skip to Main Content

ফিচার I ভোজবৈচিত্র্যের উৎসবে

গুলশানের সবচেয়ে উঁচু বাড়িটার সর্বোচ্চ তলায় দাঁড়ালে ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’কে তো মনে পড়বেই! কলকাতার এই গানের দলের সুরের ধারায় যেমন বাউল থেকে শুরু করে বব ডিলান, তেমনি ফোর পয়েন্টস বাই শেরাটনের খাদ্যসম্ভারেও জাপানের সুশি থেকে মেক্সিকোর বুরিতো- মজুত সবই! তারই সুস্বাদু হদিস দিয়েছেন রসনালিখিয়ে সামীউর রহমান

স্ট্রিট ফুড ফেস্টিভ্যাল। গত বছরের সাফল্যের পর ২০১৮ তে এই আয়োজনের দ্বিতীয় কিস্তি। এবার আরও বড় পরিসরে। আগেরবারের ঘাটতিগুলো পুষিয়ে নিয়ে। নানান সূচকে ঢাকাকে বসবাসের অনুপযোগী নগরের তালিকায় উপরের দিকে রাখলেও এই শহরের ওপর আন্তর্জাতিক হোটেল ব্যবসায়ীদের যে নজর, তাতে সেসব সূচককে গুজব বলেই মনে হতে পারে। শেরাটন নামটা ঢাকাবাসীর কাছে পরিচিত বহুদিন ধরেই। ইন্টারকন থেকে শেরাটন, রূপসী বাংলা হয়ে আবার ইন্টারকন হতে চলা সেই হোটেলের সামনের ব্যস্ত রাস্তাটা যে এখনো শেরাটনের মোড় নামেই পরিচিত! গুলশানের এই আকাশছোঁয়া পান্থশালাতেও কি তাদের আতিথেয়তার ছোঁয়া? জানতে চাইলে বিপণন ব্যবস্থাপক মেহরান হুসেইনের উত্তর, এই হসপিটালিটি ব্র্যান্ডটি বর্তমানে বিশ্ববিখ্যাত ম্যারিয়ট গ্রুপের আওতাধীন। ম্যারিয়টের একটি ব্র্যান্ড স্টারউডের অধীনে ফোর পয়েন্টস বাই শেরাটন নামের ৩০০টির মতো হোটেল ছড়িয়ে আছে বিশ্বের নানা প্রান্তে। ঢাকা শহরে এর অবস্থান একদম অভিজাত এলাকার প্রাণকেন্দ্রে, গুলশান ২ নম্বর গোলচত্বরে। সেখানকার ২৫ তলা ভবনের উপরের তলায় বসে ঢাকা শহরের এক অন্য রকম দৃশ্য দেখতে দেখতে ব্রাজিলিয়ান শেফের জিভে জল আনা খাবার চেখে দেখবার সুযোগটা যদি হাতছাড়া করতে না চান, তাহলে ‘দ্য ইটারি’ হোক আপনার গন্তব্য।
রাস্তার খাবার। উচ্চারণমাত্র একটা অস্বাস্থ্যকর আবহ এসে যায়। ফুচকার স্বাদ যত সুখকর হোক, কখনো কখনো তা উদরকে অপ্রীতিকর করে দেয়। রাস্তার ধারের গরম গরম তেলেভাজা খেতে কার না ভালো লাগে; কিন্তু তারপর গ্যাসের ওষুধও আবশ্যিক! ফোর পয়েন্টস বাই শেরাটনের স্ট্রিট ফুড ফেস্টিভ্যালে এসব শঙ্কা নেই। কিন্তু আছে মেক্সিকো, ইতালি, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান ও থাইল্যান্ডের বিচিত্র পথখাবারের প্রাপ্তিযোগ। এক ছাদের তলায়। লাইভ পাস্তা কাউন্টারে হরেক রকমের পাস্তা, চিজ আর সসের প্রাচুর্য। পাশেই পাওয়া যাচ্ছে গরম গরম পিৎজা। পাতলা অথচ মুচমুচে ক্রাস্ট, তার উপর দরাজ হাতে ঢালা মোজারেলা চিজ আর টমেটোর ফালি। মেক্সিকান খাবারের নামে বাংলাদেশের রেস্টুরেন্টগুলোতে যা পরিবেশিত হচ্ছে, তার অনেকটাই আদতে মেক্সিকান নয়, এমনই দাবি ফোর পয়েন্টস বাই শেরাটন ঢাকা কর্তৃপক্ষের। লাইভ মেক্সিকান ফুডের কাউন্টারটি সাজানো হয়েছে কাঠের ভ্যানগাড়ির আদলে। তাতে টাকো, নাচো, বুরিতো… সব বানিয়ে দেওয়া হচ্ছে টাটকা।
৮০টির বেশি পদের এই আয়োজন করাই হয়েছে কোরবানির ঈদের পর ভারী খাওয়াদাওয়া থেকে একটু বেরিয়ে এসে হালকা চটুল স্বাদের রসনায় মন ভরানোর জন্য। প্রথাগত মধ্যাহ্নভোজ বা নৈশভোজের বদলে বন্ধুবান্ধব কিংবা পরিবারের সদস্যদের নিয়ে উপভোগ্য সময় কাটাতে এই স্ট্রিট ফুড ফেস্টিভ্যালে একদিন ঢুঁ মারা যেতেই পারে। অ্যাপেটাইজারে স্যুপ ও স্যালাডের রকমারি পসরা সেখানে। ক্রিম অব মাশরুম স্যুপ অথবা থাই স্যুপে শুরু করা যেতে পারে সন্ধ্যাটা। তারপর স্যালাড বার থেকে বেছে নেওয়া যেতে পারে পছন্দের তাজা সবজি আর ফল। কোল্ড কাটস আর নানান রকম ড্রেসিং তো আছেই! খাবারের প্লেটটা নিয়ে বসে পড়ুন কাচের দেয়ালের পাশের কোনো সুসজ্জিত টেবিলে। তারপর তাকান এদিক থেকে ওদিকে। প্রথমবার এলে মুগ্ধতা কাটতে একটু সময় লাগবেই! এই ভবনের সামনে আড়াল হয়ে দাঁড়াবার মতো বড় কোনো দালান এখনো নির্মিত হয়নি। তাই গুলশান ২ থেকেই আপনার চোখে ধরা দেবে শাহজালাল বিমানবন্দরের রানওয়ে ও হ্যাঙ্গার। দেখতে পাবেন বিমানের ওঠানামা। দূরে সেনানিবাস কেন্দ্রীয় মসজিদের চারটা মিনার, ফ্লাইওভারে গাড়ির সারি, গায়ে গায়ে লাগানো দালানের এই শহরে বিরল কিছু ফাঁকা প্লট আর গুলশান লেকের জল। দিনের দৃশ্য আর রাতের দৃশ্যে আকাশ-পাতাল তফাত। তখন তো আলো-আঁধারির খেলা।
শহরের নানান প্রান্তে প্রতি মুহূর্তে তৈরি হওয়া আর মিলিয়ে যাওয়া বিচিত্র ছবি পাখির চোখে দেখতে দেখতেই চলুক খাওয়া-দাওয়া। স্যালাড চেখে দেখার পর গন্তব্য হতে পারে মেক্সিকান খাবারের স্টল। যেখানে তাৎক্ষণিকভাবে বানিয়ে দেওয়া হবে টাকো, নাচো বা বুরিতো। এরপর জাপানের সুশি, চিকেন টেরিয়াকি ইতালির পিৎজা বা পাস্তা খাওয়া যেতে পারে। তবে একটা ঘাটতির কথা বলতেই হয়। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের নানান ঘরানার পথনাশতার কথা ভোজনরসিকেরা ভালো করেই জানেন। কলকাতার কাঠি রোল, দক্ষিণ ভারতের দোসা থেকে মুম্বাইয়ের পাওভাজি- কিছুই নেই এই ফেস্টিভ্যালে! এমনকি বাংলাদেশের ফুচকা বা পুরি, পেঁয়াজু, বেগুনিও স্থান পায়নি। লাইভ কাউন্টারে স্বাস্থ্যকর টাটকা তেলে ভেজে দেওয়া গরম গরম ডালপুরি, পেঁয়াজু কিংবা বেগুনির সঙ্গে তেঁতুল আর ধনেপাতার চাটনি যে গুনে গুনে ১০ গোল দেবার সামর্থ্য রাখে যেকোনো বিদেশি পদকেই!
যার হাতের ছোঁয়ায় ‘দ্য ইটারি’র চুল্লি থেকে নানান সুখাদ্য বেরোচ্ছে, তিনি ‘ফোর পয়েন্টস বাই শেরাটন’-এর ব্রাজিলিয়ান শেফ কাইকি চেরিকোনে। ব্রাজিলিয়ান মানেই ফুটবলের অনুরাগী। ব্রাজিলিয়ান সমর্থক জানান দিতেই কথার ঝুড়ি উপুড় করে দিলেন কাইকি- ‘আমি অনেক দেশ ঘুরেছি। এখানে আগে কাজ করেছেন বা ওয়েস্টিনে কাজ করেছেন এ রকম বেশ কজন শেফকে আমি চিনি। অনেকের সঙ্গে কাজও করেছি। তাদের বেশির ভাগই বিদেশ থেকে আমদানি করা সবজি ব্যবহার করাটা পছন্দ করতেন। আমার কাছে মনে হয়েছে, এখানকার খাবারে টাটকা সবজি ব্যবহার করা উচিত। আমি স্থানীয় কাঁচাবাজারে গিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখেছি, নিজে বেছে সবজি কিনেছি।’ এই ঘোরাঘুরি করতে করতে বেগুনের সঙ্গে দিব্যি প্রেম জমে গেছে এই ব্রাজিলিয়ানের, ‘সবুজ রঙের বেগুনটা আমার কাছে খুব ভালো লেগেছে। অসাধারণ এর স্বাদ। গ্রিল করে খাওয়া যায়, ভেতরে পুর ভরে স্টাফড আইটেম বানানো যায়। অনেক কিছু বানানো যাবে বেগুন দিয়ে।’
স্ট্রিট ফুড মানে শুধু এর স্বাদ নয়, পরিবেশটাও সে রকম হওয়া চাই। রাস্তায় দাঁড়িয়ে চটজলদি খাওয়া, সঙ্গে খাবারের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে জমে ওঠা আড্ডা। এখানে ভেলপুরি, ওখানে ফুচকা। এদিকটায় ঝালমুড়ি, অন্যদিকটায় ঘুগনি-ছোলা। পাঁচ তারকা হোটেলে সেই হইচই সরগরম ব্যাপারটা নেই। তবে যারা পথের খাবারের স্বাদ চাখতে চান, আর খাবারের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিয়ে একদমই আপোস করতে নারাজ, তাদের জন্য ফোর পয়েন্টস বাই শেরাটনের এই আয়োজন জুতসই। যদি সেটা না-ও হয়, তবু পাখির চোখে ঢাকা দেখার জন্য এই ঠিকানায় ঢুঁ মারাই যায়। যে শহরে জানালা দিয়ে আকাশ দেখার বদলে প্রতিবেশীর পেছন বারান্দায় জমা জঞ্জাল দেখতে হয়, সেখানে দিগন্ত জোড়া দৃষ্টি আর ব্রাজিলিয়ান শেফের হাতে খাসা খানার জন্য হাজার চারেক টাকা খরচ তো করাই যায়! আর পকেটে যদি থাকে নির্দিষ্ট কিছু ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড, তাহলে স্বাধীনতা বেড়ে যায় বৈকি!

লেখক: ভোজন রসিক ও ক্রীড়া সাংবাদিক, কালের কন্ঠ
ছবি: ক্যানভাস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top