skip to Main Content

বিশেষ ফিচার I অ্যান্টি-ফ্যাশন

ছক ভাঙার ফ্যাশন। গড্ডলিকার বাইরে নিজেকে প্রকাশের পরিবর্তনশীল পোশাকধারা। লিখেছেন আশরাফুল হক

পোশাক ও অনুষঙ্গের সর্বসাম্প্রতিক প্রচলিত ও জনপ্রিয় ধারাই হচ্ছে ফ্যাশন। নিজেকে হালনাগাদ রাখতে যারা চায়, তারাই চালু হয়ে যাওয়া কেতায় সমর্পিত হতে পছন্দ করেন। এই টেনশন থেকে যে, লোকে যদি ‘সেকেলে’ বলে! ফ্যাশন তাদের জন্য সমকালীন হয়ে ওঠার পথ বা অবলম্বন। বিপুল-অধিকাংশ মানুষ, বিশেষত যারা শহরের বাসিন্দা, তাদের চাই এমন এক পোশাক-কেতা, যা নিশ্চিন্তে গ্রহণ করা যায়, অন্তত যাতে কেউ ভ্রু কুঁচকাবে না। প্রত্যেকেই চায় সময়ের কাছে বিশ্বস্ত থাকতে, তা প্রামাণ্য হয়ে ওঠে পোশাক এবং এর সঙ্গে মানানসই অনুষঙ্গে। এটা একটা ছক, যা তৈরি করে জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী ফ্যাশন ব্র্যান্ড, এর পেছনে কাজ করেন বিখ্যাত ও দক্ষ ডিজাইনাররা। একধরনের সংগঠনমূলক সক্রিয়তার মধ্য দিয়ে এর বিপণন ঘটে, ছড়িয়ে পড়ে এবং বিপুল মানুষের শরীরে শোভা পেতে থাকে। এর বিপরীতে অবস্থান নেওয়া কিংবা একে এড়ানো কঠিন। কিন্তু সেই প্রয়াস যে কেউ নেয় না, তা নয়। বিশেষত যারা স্রোতের উল্টো চলতে চায়, প্রচলিত পোশাক পরে নিজেকে ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে ফেলতে চায় না, তারাই এমনটি করে। অনেকের কাছেই এ হলো স্বাতন্ত্র্যের ভাষা কিংবা বিদ্যমান সংস্কৃতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। এমনকি, পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিপ্রতীপে অনেকেই নিজেদের অবস্থান ব্যক্ত করে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের চালু করা পোশাক বর্জনের মধ্য দিয়ে। তারা পরে নিজেদের উদ্ভাবিত পোশাক। কিংবা এমন পোশাক, যা ট্রেন্ডের বাইরে। অথবা, প্রচলিত পোশাক ও অ্যাকসেসরিজের মধ্যেই গ্রহণ-বর্জনের মাধ্যমে সৃষ্টি করা হয় ব্যতিক্রমী লুক, যাতে সবার থেকে ব্যবহারকারী লক্ষণীয়ভাবে আলাদা হয়ে ওঠে। সমালোচকেরা একে অ্যাটেনশন সিকিং ফ্যাশন বা দৃষ্টি আকর্ষণের ফ্যাশন বলে অভিহিত করেন। তবে হাই-প্রোফাইল ডিজাইনাররা এর পক্ষে, তারা বেশির ভাগ সময় এমন পোশাক পরেন, যা বাজার-চালু ডিজাইনের বাইরে এবং নিজেদের পোশাকনকশা কোনো ব্র্যান্ডের হাতে ছেড়ে দেন না। অর্থাৎ এটি বিপণনের সুযোগ তারা রাখেন না। সংগীত দলের সদস্য ও নারীবাদীরা এমন পোশাক ও অ্যাকসেসরিজ ধারণ করেন, যাতে এড়িয়ে যাওয়া হয় ফ্যাশনের প্রচলিত ধারা। এ ক্ষেত্রে ব্যান্ড ও ফেমিনিস্টদের দুরকম দৃষ্টিভঙ্গি সক্রিয়। একদলের উদ্দেশ্য প্রথা ভাঙা ও স্বাতন্ত্র্য সৃষ্টি আর অন্যরা পুরুষতন্ত্র-নির্দেশিত পোশাকসংস্কৃতির বিরুদ্ধে অবস্থান জানিয়ে দেয়।

এই প্রবণতা শুরু হয়েছে গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশক থেকে, যখন বিভিন্ন ব্যান্ডের সদস্য ও নারীবাদে দীক্ষিত কর্মীদের প্রেরণায় আটলান্টিকের দুই পারে রঙিন ও ‘ফ্যাশনেবল’ পোশাক বর্জন করে সাদা-কালো ড্রেস পরার ট্রেন্ড চালু হয়। লৈঙ্গিক পোশাক বাদ দিয়ে মেয়েরা পরতে শুরু করে ছেলেদের পরিধেয়, তবে তাতে ডিজাইনের খানিকটা বদল ঘটে ফেমিনিন লুক রক্ষার জন্য। অন্যদিকে ছেলেরা কালো প্যান্ট ও সাদা টি-শার্ট পরতে থাকে। কিন্তু এই দৃশ্যের জন্ম আরও আগে, মূলত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে, বিশ শতকের প্রথম দশকে, যখন অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব পোশাকেও পড়েছিল এবং মিনিম্যালিস্টিক ফ্যাশনের প্রচলন সে-সময়েরই দান। গ্যাব্রিয়েল বোঁরে শ্যানেল (১৮৮৩-১৯৭১), যিনি কোকো শ্যানেল নামে বিখ্যাত, তাঁর হাতেই এর শুরু। অসচ্ছলদের জন্য তিনি প্রণয়ন করেন এমন পোশাক, যাতে ‘লেস ইজ মোর’ বার্তাটি দ্রষ্টব্য হয়ে ওঠে। মেঝে-ছোঁয়া গাউনের নিচের প্রান্ত ক্রমে গোড়ালি, তারপর হাঁটু অব্দি উঠে আসে। রঙেও তা হয়ে এলো মিনিম্যালিস্টিক, মানে সাদা আর কালোর বাইরে গিয়ে খরচ বাড়ানো যাবে না। মার্কসীয় প্রেক্ষণবিন্দু থেকে একে বর্ণনা করা হয়েছে বুর্জোয়া ফ্যাশনের বিপরীতে প্রলেতারিয়েত ফ্যাশন বলে। অধিকন্তু পোশাকের মধ্য দিয়ে বঞ্চিতরা নিজেদের অবস্থান বোঝানোর একটা সুযোগ পেল।
অ্যান্টি-ফ্যাশনের ধারণাটি রোম্যান্টিক, (কিছুটা নৈরাজ্যবাদীও বটে) যদিও এর শুরু বাস্তবতাকে মোকাবিলা করতে গিয়ে। তবে যে স্টাইলে চার্লি চ্যাপলিনকে (১৮৮৯-১৯৭৭) দেখা যেত রুপালি পর্দায়, তা অ্যান্টি-ফ্যাশনেরই প্রতিনিধিত্ব করে। এই সূত্রে যে সমকালীন ফ্যাশন সংস্কৃতি ও সাজসজ্জার প্রতিষ্ঠিত ছককে এতে অস্বীকার, কোথাও কোথাও আঘাত করা হয়েছে। চ্যাপলিনের লক্ষ্যবস্তু ছিল পণ্যবাদী সমাজ, যেখানে পুঁজিপতিরা মানুষের জীবনধারার নিয়ন্ত্রক। এই সিস্টেম বা ব্যবস্থাকে তিনি উপহাস করেছেন, উদাহরণস্বরূপ, উল্টাভাবে জুতা পরে। অ্যান্টি-ফ্যাশন যদি পোশাকে প্রতিবাদের ভাষা হয়, তবে মানতে হয়- চ্যাপলিনের সাজপোশাক তাই। তবে সমকালীন ফ্যাশনে এটা কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি; সে রকম উদ্দেশ্য চ্যাপলিনের সম্ভবত ছিল না। অধিকন্তু, সে-সময় এবং আজও, অ্যান্টি-ফ্যাশনের লক্ষ্য বাজার বা ভোক্তা নয়; বরং বাজার-অর্থনীতিতে গৃহীত পোশাকসংস্কৃতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা। অন্যদিকে ফ্যাশনের গড্ডলিকা প্রবাহের বিপরীতে দাঁড়ানো, যার মধ্য দিয়ে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের প্রকাশ ঘটে। এটা সৃষ্টিশীল, কারণ বাজার-নির্ধারিত ফ্যাশনের ছক ভেঙে পোশাক সম্পর্কে নতুন ও ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ এর অভিপ্রায়। যারা এটি সৃষ্টি করেন, তারা চান না তাদের প্রণীত পোশাকের ডিজাইন কেউ অনুসরণ করুক। বা, তা মামুলি হয়ে যাক। এটা আজকের বাস্তবতা কিংবা যে লক্ষ্যে অ্যান্টি-ফ্যাশনের উদ্ভব ঘটেছিল এবং পল্লবিত হয়েছিল, তা থেকে এটি সরে গেছে। অসচ্ছলদের পোশাক ক্রমে বুর্জোয়া ফ্যাশনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদজ্ঞাপক হয়ে উঠলো, তারপর নারীবাদীরা পুরুষতন্ত্রের বিপরীত ভাষা হিসেবে একে প্রকাশ করতে লাগলেন এবং শেষ পর্যন্ত তা হয়ে গেল এলিটদের স্বাতন্ত্র্য দেখানোর পোশাক।
অ্যান্টি-ফ্যাশনে পোশাকের সুনির্দিষ্ট কোনো রূপরেখা নেই। কেননা, এটি ছক ভাঙার ফ্যাশন। শুরুতে প্রয়োজন, পরে মতাদর্শিক অবস্থান একে নিয়ন্ত্রণ করেছে। আর এখন এটি নিছক ব্যক্তিক এবং আভিজাত্যসুলভ স্বাতন্ত্র্য প্রকাশের উপায়। তবে এই বিবর্তন অ্যান্টি-ফ্যাশনের ধারায় কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। সেই সাদা-কালো, চাকচিক্যবর্জিত আর কখনো কখনো ক্যাজুয়ালের মধ্যে ব্যতিক্রমী লুক সৃষ্টির প্রয়াস আজও অব্যাহত। তা কেবল নিজের ব্যক্তিত্ব ও অবস্থান আলাদা করে জানিয়ে দেওয়ার জন্য। এখনকার ডিজাইনাররা যেসব পোশাক পরে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে হাজির হন, সেগুলো চলতি ফ্যাশনের বাইরে। এসব পোশাকের ডিজাইন তারাই করে থাকেন এবং আর কারও তা পরার সুযোগ নেই, অন্তত কেনার ব্যবস্থা নেই। অর্থাৎ আজকাল এই ফ্যাশনের মানে হলো নিজের ডিজাইনে বানানো পোশাক। তবে তা সাদা-কালো হওয়া চাই। ম্লান সাদা হলেও চলে। নিজের করা ডিজাইন আর সাধারণ যেকোনো ফ্যাব্রিক নিয়ে দর্জির কাছে গিয়ে এই পোশাক তৈরি করিয়ে নেওয়া যায়।
আগেই বলা হয়েছে, ফ্যাশনের প্রচলিত ছক বা ধারা ভেঙে সাদামাটা অথচ ইউনিক সাজপোশাক অ্যান্টি-ফ্যাশনের মূলকথা। বাংলাদেশের বিখ্যাত গায়ক জেমস প্রথম এই ফ্যাশন নিয়ে আসেন। গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে পাঞ্জাবি ও জিনসের সঙ্গে কালো জুতা আর কখনো কখনো সাদা কেডস পরে তিনি শ্রোতাদের সামনে হাজির হন। অ্যান্টি-ফ্যাশনের অনুসারীরা নিজেদের স্টেটমেন্ট পাল্টাতে অভ্যস্ত। জেমসও তাই করেছেন। শুরুতে জিনস-পাঞ্জাবি-জুতার সঙ্গে সব ঋতুতেই তাঁর গায়ে চাদর দেখা যেত। পরে চাদরের পরিবর্তে গামছা জড়িয়ে তিনি বদলে ফেলেছেন নিজের ফ্যাশন লুক। অ্যাকসেসরিজেও ঘটিয়েছেন বদল। নানা মেটালের ব্রেসলেট পাল্টে প্লাস্টিকের ব্রেসলেট যেমন পরেছেন, তেমনি কবজিতে কিছুই না পরেও শ্রোতার সামনে এসেছেন। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা পরতে তাঁকে দেখা গেছে সম্প্রতি। ফলে, তিনি হয়ে উঠেছেন এই অঞ্চলের অ্যান্টি-ফ্যাশনের সবচেয়ে লক্ষ্যযোগ্য আইকন।
অ্যান্টি-ফ্যাশনে ব্যক্তি নিজের হয়ে ওঠে। কোনো প্রথা, রীতি, ছক, ট্রেন্ড এর ব্যাঘাত ঘটাতে পারে না। অনুকরণের বাইরে এটা ব্যক্তিকে দেয় নিজের রুচি ও মূল্যবোধ প্রকাশের সুযোগ। কিন্তু দৃষ্টি আকর্ষণ এর উদ্দেশ্য নয়। তা সত্ত্বেও ফ্যাশনেবলদের ভিড়ে এটি নজর কাড়ে। স্বাতন্ত্র্যের জোরে ছাপিয়ে যায় সবাইকে।

ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top