skip to Main Content

এডিটরস কলাম I নিজেকে জানতে হবে

জগৎ ও জীবন চলে প্রয়োজন মেনেই এবং মানুষের মধ্যকার বেশির ভাগ যোগাযোগই প্রয়োজনভিত্তিক। এর ঊর্ধ্বে উঠতে না পারলে সম্পর্ক গড়ে ওঠে না। টিকে থাকার জন্য আমাদের পারস্পরিক যোগাযোগ খুব দরকার; কিন্তু সম্পর্ক আরও বেশি জরুরি, তাতে যোগাযোগ কেবল স্থায়িত্ব অর্জন করে না, মানবিক অনুভূতি জাগরূক থাকে, চিত্ত উদার হয়ে ওঠে, দায়িত্বশীলতা সঞ্চারিত হয় সমাজে

আমরা অনেক দূর এগিয়ে গেছি। প্রসারিত করেছি নিজেদের জগৎ। এটা সম্ভব হয়েছে প্রযুক্তির কল্যাণে। কিন্তু কোথায় যেন ফাঁক রয়ে গেছে বলে আমার মনে হয়। ফাঁদও তো কম নয়। এই যে দুঃসংবাদগুলো পাই প্রতিদিন খবরের কাগজে, টিভিতে, অনলাইন ও সোশ্যাল মিডিয়ায়— সেসব নিয়ে একটু ভাবলে যেকোনো সচেতন ব্যক্তিরই মনে প্রশ্ন জাগবে, দৃশ্যমান উন্নতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চেতন-অবচেতন আর মানবিক মূল্যবোধের সামূহিক উন্নতি আমাদের ঘটেছে কি? কত কিছু আমরা জানি, কত দিকে আমাদের যোগাযোগ, কিন্তু কোথায় যেন ঠেকে যাচ্ছি। আমাদের বেদনা কমছে না।
কেন? আমরা তো বিচ্ছিন্ন নই শেষ পর্যন্ত। ব্যক্তিক, পারিবারিক, সামাজিক, দৈশিক, এমনকি বৈশ্বিক যোগাযোগের মধ্যেই আমরা রয়েছি। বলা যায়, এখন মানুষ যতটা ব্যক্তিক, ততটা বৈশ্বিক। পৃথিবীজুড়ে মানুষ একে অন্যের সঙ্গে তাৎক্ষণিক যোগাযোগের বেশ কিছু ব্যবস্থা করে নিয়েছে। সেসব যথেষ্ট কাজে লাগছে। কিন্তু প্রায়ই অনুভব করি, সবই মানুষের হাতের মুঠোয় এলেও, তারা পরস্পর দূরে সরে যাচ্ছে। আমার এক বন্ধু ঠাট্টা করে বলে, এখন মানুষের মধ্যে যোগাযোগটা খুব সহজ, কিন্তু সম্পর্ক কঠিন। কখনো কখনো আরও চড়া করে বলে— যোগাযোগ আছে, সম্পর্ক নেই। সে যে কথাচ্ছলে কত গভীর একটা সত্য বলে দিল, তা ভেবে ইদানীং বিহ্বল হয়ে যাই। এটা ঠিক, জগৎ ও জীবন চলে প্রয়োজন মেনেই এবং মানুষের মধ্যকার বেশির ভাগ যোগাযোগই প্রয়োজনভিত্তিক। এর ঊর্ধ্বে উঠতে না পারলে সম্পর্ক গড়ে ওঠে না। টিকে থাকার জন্য আমাদের পারস্পরিক যোগাযোগ খুব দরকার; কিন্তু সম্পর্ক আরও বেশি জরুরি, তাতে যোগাযোগ কেবল স্থায়িত্ব অর্জন করে না, মানবিক অনুভূতি জাগরূক থাকে, চিত্ত উদার হয়ে ওঠে, দায়িত্বশীলতা সঞ্চারিত হয় সমাজে। আত্মসর্বস্ব ও স্বার্থকেন্দ্রিক মানুষের সমাজে লোভ, হিংসা, সন্দেহ, ভয় থাকবেই। সেখানে সত্যের চেয়ে গুজব, ভালোবাসার চেয়ে ঘৃণা, মমতার চেয়ে নিষ্ঠুরতা বেশি শক্তিশালী।
আমি সব সময় মানুষের সম্ভাবনায় আস্থা রাখি; মনে করি, মানুষ শেষ পর্যন্ত তার শ্রেষ্ঠ পথই খুঁজে নেয়। কিন্তু যে বিচিত্রমুখী বাস্তবতার মধ্যে এখনকার মানুষের বসবাস, তাতে তার পক্ষে মুশকিল আত্ম-উন্নয়নের ভালো পথটি বের করা। আর অপশনও তো কম নয়।
তাহলে সঠিক পথটি খুঁজে পাওয়ার সঠিক উপায় কী? আমার মনে হয়— নিজেকে জানা। আত্মসত্যটি বুঝতে পারা। সে জন্য নিজের কাছে থাকতে হয়। বুদ্ধি, বিবেক, অনুভূতি, শিক্ষা কাজে লাগিয়ে। তবে নিজের কাছে থাকা মানে অন্যদের সরিয়ে রাখা নয়। ভাববেন, অন্যদেরও আপনি নিজের মধ্যে ধারণ করেন। নিজের মধ্যে অন্যদের ধারণের মধ্য দিয়ে তাদের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক সার্থক ও গভীর হয়ে ওঠে। সমগ্র মানবজাতিকে এভাবে আমরা প্রত্যেকেই যদি ধারণ করতে পারি, তবে এই পৃথিবী ও জীবন কত সুন্দর আর সুখকর হয়ে উঠবে, ভাবুন তো!
আমি কখনোই আশা হারাই না। মানুষের ওপর থেকে ভরসা হারাই না। যত মন্দ ঘটনাই ঘটুক, ভালো অভিজ্ঞতাগুলো আমার কাছে বেশি মূল্যবান। এই যেমন এখন মনে পড়ছে বনানীতে অগ্নিকা-ের সময় সেই শিশুটির কথা, যে পানির পাইপের ফুটো চেপে ধরে বসে ছিল অনেকক্ষণ, আগুন নেভানো পর্যন্ত। এটা তো শিশুটিকে কেউ শিখিয়ে দেয়নি। তার অনুভূতিই তাকে দিয়ে এই মহৎ কাজটি করিয়ে নিয়েছে। সে আসলে অবচেতনেই ধারণ করেছিল মানবতাকে, বিপন্ন মানুষদের রক্ষায় তাই নিজের সামর্থ্যটুকু উজাড় করে দিয়েছিল।
মানুষের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে জ্ঞানীরা মূল্যবান অনেক কথা বলেছেন। আমি বলি, মানুষ যা ভাবে, বলে এবং করে, সে আসলে তা-ই। কেউ মন্দ হতে চায় না। কেননা, শেষ পর্যন্ত তাকে নিজের মুখোমুখি হতে হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top