skip to Main Content

আলাপন I ‘আমরা চাইনি অনেক কিছু’

বিচ্ছিন্নতার নাগরিক পরিসরে যৌথযাপনের একটি চালচিত্র। একে অন্যের সুখ-দুঃখের ভাগীদার হয়ে সুখে ঘরকন্না করে চলেছেন ভাস্কর বন্দ্যোপাধায় ও শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায়। একজন প্রসিদ্ধ আবৃত্তিশিল্পী, নাট্য নির্দেশক ও অভিনেতা; আরেকজন বরেণ্য নৃত্যশিল্পী। তাঁদের সুখীগৃহকোণে কিছু মুহূর্ত অতিবাহিত করে সংসারের রঙবাহার আর মায়ার বন্ধনের চিত্রমালা তুলে ধরলেন রানা আহমেদ

জীবনযাপনে তাঁরা সাধারণ, কিন্তু শৈল্পিক। বসবার ঘরে নানা রকম ছোট-বড় স্ট্যাচু, পিতলের ঘণ্টা, কিছু স্মরণীয় মুহূর্তের ছবি। একটা ছবিতে এসে চোখ আটকে গেল- ইন্দিরা গান্ধীর কাছ থেকে মেডেল নিচ্ছেন শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায়। ভেতরের ঘর থেকে নাচের মহড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে। বাইরে কবিতার বই হাতে ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায় দরাজ কণ্ঠে আবৃত্তি করছেন
‘হে উদাসীন পৃথিবী,
আমাকে সম্পূর্ণ ভোলবার আগে
তোমার নির্মম পদপ্রান্তে
আজ রেখে যাই আমার প্রণতি…’
এমনি করেই নাচ আর কবিতায় মাখামাখি করে কেটে গেছে ৩১ বছর।
শুরুটা করলেন শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায়।
-আমরা দুজনেই তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি, তখন সংস্কৃতি সংসদ বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক সক্রিয় ছিল। আমি নাচ করতাম, ও আবৃত্তি করতো। এই উপলক্ষে দেখা হতো, চিনতাম দুজন দুজনকে। কিন্তু খুব একটা কথা হতো না।
একবার হলো কি, আমরা দুজনেই ভারতের আইসিসিআর স্কলারশিপের জন্য আবেদন করতে গিয়েছি শিল্পকলায়। আমি আমার ফরমটা হারিয়ে ফেলেছি, ও আমাকে হাতে লিখে আবেদনপত্র তৈরি করে জমা দিতে সাহায্য করে। তখন থেকেই আসলে পরিচয়টা যেন একটু গভীরতা পেল।
পাশে বসা ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, তারপর থেকে কিছু একটা ভেতরে কাজ করতো। ঠিক প্রেম নয়, কিন্তু শুধু পরিচিতের জন্য যে অনুভূতি, এটা তার থেকে আলাদা।
এরপর আমরা স্কলারশিপ নিয়ে ভারতে চলে যাই একসঙ্গেই। কিন্তু আমি শান্তিনিকেতনে, ভাস্বর দিল্লিতে।
সেখানে থাকার সময় আমাকে মাঝে মাঝে চিঠি লিখেছে, কিন্তু তা প্রেমপত্র নয়, এমনি ভালোমন্দ খবর নেওয়ার জন্য।
আমরা যখন ফিরে আসি, সময়টা ১৯৮২।
আমরা রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদের সদস্য ছিলাম। ১৯৮৩-তে সম্মেলনে আমরা অংশগ্রহণ করি। সেখানে ওয়াহিদুল হক প্রথম বলেন আমাদের এক করার কথা। আমি বলেছিলাম, দেখুন, আমি আসলে এখন নাচ ছাড়া অন্য কিছু ভাবছিই না। তবু তিনি দুই পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছিলেন।
এর মধ্যে ভাস্বরের বাবা মারা যান বলে বিয়ের কথা আর এগোয়নি। ভাস্বর বলতে থাকেন।
-আমি আবার স্কলারশিপ নিয়ে বাইরে চলে যাই। ও নানা কাজে নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আমি যখন ফিরে আসি সাতাশিতে, তখন আবার আমাদের বিয়ের কথাটি পরিবারের সবার মনে এলো। তখন খুব দ্রুত কাজটি হয়ে গেল।
২০ ফেব্রুয়ারি এনগেজমেন্ট, ৭ মার্চ বিয়ে। এর আগে অবশ্য আমরা দুজন বসে কথা বলি, যেহেতু আমাদের প্রেমের সম্পর্ক ছিল না, তাই কথা বলে দুজনেই ফাইনালি সিদ্ধান্তে আসি, হ্যাঁ, হতে পারে। তবে পুরো বিষয়টা পারিবারিকভাবেই হয়েছিল।
সেই থেকে চলছে ৩১ বছর।
আলাদা শিল্পমাধ্যমে কাজ করেন বলে কি কোনো সমস্যা হয় বোঝাপড়ায়? উত্তরে খুব জোর দিয়েই বললেন ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়, না, বরং অনেক সুবিধা হয়। আসলে নাচ এবং আবৃত্তি কিংবা নাটক আলাদা মাধ্যম হলেও অনেক ক্ষেত্রেই একে অপরের সঙ্গে যুক্ত গভীরভাবে।
আমি ওর নাচের অনুষ্ঠানের সেট ও লাইটিংয়ে কাজ করে আসছি শুরু থেকেই। আবার এমন হয়েছে অনেক, কবিতার সঙ্গে নাচের যুগলবন্দি, অনেক নাচের প্রযোজনায় আমি ধারাবর্ণনা করেছি। তাই আলাদা একেবারে বলা যাবে না। তা ছাড়া সামনে একটা অনুষ্ঠানের কথা ভাবছি- নৃত্যাবৃত্তি; কবিতার সঙ্গে নাচ…
এটা তো গেল কাজের কথা, সংসারে এসেও অনেক বিষয়ে নিজেদের কৈফিয়ত দেবার যে বিষয় থাকে, সেটা দিতে হয় না বললেন শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায়।
আগে তো মোবাইল ছিল না, হঠাৎ আমার কোনো অনুষ্ঠান বা মহড়ায় যেতে হলে টেবিলে একটা চিরকুট লিখে চলে যেতাম। ওর ক্ষেত্রেও তাই হতো।
এমন তো প্রায়ই হয়, যেকোনো অনুষ্ঠানে একসঙ্গেই যাচ্ছি আমরা। ও আবৃত্তি কিংবা নাটক নিয়ে, আমি নাচ নিয়ে।
আসলে দুজনের বোঝাপড়াটা খুব জরুরি। এটা থাকলে কোনো সমস্যা হয় না।
তবে আমি শুরু থেকেই বুঝে গেছি, ভাস্বর খুব মনভোলা মানুষ। এমন হয়েছে, সে রাত ১০টায় বাসায় এসেছে, কথা ছিল বাজার নিয়ে আসবে, কিন্তু দেখা গেল খালি হাতে এসে বসে আছে। আমি জিজ্ঞেস না করা পর্যন্ত মনেই হয়নি তার বাজার আনার কথা।
ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায় বলে উঠলেন, হ্যাঁ, এই দিকটা আমার আছে, শর্মিলাই সব সামলে রাখে। আমার জামাকাপড় কেনা থেকে শুরু করে কোথায় কবে কোন জামাটা পরবো- সবকিছু একাই করে।
শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায় শুনছিলেন। ভাস্বর বলে উঠলেন, আসলে পোশাকের ব্যাপারে আমি একটু বেশি খুঁতখুঁতে। আমাদের একসঙ্গে অনেক অনুষ্ঠানে যেতে হয়, তাই আমার পোশাকের সঙ্গে মিলিয়ে ওর জামা বা পাঞ্জাবি আমিই কিনি।
ও আমাকে কোনো এক জন্মদিনে প্রথম বই কিনে দিয়েছিল। সেটাই আমাকে দেওয়া ওর প্রথম উপহার। এরপর মনে হয় একবার শাড়ি কিনে দিয়েছিল…
ভালো থাকার মন্ত্র কী? এই প্রশ্নে ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, আসলে দুজন মানুষ সম্পূর্ণ আলাদা পরিবার, সমাজ, সংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠে। মতের অমিল, পছন্দে ভিন্নতা- এসব তো থাকবেই। তবে কেউ যদি কমপ্রোমাইজ করতে না জানে, না পারে, তার জন্য একসঙ্গে থাকা কঠিন। আমি তো মনে করি, এই ভিন্নতাই একজন মানুষের পরিচয়। কিন্তু আমি যার সঙ্গে সংসার করছি, আমার ভালো-মন্দ সবকিছু যে সহ্য করছে, তার মতামতকে যদি আমি গুরুত্ব না দিই, তাহলে তো চলবে না। আর এটাই হলো ভালো থাকার, ভালো রাখার একমাত্র উপায়।
এখন তো একটু এদিক-সেদিক হলেই সংসার ভেঙে দিচ্ছে অনেকেই। আমরা তো আমাদের বাবা-মাকে দেখে শিখেছি, তারা একে অপরের সঙ্গে কেমন আচরণ করতো, সেটা আমাদের অনুপ্রাণিত করে। আমরা ভাগ্যবান যে কখনো আমাদের অন্য চিন্তা করতে হয়নি। আমার যদি কোনো কারণে ওর কাছে দুঃখ প্রকাশ কিংবা ক্ষমা চাইতে হয় কোনো ভুলের জন্য, তাতে তো দোষের কিছু নেই। আমি তো বাইরের কারও কাছে তা করছি না, আমার সবচেয়ে আপন মানুষটির কাছে করছি।
শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায় যোগ করেন, অমিল হবেই, এমন কেউ নেই যে বলতে পারেন তাদের কোনো বিষয়ে অমিল নেই। ভাই-বোনের মধ্যেই তো পছন্দে অমিল থাকে, মতে ভিন্নতা থাকে আর দুই পরিবারের দুজন মানুষে তো থাকবেই। তবে সবকিছু বিবেচনা করে চলতে হয়। সুন্দরভাবে থাকার ইচ্ছাই মানুষকে ভালো রাখে। দোষ-ত্রুটি তো থাকবেই। একসঙ্গে থাকবো, ভালো-মন্দ মিলিয়েই থাকবো- এই কথা মনে রাখি।
পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে সম্পর্কের জায়গাটিও খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমার তো বিয়ের পর থেকেই ওর পরিবারের কাউকে আলাদা মনে হয়নি। ওর দিদি মানে আমারও দিদি, ওর দাদা মানে আমারও দাদা। আমাকেও তারা সবাই খুব আপন করে নিয়েছিল। এই সম্পর্কটাকে যত্ন করে এগিয়ে নিয়ে চলি।
আমার কাজকে ও শ্রদ্ধা করে, আমিও ওর কাজকে ভালোবাসি। আর ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায় একজন সহজ-সরল ভালো মানুষ। এই সিমপ্লিসিটি সারা জীবন বজায় রাখা একটা বড় গুণ। অনেক ত্রুটি আড়াল হয়ে যায় ওর এই সিম্পলিসিটির জন্য। ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায় একজন নাট্যনির্দেশক, অভিনেতা ও আবৃত্তিশিল্পী, কিন্তু আমার ওকে আবৃত্তিশিল্পী হিসেবে ভাবতেই বেশি ভালো লাগে। কারণ, আমার মনে হয় ওর সবচেয়ে ভালোবাসার জায়গা আবৃত্তি এবং ওর সংগঠন কথা আবৃত্তি চর্চাকেন্দ্র। যদিও সে নাটকে অনেক ভালো কাজ করেছে। পিএইচডিটাও করেছে নাট্যশাস্ত্রে…
ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায় কথা এমনিতেই একটু কম বলেন। এতক্ষণ শুনছিলেন সবচেয়ে কাছের মানুষের বয়ান।
এবার শুরু করলেন তিনি, আমরা আসলে অনেক কিছু চাইনি, এই না চাওয়াটাই আমাদের ভালো রাখে। আমি শর্মিলাকে ধন্যবাদ দেবো এই জন্য।
স্ত্রী হিসেবে তাঁর সব দায়িত্ব সে ঠিক ঠিক পালন করেছে।
ওঁর নাচের স্কুলের ত্রিশ বছর হলো। নিজে অনেক অনুষ্ঠান করে, বাচ্চাদের শেখায়, সন্তানের খেয়াল রাখে। শুধু নিজের কথা চিন্তা না করে নাচকে সামগ্রিকভাবে একটা সম্মানজনক জায়গায় নিয়ে যাওয়াই তার ভাবনাজুড়ে। কয়েকটা কর্মশালা করেছে, যেখানে সারা দেশ থেকে অনেকেই অংশ নিয়েছে। আমার মনে পড়ে, আমাদের সন্তান জন্মের কিছুদিন আগে যখন স্বাভাবিকভাবেই ও নাচতে পারতো না, কিন্তু বসে বসে হাতের ইশারায় সবাইকে নাচের নির্দেশনা দিয়েছে।
আমাদের একমাত্র সন্তান তাথৈ মায়ের অনুসারী হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অ্যানথ্রোপলজিতে মাস্টার্স শেষ করে শান্তিনিকেতনে গিয়েছিল নাচের ওপর পড়াশোনা করতে। সেখানে নাচের দশটা বিভাগের মধ্যে সে প্রথম হয়েছে। আমাদের ইচ্ছা মায়ের মতো সেও নাচ করবে, শেখাবে। দেয়ালের সেই ছবিটার দিকে তাকিয়ে ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায় যেন একটু আনমনা হয়ে গেলেন। কিছুটা সময় নিয়ে বললেন, স্বপ্ন দেখি তাথৈ ওর মায়ের মতো মেডেল নেবে। দেয়ালের ওই ছবির পাশে সেই ছবিটাও এই ঘরের শোভা বাড়াবে একদিন।
সেদিন হয়তো খুব দূরে নয়। এরই মধ্যে অভিনয় করেছে কলকাতার বিখ্যাত পরিচালক গৌতম ঘোষের লালন ফকিরের জীবন ও কর্মের ওপর নির্মিত ‘মনের মানুষ’ চলচ্চিত্রে। তবু তাঁর ধ্যানজ্ঞান- সবই নাচকে ঘিরে।
শিল্পের সংসারে শিল্প হয়েই ভালোবাসা বয়ে চলছে, বেড়ে উঠছে। ঘুরেফিরে একটি কথাই মনে আসছে বারবার, ‘আমরা অনেক কিছু চাইনি, এই না চাওয়াই আমাদের ভালো রেখেছে।’
অন্তহীন চাওয়ার এই পৃথিবীতে এই অল্পে খুশি মানুষ আজ খুব একটা মেলে না। কিছু মানুষের অতি সাধারণ থাকার চেষ্টাই তাদের অসাধারণ করে তোলে।

ছবি: ফয়সাল সুমন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top