skip to Main Content

কভারস্টোরি I পালাবদলের এখনই সময়

আন্তর্জাতিক ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি কোন পথে চলছে, অনেকেরই তা জানা। বৈশ্বিক পরিবর্তনকে মাথায় রেখে সংশ্লিষ্টদের পদক্ষেপ সম্পর্কেও বিশ্ব ওয়াকিবহাল। তবে আমরা জ্ঞাত নই আমাদের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির কর্মকান্ড সম্পর্কে। টেকসই ফ্যাশন নিয়ে ভাবনাও অস্পষ্ট। পরিস্থিতি বদলে দেওয়ার এখনই সময়। এই বিষয়ে আলোকপাত করেছেন আবদুল্লাহ আল-কেমি

বাংলাদেশ ও বহির্বিশ্বের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি বেশ কিছু সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সোজা বাংলায় একে ধারণক্ষমতার হ্রাস বলা যেতে পারে। ধারণক্ষমতা বলতে বোঝানো হয়েছে পোশাকের চাহিদা ও জোগানকে। এক জরিপে বলা হয়েছে, ২০৩০ সাল নাগাদ ইন্ডাস্ট্রিগুলোতে পানির খরচ প্রায় ৫০ শতাংশ বেড়ে ১১৮ বিলিয়ন কিউবিক মিটারে দাঁড়াবে। বাতাসে নিসৃত কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ হবে ২৭৯১ মিলিয়ন টন এবং কারখানা বর্জ্যরে পরিমাণ হবে ১৪৮ মিলিয়ন টন। হিসাবটি তৈরি করা হয়েছে এখনকার ব্র্যান্ডশপ ও খুচরা বিক্রেতাদের ব্যবসায়িক অগ্রগতির ওপর ভিত্তি করে। বেশ কিছু ব্র্যান্ড এখন ডাইংয়ে পানি ও কেমিক্যালের ব্যবহার এবং প্রাকৃতিক শক্তির অপচয় কমিয়ে সুতি কাপড় তৈরি করছে। এখনকার ডাইং টেকনোলজি পানির ব্যবহার প্রায় ৫০ শতাংশ কমিয়ে দেয়। যুক্তরাজ্যে এখন এই প্রযুক্তির সাহায্যে ৭-৮ শতাংশ কম কার্বন ও পানিজাত বর্জ্য উৎপাদন করে। বলে রাখা ভালো, বর্তমানে একটি সুতি টি-শার্ট তৈরিতে প্রয়োজন হয় ২৭০০ গ্যালন পানি।
ইন্ডাস্ট্রিগুলো এসব বিষয় খেয়াল করলেও বিপত্তির জায়গা আরেকটি আছে। এখনকার মানুষের কেনাকাটা বেড়ে গেছে অনেক। ফ্যাশন ট্রেন্ডের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার খাতিরে এই গ্রাফ এখন ঊর্ধ্বমুখী। ২০১২ সালের দিকে যুক্তরাজ্যে মানুষের কেনাকাটা বেড়েছে প্রায় ১০ শতাংশ। ফ্যাশনের পরিবর্তন ও ট্রেন্ডের মারপ্যাঁচে পড়ে প্রায় ৩০ বিলিয়ন পোশাক অযথাই পড়ে থাকছে ওয়্যারড্রোবে। ফ্যাশনের দ্রুত পরিবর্তন ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিগুলোকে বেশ কিছু বিষয়ের সম্মুখীন করে। দ্রুত পরিবর্তন মানে দ্রুত উৎপাদন। ধারণা করা যায় যে, ক্ল্যাসিক ডিজাইনের পোশাক সপ্তাহ কিংবা মাসের পরিবর্তে বছরের পর বছর টিকে থাকে। ফলে নতুন পোশাক কেনার প্রবণতা বেশ কিছুটা কমে যায়, যা পরিবেশের ওপর পোশাক উৎপাদনের প্রভাব হ্রাস পেতে সাহায্য করে। আমরা বিশ্বাস করি, আমাদের সিদ্ধান্তগুলো বুদ্ধিদীপ্ত, সচেতন, সুচিন্তিতভাবে হয়। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন কথা বলে। মানুষের চাহিদার বিচিত্রতা এবং ফ্যাশনের ক্ষেত্রে মৌলিক চাহিদাগুলোর কাছে যৌক্তিক খরচের বিষয়টা খুব গুরুত্ব পায় না। পছন্দের ক্ষেত্রে হয়তো অবচেতনেই আমরা অনেকটা স্বার্থপর। সাধ ও সাধ্যের বিষয়ে পার্থক্য তৈরি করতে সচেতনভাবেই আমরা নারাজ। একটা ভোগবাদী অবচেতন ট্রেন্ড অনুসরণে আমাদের বাধ্য করে।
যুক্তিবাদী আর ফ্যাশন জার্নালিস্টরা কিংবা কিছু ব্র্যান্ডও এই সচেতনতার লক্ষ্যে সক্রিয়। যদিও বাস্তবে এর ফলাফল তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। বরং, বেশি বেশি তথ্যের কারণে ক্রেতাদের ভেতরে বাড়ছে বিভ্রান্তি। যখন বিশেষজ্ঞরা ফ্যাশনের ক্ষেত্রে বড় ইস্যুগুলোর ব্যাপারে ইতিবাচক সাড়া দেয় না, তখনই ক্রেতারা অন্ধভাবে নিজের পছন্দকে প্রাধান্য দিতে থাকে।
তেলের ইন্ডাস্ট্রিগুলোর পরে আবর্জনা উৎপাদনের তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে আছে গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রি। পোশাক উৎপাদনে বেশি চাহিদা থাকার কারণে এই শিল্প দিন দিন পরিবেশের ওপর একটা চাপ তৈরি করছে। বিংশ শতাব্দীর শুরুকে বলা যেতে পারে রেডি-টু-ওয়্যার কনসেপ্টের দৌরাত্ম্য শুরুর শৈশবকাল। একটি হিসাব বলছে, সাধারণভাবে একজন আমেরিকান প্রতিবছর পোশাক, অ্যাকসেসরিজ, জুতা মিলিয়ে প্রায় ৮২ পাউন্ড পরিত্যক্ত জিনিস ফেলে দেয়। এবং সারা বিশ্বে প্রতি মাসে ৮০ বিলিয়ন পিস ড্রেস আমরা ব্যবহার করে থাকি। এই পরিসংখ্যান দুই দশক আগের হিসাব থেকে প্রায় ৪০০ শতাংশ বেশি। পাশাপাশি চোখ আরও কপালে তোলার মতো পরিসংখ্যান রয়েছে। পৃথিবীর বড় বড় ব্র্যান্ড প্রতিবছর অবিক্রীত ও ভুল ডিজাইনের অযুত-নিযুত অর্থের পণ্য পুড়িয়ে ফেলে। এ নিয়ে বিশ্বজুড়ে নতুন করে শুরু হয়েছে সমালোচনা।
এইচ অ্যান্ড এম, নাইকি, অ্যাডিডাস কিংবা জারার মতো কোম্পানিও এখন টেকসই ফ্যাশন নিয়ে কাজ করছে। আমাদের হাতে কিছু অপশন রয়েছে। যেমন অর্গানিক কটনের ব্যবহার। এই কটন উৎপাদনে কেমিক্যালের ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ে না। এই প্রক্রিয়ায় তৈরি কাপড়ের বেশির ভাগই জৈবিক উৎপাদনের ওপর নির্ভরশীল। এরপর লক্ষ রাখা যেতে পারে প্রাকৃতিক রঙের ব্যাপারে। কালার ভাইব্র্যান্সি এবং কাপড়ের দামের ওপর ভিত্তি করে ইদানীং প্রচুর সিনথেটিক ডাই ব্যবহার করা হচ্ছে, যার বেশির ভাগই বিষাক্ত। ন্যাচারাল ডাইংয়ের কাপড়ের চাহিদা হয়তো এই প্রবণতায় সাহায্য করবে।
নানা বৈশ্বিক জটিলতা মাথায় রেখে সব শিল্প খাতই এখন ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবছে। চেষ্টা করছে টেকসই পদ্ধতি অনুসরণের। ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির মাথাব্যথা শুরু হয়েছে। কারণ, এখান থেকে প্রতিবছর ল্যান্ডফিল বর্জ্য উৎপাদিত হচ্ছে অন্তত ৫৩ মিলিয়ন টন। এর পাশাপাশি আরও রয়েছে অনবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার, পানির অপচয়, ক্ষতিকর রাসায়নিক পর্দার ব্যবহার আর অবশ্যই কার্বন নিঃসরণ।
ফলে টেকসই বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া ছাড়া এখন আর গত্যন্তর নেই। তবে গ্লোবাল ফ্যাশন অ্যাজেন্ডার (জিএফএ) বিশ্বাস, ২০১৭ সাল থেকে অন্তত ৭৫ শতাংশ ফ্যাশন কোম্পানি এখন টেকসই বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় রেখে কাজ করে যাচ্ছে। জিএফএর সর্বশেষ সমীক্ষা অনুযায়ী এই প্রক্রিয়ায় আওতায় এসেছে ৯৩টি কোম্পানি, যারা অন্তত ২০৭টি ব্র্যান্ডের প্রতিনিধিত্ব করে থাকে। তথ্য বলছে, ২০১৬ থেকে ২০১৮ সাল—এই সময়ের মধ্যে টেকসই পণ্যের উৎপাদন বেড়েছে ১৩৯ শতাংশ, ভিগান পণ্যের উৎপাদন বেড়েছে ১১৬ শতাংশ আর বাঁশজাত পণ্যের উৎপাদন বেড়েছে ৩৬ শতাংশ। পাশাপাশি রিসাইকেলড প্রোডাক্ট বেড়েছে ৩৫ শতাংশ।
অতএব বোঝাই যাচ্ছে, বিশ্বব্যাপী সচেতনতার জোয়ার সৃষ্টি হয়েছে। বস্তুত এই ক্রান্তিতে উপনীত হয়ে আমরা কতটা এসব সম্পর্কে অবগত কিংবা সচেতন—এই প্রশ্ন থেকে যায়। উত্তর যে ইতিবাচক হবে না, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে এখন আমাদেরও ভাববার সময়। ভবিষ্যতে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার প্রয়োজনে। কারণ, আমাদের এখানে হাউজগুলো যেমন সচেতন নয়, তেমনি নেই নজরদারি করার মতো কোনো প্রতিষ্ঠান আর পরিবেশবাদী সংস্থা।
বাংলাদেশে ফ্যাশন মানে অনুসরণভিত্তিক পোশাকি বিলাসিতা। এখানে মৌলিক ফ্যাশন নেই। আদতে মৌলিক ফ্যাশন না থাকায় আমাদের এখানে নতুনত্বের শুরু হয় ধীর লয়ে। ফলে বৈশ্বিক ধারার সঙ্গে আমরা তাল মেলাতে পারি না। ফ্যাশন রাজধানীগুলোয় ফ্যাশন উইক থেকেই জন্ম হয় নতুন ট্রেন্ডের। আর সেখানে তাই বলা যায় বজ্রগতিতে ছড়িয়ে যায় নতুন ট্রেন্ড। এরপর পশ্চিম থেকে পুবে আসতে সময় নেয় বেশ। কারণ, এই পরিক্রমায় পার হতে হয় নানা স্তর। উপমহাদেশের মধ্যে এখন ভারত অনেক অগ্রসর। বাংলাদেশে এই বৈশ্বিক ধারা ও নতুনত্ব পৌঁছায় আরও পরে। তবে ভুবনায়নের জমানায় আমরা একই সময়ে ট্রেন্ড সম্পর্কে অবগত হলেও পণ্য পেতে সময় লেগে যায়। অবশেষে বৈশ্বিক ফ্যাশনের কিছু অংশ অনুসরণ করতে সফল হই। বছর বছর এই ধারা চলছে একইভাবে। অপরিবর্তনীয় নিয়ম হিসেবে। কেবল ট্রেন্ডের বিবর্তন তো নয়, সমগ্র ফ্যাশন ব্যবস্থার উন্নয়নও হয়ে থাকে সমানতালে। উন্নত বিশ্বে তো বটেই, উন্নয়নশীল বিশ্বেও এই মনোযোগ আছে ষোলো আনা। অথচ এ ক্ষেত্রে আমরা একেবারেই উদাসীন। এবং এই ঔদাসীন্য একেবারেই সচেতন। আমরা কেবল কয়েকটা মোটিফ, কিছু প্যাটার্ন, আর কিছু রঙকে দ্রুত বাক্সবন্দি করে তা থেকে সেই সমানে চলা ট্র্যাডিশন অনুসরণ করে বছরে বছর, উপলক্ষের পর উপলক্ষ—একই ধারায় পোশাক নকশা করে যাচ্ছি। যেখানে ফ্যাশন ডিজাইন মানে মূলত জমিন অলংকরণ। এমনকি পরিবেশ সচেতনতা, উদ্ভাবন, ট্রেন্ড বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণা এখানে নেই। প্রয়োজনও অনুভব করা হয় না। আউট অব দ্য বক্স আয়োজনে অনীহা প্রকট।
হ্যাঁ, স্থানীয় ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে অর্থ পশ্চিমের মতো বেশুমার নেই। এই বাস্তবতা মাথায় রেখেই বলা যায়, অর্থ সব সময় মুখ্য নয়। প্রয়োজন ইচ্ছার। বদলানোর, নতুনকে গ্রহণের। সাধ্যের মধ্যেই করা সম্ভব অনেক কিছুই। কিন্তু আমাদের দেশীয় ফ্যাশনের যে ধারা চলছে, সেটাকে মোটাদাগে ঝড়ে আম কুড়ানো বলাই ভালো।
উদাহরণ হিসেবে বৈশাখের কথাই ধরা যাক। পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে সামর্থ্যভেদে হাউজগুলো কালেকশন তৈরি করে থাকে। সেখানে ক্রেতা সন্তুষ্টি কতটা গুরুত্ব পায়, তা নিয়ে আলোচনা হতেই পারে। এমনকি এই সংগ্রহ তৈরি করতে গিয়ে প্রতিটি হাউজ কি ভোক্তাস্বাস্থ্য, পরিবেশ সুরক্ষার মতো বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে থাকে? কিংবা তা নিয়ে কি চিন্তাভাবনা করা হয়? অথচ, এসব নিয়ে ভাবা এবং তা বাস্তবায়নের উপযুক্ত সময় হতে পারে বিভিন্ন উপলক্ষ।
সীমাবদ্ধতা ও পুনরাবৃত্তির বৈশাখ
সীমাবদ্ধতা আমাদের রয়েছে। তবে এমন কিছু বিষয় আছে যেগুলো অতিক্রমযোগ্য। এ ক্ষেত্রে প্রথমেই আসে ক্রেতা সন্তুষ্টি। এটি পূরণ করা সম্ভব। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা গুরুত্ব পায় না। উপেক্ষিত থেকে যাওয়া বিষয়গুলো, যেমন পরিবেশ সচেতনতা এবং ভোক্তা সন্তুষ্টির কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে।
এখানে একটু বলে রাখা প্রয়োজন, ক্রেতা সন্তুষ্টি সব সময় অভিন্ন থাকে না। এর সূচক ক্ষেত্র বিশেষে অর্থাৎ উপলক্ষ বা উৎসবের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী বদলে যায়। তবে রেগুলার শপিংই হোক আর অকেশনাল বা উপলক্ষে ক্রেতা সন্তুষ্টিকে বিশেষ গুরুত্বে বিবেচনা করা জরুরি। সব দেশের ব্র্যান্ডগুলো এ বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে থাকে। আমাদের ব্র্যান্ডগুলোর এদিকে নজর দিতে হবে। তাদের চাহিদাকে গুরুত্ব দিতে হবে। এমনকি আন্তর্জাতিক ট্রেন্ডকে দেশীয় আবহে উপস্থাপন করতে হবে।
ফাস্ট ফ্যাশন এবং অকেশনাল সেলের প্রথম মার্কেট প্ল্যান করার কথা ক্রেতাদের মনোভাব, ভালো লাগা, মন্দ লাগাকে মাথায় রেখে। যাতে ক্রেতা নিজেকে স্পেশাল হিসেবে ভাবতে পারে।
একজন রকস্টার এবং একজন সরকারি চাকরিজীবীর জন্য করা ডিজাইন কর্নার এক নয়। কিন্তু আমরা গড়ে চিন্তা করি বলে ক্রেতাদের স্পেশাল ভাবার উপায় এ ক্ষেত্রে নেই। উপলক্ষের সুন্দর বার্তা, উপহার এসব হতে পারে আরেক উপায়, যা ক্রেতাদের মধ্যে সাড়া ফেলবে এবং সন্তুষ্টির মনোভাব জন্মাতে সহায়ক হবে। কিন্তু এই দিকগুলো আমাদের উদ্যোক্তাদের কাছে উপেক্ষিত থাকে। উপলক্ষ ও উৎসব—উভয়ই আমাদের কাছে আবেগের। ফলে কেনাকাটায়ও সেই আবেগ অনুঘটকের কাজ করে। এর সঙ্গে ক্রেতা সন্তুষ্টিও সম্পর্কযুক্ত। কিন্তু ক্রেতার আবেগ সদর্থেই গুরুত্ব পায় না। গড়পড়তা একই নিক্তিতে মাপার প্রবণতা বছরের পর বছর ধরে আমাদের উদ্যোক্তাদের মধ্যে পরিলক্ষিত হচ্ছে।
এর সঙ্গে আরও রয়েছে ডিজাইনে গতানুগতিকতা। সেই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে একই মোটিফ, একই ধরনের জমিন অলংকরণ আর ভারতীয় ডিজাইনারের অনুসরণের ধারা চলে আসছে। অথচ পণ্য তৈরির নেপথ্য গল্প বলার যে চল বহির্বিশ্বের রয়েছে, সে ধারা এখানে অনুসৃত হয় না।
অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত স্বাস্থ্য আর পরিবেশ সচেতনতার বিষয়। পরিবেশবান্ধব ফ্যাশনচর্চার কথা আলাদা করে বলার প্রয়োজন। কারণ, এ ক্ষেত্রে চিন্তা, উদ্যোগ, চর্চা ও ফলাফল—সবই শূন্য। প্রোডাকশনে ক্ষতিকর কেমিক্যালের ব্যবহার কমানোর উদ্যোগ নেই। অথবা পলিথিন ব্যবহার নিয়েও চিন্তা নেই। আর পণ্য পুনর্ব্যবহার অর্থাৎ রিসাইকেল ও রিইউজ নিয়ে কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না আমাদের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে। তারপরেও বৈশাখ আসছে। বৈশাখ কালেকশন হচ্ছে। বেচাকেনাও হচ্ছে।
জরুরি উদ্যোগ
পরিবেশ ফ্যাশনের জন্য নয়, বরং ফ্যাশন পরিবেশের ক্ষুদ্র অংশ। এখানে মানবজীবন সুন্দর হয় গুরুত্বের সঠিক স্তরবিন্যাসে। আমাদের সবার আগে বুঝতে হয় কোনটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং কোনটি কম। এবং সেই অনুযায়ী জীবনযাপন করতে হয়। আমরা সরাসরি পরিবেশনির্ভর, তাই পরিবেশ বাঁচাতে জরুরি উদ্যোগ নেওয়া উচিত জলদি। তবে, অবশ্যই ফ্যাশনকে উপেক্ষা করে নয়। এ ক্ষেত্রে বৈশ্বিক চিন্তার সাসটেইনেবল ফ্যাশন পদ্ধতিকে অনুসরণ করাই সহজ ও কাজের। বছরজুড়ে এমন অনুশীলনে লাভের মাত্রা কমে যাওয়ার আশঙ্কাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তবে শুরুতে উপলক্ষ এবং উৎসব দিয়েই শুরু হতে পারে নতুন প্রয়াস। পাশাপাশি ক্রেতা সন্তুষ্টির বিষয়টি বিশেষ গুরুত্বে বিবেচনায় রাখতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন হবে গতানুগতিক ধারা পরিহার করা। তবে সবার আগে চাই মনোভাবের পরিবর্তন। নতুনকে গ্রহণ করার ইতিবাচক মানসিকতা।
টেকসই ফ্যাশনের অনুশীলন
সাসটেইনেবল ফ্যাশন বা টেকসই ফ্যাশনের নিয়মকানুন মেনে চলার পূর্বশর্ত মুনাফার একটা অংশ পরিবেশ সচেতনতামূলক কাজে ব্যবহার করা। যেটাকে করপোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি বলা হয়। পাশাপাশি উৎপাদনের প্রতিটি পর্যায়ে তো বটেই, কর্মক্ষেত্রে মূল্যবোধের চর্চাও গুরুত্ব পাওয়া উচিত। এসবের ফলে ব্র্যান্ড ভ্যালু দৃঢ়তর হতে পারে।
রিসাইকেল
উৎপাদনে অপচয়রোধ এবং ওয়েস্ট ম্যাটেরিয়াল কাজে লাগিয়ে নতুন ও ব্যবহারযোগ্য কিছু তৈরি করাই রিসাইক্লিং। ওয়েস্ট ম্যাটেরিয়াল দিয়ে বানানো যেতে পারে হাতব্যাগ, শপিং ব্যাগ থেকে শুরু করে অন্যান্য অনেক দৈনন্দিন অনুষঙ্গ। একইভাবে পরিবেশদূষণ, পানির অপচয় রোধ ও ক্ষতিকর পদার্থ ব্যবহার থেকে বিরত থাকা দরকার। বিশ্বের প্রধান একটি দূষিত শহরে দেশীয় ফ্যাশন উদ্যোক্তাদের এহেন উদ্যোগ বিশেষ প্রশংসা পাবে। একই সঙ্গে পরিবেশ রক্ষায় সহায়ক হবে। রিসাইক্লিং, শুধু পরিবেশ বাঁচাতে সহযোগিতা করে না, এই প্রক্রিয়া অর্থনীতিকেও প্রভাবিত করবে। এই উদ্যোগ প্রতিষ্ঠানের জন্য লাভজনক হতে পারে।
আপসাইকেল
আপসাইক্লিংও একধরনের রিসাইক্লিং। কিন্তু এখানে সরাসরি প্রোডাক্টের রিইউজ বা পুনরায় ব্যবহার ঘটে। পোশাকের বেলায়, ব্যবহৃত কোনো প্রোডাক্ট আগের চেয়ে ভালো মানের করে তোলা এবং নতুনভাবে ব্যবহার করাই রিসাইক্লিং। এখন পুরোনো পোশাক কোথায় পাবে ফ্যাশন হাউজ? সহজ উপায় হচ্ছে, বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ক্রেতাদের কাছ থেকে পুরোনো প্রোডাক্ট জমা নেওয়া। রিসাইকেল করে সুবিধাবঞ্চিতদের মধ্যে বিনা মূল্যে বা স্বল্প মূল্যে বিতরণ করা যেতে পারে। এতে ক্রেতারা যেমন জমা দিতে আগ্রহ প্রকাশ করবে, তেমনি ওই ব্র্যান্ডের প্রতি তাদের ইতিবাচক মনোভাব তৈরি হবে। তৈরি হবে ব্র্যান্ড লয়্যালটি। তাদের প্রোডাক্ট কেনার আগ্রহ বাড়বে। এমনকি পুরোনো পোশাকটি জমা দেওয়ার সময়ও হতে পারে বড়সড় শপিং। তাই এই উদ্যোগ একই সঙ্গে হবে সাসটেইনেবল, এথিক্যাল এবং লাভজনক। তা শুরু হতে পারে এবারের পয়লা বৈশাখ থেকে।
অন্যদিকে আপসাইক্লিং থেকেই বের হতে পারে মূল্যবান ফ্যাশন ভাবনা আর গুরুত্বপূর্ণ ডিজাইন। উন্নত বিশ্বে যেমন এই চর্চা বর্তমানে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। ডেনিমের ব্যবহার যেখানে অগ্রগণ্য। হতে পারে ফিউশন ডিজাইন। তবে, তা অবশ্যই নতুন পোশাকের মর্যাদা পাওয়ার উপযুক্ত হতে হবে। অনেকের ধারণা হতে পারে, এমন আপসাইক্লিংয়ের জন্য দামি মেশিনারিজ প্রয়োজন। আসলে তা মোটেও নয়। হ্যাঁ, মেশিনের ব্যবহারে কিছু আপসাইক্লিং করা হয় অনেক জমকালো পোশাক তৈরির খাতিরে। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন একটু গন্ডির, বাইরে চিন্তা করা, পুরোনোকে নতুন করে দেখতে শেখা। ব্যবহৃত ডেনিম প্যান্ট দিয়ে নতুন ব্যাগ বানানো যার উদাহরণ।
কাজের সুযোগ সৃষ্টি
প্রতিটি ফ্যাশন হাউজের দক্ষ জনশক্তি প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে সুবিধাবঞ্চিত ও শারীরিক প্রতিবন্ধীদের কার্যকর ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে উপযুক্ত করে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা যেতে পারে। তাতে সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা পূরণ হবে। আর এই উদ্যোগকে ইউনিক সেলিং পয়েন্ট বা ইউএসপি হিসেবে ব্র্যান্ড কমিউনিকেশনে ব্যবহার করে ব্র্যান্ডকে আরও গ্রহণযোগ্য করে তোলা যাবে। এমনকি অন্যদের জন্য এই উদ্যোগ হয়ে উঠবে অনুসরণযোগ্য।
পরিবেশবান্ধব ব্যবস্থা ও ব্যবস্থাপনা
অ্যাসিড বৃষ্টির প্রবণতা বাড়ছে। ঋতুচক্রে দেখা দিচ্ছে ব্যাপক অনিয়ম। বৃদ্ধি পাচ্ছে বৈশ্বিক উষ্ণতা। কৃত্রিম এবং ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থে দূষিত হচ্ছে বাতাস, মাটি ও জল; যা আমাদের শরীরে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। বাড়ছে রোগের উপদ্রব। নতুন সমস্যা যেমন তৈরি হচ্ছে, পুরোনো সমস্যা তেমনি হয়ে উঠছে আরও ভয়াবহ। এর জন্য নিজেদের দায়কেও অস্বীকার করা যাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ফ্যাশন উদ্যোক্তারা প্রয়োজনীয়, কার্যকর আর সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করে তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারেন।
ফ্যাশন পরিবেশের ছোট অংশ। পরিবেশ মোটেও ফ্যাশনের দাস নয়। তাই সমগ্র ফ্যাশন সিস্টেম পরিবেশবান্ধব হওয়া জরুরি। যাকে বলা হচ্ছে টেকসই ব্যবস্থা। বর্তমানে বাংলাদেশ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কাজ করে যাচ্ছে। ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিও এই প্রক্রিয়ার অংশ হতে পারে নিজেদের আরও গ্রহণযোগ্য করে তুলতে।
পাশাপাশি তাদের উচিত এথিক্যাল প্র্যাকটিসের অংশ হিসেবে পলিথিন ব্যবহার বন্ধ করা, অর্গানিক কাপড় ব্যবহার করা, ডে লাইট সেভিংয়ের চর্চা করা, মানসম্মত, পরিবেশ ও স্বাস্থ্যবান্ধব রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করা, পানির অপচয় রোধ করা। কোনো কিছুই রাতারাতি হয় না। দীর্ঘদিনের অনুশীলনকে রাতারাতি বদলে ফেলা যাবে না। তবে উদ্যোগ নিয়ে সুস্থ ও সুন্দর পৃথিবীর জন্য কাজ শুরু করা যেতে পারে। আর তা হবে বিশেষ প্রশংসার্হ।
প্রতিবছর পরিকল্পনা করে প্রতি কোয়ার্টারে একটা করে ছোট কালেকশন এই উদ্যোগের ফল হিসেবে তৈরি করে প্রয়োজনীয় প্রচারের মাধ্যমে ভোক্তার কাছে তুলে ধরা যেতে পারে। তা ছাড়া এই প্রয়াসের দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ হিসেবে গ্রিন ফ্যাক্টরি তৈরি, কার্বন ফুটপ্রিন্ট কমাতে গাছ লাগানো যেতে পারে।
গার্মেন্ট উইদাউট গিল্ট— এ ধরনেরই একটি উদ্যোগ। শ্রীলঙ্কার তৈরি পোশাকশিল্প ২০১০ সালে উদ্যোগটি নেয়। এর সুফল পাওয়া যাচ্ছে পুরোদস্তুর। আমাদের দেশের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিও এই ধরনের উদ্যোগ নিতে পারে। যা তাদের ব্র্যান্ড ভ্যালু বাড়াতে বিশেষ সহায়ক হবে।
স্বচ্ছতা
সরাসরি কোনো পরিবেশবান্ধব উদ্যোগ বা মানবিক সহযোগিতা যেমন মূল্যবোধের অন্তর্ভুক্ত, তেমনি ব্যবসায় স্বচ্ছতা রাখাও একই রকম আদর্শিক ও সম্মানজনক। সুবিধারও বটে। এই যুগে এসে সাধারণ মানুষ সর্বদা বিভ্রান্ত থাকে। প্রোডাক্টের ব্যাপারে ক্রেতাদের স্বচ্ছ ধারণা দেওয়াও জরুরি। বিহাইন্ড দ্য স্টোরির কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। বিশেষ বিশেষ উপলক্ষ আর উৎসবের আগে তৈরি সংগ্রহের নেপথ্যের গল্প ক্রেতাকে জানানো যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে সামাজিক মাধ্যম।
তদারকি
মূল্যবোধের অনুশীলনে আরও একটি বিষয় থেকে যায়। সরকারি নিয়মনীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা। যদিও আমাদের রক্তে রয়েছে নিয়মভাঙার প্রবণতা। আর তদারককারী সংস্থার গাফিলতিও প্রণিধানযোগ্য। তবে নানা পরিস্থিতির উদ্ভব এ নিয়ে সচেতনতার জন্ম দিয়েছে। আমাদের উদ্যোক্তারাও বর্তমানে যথেষ্ট সচেতন। অনেকেই সব নীতিমালা অনুসরণ করেই অফিস কিংবা কারখানা বানিয়েছেন। সেখানে পরিবেশবান্ধব বিষয়ও এই অনুশীলনে অনুসৃত হচ্ছে। তবে অবশ্যই তদারকির প্রয়োজন রয়েছে। এ জন্য সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে আরও উদ্যোগী ও তৎপর হতে হবে।
আমরা সবকিছুই শুরু করি দেরিতে। এ যেন আমাদের মজ্জাগত প্রবণতা। তবে প্রকৃতির বিপর্যয়কে ত্বরান্বিত না করে এখনই সময় সতর্ক হওয়ার। তাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মঙ্গল আমাদেরই। সুতরাং নতুন বছরের সূচনায় আমাদের শপথ হোক নতুন লক্ষ্যে, নতুন উদ্যোগে ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিকে এগিয়ে নেওয়ার।
মডেল: চলচ্চিত্র পরিচালক মোস্তফা সারয়ার ফারুকী, অভিনেত্রী নুসরাত ইমরোজ তিশা, নাজ ও অনিক
ওয়্যারড্রোব: লা রিভ
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: সৈয়দ অয়ন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top