skip to Main Content

ট্রাভেলগ ১ I জোহানেসবার্গে ভাষাসৈনিকের সঙ্গে

এই ভ্রমণ যেন দক্ষিণ আফ্রিকার কালো মানুষের অতীতে ঢোকার জন্যই। মাতৃভাষার সেই আন্দোলন, শ্বেতাঙ্গদের নিষ্ঠুরতা, খনিশ্রমিকের জীবন- সব জীবন্ত করে। লিখেছেন মঈনুস সুলতান

আজ আমার স্ত্রী হলেনকে নিয়ে জোহানেসবার্গের শহরতলি সোয়েটোর দিকে রওনা দিয়েছি আমাদের বহুদিন আগেকার সুহৃদ নাটলানটার সঙ্গে। সোয়েটো শহরতলির সংকীর্ণ পরিসরে তেরো বা চৌদ্দ লাখ মানুষের বসবাস। ছোট্ট ছোট্ট ফ্ল্যাটের চিপাচিপিতে মানুষ হাঁসফাঁস করে হামেশা; এখানে ট্রাফিক জ্যাম প্রচুর, দিনযাপনে অসচ্ছলতার ছাপ স্পষ্ট, তবে ফুটপাতে স্ট্রিট কিডরা বাদ্যবাজনায় চিত্তবিনোদন করে থাকে; তাদের ড্রামবিটে গমগম করে পরিবেশ। এ শহরতলিতে ক্রাইম অশেষ, কোলাহল এন্তার। এখানে এক পাক ঘুরে বেড়ানোর বাসনা দুর্বার হয়ে উঠলে হলেন নাটলানটাকে রিং করে। মুশকিল আসান হিসেবে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় বাক্কি নামে পরিচিত একটি পিকআপ ভাড়া করে নিয়ে এসেছেন আমাদের ট্যুরের জন্য।
অনেক বছর আগে নাটলানটা যুক্তরাষ্ট্রে এসেছিলেন সামার ইনস্টিটিউট ফর লিটারেসি প্রফেশনালসের কর্মসূচিতে যোগ দিতে। হলেন ছিল সামার ইনস্টিটিউটের প্রশাসক, আমিও কাজ করছিলাম প্রশিক্ষক হিসেবে। সে সুবাদে নাটলানটার সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্ব। দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের পয়লা কাতারের জেলখাটা কর্মী নাটলানটা। তাঁর শরীরে গুলিবিদ্ধ হওয়ার স্মৃতি আজও অম্লান। আমি এ নিয়ে স্থানীয় রেডিওতে কথিকা পড়লে, কয়েকজন মার্কিন শ্রোতা তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। সিসোটো গোত্রের এ কৃষ্ণাঙ্গ ভদ্রসন্তানের একাডেমিক পড়াশোনা সামান্য, তবে অন্যদের পড়ানোর আগ্রহ তাঁর প্রচুর। ইনি অনেক বছর ধরে বয়স্ক শিক্ষার প্রশিক্ষক হিসেবে সোয়েটোতে খনিশ্রমিকদের লেখাপড়া শেখাচ্ছেন।
নাটলানটা বাক্কি চালিয়ে ট্রাফিকে পড়তেই সাবধানে বাউলি কেটে ঢুকে পড়েন ছোট্ট একটি গলিতে। ড্রাইভ করতে করতে তিনি সশব্দে হাঁপান, জিব বের করে পুরু ঠোঁট চাটেন, তারপর দারুণ সাদা দাঁতে হেসে বলেন, ‘সোয়েটো শহরতলিটি একেবারে নতুন না। ১৯৩০ সালে সাউথ আফ্রিকার বুয়ার সরকার যখন কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীকে রোগ ছড়ানো ও নোংরামির বদনাম তুলে শ্বেতাঙ্গপ্রধান জোহানেসবার্গ থেকে আলাদা করার সিদ্ধান্ত নেয়, তখন খনিশ্রমিকদের বসবাসের জন্য জন্ম হয় এ শহরতলির।’ এ পর্যন্ত বলে দাঁত কিড়মিড়িয়ে নাটলানটা টেনেহিঁচড়ে গিয়ার বদলান। তাঁর শরীরে ফের তোড় ওঠে প্রবল হাঁপানির। দেখি, তাঁর মুখমন্ডল ও গলায় কুকুরের কামড়ের দগদগে চিহ্নগুলো ফুলে-ফেঁপে কেঁপে-কেঁপে নিচ্ছে এক কার্টুন চরিত্রের আকৃতি।
এলোপাতাড়ি ট্রাফিক নাটলানটার বাক্কির গতিকে বিশেষ একটা শ্লথ করতে পারে না। তিনি কী এক কৌশলে আমাদের নিয়ে আসেন অরল্যান্ডো টাওয়ারের কাছে। বাহনটি এখানে দাঁড় করালে আমরা জানালা দিয়ে দেখি তেত্রিশতলা টাওয়ার দুটির আলিশান আকৃতি। অনেক বছর আগে ইটপাথরের যুগল মিনার তৈরি হয়েছিল কয়লাচালিত বিজলি উৎপাদনের পাওয়ার স্টেশন হিসেবে। বর্তমানে পর্যটকেরা এক টাওয়ার থেকে অন্য টাওয়ারে ব্রিজ ধরে হেঁটে যেতে পারেন। শ্বেতাঙ্গদের এ বিদ্যুৎমন্দিরে কৃষ্ণাঙ্গ শিল্পীরা জুড়ে দিয়েছেন তাঁদের সৃজনশীলতার ছাপ। তারা জোড়া ভবনটির উত্তাপ উপেক্ষা করে দেয়ালের সর্বত্র এঁকেছেন বিপুল সাইজের ম্যুরাল। অরল্যান্ডো টাওয়ার থেকে সামান্য দূরে আছে নেলসন ম্যান্ডেলার বসতবাড়ি, পাশের গলিতে এক জামানায় বাস করতেন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ধর্মযাজক ডেসমন্ড টুটু। কিন্তু আমরা চাক্ষুষ করতে চাচ্ছি আমাদের সুহৃদ নাটলানটার বালক বয়সে বেড়ে ওঠার পরিসর। দেখতে চাইছি তাঁর সংসার, নিজস্ব ঘর। বিষয়টি তাঁকে খুলে বলতেই তিনি ফের বাক্কি স্টার্ট দিয়ে হাত তুলে অরল্যান্ডো টাওয়ারকে গুডবাই স্যালুট করেন।
নাটলানটার বাহনটি এবার ছুটল অরল্যান্ডো ওয়েস্ট জুনিয়র হাইস্কুলের দিকে। সাউথ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ-শাসনবিরোধী আন্দোলনের খবর যারা রাখেন, এ স্কুলের অবদান সম্পর্কে তারা ওয়াকিবহাল। আমি এখানে ছাত্রদের অভ্যুত্থানের সঙ্গে আমাদের ভাষা আন্দোলনের সাযুজ্য নিয়ে ভাবি। ১৯৭৬ সালে আরোপ করা হয় ‘আফ্রিকানস্ মিডিয়াম ডিক্রি’ নামে একটি কালাকানুন, যার আওতায় ছাত্রদের মাতৃভাষা নিষিদ্ধ করে শ্বেতাঙ্গ বুয়ারদের ভাষা আফ্রিকানস্-এর মাধ্যমে পড়াশোনা করার নির্দেশ দেওয়া হয়। প্রতিবাদের শুরু হয় এ স্কুল থেকে। ছাত্ররা মিছিল বের করলে পুলিশ গুলি চালায়। ঘটনাস্থলেই ১৭৬ জন ছাত্র নিহত হয়, এবং আহত হয় ১০০০ ছাত্র।
নাটলানটা স্কুলটির কাছেই একটি জাকারান্দা বৃক্ষের ছায়াতলে বাক্কি পার্ক করান। ভেতরে ক্লাস চলছে, তাই অনুমতি নিয়ে ছাত্রদের পড়াশোনার দালানটি দেখার কোনো আগ্রহ বোধ করি না। তবে হলেন এ সুযোগে নাটলানটার কাছে জানতে চায়, ‘টেল মি ইয়োর ইনভলভমেন্ট, কী ঘটেছিল ওই দিনে?’ উনি জবাব দেন, ‘আমার বয়স তখন বারো কিংবা তেরো। মিছিলের পয়লা কাতারে আমি ছিলাম। পুলিশের ট্রাক থেকে লাফিয়ে নামে পঁচিশ-তিরিশটি শিকারি কুকুর। তারা স্ট্রেটকাট আমাদের অ্যাটাক করে।’ বলেই নাটলানটা শার্টের বোতাম খুলে আমাদের তাঁর বুকে কামড়ের দগদগে চিহ্ন দেখিয়ে ফের কথা বলেন, ‘কুকুরের কামড়ে অতিষ্ঠ হয়ে আমি পাথর তুলে নিয়েছিলাম, তখন পুলিশের ট্রাক থেকে স্নাইপাররা গুলি ছোড়ে। আমার পেটের বাঁ দিকে একটি গুলি লাগলে আমি মাটিতে পড়ে যাই। পাশে দাঁড়ানো আমার ক্লাসমেট কেটেলেটসো ছুরি খুলে একটি কুকুরকে রুখে দাঁড়ায়। তখন পুলিশ স্নাইপারের ক্লোজ রেঞ্জ গুলিতে তার মাথার খুলি উড়ে যায়।’
আমরা সড়ক ধরে কিছুটা হেঁটে গিয়ে যেখানে কেটেলেটসো গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে ছিল, সেখানে দাঁড়াই। নাটলানটা মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে আঙুলের ইশারায় ক্রুশচিহ্ন এঁকে তাঁর প্রয়াত ক্লাসমেটের জন্য প্রার্থনা করেন। তারপর আমাদের নিয়ে আসেন ডান দিকের গলিপথে। পুরো এলাকাজুড়ে এলোপাতাড়ি গড়ে উঠেছে জংধরা ঢেউটিন ও বাক্সভাঙা কাঠের ঘরদুয়ার। ছড়ানো আবর্জনার আশপাশে শুধু কার্ডবোর্ডে গড়া হয়েছে প্রায়-গৃহহীন মানুষজনের গেরস্থালি। নাটলানটা খানিক দূরের একটি জংধরা ঢেউটিনের ছাপরা দেখিয়ে ইশারায় জানান, তাঁর স্কুলজীবনের বন্ধু কেটেলেটসোর পরিবার এখনো বাস করছে এ বস্তিতে।
তিনটি বাচ্চা ছেলে আমাদের হাতের ইশারায় কী যেন বলে। তাদের গলা থেকে ঝুলছে কাঠের কাঠামোতে বিস্কুটের টিন পেরেক দিয়ে গেঁথে তৈরি গিটার। আমরা তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে ইতস্তত করছি বুঝতে পেরে নাটলানটা ফকফকে সাদা দাঁতে হেসে বলেন, ‘ফিয়ার নট, দে আর গুড কিডস্। একটু গানবাজনার ধাত আছে। এদের কোক খাওয়ার পয়সা দিলেই খুশি হয়ে গিটার বাজিয়ে শোনাবে।’ হলেন এদের দিকে তাকিয়ে গিটারগুলো বাজানোর ইশারা দেয়। কিন্তু এরা কেন জানি হেসে কুটিকুটি হয়ে সড়ক ছেড়ে হেঁটে চলে যায়। একটি ঢেউটিনের ঝুপড়ি মতো ঘরের দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে অতঃপর গম্ভীর মুখে সুর তোলে। এদের বাজনা খারাপ নয়, গলা খুলে, ‘আ সি মবোনানগা../লপহা একোহোনা/লপহা এহলোলি কোহোনা’ ইত্যাদি গাইলে, টের পাই তাদের মাতৃভাষায় কী যেন এক জাদু আছে- যা আমাদের মন ছুঁয়ে যায়। হলেন এগিয়ে গিয়ে তাদের কোক খাওয়ার পয়সা দেয়। তারা মাথা ঝুঁকিয়ে বাও করে ফের দারুণ জোশে বাজায়, ‘ব্রিং ব্যাক নেলসন ম্যান্ডেলা/ ব্রিং হিম ব্যাক অল টু সোয়েটো/ আই ওন্ট টু সি হিম ওয়াকিং ডাউন দ্য স্ট্রিট উইথ উইনি ম্যান্ডেলা’।
আমরা বাক্কিতে ফিরে আসি। নাটলানটা এবার গাড়ি হাঁকান ডিয়েপক্লুফ বস্তির দিকে। বাক্কির গিয়ারটি ঠিকমতো ঘাটে পড়ে না, তাই তিনি দাঁত কিড়মিড়িয়ে তা অ্যাডজাস্ট করে বলেন, ‘কেটেলেটসোও এভাবে গিটার বাজিয়ে গান করতে ভালোবাসত। ১৯৭৬ সালে সোয়েটোর এ জায়গায় যখন ছাত্ররা তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া বুয়ার সম্প্রদায়ের ভাষা আফ্রিকানস্-এর বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে, তখন কেটেলেটসো তার প্রতিবাদে গান বেঁধেছিল। ম্যান্ডেলার কারামুক্তির দাবিতে এ গানটিও সে রচেছিল।’ গাড়ি দুপাশে ছড়ানো বস্তির ভেতর দিয়ে ছোটে। আমি উইন্ডশিল্ডের ভেতর দিয়ে বেগুনি পুষ্পে পল্লবিত অপস্রিয়মাণ জাকারান্দার ঝাড়গুলোর দিকে তাকিয়ে কেটেলেটসোর সংগীতবিষয়ক স্বপ্ন নিয়ে ভাবি। নেলসন ম্যান্ডেলার কারামুক্তি ঘটেছে, তিনি বহাল তবিয়তে এক টার্ম প্রেসিডেন্সি চালিয়ে শোভনভাবে অবসর নিয়ে জগৎজোড়া নেতার সম্মান পেয়েছেন। বলা চলে, কেটেলেটসোর সামাজিক স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়েছে। কিন্তু তার জীবনকে বেইনসাফিভাবে ছোট করে যে ভুবনে পাঠানো হয়েছে, সেখানে তার স্বদেশের পরিবর্তন সম্পর্কে অবগত হওয়ার কোনো উপায় আছে কি?
ডিয়েপক্লুফ বস্তির কাছাকাছি এসে নাটলানটা সড়কের পাশেই বাহনটি পার্ক করেন। আমরা নেমে উঁচু রাজপথের গার্ডরেলের পাশে দাঁড়িয়ে নিচু জমিতে বিস্তৃত সোয়েটো হাউজিং প্রজেক্টের দিকে তাকাই। নাটলানটার জবানিতে জানতে পারি যে এক জামানায় এদিকে ছিল কারাগারের মতো বেজায় বড় বড় শ্রমিক ব্যারাক। খনিশ্রমিক পুরুষেরা ব্যারাকের ফ্লোরে কম্বল বিছিয়ে ঘুমানোর সুযোগ পেতো। পারিবারিকভাবে বাড়ি ভাড়া করে বসবাসের অধিকার মেহনতি মানুষদের ছিল না। নারীবর্জিত দিনযাপনের কারণে ব্যারাক ঘেঁষে গড়ে উঠেছিল ব্রথেল। ওখান থেকে ছড়াচ্ছিল নানা রকমের যৌনরোগ- যা বর্তমানে এইচআইভি/এইডসের বিপুল সংক্রমণে এপিডেমিকের আকার পেয়েছে। তো ম্যান্ডেলা শ্বেতাঙ্গ-শাসন উচ্ছেদ করে উদ্যোগ নেন সোয়েটো হাউজিং প্রজেক্টের। এর অধীনে ম্যাচবক্স হাউজ নামে পরিচিত এ ফ্ল্যাটবাড়িগুলো তৈরি হয়েছে। টিনের চারচালা ঘরে ব্যবস্থা হয়েছে দুটি করে পরিবারের গেরস্থালির।
ম্যাচবক্স হাউজগুলোর পরিসর রাজসড়কের উচ্চতা থেকে ভাসা ভাসাভাবে দেখে আমরা বাক্কির দিকে ফিরি। চলমান গাড়িটিতে আর বেশিক্ষণ বসতে হয় না। ডিয়েপক্লুফ বস্তির পেছন দিকের একটি ম্যাচবক্স হাউজের সামনে নাটলানটা গাড়ি পার্ক করান। সাউথ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ শাসনবিরোধী আন্দোলনে ভিকটিম হওয়ার কারণে নাটলানটার চাচিকে এ বাড়ি দেওয়া হয়েছে। মহিলা বাড়ির একটি কামরা ভাড়া দিয়েছেন এক মুদিদোকানিকে। দোকানটি বন্ধ। তার শাটারের পাশে নিষ্পাপ একটি শিশুকে পিঠে বেঁধে চুপচাপ বসে আছে নাটলানটার চাচাতো বোন নায়াকালো। আমরা গাড়ি থেকে নামছি দেখতে পেয়ে তরুণীটি ছুটে যায় ঘরের ভেতরে, বোধ করি তার মাকে মেহমান আগমনের খবর দিতে। মাত্র দুটি কামরা নিয়ে বাস করছে বেশ বড়সড় এ পরিবার। জানালার পাশে ছিট কাপড়ের গাউন পরে হ্যাট মাথায় বসে আছেন নাটলানটার চাচি মিসেস মাতসিমেলা। তিনি মাথা থেকে হ্যাট খুলে একটু ঝুঁকে আমাদের বসতে বলেন। বাড়িতে বিদ্যুতের কানেকশন এখনো আসেনি। ছোট্ট টেবিলটির উপর রাখা কালিমালিপ্ত চিমনিওয়ালা একটি হারিকেন লন্ঠন ও দুটি কেরোসিনের কুপি। ঘরের এক কোণে টুলে রাখা ফ্লাক্স, চিনির বয়াম, কনডেন্সড মিল্কের পট ও পেয়ালা-পিরিচ। নায়াকালো পিঠের বাচ্চাটিকে ফ্লোরে রেখে, কোমরে ওড়নির মতো স্যাশটি কষে বেঁধে ফ্লাস্ক থেকে পেয়ালায় ঢালে গরম জল। মিসেস মাতসিমেলা আমার দেশ সম্পর্কে মন্তব্য করে কথাবার্তার সূত্রপাত করেন। তিনি জানতে চান, বাংলাদেশে যে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, তাতে আমার পরিবারের কেউ মৃত্যুবরণ করেছে কি না। আমি উত্তর দিয়ে জানতে চাই, স্বাধিকার আদায়ের সংগ্রামে তাঁদের পরিবারে খতরা কিছু হয়েছে কি? কোনো জবাব না দিয়ে মিসেস মাতসিমেলা ইঙ্গিতপূর্ণ দৃষ্টিতে নাটলানটার দিকে তাকান। নাতলানটা তাঁর চাচাতো বোন নায়াকালোর বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশনের শান্তি প্রক্রিয়ার কাহিনি বলেন। নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত ধর্মযাজক ডেসমন্ড টুটুর তত্ত্বাবধানে ১৯৯৬ সালে সংগঠিত হয় ট্রুথ কমিশন। এর আওতায় তিরিশ বছর ধরে শ্বেতাঙ্গ-শাসিত সাউথ আফ্রিকায় ঘটে গেছে মানবাধিকার লঙ্ঘনের যেসব ঘটনা, এগুলো নিয়ে তদন্ত চালানো হয়। প্রায় বিশ হাজার ভিকটিম কমিশনের সভায় এসে তাদের নির্যাতিত হওয়ার প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন। সাত হাজার শ্বেতাঙ্গ অত্যাচারীও অপরাধ স্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থনা করেন।
তাঁদের পরিবারের ওপর দিয়ে যে দুর্যোগ গেছে, সে সম্পর্কে মিসেস মাতসিমেলাকে সরাসরি প্রশ্ন করবো কি না, তা নিয়ে দ্বিধায় পড়ি। তিনি উঠে এসে হলেনের হাত স্পর্শ করে বলেন, ‘আই ডোন্ট হ্যাভ অ্যানি মোর অ্যানি ব্যাড ফিলিংস অ্যাগেইনস্ট অ্যানি হোয়াইট পিপুল ম্যাম।’ তারপর তিনি সিসোটো ভাষায় বলে যান তাঁর স্বামী মিস্টার মাতসিমেলার খুন হওয়ার কাহিনি। নাটলানটার তর্জমায় আমরা জানতে পারি, স্বর্ণখনির শ্রমিকদের নিয়ে ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে তুলেছিলেন তিনি। গ্রেপ্তার হলে এপারটাইট বা বর্ণবাদবিরোধী তৎপরতার জন্য তাঁর মুখমন্ডল চটের পুরু ব্যাগ দিয়ে পেঁচিয়ে পানিতে চোবানো হয়। এতে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যান মিস্টার মাতসিমেলা। ট্রুথ কমিশনে তাঁকে নির্যাতনকারী শ্বেতাঙ্গ দারোগার হাজির হয়ে ক্ষমা প্রার্থনার কথা ছিল। কিন্তু স্ট্রোকজনিত প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হওয়ায় পুলিশ কর্মকর্তাটি দৈহিকভাবে উপস্থিত না হয়ে চিঠি পাঠিয়ে ক্ষমা চান।
অত্যন্ত ট্র্যাজিক এ ঘটনার বিবরণ দিয়ে মিসেস মাতসিমেলা উঠে একটি ড্রয়ার টেনে বের করে আনেন ক্ষমাপ্রার্থনার চিঠিটি। হলেনের হাতে তা তুলে দিলে সে মিসেসকে জড়িয়ে ধরে। তো চোখ মুছে তিনি বলেন, ‘আমার স্বামী মিস্টার মাতসিমেলাকে আমি সম্মানের সঙ্গে সমাহিত করতে চেয়েছিলাম। সংসারে তখন টাকাপয়সার বড় টানাটানি চলছিল। তারপরও ধারদেনা করে তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার জন্য কিনেছিলাম একটি স্যুট। উকিল লাগিয়ে অনেক ছোটাছুটি করে মর্গ থেকে সংগ্রহ করি তাঁর লাশ। চার্চে প্রার্থনায় যাওয়ার আগে স্যুট পরানোর জন্য নাটলানটা কফিনের পেরেক উপড়ে ডালা খোলে। আমাদের অদৃষ্ট আসলেই মন্দ ছিল। মর্গ থেকে মিস্টার মাতসিমেলার পরিবর্তে অন্য এক খনিশ্রমিকের লাশ পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। তারপর আমি ও নাটলানটা অনেক খোঁজখবর করি, কিন্তু মিস্টার মাতসিমেলার দেহটি আর পাওয়া যায়নি।’
আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠা মিসেস মাতসিমেলাকে তাঁর কন্যা নায়াকালো হাত ধরে নিয়ে যায় বারান্দায়। ওখানে চা দেওয়া হয়েছে। তো আমরাও নাটলানটার সঙ্গে বারান্দায় এসে টুলে বসি। নোনতা বিস্কুটের সঙ্গে চা পান করতে করতে আমরা নীরবে দক্ষিণ আফ্রিকার ভাষা ও স্বাধিকার আন্দোলনে শরিক হওয়া এক সৈনিকের পরিবারের কথা ভাবি।
mainussultan@hotmail.com
ছবি: লেখক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top