skip to Main Content

ফিচার I মাংসের শুঁটকি

শুকিয়ে মাংস সংরক্ষণ ও খাওয়া। শিকার-যুগ থেকে এর চল। দিনে দিনে এই খাবার তৈরির প্রক্রিয়া আরও উন্নত হয়েছে

মাংসের শুঁটকির উৎপত্তি হাজার বছর আগে। একসময় যাযাবরের খাবার হিসেবে সঙ্গে নেওয়া হতো মাংসের শুঁটকি। আবিষ্কারের নেশায় মত্ত মানুষের ক্ষুধা নিবারণে এটি সহায়ক হয়েছে। নিরবচ্ছিন্ন ভ্রমণকারীর খাদ্য হিসেবে এর তুলনীয় কিছুই ছিল না। কেননা, এ খাবার পুষ্টিমানে ভরপুর। ভক্ষণযোগ্য থাকে বহুদিন।
খাদ্য সংরক্ষণের তাগিদেই লবণ মেখে সূর্যের আলোয় শুকানো হতো পশুর মাংস। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে গোড়াপত্তন হওয়া রোমান সাম্রাজ্যের সৈন্যদলের পছন্দের খাবার ছিল মাংসের শুঁটকি। শূকরের মাংস শুকিয়ে খাওয়ানো হতো তাদের। মাংস শুকাতে লবণ ব্যবহার করা হতো। সূর্যের আলোর বদলে অনেক সময় আগুনের আঁচে শুকানো হতো। সেনাদল ছাড়াও জনসাধারণের পছন্দের তালিকায় ছিল খাবারটি।
দক্ষিণ আফ্রিকায় মাংসের শুঁটকীকরণের দুটি পদ্ধতি এখন পর্যন্ত টিকে আছে। বিলটং ও জার্কি। উপাদান, স্বাদ ও প্রস্তুত প্রণালির দিকে এ দুটি পদ্ধতির মধ্যে তিনটি পার্থক্য লক্ষণীয়। বিলটং করতে মাংস পুরু করে কেটে শুকানো হয়। জার্কি করা হয় তুলনামূলক পাতলা মাংস কেটে। বিলটং তৈরিতে ভিনেগার ও লবণের প্রয়োজন হয়। এগুলো বিলটং শুঁটকিতে সুগন্ধ এনে দেয়। জার্কিতে ভিনেগার লাগে না। এ ছাড়া বিলটং শুঁটকি তৈরি হয় প্রাকৃতিক তাপে। মাংসের টুকরাগুলো হুকে ঝুলিয়ে রেখে দেওয়া হয়। বিপরীত দিকে জার্কি তৈরি হয় ডিহাইড্রেটরে। ৬ থেকে ১২ ঘণ্টা ধরে। ডাচরা যখন দক্ষিণ আফ্রিকায় যেতে শুরু করে, তখন দীর্ঘ যাত্রাপথে সংরক্ষিত খাবারের প্রয়োজন ছিল তাদের। ফলে, মাংস সংরক্ষণের বিলটং পদ্ধতির উদ্ভাবন ঘটে। অপরদিকে জার্কি পদ্ধতির উদ্ভব ঘটে দক্ষিণ আমেরিকায়। ঊনবিংশ শতাব্দীতে। ইনকা সভ্যতা থেকে উদ্ভূত কেচুয়া উপজাতি এর উদ্ভাবক। তারা যে পদ্ধতিতে বিফ জার্কি করে সেটিকে বলা হয় ‘চা’আরকি’ অথবা ‘চারকুই’। হরিণ ও মহিষের মাংস দিয়ে জার্কি তৈরি করে। মাংস পাতলা করে কেটে আগুনের আঁচে শুঁটকি করে কেচুয়ারা। পরবর্তী সময়ে স্প্যানিশরা এ পদ্ধতি শেখে এবং তাদের মাধ্যমেই সারা বিশ্বে তা ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে বিলটং এবং জার্কি উভয় পদ্ধতিতে তৈরি করা মাংসের শুঁটকি বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় খাদ্য। তবে পুষ্টিবিদেরা জার্কির তুলনায় বিটলং খাওয়ার পক্ষে।
চীনে মাংসের শুঁটকি তৈরি হয় বড় ট্রেতে। কাটা মাংসে লবণ অথবা প্রয়োজনমতো চিনি মিশিয়ে রোদে শুকানো হয়। এভাবে শুকানো মাংসকে চীনে ‘বাকওয়া’ বলে। ভারতে মাংসের শুঁটকিকে বলা হয় ‘হান্টার বিফ’। এ প্রক্রিয়ায় মাংসে পটাশিয়াম নাইট্রেট যোগে মেরিনেট করা হয়। এরপর আভেনে শুকিয়ে নেওয়া হয়।
মাংসের শুঁটকি যেভাবেই তৈরি হোক না কেন, এর পুষ্টিমানে খুব একটা হেরফের হয় না। প্রতি ১০০ গ্রাম শুঁটকিতে ১৭৯ ক্যালরি, ৫.৪ গ্রাম ফ্যাট, ৩.৬ গ্রাম স্যাচুরেটেড ফ্যাট, ৩.৬ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট, ৩.৬ গ্রাম চিনি, ২৮.৬ গ্রাম প্রোটিন, ৩.৯ মিলিগ্রাম আয়রন, সোডিয়ামসহ শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় অন্যান্য উপাদান বিদ্যমান।
কদিন বাদেই কোরবানির ঈদ। শহুরে জীবনে ফ্রিজের কল্যাণে মাংস সংরক্ষণের বিভিন্ন পদ্ধতি বিলুপ্তপ্রায়। তবে মফস্বলে কিংবা যেখানে ফ্রিজ নেই, সেখানে সংরক্ষণের বিভিন্ন পদ্ধতি এখনো চোখে পড়ে। মাংসের টুকরা খেজুরকাঁটা কিংবা কাঁটাচামচ দিয়ে কেচে টিনের কৌটার মধ্যে ভিনেগার অথবা লেবুর রসে ডুবিয়ে সংরক্ষণ করা যায়। আরেকটি পদ্ধতিতে আদা, রসুন ও পেঁয়াজ ভালো করে বেটে মাংসের সঙ্গে মেখে জ্বাল দিতে হয়। সঙ্গে দিতে হয় কিছু চর্বি। একদিন পরপর জ্বাল দিয়ে এ মাংস ১৫ থেকে ২০ দিন ধরে সংরক্ষণ করা যায়। ফ্রিজ আসার আগে পুরান ঢাকার বাসিন্দারা যে বিশেষ পদ্ধতিতে মাংস সংরক্ষণ করতেন, সেটি ‘ঢাকাইয়া কোরমা’ নামে পরিচিত। এতে প্রথমে মাংস লবণ, আদা, রসুন দিয়ে অনবরত জ্বাল দেওয়া হয়। একসময় পানি শুকিয়ে যায়। তিন দিন পর ঘি, তেজপাতা, আদা, রসুন ইত্যাদি যোগে আবার জ্বাল দেওয়া হয়। দ্বিতীয় ধাপে জ্বাল দেওয়ার সময় গরুর পেট থেকে পাওয়া চর্বি টুকরা টুকরা করে মাংসের পাত্রে দেওয়া হয়। চর্বি গলে গেলে মাংস সেই তেলের মধ্যে ডুবন্ত অবস্থায় থাকে। এভাবেই তা সংরক্ষিত থাকে। ঠিকমতো করতে পারলে এক বছর পর্যন্ত মাংস রাখা যায়। এসব পদ্ধতির চেয়ে মাংস শুঁটকি করে সংরক্ষণ করাই সহজ। তবে কাঁচা মাংসের শুঁটকি হয় না।
এই শুঁটকি তৈরি করতে চাইলে মাংস থেকে হাড় ও চর্বি আলাদা করে নিন। ভালো করে ধুয়ে লবণ ও হলুদ মিশিয়ে সেদ্ধ করুন। অতিরিক্ত পানি না দেওয়াই ভালো। মাংস এমনভাবে সেদ্ধ করতে হবে যেন ভেতরে কাঁচা না থাকে। সেদ্ধ হওয়ার পর পানি ঝরিয়ে ঠান্ডা করে নিন। এরপর চিকন তার বা সুতলিতে মাংসের টুকরাগুলো বেঁধে কড়া রোদে শুকাতে দিন। অন্তত দুদিন ধরে শুকাতে হবে। অনেকে চুলার আঁচে শুকায়। তবে সূর্যের আলোতে শুকানোই ভালো। তার বা সুতলিতে ঝোলাতে না চাইলে চৈনিকদের মতো বড় কোনো ডিশে নিয়েও শুকাতে পারেন। শুকিয়ে গেলে নিশ্ছিদ্র পলিথিনে মুড়ে এয়ারটাইট টিনের কৌটায় বন্ধ করে রাখুন। প্রিজারভেটিভ হিসেবে বাড়তি কিছু নিষ্প্রয়োজন। মাংসে ব্যবহৃত হলুদ ও লবণই প্রিজারভেটিভ হিসেবে কাজ করবে। মাংসের শুঁটকি দিয়ে নানা পদের খাবার তৈরি হয়। এর ভুনা অনেক সময় তাজা মাংস ভুনার স্বাদকেও ছাড়িয়ে যায়।
হাই প্রোটিন ও লো ফ্যাট ফুড হিসেবে সারা বিশ্বে মাংসের শুঁটকির চাহিদা বেড়েই চলেছে। আমেরিকানরা স্ন্যাকস হিসেবে এটি খায়। তারা একে এতটাই গুরুত্ব দেয় যে, শুঁটকি তৈরির সময় এর গুণগত মান ঠিক আছে কি না, তা খতিয়ে দেখে। মাংসের শুঁটকির পিএইচ মাত্রা, গন্ধ ও স্বাদ নিশ্চিত হওয়ার পরই বাজারে ছাড়া হয়।

 শিবলী আহমেদ
ছবি: অঙ্কুর রায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top