skip to Main Content

ফিচার I বিরিয়ানিতে আলুর দোষ

স্থানান্তরের সঙ্গে সঙ্গেই পাল্টে গেছে কাচ্চি বিরিয়ানির ধারা। অনুঘটক আলু। কলকাতা থেকে ঢাকায়। লিখেছেন সামীউর রহমান

বিয়ে এবং বিরিয়ানি যেন এক সুতায় গাঁথা। আর বিরিয়ানির সুগন্ধি চাল, কোলেস্টেরলের চোখরাঙানি উপেক্ষা করে পাতে তুলে নেওয়া মাংস- সবকিছু ছাপিয়ে মনটা উচাটন হয়ে ওঠে আলুর টুকরাটির জন্য। টেবিলের ভাগযোগে যদি আলু না মেলে, তাহলেই বেয়ারাকে হাঁক। ধোঁয়া ওঠা গরম আলুটিকে আঙুলের চাপে ভেঙে, খানিকটা আলুবোখারার চাটনি মেখে যদি নাই-বা হয় খাওয়া, তাহলে কেন এত সেজেগুজে বিবাহ আসরে যাওয়া!
কাচ্চি বিরিয়ানির আলু যেন পাশের বাড়ির মেয়েটির হঠাৎই একদিন বিশ্বসুন্দরী হয়ে যাবার মতো। রোজকার রুটি আলুভাজি, আলুভর্তা ডালভাত আর মোড়ের দোকানের তেলেভাজায় বেসনগোলানো আলুর চপে যে স্বাদ, বিয়েবাড়ির কাচ্চি বিরিয়ানিতে সেটিই একদম অন্য চেহারায়। পোলাও চালের সুগন্ধি গায়ে মেখে, মসলায় জারিত হয়ে বিরিয়ানির ডিশ থেকে যে আলু পাতে উঠে আসে, আটপৌরে হেঁসেল থেকে তার দূরত্ব অনেক। উৎসবের মৌসুম বলে কথা! বাস্তবতা হলো, বিরিয়ানিতে এই বস্তুর কোনো স্থানই ছিল না; বরং ইতিহাসের করুণ এক অধ্যায়ের হাত ধরেই বিরিয়ানিতে লেগেছে ‘আলুর দোষ’।
ভারতবর্ষে ব্যবসা করতে আসা ব্রিটিশরা একসময় হাতে নিল ভারতের রাজদন্ড। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পরাজয়ের পর ক্ষয়িষ্ণু দেশীয় রাজ্যগুলোর স্বাধীনতা হরণ করতে থাকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। এমনই এক অস্থির সময়ে, সিপাহি বিদ্রোহের আগের বছর অর্থাৎ ১৮৫৬ সালে অযোদ্ধার নবম নবাব ওয়াজিদ আলী শাহকে ক্ষমতাচ্যুত করল ইংরেজরা। নির্বাসন দিল কলকাতার মেটিয়াবুরুজে। আত্মীয়স্বজন, পরিবার-পরিজনের সঙ্গে পাচক, বাদক, নাচিয়ে, গাইয়েদের বিশাল এক বহর নিয়ে তিনি এসে বসতি গড়লেন কলকাতার মেটিয়াবুরুজে। তার হাত ধরেই বিরিয়ানিতে এল আলু। কীভাবে- সেই গল্প শোনা যাক নবাবের বংশধর মানজিলাত ফাতিমার কাছ থেকে। কিছুদিন আগে, কলকাতা থেকে ঢাকায় এসেছিলেন ওয়াজিদ আলী শাহের প্রপৌত্রী মানজিলাত ফাতিমা। গুলশানের ‘কারি অ্যাকসেন্ট’ রেস্তোরাঁয় তিনি আয়োজন করেছিলেন খানদানি আওয়াধি খাবারের এক উৎসবের, যেখানে তিনি রান্না করেছেন খাস নবাবি খানা। কাবাব, পরোটাসহ অনেক খাবারের সেই আয়োজনে মধ্যমণি কিন্তু ছিল বিরিয়ানিই, যা বংশপরম্পরায় রান্না করা হয়েছে নবাবি বাবুর্চিদের রসুইতে।
‘নবাবি খাবার যে খুব মসলাদার, তা কিন্তু নয়। কারণ, তারা এসব রোজ খেতেন। একা খেতেন না, অনেক মেহমান থাকত। ওয়াজিদ আলী শাহের জন্য ছটা রান্নাঘরে রোজ খাবার রান্না হতো। সেখান থেকে নবাব পছন্দ করে খেতেন’- নবাবি শানশওকতের কথা এভাবেই বলছিলেন মানজিলাত। লক্ষ্ণৌ থেকে কলকাতায় নির্বাসিত হবার পর নবাবের শানশওকতে টান পড়ল। তখন তো আর নবাবি নেই, ইংরেজদের থেকে পাওয়া মাসোহারাই ভরসা। পরিমাণটা অনেক হলেও তা ছিল সীমিত! তখন বাবুর্চিরা মাংসের সঙ্গে আলু মিশিয়ে দিতে শুরু করলেন নবাবের শাহি বিরিয়ানিতে। জনশ্রুতি আছে, বয়স হয়ে যাওয়ায় নবাবের দাঁত পড়ে গিয়েছিল, তাই বাবুর্চিরা বিরিয়ানিতে আলু দিতে শুরু করেন। ভুলটা ভাঙালেন মানজিলাত, ‘লক্ষ্ণৌতে নবাবের ছিল ছয়টা শাহি বাবুর্চিখানা, প্রতিটা পাকশালে একেকজন করে বিশেষ দক্ষতার বাবুর্চি থাকতেন। খাবারদাবারের পেছনে প্রচুর খরচ করা হতো, ইনামের আশায় নতুন নতুন সব রান্না রেঁধে নবাবকে তাক লাগিয়ে দিতে চাইতেন বাবুর্চিরা। কলকাতায় আসার পর সেই শানশওকত তো আর রইল না। কলকাতায় এসে নবাবের খাবার তৈরির ঘর হয়ে গেল একটি। যদিও তাতে আভিজাত্য ঠিকই টিকিয়ে রাখা হয়েছিল। তাই মনে হয় স্বাস্থ্যগত কারণে নয়, বরং উদ্ভাবনী প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই বিরিয়ানিতে আলুর প্রচলন করা হয়েছিল। আর এখন যেমন আলু খুব সহজলভ্য, তখন তো সে রকম ছিল না। আলু আসত পর্তুগাল থেকে, পর্তুগিজরা আলুর প্রচলন করেছিল ভারতবর্ষে। তাই আলু অভিজাত খাবার হিসেবেই গণ্য ছিল।’
মানজিলাত আওয়াধি ঘরানার রান্না শিখেছেন মায়ের কাছ থেকে। তার মা শিখেছিলেন শাশুড়ি অর্থাৎ মানজিলাতের দাদির কাছ থেকে। পারিবারিক নানা অনুষ্ঠানে যখন মানজিলাত বন্ধুবান্ধবকে খাইয়েছেন আওয়াধি রান্না, সবাই খুব প্রশংসা করেছে। তারপর প্রথমে বাসা থেকেই অর্ডার ডেলিভারি দিতেন, পরে স্বামীর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ছাদের উপরের ঘরটাকে সাজিয়ে খুলেছেন রুফটপ রেস্টুরেন্ট ‘মানজিলাত’স’। এখানেই পাওয়া যাবে আদি অকৃত্রিম নবাবি ঘরানার বিরিয়ানি, সঙ্গে আরও নানান রকম কাবাব ও পরোটা। ঢাকায় এসে একটি বিয়ের অনুষ্ঠানের কাচ্চি বিরিয়ানি চেখে দেখেছিলেন মানজিলাত। ঢাকাই বিরিয়ানির সঙ্গে আওয়াধি বিরিয়ানির মিল ও অমিল দুটো নিয়েই তার বিশ্লেষণ, ‘কাছাকাছি হলেও প্রণালিটা একটু আলাদা। ঢাকাই বিরিয়ানিটা নামেই বোঝা যাচ্ছে যে এখানে মাংসটা কাঁচা অবস্থায় হাঁড়িতে দেওয়া হয়, তার আগে অবশ্য পেঁপেবাটাসহ অনেক কিছু মিশিয়ে মাংসটাকে নরম করে নেওয়া হয়। তার সঙ্গে চাল ও বিভিন্ন মসলা মিশিয়ে দমে বসানো হয়। কলকাতায় মাংসটা আমরা আগে আলাদা রান্না করে নিই, এটাকে বলে কোরমা। আমার বিরিয়ানিটা হচ্ছে দম বিরিয়ানি। চাল, মাংস, আলু- সব কটিই আলাদা রান্না হয়। চালটা চার ভাগের তিন ভাগ ফুটিয়ে নেওয়া হয়, মাংসটা প্রায় হয়ে এসেছে এ রকম একটা অবস্থায় আনা হয় এবং আলু সেদ্ধ করে ভেজে রাখা হয়। এরপর পরিবেশনের আগে দমে বসিয়ে রাখা হয়।’ পারিবারিক রান্নাঘরের একটা গোপন টোটকাও শিখিয়ে দিয়ে গেছেন মানজিলাত, ‘আমার দাদিজান কোরমাটা রান্না করতেন সর্ষের তেলে। ঘি দেওয়া হতো খুশবুর জন্য, মাংসটা রান্না হতো সর্ষের তেলে।’ এতে করে বিরিয়ানির যে ‘সিগনেচার টেস্ট’ তৈরি হয়, সেটা মানজিলাতের হেঁশেল ছাড়া আর কোথাও মিলবে না। আলুর ব্যাপারে ঢাকায় এসে একটু সমস্যায় পড়তে হয়েছিল মানজিলাতকে। এখানকার বাজার থেকে কেনা আলুর টুকরাগুলোর কোনো কোনোটা সেদ্ধ হচ্ছিল না। পরে সমাধান খুঁজে পেলেন। বড় আলুকে টুকরা করলে মাঝের মোটা অংশটা বাদ দিয়ে বাকি টুকরাগুলো দিয়েছেন বিরিয়ানিতে। এরপর আর সমস্যা হয়নি। মানজিলাতের আওয়াধি বিরিয়ানি যারা বাড়িতে বানাবেন, তারা এই টোটকাটা ভুলবেন না!
বিয়েবাড়ির ভোজে কাচ্চি বিরিয়ানির দোসর জালি কাবাব যদি না থাকে, তাহলে তো খাওয়াই জমবে না! মানজিলাতও জানালেন, আওয়াধি খানাখাজানায় আছে বিনা শিকের কাবাবিয়ানা। মুখের ভেতর গলে যায় বলেই গলৌটি কাবাব, যা তৈরি হয় বাচ্চা ভেড়ার মাংসের সঙ্গে পুদিনা ও নানান রকম ভেষজ মসলা মিশিয়ে। এই কাবাবটা এতই নরম ও মখমলি যে, পাতে তুলে দিতে গেলে ভেঙে পড়বেই! আরও আছে শামি কাবাব, হান্ডি কাবাব, পেশাই করা মাংসের ঘুটনা কাবাব, যেটা অনেকটা মাংসের ভর্তার মতো, বটি কাবাবের মতো অনেক কাবাবের পসরা। বেশির ভাগ কাবাবই রান্না হয় তাওয়া বা হান্ডিতে, শিকে গেঁথে কয়লায় ঝলসে রান্নার কায়দা খুব একটা নেই আওয়াধি ঘরানায়।
ওয়াজিদ আলী শাহর পূর্বপুরুষেরা এসেছিলেন ইরান থেকে। তারা ছিলেন শিয়া সম্প্রদায়ের মানুষ। মহররমের সময় আওয়াধি পরিবারগুলোতে বিশেষ রকমের একটা ডাল রান্না করা হয়, যাকে বলে ‘মালকা মাসুর ডাল’। মানজিলাত জানালেন, উৎসবে পার্বণেও এই ডাল থাকে তাদের পারিবারিক দস্তরখানায়। কারণ, তারা শুধু শোকে নয়, আনন্দের দিনেও স্মরণ করতে চান ইমাম হোসেনকে।
উত্তর ভারতীয় রান্নায় মিষ্টি মানেই নানান রকম বাদাম আর শুকনা ফলের কেরামতি। সুজির হালুয়ার মতো যে মিষ্টান্নটি চেখে দেখতে দিলেন, তাতে জাফরানের কমলা রঙের সঙ্গে পেস্তা বাদামের সবুজ, কাজুর সাদা আর তবকের রুপালি রং মিলেমিশে একাকার। শাহি ক্ষীর দিয়েছিলেন কাঁসার বাটিতে। জমাট ঠান্ডা দুধে বাদাম, মেওয়া, গোলাপের পাপড়ির নির্যাস আর কিশমিশের মিষ্টতা মিলে সে এক অসামান্য স্বাদ! শেষ পাতে ঢাকাই বিয়েবাড়ির খাবারের সঙ্গে নবাবি হেঁসেলের খানিকটা অমিল থাকলেও গলা ভেজানোর বেলায় কোনো অমিলই নেই। সীমান্তের এপারে কিংবা ওপারে, বোরহানি আছেই বিরিয়ানির সঙ্গী হয়ে।
ওয়াজিদ আলী শাহ যখন মেটিয়াবুরুজে এসে নতুন লক্ষ্ণৌ গড়ে তুলেছিলেন, তখন তো আর এপার বাংলা ওপার বাংলা ছিল না। মানজিলাত মনে করেন, ঢাকাই বিরিয়ানির শিকড়টা আসলে ওয়াজিদ আলী শাহের হেঁসেলেই। সময়ের স্রোতে যাতে লেগেছে পরিবর্তনের হাওয়া। ঢাকা-কলকাতার দূরত্ব এখন অনেকটাই ঘুচে গেছে। কলকাতায় বেড়াতে গেলে চেখে দেখতে পারেন মানজিলাতের হাতের আওয়াধি খাবার। তার রেস্টুরেন্টটা কসবায়। সৌরভ গাঙ্গুলীর দাদাগিরিতে এসে দাদাকে বিরিয়ানি খাইয়েছেন মানজিলাত, অতিথি হয়ে এসেছেন জি বাংলার রান্নাঘরেও। ঢাকায় তার হাতের রান্না কিছুদিন আগে চেখে দেখেছেন কারি অ্যাকসেন্ট রেস্তোরাঁর অতিথিরা। ব্যবস্থাপক অভিজিত সিনহা জানিয়েছেন, দারুণ সাড়া পেয়েছেন ঢাকার ভোজনরসিকদের কাছ থেকে। এমনকি ঢাকানিবাসী ভারতীয়রাও এসে খেয়ে গেছেন। মানজিলাতও জানিয়েছেন, আবার আসবেন। ঘুরে বেড়াবেন পুরান ঢাকার বিরিয়ানির দোকানগুলোতে, যেখানে হয়তো তার পূর্বপুরুষের দেখানো পথেই কেউ বংশপরম্পরায় বিরিয়ানির হাঁড়ি চড়াচ্ছেন।

লেখক: কালের কণ্ঠের সিনিয়র স্পোর্টস রিপোর্টার ও রসনালিখিয়ে
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top