skip to Main Content

আলাপন I পিতৃতন্ত্রের বিপরীতে আমরা মাতৃতন্ত্র চাই না—খুশী কবির

 

পাঁচ দশক ধরে নারীর মুক্তি ও উন্নয়নে তিনি কাজ করে চলেছেন। যদিও তার প্রত্যয়—প্রকৃত মানবমুক্তির মধ্যেই নারীর স্বাধীনতা নিহিত। এটি একটি চলিষ্ণু প্রক্রিয়া। এই আলাপে তার সঙ্গে অংশ নিয়েছেন আশরাফুল হক

ক্যানভাস: উন্নয়নের অংশীদার হিসেবে নারীর যে ভূমিকা, তা গতিশীল করার জন্য একটি সংগঠনের প্রয়োজন, আপনি কখন থেকে সেটি অনুভব করা শুরু করেছিলেন?
খুশী কবির: স্বাধীনতাযুদ্ধের পরপর যখন এ দেশ গড়ার কাজ শুরু হয়েছিল, তখন আমি একটা বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে যোগ দিয়েছিলাম। সেখানে আমার মতো আরও অনেকেই ছিলেন। আমরা সবাই মিলে ’৮০ সালে এটা শুরু করি। শ্রেণি ও পুরুষতন্ত্রের শোষণ—দুটিকেই এর মাধ্যমে আমরা ভাঙার চেষ্টা করছি। ‘নিজেরা করি’ যে শুধু নারী উন্নয়নের জন্যই কাজ করছে তা নয়। আমরা গ্রামাঞ্চলেই বেশি কাজ করি। যারা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী, সুবিধাবঞ্চিত এবং একেবারে প্রান্তিক, তাদের মুক্তির লক্ষ্যে কাজ করে। আমাদের বৈষম্যমূলক যে সমাজ আছে সেটি এবং পিতৃতন্ত্র—এ দুটি আমাদের চিন্তা-চেতনা, চলাফেরা, সবকিছুকেই নিয়ন্ত্রণ করছে। আশপাশের মানুষ নারীকে ভিন্নভাবে দেখে। সেটা বাসে চলাফেরা হোক, রাস্তাঘাটে হোক কিংবা বাজারে—সব জায়গাতেই কিন্তু নারীকে সমস্যায় পড়তে হয়। যৌন হয়রানি, চিমটি কাটা কিংবা একটা বাজে মন্তব্য—এসবের শিকার নারীরা হয়েছে। নারীকে বাসে উঠতে দেওয়া হবে না—এ রকম তো হয়েছে।
ক্যানভাস: রাস্তাঘাট ছাড়াও বাড়িতে নারীর প্রতি যে সন্ত্রাস, এ বিষয়ে আপনি কিছু বলুন…
খুশী কবির: ডমেস্টিক ভায়োলেন্স তো অহরহ হচ্ছে। কিন্তু কেটে যাওয়া, গুরুতর আঘাত পাওয়া, অর্থাৎ খুব সিরিয়াস জখমকেই কেবল নারীরা মারধর মনে করে। এমনি যে চড়-থাপ্পড়, সেটাকে স্বাভাবিক ভাবে। সেটাকে ভায়োলেন্স হিসেবে দেখে না। এই জিনিসটাও ভাঙতে হচ্ছে আমাদের। নারী যদি নিজের পায়ে দাঁড়ায়, সচ্ছল হয়, সে যদি লেখাপড়া করে, তাহলে এগুলো কমে যাবে। তবে শুধু শিক্ষা গ্রহণই নয়, নিজেকে ব্যক্তি হিসেবে চিন্তা করতে হবে, নারীর নিজেরও যে একটি সত্তা আছে, তা চিন্তা করতে শিখতে হবে।
ক্যানভাস: এই অঞ্চলে নারীবাদ মূল জায়গা থেকে সরে এসেছে, অনেকেই এ রকম বলছেন। একটি জরিপে দেখা গেছে, নারী ও পুরুষের সম্মিলিত পরিশ্রমের বেশির ভাগই করে নারী, কিন্তু সেই অনুযায়ী নারীর আয় নগণ্য আর সম্পত্তি প্রায় শূন্য। এই জায়গায় কাজ না করে নারীরা অন্য জায়গায় কাজ করছে। যেমন তারা এখন যৌন স্বাধীনতার ওপরে বেশি জোর দিচ্ছে বলে অনেকেরই ধারণা।
খুশী কবির: সব মতাদর্শেই তো ভাগ আছে। নারীবাদেও সেই ভাগগুলো আছে। একদম প্রথম থেকেই। উদারপন্থী নারীবাদী, উগ্র নারীবাদী—অনেকে উগ্র বলে শব্দটা। তারা মনে করে, পুরুষই হচ্ছে তাদের শত্রু। ইকোফেমিনিস্ট আছে, সমাজতান্ত্রিক নারীবাদী আছে, মার্ক্সবাদী নারীবাদী আছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে আমি উগ্র-নারীবাদী বেশি দেখি না। একদম নেই তা, এটা বলব না। তবে সংখ্যায় কম। মূল কথা হচ্ছে, পিতৃতন্ত্রের বিপরীতে আমরা মাতৃতন্ত্র চাই না। আমরা দেখতে চাই সমতা। আসলে যে বিষয়গুলো একটু চমক দেয়, যা চটকদার, সেগুলো প্রকাশ পায় বেশি। ‘পুরুষরা যদি যেমন ইচ্ছা প্রেম করতে পারে, নারী কেন করতে পারবে না’—এটা খুব চমক দেওয়া বিষয়। তবে আপনি যেটা বলছেন, সাংগঠনিকভাবে আমি তা হতে দেখিনি।
ক্যানভাস: নারীবাদের প্রধান যে দুটি বিষয়, কণ্ঠস্বরের স্বাতন্ত্র্য এবং লৈঙ্গিক রাজনীতি। বলা হচ্ছে, নারীর কণ্ঠস্বর নারীরই হবে, পুরুষের চাপিয়ে দেওয়া কণ্ঠস্বরে নারী কথা বলবে না। কণ্ঠস্বর বলতে শাব্দিক অর্থে কণ্ঠস্বর বলা হচ্ছে না, নারীর আচরণও তার কণ্ঠস্বর। আজকাল নারীর লাইফস্টাইলে হিজাব প্রবলভাবে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। এটা পুরুষতন্ত্র চায়। সেই নারীরা চাকরি করছেন, নিজেদের দাবি করছেন তারা মডার্ন মুসলিম। বেগম রোকেয়া যেখানে পর্দাপ্রথার বিরুদ্ধে কথা বলছেন, যদিও তিনি কৌশলগত কারণে নিজেও পর্দা করেছেন, এখন তো সেই কৌশলের দিন ফুরিয়ে গেছে। এখন কেন সেটা হচ্ছে?
খুশী কবির: রাষ্ট্রের আইনগুলো হচ্ছে পুরুষতান্ত্রিক। অনেকেই বলেন, দেশের প্রধানমন্ত্রী নারী। প্রধানমন্ত্রী নারী হলেও ব্যবস্থা তো পুরুষতান্ত্রিক। নারী হলেই যে সে নারীবাদী হবে, তা কিন্তু নয়। আবার পুরুষ হলেই যে সে নারীবাদী নয়, সেটাও নয়। হিজাব মালয়েশিয়াতে আছে, আফ্রিকার কয়েকটি দেশে আছে। তারা কোরআনকে বিশ্লেষণ করছে একটা নারীবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে। যেমন পর্দা। পর্দা সম্পর্কে যে আয়াত এসেছে, তা কেন এসেছে, কখন এসেছে—এটা নিয়ে বেশ কয়েকটি লেখা আছে। পর্দার ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে, নারীর নিজের জায়গা ও পাবলিক জায়গার মধ্যে একটা পর্দা থাকা উচিত। যাতে যেকোনো পুরুষ কোনো নারীর ব্যক্তিগত জায়গায় না ঢুকতে পারে। এ কারণে এই শব্দটা এসেছে। কিন্তু বলা হয়নি যে পাবলিক স্ফেয়ারে যাওয়া যাবে না। পর্দার সংজ্ঞাটা এসেছে পাবলিক আর প্রাইভেট স্ফেয়ারের পার্থক্য করার জন্য। এখন যে হিজাব পরা হচ্ছে, হিজাবেরও অর্থ হচ্ছে পর্দা। এখন এটাকে আমরা পোশাক মনে করি। এই পোশাক এসেছে ওয়াহাবিদের মাধ্যমে। হিজাব বেড়ে যাওয়া হচ্ছে ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়াহাবি কালচারটা নিয়ে আসা। শুধু পুরুষেরাই চায় না যে নারীরা হিজাব পরুক; অনেক নারীরাও তা চায়। অনেকে বলেন, এটি পরে তিনি নিরাপদ বোধ করেন, রাস্তায় সমস্যা হয় না, সমাজ তাকে খারাপ মনে করে না। কিন্তু হিজাব পরেও তো মেয়েদের রক্ষা করা যাচ্ছে না। অনেক মেয়ে হিজাব পরেও ধর্ষণের শিকার হচ্ছে; হত্যা করা হয়েছে। মাদ্রাসার ছাত্রী, যারা বোরকা পরে, তারাও ধর্ষণের শিকার হয়েছে, খুনও হয়েছে। পোশাকের সঙ্গে ধর্ষণের কোনো সম্পর্ক নেই; নারীকে উত্ত্যক্ত করারও কোনো সম্পর্ক নেই।
ক্যানভাস: অন্তত পাঁচটি দশকে নারীর অবস্থা আপনি দেখেছেন। এখনকার পরিস্থিতি কী?
খুশী কবির: আমার পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, গ্রামীণ নারী, অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে যাদের গ্রহণই করা হয় না, তারা নতুন চিন্তাভাবনা করা শুরু করেছে এবং নিজেদের সত্তাকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য কাজ করছে।
ক্যানভাস: বিভিন্ন জায়গায় পুলিশি অভিযান হয়; মেয়েদের ধরে। কিন্তু পুরুষটিকে ধরা হচ্ছে না, তাদেরকে দেখানো হচ্ছে না…
খুশী কবির: পুরুষকেও ধরে। নিয়ে আসে। কিন্তু মিডিয়া সেই দিকটা নিয়ে আসছে না। যখন মাদকের কোনো গডফাদারকে ধরে নেওয়া হয়, তার সঙ্গে যখন কোনো নারী থাকে, সেটা প্রকাশ পায়। কিন্তু পুরুষের ক্ষেত্রে তেমনটা হয় না। হয়তো মাদক ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ওই নারী একজন পুরুষের অধীনেই এই ব্যবসা করছে। আমি এই ব্যবসার পক্ষে বলছি না। আমি বলছি মিডিয়ায় কীভাবে নিয়ে আসা হয় সে বিষয়ে।
ক্যানভাস: গ্রামে খুব রক্ষণশীল সমাজের মধ্যে আপনি কাজ করেছেন। এই রক্ষণশীলতা আপনার সামনে কখনো উপদ্রব বা বাধা হিসেবে এসেছে?
খুশী কবির: না, বাধা হিসেবে আসেনি। তবে প্রথম দিকে তারা আমাকে তাদের বাড়ির নারী হিসেবে দেখেনি। তারা ভাবত আমি শহুরে। পুরুষেরা আমাকে পুরুষ হিসেবে দেখত। তবে আমার সুবিধা হয়েছে, নারীরা তাদের ঘরের প্রতিটি বিষয় আমার সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করত। পুরুষেরাও আমার সঙ্গে সবকিছু আলোচনা করত। আমাকে গ্রহণ করেনি কোথাও, এমন হয়নি।
ক্যানভাস: আপনার পাঠাভ্যাস সম্পর্কে জানতে চাই…
খুশী কবির: পাঠাভ্যাস এখনো আছে। আমি চেষ্টা করি নতুন লেখকেরা কীভাবে লিখছে সেটা পড়তে। খুব হালকা লেখা আমার পছন্দ নয়। আমি যখন বই পড়ি তখন বইয়ের সঙ্গে আমার কথোপকথন হয়। বইয়ের চরিত্র বা বইয়ের বিষয় নিয়ে আমি খুব চিন্তা করি।
ক্যানভাস: নারীবাদী লেখকদের মধ্যে কাকে পছন্দ?
খুশী কবির: যদি বাঙালি নারীবাদী লেখকদের কথা বলি, শাহীন আখতারকে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করি। তসলিমা নাসরিনের কবিতা আমার খুব ভালো লাগে।
ক্যানভাস: অবকাশ মিললে, মানে ছুটির দিনে আপনি কী করেন?
খুশী কবির: আমার তো অবসর নেই। বাড়িতে আমার সহকারী বলে, ‘আপা, আপনি তো দেখি শুক্রবার-শনিবারে সবচেয়ে বেশি ব্যস্ত থাকেন।’ আসলে যত মিটিং বা প্রোগ্রাম করা হয়, তা শুক্র ও শনিবারেই হয়। সকাল থেকেই ফোন আসতে থাকে। যার যা কিছু দরকার, সে বিষয়ে কথা বলে। রাতেও ফোন আসে। আমি যেহেতু বই পড়তে পছন্দ করি, তাই যখন সুযোগ পাই, বই পড়ি। ভালো চলচ্চিত্র দেখতে পছন্দ করি; যদিও সময় পাই না। ভালো নাটক দেখতে পছন্দ করি। আমি আর্ট এক্সিবিশনগুলোতে খুব যাই।
ক্যানভাস: সামনের দিনগুলোতে আপনার পরিকল্পনা কী?
খুশী কবির: নতুন প্রজন্ম যাতে আরও বেশি করে মুক্তমনে চিন্তা করতে পারে। সে বিষয়ে কাজ করে যেতে চাই।
ক্যানভাস: নারীর সত্যিকারের মুক্তি কী করে সম্ভব?
খুশী কবির: নারীর মুক্তি একটা চলমান প্রক্রিয়া। কোনো জিনিসই হুট করে মুক্ত হয়ে যায় না। মুক্তি হচ্ছে আজীবনের একটি সংগ্রাম। সংগ্রামটা চলতেই থাকবে এবং চলতেই হবে। যখনই কেউ মনে করে যে আমি একটি জিনিস অর্জন করে ফেলেছি, এখন আমি একটু বিশ্রাম নিই, এটা ভুল। সংগ্রামটা সর্বক্ষণ সর্বযুগে যেন চলমান থাকে, সেটা নিশ্চিত করা সবার দায়িত্ব।

ছবি: সৈয়দ অয়ন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top