থেকে রাজ্যশ্রীর রক্তিম পট্টবস্ত্রটিকে আলাদা করে চিনে নেওয়া যায়নি; বরং ভারতীয় সনাতন রীতি অনুসারে বিয়ের সাজ ছিল সাদা এবং সেখানে ঔজ্জ্বল্যের পরিবর্তে প্রাধান্য ছিল পবিত্রতা আর সৌন্দর্যের। কিন্তু নূরজাহানের নূরমহালী মধ্যযুগের সাজের ক্ষেত্রে একটা বড় রকমের পরিবর্তন ঘটিয়ে দেয়। এরপর থেকে বিয়ের কনের সাজ মানেই তাতে জমকালো জড়োয়ার প্রাচুর্য অনিবার্য। এই ধারা বহাল ছিল পরবর্তী বহু সময়জুড়ে।
ব্রিটিশ ভ্রমণ লেখক অ্যানা হারিয়েট লিউনাউসের বর্ণনায় মেলে উনিশ শতকের অভিজাত মুসলিম মেয়েদের বিয়ের সাজের নিখুঁত বিবরণ। তখনো খানদানি পরিবারগুলোতে সাবেকি ধারার প্রচলন ছিল পুরো মাত্রায়। তাই জাঁকজমকের প্রাচুর্যের পষ্টতা বিবরণের প্রতিটি অংশে। মোগল যুগের আড়ম্বর যেন পরবর্তীকালের নারীদের সাজসজ্জাকে সম্পূর্ণভাবে প্রভাবিত করে রেখেছিল। একই সঙ্গে সবকিছুকে সোনাদানা, রং, কারুকাজ দিয়ে ভরিয়ে দেওয়ার প্রবণতার কথা ছিল অ্যানার সেই বিবরণে। ঘাঘরা, কুর্তা বা কাঁচুলিতে জরির সঙ্গে জড়োয়া পাথর ছাড়াও মুক্তার সারি বসানোর চল ছিল। আর চুলে, কপালে ও জুতায় জড়ানো সোনা, তার ওপর পুরো সাজের ওপর স্বচ্ছ সোনা রঙের ওড়নার আড়াল—আড়ম্বরের এতটুকুও কমতি ছিল না যেন কোথাও। মোগল হারেম সংস্কৃতিতে এমন বাড়াবাড়ি বরাবরই চোখে পড়ত। আড়ম্বরপ্রিয় মোগলদের এই সাজসজ্জাই অভিজাত সমাজে গৃহীত হতে শুরু করে ফ্যাশন হিসেবে। প্রভাবিত হতে শুরু করেন রাজস্থান, গুজরাটসহ নানা অঞ্চলের নারীরা।
মোগল আমলে এমন চোখধাঁধানো আড়ম্বরের মধ্যেও নারীর সাজকে রুচিসম্মত করে তুলতে সদা সচেষ্ট ছিলেন নূরজাহান। তার এবং তার সময়কার সাজ প্রসাধনে ফুল, কচি পাতা, আধফোটা ফুলের কুঁড়ি বা পদ্মের মৃণাল অলংকার হিসেবে গৃহীত হয়নি। এর বদলে নূরজাহানের আমলে ব্যবহার শুরু হয় সোনা অথবা হীরায় জড়ানো ফুলের। এ ছাড়া দামি পাথর বসানো রুপার ফুল আর জরির ফুলেরও কদর বাড়ে। নূরজাহানের হাত ধরে হারেমে প্রবেশ করে রাজপুতানা ধারার পোশাক। প্রমাণ? নূরজাহানের সে সময়কার ছবিতে। যেখানে তাকে দেখা গেছে ডোরাকাটা পাজামার ওপর খাটো জামা পরনে, যা কাঁচুলি আর কুর্তার সমন্বয়ে তৈরি। সঙ্গে মসলিনের পেশওয়াজ। কাংড়ার মেয়েরা পরতেন এমন লম্বা চোলি, যার আস্তিনটা কবজি ছুঁতো। এ ছাড়া নূরজাহান জনপ্রিয় করে তোলেন জাঙ্গুলি নামের একধরনের জামা—লম্বায় হাঁটু অব্দি, সামনে-পেছনে হীরা-জহরতের ছড়াছড়ি।
নূরজাহানের অতিরিক্ত আড়ম্বরে অনীহার প্রমাণ মিলেছে বারবার। বার্নিয়েরের বর্ণনা থেকে জানা যায়, নূরজাহানের সময় মোগল হারেমের পোশাক এত সূক্ষ্মভাবে তৈরি করা হতো যে কোনো কোনোটি এক রাতের বেশি ব্যবহারের জো ছিল না। সেই পোশাকে থাকত সোনার ঝালর, সূক্ষ্ম নকশা, রেশমের ফুল, জরির কাজ। নূরজাহান নিজে আবিষ্কার করেছিলেন অনেক ধরনের নকশা। কিনারি বা লেস, এ ছাড়া পাঁচতোলিয়া ওড়না, দুদামী পেশওয়াজ, বাদলা বা একধরনের কম দামি জরি—সবই তার সৃষ্টি। আতর ই জাহাঙ্গীরী তৈরির জাদুকরও এই সম্রাজ্ঞী। নূরজাহান বরাবরই পোশাকের ওপর সূক্ষ্ম কাজ পছন্দ করতেন। অনেক ইতিহাসবিদের তাই মত, চিকনকারীর নকশাও তারই আবিষ্কার। শোনা কথা, অন্যান্য জিনিসের মতো বোতামের আবিষ্কর্ত্রীও তিনি। এ নিয়ে গল্পও প্রচলিত আছে। মোগল সম্রাজ্ঞীদের মধ্যে একমাত্র নূরজাহানই রাজসভায় যেতেন। একদিন রাজদরবারে যাওয়ার আগে উপযুক্ত বেশবাস সম্পূর্ণ হওয়ার পর দেখা গেল, তার পোশাকের এক জায়গায় ফিতা বসাতে ভুলে গেছে দর্জি। এবার বুঝি কার গর্দান গেল! নূরজাহানের এক প্রত্যুৎপন্নমতি পরিচারিকা নিজের কান থেকে সোনার ঝুমকো দেওয়া কুন্ডলটি খুলে সেটা দিয়ে আটকে দিলেন জামার দুটি প্রান্তভাগ। মুগ্ধ হলেন নূরজাহান। ফরমান জারি হলো তার সব পোশাকে ফিতা বা পার্টির বদলে এই নতুন জিনিস লাগানো হবে। আর যে পরিচারিকার কল্পনা থেকে এটি উদ্ভূত হয়েছিল, তাকে শুধু পারিতোষিকই দিলেন না, তার নামেই এর নামকরণ হলো বাট্টান। প্রসাধনে নূরজাহানের অসামান্য আবিষ্কার আতর।
তাহলে কী বোঝা গেল?
নূরজাহান স্বামীর সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে শুধু রাজ্য পাট, বিচারকার্য আর ঢাল-তরবারি সামলাননি; নকশা করেছেন পোশাক, বাগান এমনকি নজরকাড়া সব মোগল স্থাপত্য। অস্বস্তিকর অতীতের ছায়া নিয়েও জায়গা করে নিয়েছেন মোগলদের মাঝে। পুরুষপ্রধান রাজদরবারে আদায় করে নিয়েছেন সম-অধিকার। এমন সাহসী, স্বাধীনচেতা, শক্তির আধার নূরজাহানকে তো বলাই যায়—দ্য মোগল ফেমিনিস্ট আইকন।

দায়-স্বীকার: আবরণে-আভরণে ভারতীয় নারী/ চিত্রা দেব
মডেল: মীম মানতাসা
মেকওভার: পারসোনা
কনসেপ্ট ও স্টাইলিং: নুজহাত খান
ওয়্যারড্রোব: সাফিয়া সাথী
জুয়েলারি: রঙবতী
ছবি: কৌশিক ইকবাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top