skip to Main Content

ফিচার I রসনাভেদ

পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশিদের খাবারে মিল যেমন রয়েছে, অমিলও তেমনই। তৈরির পদ্ধতিতে মসলা ব্যবহারে তফাতটা বেশিই। দুই বাংলার খাদ্যচর্চার পার্থক্য নিয়ে রন্ধনশিল্পী আলপনা হাবিব ও নয়না আফরোজের কথাগুলো লিপিবদ্ধ করেছেন শিবলী আহমেদ

খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে বদলেছে রান্নার ধরন। সময়সাপেক্ষ এবং জটিল পদগুলো এখন রাঁধতে বা তৈরি করতে চান না অনেকেই। সহজ খোঁজেন। কয়েক দশক আগেও অতিথি আপ্যায়নে কিংবা শিশুদের খুশি রাখতে বাংলায় পিঠার চল ছিল। সেই জায়গায় এখন এসেছে কাস্টার্ড। বিদেশি পদগুলো দেশের মানুষের পাতে ওঠে ইউটিউব কিংবা গুগলের বদৌলতে। দেশীয় রান্নার পদ্ধতিও বিদেশে যায়। প্রযুক্তির উৎকর্ষে এভাবেই রন্ধনশিল্পের বিনিময় ঘটে। এর মন্দ দিকের পাশাপাশি ভালো দিকও আছে। মানুষ দেশান্তরি হলে এখন আর খাবার খেতে অসুবিধা হয় না। দেশে থাকতেই বিদেশি খাবারে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে সবাই। ষাটের দশকে মার্কিন রেস্তোরাঁর বুফেতে ভাত সহজলভ্য ছিল না। কেউ খেতে চাইলে কোনোমতে দুই চামচ জোগাড় করে দেওয়া হতো। কিন্তু আজকাল আমেরিকান কিংবা ইংলিশ রেস্তোরাঁয় ভাত খাওয়ার সুযোগ আছে। কিন্তু রন্ধনশৈলীর লেনদেনের ফলে দেশীয় রান্নার স্বকীয়তা হারিয়ে যেতে বসেছে। এর জন্য শুধু বিদেশি খাবারের আগ্রাসন নয়, মানুষের ব্যস্ততাও দায়ী। সময়ের অভাবে বেশি মসলার খাবারও বাড়িতে রান্নার পক্ষপাতী নন কর্মজীবীরা। অবশ্য ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য পুরোনো পদগুলো চর্চা করেন কেউ কেউ। সেখানেও কিছুটা ফাঁকি আছে। সংক্ষেপে কাজ সারতে গিয়ে খাবারগুলো মানসম্মত হয়ে উঠছে না। পুরোনো স্বাদ বা গন্ধ বজায় থাকছে না।
ব্যস্ততর জীবনে স্বাস্থ্যের দিকে লক্ষ রাখতে হয়। যার প্রভাব পড়ে খাদ্যাভ্যাসে। অতীতে খাওয়ার পাতে আচার ছিল আবশ্যিক। এখন তেল এড়াতে আচার ছেড়েছেন অনেকে। কার্বোহাইড্রেট কমাতে মিষ্টি খাওয়াও কমেছে।
একটা সময় নারীরা রসুইঘরে বেশি সময় দিতেন। এখন সময় কম, তাই পাটা-পুতায় বেটে মসলা খাওয়ার চল উঠে গেছে। সেখানে এসেছে ব্লেন্ডার। গুঁড়া মসলায় বাজার সয়লাব। আদা-রসুনও বয়ামবন্দি। বলা বাহুল্য নয়, হাতে বাটা মসলা আর ব্লেন্ড করা বা প্যাকেটজাত মসলা ব্যবহার করে তৈরি পদের স্বাদ এক হয় না। মৌলিকতার পাশাপাশি স্বাদও কমে যায়। গন্ধও ঘ্রাণেন্দ্রিয়কে বিচলিত করে না।
রান্না সহজ করার জন্য যোগ হচ্ছে নতুন নতুন উপাদান। ফলে স্বাদ, রান্নার ধরন ও টেক্সচার বাঁক নিচ্ছে নতুন দিকে। রন্ধনশিল্পের এমন বিবর্তন বিশ্বব্যাপী। ভারত ও বাংলাদেশে তো বটেই, উভয় দেশের রান্নায় মিলের পাশাপাশি পার্থক্যও অগুনতি। তফাত মসলায়, রান্নার পদ্ধতিতে ও রঙে। পূজা-পার্বণের রেসিপিগুলোও কিছুটা পৃথক।
পশ্চিমবঙ্গের সনাতন ধর্মাবলম্বী বাঙালিদের রান্না ফোড়ন সমৃদ্ধ। কালোজিরা ফোড়ন, রাঁধুনি ফোড়ন, জিরা ফোড়ন, পাঁচফোড়ন, শর্ষে ফোড়ন ইত্যাদি। বাংলাদেশে একে বাগাড় বলে। কিন্তু এ দুটি পুরোপুরি এক নয়। বাংলাদেশিরা রান্নার শেষে বাগাড় দেয়। সে জন্য আগেই আলাদা করে তেলের ওপর পেঁয়াজ, রসুন, মরিচ, হলুদ দিয়ে একটি মিশ্রণ বানিয়ে রাখতে হয়। তার মধ্যে ডাল অথবা শাক দিয়ে দেন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের ফোড়নে তেলের ওপর প্রথমে ‘ছক’দেওয়া হয়। গরম তেলে কিছু মসলা দিলে ‘ছক’করে শব্দ হয়। সেখান থেকে নামটি এসেছে। তাতে শর্ষে ব্যবহৃত হতে পারে। কিংবা কালোজিরা, সাদা জিরা, পাঁচফোড়ন, রাঁধুনি (ভারতে ব্যবহৃত মসলাবিশেষ)। সঙ্গে শুকনা বা কাঁচা মরিচ। তারপর সবজি। সব শেষে হলুদ ও আদাবাটা। এটাই কলকাতার ফোড়ন পদ্ধতি। বাংলাদেশে সবজি ও বাগাড় আলাদা করে তৈরি করে দুটিকে মিশিয়ে দেওয়া হয়।
দুই বাংলার মুসলমানদের খাবারে জায়ফল ও জয়ত্রীর ব্যবহার আছে। তাদের পদে তেল-মসলার ব্যবহার বেশি। কষিয়ে রান্না করা হয়। পাতলা ঝোল দেখা যায় ভারতীয় বাঙালিদের রান্নায়। মাছের ও মাংসের পাতলা ঝোল হয়। সবজিরও হতে পারে। এমনকি কাঁচকলারও। কলার ঝোল বাংলাদেশের কোনো মুসলমানকে দিলে হয়তো খেতেই চাইবে না। তারা কাঁচকলা দিয়ে ইলিশ মাছ খায়। তা ওপারের বাঙালি হিন্দুরা খায় না। সেখানে ইলিশ মাছের সঙ্গে বড়জোর বেগুন বা কুমড়া দেয়। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের নিরামিষের মধ্যে পার্থক্য আছে। সেই অঞ্চলে নিরামিষ শুক্তো খায় কিন্তু বাংলাদেশিরা মাছের মাথা দিয়ে শুক্তো রাঁধে।
পাঁচমিশালি ডালের প্যাকেট পাওয়া যায় বাংলাদেশে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের ডাল আলাদা। কলকাতায় মটর ডাল খাওয়ার চল আছে, যা বাংলাদেশে খুব একটা প্রচলিত নয়। আবার, এ দেশের ডাল চর্চরি পদটি সম্পর্কে কলকাতার বাসিন্দারা জানে না। তারা ডাল কেবল ঘন কিংবা পাতলা করে রেঁধে খায়।
রান্নার পদ্ধতি ও মসলার ব্যবহারে পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশি বাঙালিদের মধ্যে পার্থক্য আছে। ওপারে হিং খায়। অবাঙালিদের কাছ থেকে এই উপাদানের ব্যবহার এসেছে। হিংয়ের পরিমাণ সম্পর্কে সতর্ক থাকা চাই। বেশি হয়ে গেলে খাবার উৎকট গন্ধে ভরে যায়। কিন্তু পরিমাণমতো দিয়ে ফোড়ন দিলে স্বাদ হয় অনন্য। পশ্চিমবঙ্গের স্থানীয়রা রান্নায় পাঁচফোড়ন ও পোস্তর মতোই হিং ব্যবহার করে। সেখানে হিং কচুরি খুব বিখ্যাত খাবার। এদিকে কিছু বছর আগ পর্যন্ত বাংলাদেশে এটি পাওয়াই যেত না।
দুই বাংলার রান্নায় চিনি ব্যবহারের পার্থক্য আছে। পশ্চিমবঙ্গে এ উপকরণ কমবেশি থাকেই। বাংলাদেশে থাকে না। এ দেশ থেকে কোনো কারণে যারা পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে স্থায়ী হয়েছেন, তারা পেঁয়াজের মিষ্টতা বের করার জন্য রান্নায় চিনি দেন।
কলকাতার বাঙালিরা শাকে পেঁয়াজ দেয় না। যেমন কুমড়া সবজিতে তারা পেঁয়াজ খায় না। পটোলেও দেয় না। আরেকটি উপকরণ হচ্ছে কালোজিরা। তাদের রান্নায় এর উপস্থিতি প্রচুর।
ইলিশ মাছ রান্নার পদ্ধতিতেও পার্থক্য আছে দুই দেশে। আগে কলকাতাবাসী পেঁয়াজ-রসুন দিয়ে ইলিশ রাঁধতেন না। তাদের ধারণা ছিল, এতে মাছ ও ঝোলের স্বাদ নষ্ট হয়। এখন তারা ইলিশে পেঁয়াজ খায়। এ মাছের সবচেয়ে জনপ্রিয় রেসিপি-কালিজিরা ও মরিচ পোড়ার ঝোল। কলকাতায় প্রায় সব মাছের রান্নায় সবজি দেওয়া হয়। বাংলাদেশে খুব একটা হয় না। ওপার বাংলায় মাংস রান্নায় পেঁয়াজ ও রসুন দেয় না। টক দই, আদা ও হিং দেয়। এ ছাড়া কলকাতায় রাঁধুনি নামে একটি মসলা ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশে এর চল নেই।
দুই বাংলার তরকারি বা অন্যান্য পদের রঙেও পার্থক্য আছে। মসলার পরিমাণের তারতম্যের কারণে এই তফাত। বাংলাদেশে ভাজা জিরার গুঁড়া ব্যবহৃত হয় বলে তরকারির রঙ গাঢ়। কলকাতায় হয় না, তাই গাঢ় নয়।
বাংলাদেশের খিচুড়ি মূলত ভুনা। গ্রেভি পদযোগে খাওয়া হয়। তা ডিম বা গোশত ভুনা হতে পারে। আলুর ঝোলও হয়। কিন্তু কলকাতার খিচুড়ি পাতলা। তারা ভাজা পদযোগে খায়। যেমন মাছ, ডিম, আলু, পটোল কিংবা বেগুন ভাজা। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের খিচুড়িতে রঙের পার্থক্য আছে। এ দেশের খাবারটিতে মাংস দেওয়া হয়। কলকাতার বাঙালির মধ্যে মাংস খিচুড়ির প্রচলন কম।
ভর্তার সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা পরিচিত ছিল না। তারা একে মাখা বা সেদ্ধ রূপে চেনে। যদিও ভর্তা ও সেদ্ধ এক নয়। কালোজিরার ভর্তা যে একটি পদ হতে পারে, এটি তারা জেনেছে কিছুদিন আগে। বাংলাদেশে মাছের ভর্তা হয়। কলকাতায় হয় না। আবার গরমকালে কলকাতার বাসিন্দারা পোস্ত খায়। যেমন ঝিঙ্গে পোস্ত, পেঁপে পোস্ত, ঢ্যাঁড়স পোস্ত ইত্যাদি। এ পদগুলো বাংলাদেশে তেমন খাওয়া হয় না।
টক রান্নাতেও পার্থক্য আছে। বাংলাদেশিরা খাট্টায় চিনি দেয় না। রসুন দেয়। কলকাতায় বিষয়টা সম্পূর্ণ বিপরীত। খাট্টাকে তারা টক কিংবা চাটনি বলে। তাতে চিনি থাকে। পেঁয়াজ-রসুন থাকে না। বড়জোর আদা, জিরা ও শুকনা মরিচ দেয়। ফলে বাংলাদেশের খাট্টা এবং কলকাতার চাটনির রঙে পার্থক্য থাকে। খাট্টায় ঝোল ঝোল ভাব থাকে। তা দিয়ে ভাত মেখে খাওয়া যায়। চাটনি দিয়ে ভাত খায় না। তা শেষ পাতে খাওয়ার পদ।
সামনেই দুর্গা উৎসব। দুই বাংলার পূজার খাবার কিছুটা ব্যতিক্রম। অন্যান্য উৎসবের খাবারেও পার্থক্য আছে। যেমন বাংলাদেশে চৈত্রসংক্রান্তিতে পাচন ও লাবাং খাওয়া হয়। কলকাতায় হয় না। দুর্গাপূজার অষ্টমীর দিন কলকাতার সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কেউ কেউ ভাত খায় না। লুচি বা পরাটা খায়। নবমীর দিন মাংস খাওয়ার রেওয়াজ আছে। দশমীতে অনেকে জোড়া ইলিশ খায়। বাংলাদেশের সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কেউ কেউ পূজার সময় আমিষ খায় না। দশমীর দিনে তাদের খাবার হচ্ছে পান্তাভাত, ডালের বড়া, শাপলা ভাজি। ঠাকুর বিসর্জন হওয়ার পর বাড়িতে আমিষ রান্না করে। দুর্গাপূজায় বাংলাদেশে দুপুর ও রাতের খাবারে মিষ্টি থাকে। সাধারণত পায়েস খাওয়া হয়। কিন্তু কলকাতায় মিষ্টি না-ও থাকতে পারে। সেখানে মিষ্টি খাওয়া হয় বিসর্জনের দিন। ঠাকুর ভাসানের পর।

ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top