skip to Main Content

কভারস্টোরি I ‘জেড’ স্টেট

এই প্রজন্মকে বলা হচ্ছে ডিজিটাল নেটিভ। এরা যথার্থ বিশ্বগ্রামের বাসিন্দা। প্রযুক্তি এদের আজন্মের সাথী। নানা গ্যাজেটসময় যেমন ওদের জীবন, তেমনি অন্তর্জালই ওদের পৃথিবী। তাওসিফ আহমেদের অনবদ্য বয়ানে উঠে এসেছে এই জেড জেনদের কথকতা

গ্রিক মিথোলজির অ্যাকিলিস কিংবা মহানায়ক আলেকজান্ডারের সময়টা যদি এখন হতো, তাহলে গল্পে আসতে পারতো ভিন্নতা। তাদের সেই সময়ের সঙ্গে এখনকার গল্পের দূরত্ব এতটাই বেশি যে কিংবদন্তির ওপর ভিত্তি করে তৈরি চলচ্চিত্রগুলোর কস্টিউম ডিজাইনাররা গলদঘর্ম হয়ে পড়েছেন। পরিবর্তনের এই যাত্রাপথ অনেকটাই স্বভাবসিদ্ধ। স্পাইক লি, জেমস বন্ড, ব্র্যাড পিট কিংবা লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিওর মতো কাছাকাছি সময়ের আইকনদের কথাও যদি বলা হয়, তবু এই দূরত্ব চোখে পড়ার কথা। খুব সাধারণ অর্থে একে আমরা জেনারেশন গ্যাপ বলে থাকি। এই একই সূত্রে এক্স থেকে ওয়াই জেনারেশন হয়ে এখন সময় চলছে ডিজিটাল নেটিভ বা ‘জেন জেড’দের। ফলে, কেলি বান্ডি, কেট মস, নাওমি ক্যাম্পবেল, ব্রিটনি স্পিয়ার্স কিংবা জেনিফার লোপেজের মতো স্টাইল আইকনদের সময়কে ছাড়িয়ে এখন নতুন এক সময় তৈরির প্রক্রিয়া চলছে। যেখানে আইকন মানে জিজি হাদিদ, কাইলি জেনার বা এমা ওয়াটসন, জাস্টিন বিবার, সেলেনা গোমেজ, মাইলি সাইরাস, জ্যেন মালিকরা।
১৯৯৫ সাল থেকে শুরু করে একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশক পর্যন্ত যাদের জন্মসাল; তাদেরকে জেড জেনারেশনভুক্ত ধরা হয়। যদিও কিছু পরিসংখ্যানে এই সময়কাল দু-এক বছর এদিক-সেদিক হয়েছে। কানাডার সরকারি পরিসংখ্যান এই জেনারেশনের জন্মকালের শুরুটা নির্ধারণ করেছে ১৯৯৩ সালকে। আবার, অস্ট্রেলিয়ার ম্যাকক্রিন্ডল রিসার্চ সেন্টারের গবেষণা অনুযায়ী এই সীমারেখা ১৯৯৫-২০০৯ সাল পর্যন্ত। এমটিভি ও আমেরিকান মার্কেটিং অ্যাসোসিয়েশন অবশ্য ২০০০ সালের পর থেকে এই জেনারেশন বিবেচনার পক্ষে। এক্স জেনারেশনের জন্মকাল ১৯৬৬-১৯৭৬ এবং ওয়াই জেনারেশনের ১৯৭৭-১৯৯৪। অনেকে জেড জেনারেশনকে জেনারেশন জোনস-এর সন্তানও বলে থাকেন।
অত্যন্ত আশাবাদী এই ছেলেমেয়েরা তাদের আগের প্রজন্মের থেকে নিজেদের অনেক এগিয়ে কল্পনা করতে ভালোবাসে। তাদের এই আধুনিকতর হয়ে ওঠার পথে মডিফিকেশনের চেয়ে ক্রিয়েশনকে তারা বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকে। আগের প্রজন্মগুলোর ক্ষেত্রে নতুন কিছু যে হয়নি তা নয়। নতুন আবিষ্কারের সঙ্গে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত বিষয়গুলো এদিক-সেদিক করেও বেশ চালিয়ে নিয়েছিল ‘এক্স’ কিংবা ‘ওয়াই’রা। প্রসঙ্গত, রবীন্দ্র-পরবর্তী সাহিত্য আন্দোলনের হিসাবটা উল্লে­খ করা যায়। কারণ, এই একটি ক্ষেত্রে ‘জেড’দের সঙ্গে পূর্বপুরুষদের বেশ মিল রয়েছে। বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অমিয় চক্রবর্তী, জীবনানন্দ দাশসহ কল্লোল আন্দোলনের সাহিত্যিকেরা যেমন চেয়েছিলেন রবীন্দ্রবলয় ভেঙে নতুন ধারার সাহিত্যচর্চা করতে, তেমনি এখনকার যুগের ছেলেমেয়েদের ভেতরেও রয়েছে সম্পূর্ণ নতুন সৃজনের তাগিদ। অবশ্য এ ক্ষেত্রে ইতিবাচকতা বা নেতিবাচকতার প্রশ্নে হয়তো অনেক প্রবীণই কপাল কুঁচকাবেন।
দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় রুচিবোধ ও অভ্যাসের পরিবর্তন এসেছে বিস্তর। এই প্রজন্মের চাহিদার কথা চিন্তা করে ফ্যাশন ডিজাইনাররা কালার, প্যাটার্ন কিংবা ডিজাইন নিয়ে যতটা ভাবছেন, ততটা হয়তো আগে ভাবতে হয়নি। এই পরিবর্তনগুলোও খুব অল্প সময়ের মধ্যে পরিবর্তনশীল। এই কিছুদিন আগেও যেখানে কালার ম্যাচিং খুব গুরুত্বপূর্র্ণ বিবেচিত হতো, এখন সেখানে কালার নিয়ে চলছে বিস্তর এক্সপেরিমেন্ট। ফলে ফরমাল গেটআপ এখন কিছুটা শিথিল হয়েছে। অক্সফোর্ড কিংবা ডার্বির জায়গায় এখন লোফার পরতে স্বচ্ছন্দবোধ করছে অনেকেই। মেয়েদের অনেককেই স্নিকার পরতে বেশি অভ্যস্ত মনে হচ্ছে। মেয়েদের ড্রেস প্যাটার্নে এখন রয়েছে ফ্লেয়ার্ড, অ্যাসিমেট্রিক, লং কিংবা শর্ট- স্থির নেই কোনো কিছুই। ড্রেসের ক্ষেত্রে ইউনিসেক্স ট্রেন্ড ফলো করছে একটা বড় সংখ্যার ছেলেমেয়েরা। ফলে স্নিকার, জিনস, টি-শার্ট, শার্ট, ট্রাউজার, রিস্টওয়াচ, সানগ্লাস, ওয়ালেটসহ আরও অনেক কিছুকেই ছেলে বা মেয়েদের জন্য আলাদা করার প্রয়োজন হচ্ছে না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই গুরুত্ব পাচ্ছে পোশাকি স্বাচ্ছন্দ্য। কেনাকাটার ক্ষেত্রে এই যুগে বেশির ভাগ ছেলেমেয়েই ব্র্যান্ড ভ্যালুকে প্রাধান্য দেয়। ১৯৮০ সালে বাংলাদেশের প্রথম ব্র্যান্ডশপ ও ফ্যাশন হাউজ ক্যাটস আই যখন যাত্রা শুরু করে, তখনকার সঙ্গে এখনকার ব্র্যান্ড ভ্যালু তুলনা করলেই এই পার্থক্যটা পরিষ্কার হবে। এমনকি ১৯৯৪ সালে ‘কে ক্র্যাফট’ কিংবা একই ‘রঙ’ বা ‘অঞ্জন’স’-এর সময়টাতেও এই ভাইব ছিল না। এরপর ধীরে ধীরে আজ পর্যন্ত অনেকগুলো ফ্যাশন হাউজ তৈরি হয়েছে। এই ‘অনেক’ কথাটা কিন্তু এসেছে ক্রেতার চাহিদার ওপর ভিত্তি করেই। ওয়াই জেনারেশন পর্যন্ত অনেকেরই শিশু অবস্থা কেটেছে শিশুসুলভ সাধারণ পোশাকে; কিন্তু বর্তমান প্রজন্মের যারা তাদের বেশির ভাগই পেয়েছে স্টাইলিশ চাইল্ড আউটফিট। ফ্যাশন হাউজগুলো এই চাহিদা মাথায় রেখে ডিজাইন করছে শিশুদের পোশাক।
কেনাকাটার ক্ষেত্রে তরুণ-তরুণীদের আরেকটি বিষয় বেশ লক্ষণীয়। অনলাইন শপ। ফলে, অল্পদিনের মধ্যেই অনলাইন শপের সংখ্যাও বেড়ে গেছে। শুধু পোশাকই নয়, রূপচর্চা থেকে শুরু করে ইলেকট্রনিকস ও লাইফস্টাইলের সঙ্গে যুক্ত প্রায় সবকিছুই পাওয়া যায় এই অনলাইন মার্কেটে। অনলাইন মার্কেটিং বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে প্রতিদিন ১৫-২০ হাজার অর্ডার প্রসেস হয়। টাকার হিসাবে বছরে প্রায় আড়াই শ থেকে তিন শ কোটি টাকার লেনদেন। লাইট ক্যাসল পার্টনার্স নামের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান একটি রিপোর্টে প্রকাশ করে, বাংলাদেশে প্রতিদিন প্রায় ১৮ শতাংশ মানুষ অনলাইনে কেনাকাটা করছে। যারা এই জোয়ারে গা ভাসিয়েছেন তাদের বেশির ভাগই তরুণ-তরুণী। পোশাক, জুতা, বিউটি প্রডাক্ট, ইলেকট্রনিক গ্যাজেটস থেকে শুরু করে আলপিন পর্যন্ত প্রায় সবকিছুই আছে কেনাকাটার এই তালিকায়।
একটি বিষয় স্পষ্ট যে দিন দিন ন্যাচারাল বিউটির প্রতি ঝোঁক বাড়ছে টিনএজারদের মধ্যে। প্রসাধনী ব্যবহারের পরিমাণ, ধরন ও উপযোগিতার ভালো একটা পরিবর্তন হয়েছে। পিপার জেফরির পরিসংখ্যান বলছে, প্রসাধনীর পেছনে খরচের পরিমাণ গত এক বছরে বেড়েছে ২০ শতাংশ। এর মধ্যে কালার প্রডাক্টে তারা খরচ করে ৩১ শতাংশ এবং হেয়ার কেয়ার প্রডাক্টে ২৪ শতাংশ। এ ছাড়া মেকআপের পরিবর্তে স্কিন কেয়ারের ব্যাপারে তাদের আগ্রহ আগের প্রজন্মের চেয়ে বেশি। একটি জরিপে দেখা যায়, ১৯৯১-৯৬-এর সময়ে মেকআপ করার প্রবণতা ছিল ৫২ শতাংশ। সেখান থেকে কমে ২০০৪ সালের দিকে এসে হয়েছে ৩৯ শতাংশ। স্কিন কেয়ারের ক্ষেত্রে এই প্রবণতা ৫৪ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৯ শতাংশে। এখনকার সময়ে টিনএজাররা দিনের কিছু নির্দিষ্ট সময় বরাদ্দ রাখছে স্কিন কেয়ারের জন্য। চেহারা কিংবা স্কিন টোন অনুযায়ী তারা আলাদা প্রডাক্ট আশা করে। চাহিদার বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে কোম্পানিগুলোও নিয়ে আসছে বিভিন্ন প্রডাক্ট। এখন মেয়েদের পাশাপাশি ছেলেরাও সমানভাবে রূপসচেতন। উল্লেখযোগ্য হারে জেন্টস স্যালনের বৃদ্ধি থেকে এটা খুবই স্পষ্টভাবে বোঝা যায়। ছেলেরাও এখন পম্পাডর, ফেড, মোহক কিংবা স্পাইকের মতো হেয়ারকাট নিয়ে নিজের লুক ব্যালান্স করছে। বর্তমান প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা একটু বুঝতে শেখার সঙ্গে সঙ্গে পরিচিত হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর সঙ্গে। এই মাধ্যমগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ফেসবুক। জেড জেনারেশনের প্রায় ৭৫ শতাংশ ছেলেমেয়েই ফেসবুক ব্যবহার করে। এ ছাড়া ইনস্টাগ্রাম, টুইটার, স্ন্যাপচ্যাট, টাম্বলার কিংবা টুইচও ব্যবহার করছে খুব আগ্রহের সঙ্গে। এর ফলে ফ্যাশন ও বিউটি সম্পর্কে তারা আরও বেশি সক্রিয়ভাবে ভাবার সুযোগ পাচ্ছে এবং অন্যভাবে বললে, প্রতিযোগিতারও একটা মনোভাব তৈরি হচ্ছে। নিজেকে অন্যের তুলনায় আলাদা করে উপস্থাপন করার ক্ষেত্রে তারা সব সময়ই মনোযোগী। এমনকি ব্র্যান্ড ব্যবহারের ক্ষেত্রেও নিজের আলাদা পরিচয় তৈরি করার ব্যাপারে তাদের যথেষ্ট উৎসাহ রয়েছে। আগেকার দিনে ‘বাইরে পরার পোশাক’ কিংবা ‘বাইরে যাবার আগে সাজগোজ’ বিষয়টি থাকলেও এখন তেমন সুযোগ কম। কারণ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কারণে প্রায় সব সময় সবাই সবার সঙ্গে ‘কানেক্টেড’ থাকছে। ফলে, সব সময়ই নিজেকে সুন্দরভাবে গুছিয়ে রাখার একটা মনোভাব কাজ করে। আর ‘বাইরে বেরোনোর সময়’ ব্যাপারটা তো রয়েছেই।
খাদ্যাভ্যাস বা ফুড হ্যাবিটের হিসাব করতে গেলে ‘জেড’রা অনেকটাই আলাদা অবস্থানে রয়েছে অন্যদের চেয়ে। তা ছাড়া এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের ঘরের বাইরে যেটুকু সময় কাটে, তার একটা বড় অংশই রেস্টুরেন্টকেন্দ্রিক। মুরব্বিদের লাইফস্টাইলে বাইরের খাবার বলতে ছিল ট্র্যাডিশনাল খাবারসহ বেশির ভাগই দেশি খাবার। সর্বোচ্চ গেলে চায়নিজ কিংবা থাই মেনু। এর বাইরে অন্য কিছু থাকলেও তা খুব বেশি উল্লেখ করার মতো নয়। অন্যদিকে বর্তমান সময়ে পাতে ঠাঁই পেয়েছে ইন্ডিয়ান, জাপানিজ, ফ্রেঞ্চ, ইতালিয়ান, রাশান কিংবা আমেরিকান রেসিপি। তাই স্প্যাগেটি, র‌্যাভিওলি, লাজানিয়া, মোজ্জারেলা, মাশায়ুই কিংবা সুশির মতো খাবার এখন বেশ পরিচিত। নতুনদের কালচারে সি ফুড নিয়েও উৎসাহের কমতি নেই। স্বাভাবিকভাবেই চাহিদার কথা মাথায় রেখে তৈরি হচ্ছে সি ফুডকেন্দ্রিক রেস্টুরেন্ট। হালের প্রতিটি রেস্টুরেন্টে ইন্টেরিয়রের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। ফলে পরিবেশগত কারণ বা নতুন খাবার টেস্ট অথবা সময় কাটানোর একটা জায়গা; যেকোনো শর্তেই ‘রেস্টুরেন্ট’ অন্য সব অপশন থেকে এগিয়ে। এই প্রজন্মের হাত ধরেই ‘ফাস্ট ফুড’ কালচারের ঢালাও প্রচলন হয়। রেস্টুরেন্টের পাশাপাশি ফুডকোর্ট কিংবা মিনি ফুডকোর্টের সংখ্যা এখন অনেক।
আর্ট অ্যান্ড কালচারেও একটা বড় পরিবর্তন চোখে পড়ার মতো। একটা সময় ছিল, যখন নিজেদেরকে নিজেদের প্রেক্ষাপটেই তৈরি করে নিতে হতো। নিজস্ব সীমানার বাইরে চিন্তা করাটা অসম্ভব না হলেও বেশ কষ্টকর ছিল। ওয়ার্ল্ড মিউজিক, থিয়েটার, মুভি ইত্যাদির সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত করা সম্ভব হয়নি; কারণ, সুযোগ ছিল না তেমন। ‘ওয়াই’ দের পক্ষে এই সুবাতাস কিছুটা থাকলেও ‘জেড’ প্রজন্ম পাচ্ছে প্রায় সবই। ফলে, বাংলাদেশি মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি এখন অন্যদের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার মতোই। বাংলা ক্ল্যাসিক, আধুনিক কিংবা মেলো বা সফট রকের পাশাপাশি এখন আলট্রা হিপহপ, ডেথ মেটাল, থ্র্যাশ মেটাল হয়ে উঠেছে জনপ্রিয়। ড্রিম থিয়েটার, মেটালিকা, আয়রন মেইডেন কিংবা ডিপ পার্পলের আদলে গড়ে উঠছে পাওয়ার সার্জ, সিভিয়ার ডিমেনশিয়া, আর্বোভাইরাস কিংবা মেঘদলের মতো ব্যান্ড। ‘জেড’ সদস্যদের সামনে এখন এই ব্যান্ডগুলো হয়ে উঠেছে আইডল। তারা নিজেরাও এই ধারার চর্চা করে থাকে। বর্তমান সময়ে ওন্ড, থ্র্যাশ বা কনক্লুশনের মতো ব্যান্ড কিন্তু তাদের অবস্থানের শক্ত জানান দিয়ে দিয়েছে। অবশ্য এ ক্ষেত্রে ইউটিউব একটা বড় শিক্ষকের ভূমিকা রাখে। তাদের মোটিভেশনের মূলস্রোত আসে এই মাধ্যম থেকেই। সিনেমা দেখার রুচিবোধ পেয়েছে ভিন্ন মাত্রা। নিজস্ব ধারার সিনেমার সঙ্গে হলিউড কিংবা বলিউডই নয়; পাশাপাশি কোরিয়ান, জাপানিজ, চায়নিজ, নেপালি, মালয়ালামসহ আরও অন্যান্য ধারার সিনেমার দর্শক তৈরি হয়েছে তরুণদের মধ্যে। এ ছাড়া বর্তমান সময়ের বাংলা সিনেমা কিংবা আর্টফিল্মও তাদের কাছে বেশ জনপ্রিয়।
টেকনোলজি ফ্রিক এই প্রজন্মের প্রতিদিনের অভ্যাসের তালিকায় স্থান পেয়েছে স্মার্ট গ্যাজেটস। কথা বলার জন্য মোবাইল ফোন এখন শুধু যোগাযোগের মাধ্যমই নেই, বরং স্মার্টফোনের স্মার্ট ব্যবহারেও তারা অভ্যস্ত। ফোন ক্যামেরায় শর্টফিল্ম তৈরির ট্রেন্ডও এসেছে এদেরই হাত ধরে। এ ছাড়া গুগল ম্যাপ, ডেইলি নোটপ্যাড, নেভিগেশন, বারকোড রিডার কিংবা লাইভ টিভির মতো নিত্যনৈমিত্তিক ব্যবহার এখন খুব সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংবাদপত্র, টিভি, খেলা দেখা, গান শোনাসহ প্রায় সবকিছুই অনলাইনে সেরে ফেলাতে তারা বেশি আগ্রহী। একটি অদ্ভুত ব্যাপার হলো, এদের অনেকেই ফটোশপের বিরুদ্ধে। এই বিরুদ্ধাচরণ মূলত খুঁত ঢাকার ব্যাপারে। তারা নিজেদের প্রকাশ করতে চায় নিজেদের মতো করেই।
অবশ্য এই সুবিধাগুলোর ক্ষতিকর নানা দিক এড়িয়ে যাবার উপায় নেই। প্রথমত, কালচার পরিবর্তনে তাড়াহুড়াজনিত কারণে অনেক ক্ষেত্রেই পাকিয়ে যাচ্ছে জগাখিচুড়ি। আমাদের ঐতিহ্যগত চর্চা বেশ বাধার সম্মুখীন। এখনকার ছেলেমেয়েরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অভ্যস্ত হলেও আদতে তাদেরকে বিচ্ছিন্নই বলা যেতে পারে। এখন আড্ডা, হইহুল্লোড় কিংবা মাঠে খেলাধুলাবিমুখ ছেলেমেয়ের সংখ্যা নেহাতই কম নয়। তারা ভার্চ্যুয়াল জগতে অনেক বেশি সম্পৃক্ত। একই সঙ্গে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়াটাও একটা বড় সমস্যা হয়ে উঠেছে। ভার্চ্যুয়ালি তারা অনেক এগিয়ে গেলেও বাস্তবতায় পিছিয়ে পড়ার কারণে হতাশার শিকার হচ্ছে। মানবিক সম্পর্কের অবনতির পেছনেও এর দায় রয়েছে। প্রয়োজন না থাকলেও প্রায় সারা দিন তারা অনলাইনে ‘অ্যাকটিভ’।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক জনমত জরিপ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘পিউ রিসার্চ সেন্টার’ ২০১৫ সালে একটি জরিপের ফলাফল ঘোষণা করে। এতে দেখা যায়, প্রায় ৭৮ শতাংশ মেয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সাহায্যে নতুন বন্ধু তৈরি করে। ছেলেদের ক্ষেত্রে এই হার ৫২ শতাংশ। তাদের জরিপে আরও দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে ৫৯ শতাংশ কিশোর-কিশোরী অনলাইনে হয়রানির শিকার। এর ভেতরে রয়েছে অপমানজনক কথাবার্তা, গালিগালাজ, গুজব ছড়ানো, শারীরিক হুমকি প্রদান এবং অপ্রত্যাশিত ও ব্যক্তিগত ছবি প্রকাশ। পিউ রিপোর্টের প্রধান গবেষক মনিকা অ্যান্ডারসন বলেন, ‘অপমানজনক কথাবার্তা, গুজব ছড়িয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা টিনএজারদের জন্য অপ্রীতিকর ও বেশ চ্যালেঞ্জিং। তবে স্মার্টফোন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যাপক বিস্তার এসব পীড়নের ঘটনা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে।’
নেতিবাচক দিকগুলো এক পাশে রাখলে এই প্রজন্মের অর্জনের হিসাবটা উল্লেখ করার মতো। মাত্র কিছুদিন আগে ‘মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ’ জয়ী জান্নাতুল ফেরদৌস ঐশী ওয়ার্ল্ড র‌্যাঙ্কিংয়ে সেরা ৩০-এ এসে প্রথম বাংলাদেশি ফাইনালিস্ট হবার গৌরব অর্জন করে। এ ছাড়া রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী তৈরি করেছে রেসিং কার। বাংলাদেশে রেসিং কার তৈরির ব্যাপারে তারা আশাবাদী। ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির রোবটিক ক্লাব উদ্ভাবন করে চলেছে একের পর এক নতুন প্রযুক্তি। এ ছাড়া জাতীয় ক্রিকেট দলে নতুন তারকাদের অনেকেই ‘জেড’ প্রজন্মের প্রতিনিধিত্ব করেন। শুধু দু-একটা উদাহরণ নয়, এমন অনেক গল্পের নায়ক-নায়িকা রয়েছে এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের ভেতরে। সুতরাং, ‘জেড’ জেনারেশনের গতিশক্তির সঠিক প্রয়োগটা জরুরি। এর পরবর্তী প্রজন্মের শুরুটাও হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। হয়তো নামকরণ বাকি আছে এখনো।

মডেল: আল ফাহাদ বারী, শেহতাজ, মুদাসসির, স্পৃহা ও মাশিয়াত
মেকওভার: পারসোনা
ওয়্যারড্রোব: মিথ
ছবি: সৈয়দ অয়ন ও ক্যানভাস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top