skip to Main Content

বিশেষ ফিচার I কোড়লকাহন

পাহাড়বাসীর প্রচলিত খাবার। জনপ্রিয়তা পাচ্ছে সমতলে। সুস্বাদু ও পুষ্টিকর। বিদেশেও এর চাহিদা বিপুল। লিখেছেন শিবলী আহমেদ

মানুষের খাদ্যতালিকায় কচি বাঁশ ঠিক কবে যুক্ত হয়েছে, তা অজানা। তবে ১৪ শ বছর আগে চীনের তাং সাম্রাজ্যের লোকেরা এটি খেত। বাঁশের পদগুলো বিশেষ মূল্যবান ছিল তাদের কাছে। ঘাস পরিবারের অন্তর্ভুক্ত এ উদ্ভিদের আঁতুড়ঘর ভাবা হয় চীনকে। সেখান থেকে এটি খাওয়া রপ্ত করে মোঙ্গলরা। যাযাবরদের মাধ্যমে বাঁশের বিভিন্ন রেসিপি ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলে। ভারতে এ খাবার কীভাবে এলো, তা অজ্ঞাত। তবে বাঁশের ‘কোড়ল’ নিয়ে এই অঞ্চলে একটি লোককাহিনি আছে। কোনো এক সময় একটি খরগোশ টানা তিন মাস শুধু বাঁশ খেয়ে বেশ হৃষ্টপুষ্টভাবে বেঁচে ছিল। সেটি দেখে ভারতবাসী ধারণা করে যে এটি নিশ্চয়ই খুব স্বাস্থ্যকর খাবার। এরপর তারা বাঁশ থেকে কোড়ল সংগ্রহ করে খাওয়া শুরু করে।
বাঁশের মোথা থেকে মাটি ফুঁড়ে শিঙের মতো যে কচি কান্ড গজায়, সেটিই কোড়ল। ইংরেজিতে ব্যাম্বু শুট। মারমারা বলে ‘মহ্ই’। ত্রিপুরাদের কাছে ‘মেওয়া’। চাকমা ভাষায় ‘বাচ্ছুরি।’ কোড়ল ৬ থেকে ১০ ইঞ্চি লম্বা হলে ধারালো চাকু দিয়ে কেটে সংগ্রহ করতে হয়। এরপর পানিতে ৪৫ মিনিট সেদ্ধ করলে বাইরের শক্ত আবরণ আলগা হয়ে যায়। ছাড়িয়ে নিলে নরম অংশ বেরিয়ে আসে। তা ছোট ছোট করে কেটে এক থেকে দেড় ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হয়। আরও নরম করতে চাইলে দ্বিতীয় দফা সেদ্ধ করে নেওয়া যেতে পারে। এভাবেই তা খাওয়ার উপযোগী হয়। মুলী, ফারুয়া, বরাক, মিতিঙ্গা, প্যাঁচা ও ওরা বাঁশের কোড়ল খেতে বেশ সুস্বাদু।
বাংলাদেশের সমতলবাসীর মধ্যে বাঁশের কোড়ল খাওয়ার তেমন চল নেই। কারণ, সেখানে বিভিন্ন মৌসুমে রকমারি শাকসবজি জন্মে। কিন্তু পাহাড়ের ফলন ভিন্ন। জুম চাষ ছাড়া শাকসবজি মেলে না। পাহাড়ের ঢালে যেটুকু ফলে, তা দিয়ে সবার চাহিদা মেটে না। বর্ষাকালে তো জুমেও শাকসবজি জন্মে না। তাই এ ঋতুতে তাদের প্রধান নিরামিষ হয় এই সবজি। মে থেকে অক্টোবর পর্যন্ত পাওয়া যায় বাঁশের কচি এ অংশ।
কোড়ল বেশ পুষ্টিকর। চীনারা এটিকে ‘স্বাস্থ্যকর খাবারের রাজা’ বলে। একটি তাজা কোড়লে প্রায় ৯৩ শতাংশই থাকে পানি। এ ছাড়া প্রোটিন আছে ০.৯৫ শতাংশ, চর্বি ৫.৮৬ শতাংশ, চিনি ১.৩৪ শতাংশ, সেলুলোজ ১.১ শতাংশ। কিছু খনিজ ও ভিটামিন মেলে। কোড়ল খেলে কোলেস্টেরল, হৃদ্রোগ, উচ্চ রক্তচাপ ও ক্যানসারের ঝুঁকি কমে। কোষ্ঠকাঠিন্য, হাঁপানি, ডায়াবেটিস, জ্বর ও মৃগী রোগ সারাতে পারে খাবারটি।
সবজি ছাড়াও কোড়লের আচার হয়। মাছ, শুঁটকি ও মাংসযোগে এর মুখরোচক পদ রান্না করা যায়। স্যালাড ও স্যুপ করেও খাওয়া সম্ভব। গাঁজন প্রক্রিয়ায় করা কোড়লের তরকারি উত্তর-পূর্ব ভারত ও বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলে বেশ জনপ্রিয়। দুই অঞ্চলের পদে পার্থক্য শুধু রান্নায়। কষিয়ে, সেদ্ধ করে বা ভেজে খাওয়া যায় কোড়ল।
রান্নার পাত্র হিসেবেও ব্যবহৃত হয় বাঁশ। ত্রিপুরা ও মারমা নৃগোষ্ঠীর মানুষ মুরগির মাংসের সঙ্গে পাহাড়ি মসলা মিশিয়ে বাঁশে পুরে ব্যাম্বু চিকেন রাঁধে। কেবাং নামে রান্নার একটি পদ্ধতিতে লাগে বাঁশের খোল। ভেতরে তেল-মসলার সঙ্গে মাছ অথবা মাংস পুরে কয়লার আঁচে রান্না করা হয় বিশেষ এই পদ। ‘করেইর চিনচু’ খাবারটি রান্না করতে বাঁশ ব্যবহার করে মণিপুরিরা। শুকনা মাছ, ভেজে রাখা চাল এবং মারৈ মিশিয়ে তৈরি করা হয় খাবারটি। মারৈ হচ্ছে মণিপুরি চাষিদের ফলানো সবজির সাধারণ নাম। বান্দরবানে ‘মুন্ডিং’ রাঁধতে হয় বাঁশের ভেতর। এ জন্য চাল ভিজিয়ে নরম করে নিতে হয়। তা দিয়ে তৈরি নুডলস বাঁশের চোঙায় পুরে তৈরি করে পাহাড়িরা। খাবারটি চিংড়ি কিংবা শুঁটকি যোগে পরিবেশনের চল আছে। এ ছাড়াও নাপ্পি ও হেবাং নামের দুটি পদের রান্নায় বাঁশের ব্যবহার আছে। সিলেটে ‘হাঁস-বাঁশ’ নামের একটি খাবার বেশ জনপ্রিয়। কচি বাঁশের কুচির সঙ্গে হাঁসের মাংস, প্রয়োজনীয় মসলা ও পছন্দের সবজিযোগে রান্না হয় পদটি।
কোড়ল রান্নার মসলায় রকমফের আছে। রন্ধনশিল্পী নয়না আফরোজ ক্যানভাসকে জানিয়েছেন, বাঁশ রান্নায় বিভিন্ন রকমের মসলার ব্যবহার হয়। বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলের রাঁধুনিরা কোড়ল রান্নায় হলুদ, মরিচ, রসুন, ধনে ও জিরা দেন। চীন ও থাইল্যান্ডে স্থানীয় মসলা দিয়ে রান্না করা হয়। ঘাসজাতীয় উদ্ভিদ হলেও বাঁশের যে অংশটি খাওয়া হয়, তাতে হজমে সমস্যা হওয়ার আশঙ্কা নেই। কোড়ল খুব গুরুপাকও হয় না। তবে অতিরিক্ত না খাওয়াই ভালো।
সারা বিশ্বে কোড়ল খাওয়ার আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে। বর্তমানে এর বার্ষিক চাহিদা ২৫০ হাজার টন। এর প্রায় ৭০ শতাংশই কিনে নেয় জাপান। সবচেয়ে বেশি বাঁশ চাষ হয় চীনে। বিশ্বের ৩৭টি দেশে বছরে গড়ে ১৩৭ হাজার টন টিনজাত ও প্যাকেটজাত কোড়ল রপ্তানি করে তারা। কোরিয়া, জাপান, হংকং, সিঙ্গাপুর, জার্মানি, ইংল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, সুইডেন প্রভৃতি দেশে এই খাদ্যের ব্যাপক চাহিদা ও বাজার আছে। ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, লাওস ও থাইল্যান্ডেও কোড়ল জনপ্রিয়।
কিন্তু কোড়লের চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে উজাড় হচ্ছে বাঁশঝাড়। এমনিতেই সব কোড়ল বাঁশে পরিণত হতে পারে না। কিছু কিছু নষ্ট হয়ে যায়। খেয়ে ফেলার কারণেও কমছে বাঁশ। সব কোড়ল না কেটে কিছু কিছু রেখে দিলে তাতে ঝাড়ের কোনো ক্ষতি হয় না। কিন্তু সচেতনতার অভাব এবং কোড়ল সংগ্রহে অনভিজ্ঞতার কারণে বাঁশ বিলুপ্ত হচ্ছে। জোগান কম হওয়ায় প্রতি কেজি ৪০ টাকা দরের কোড়ল এখন ১০০ টাকায় কিনতে হয়। দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করে এর থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব। কিন্তু পাহাড়িদের ক্রমবর্ধমান বাসস্থানের চাহিদা মেটাতে কেটে ফেলা হচ্ছে ঝাড়। বিলুপ্ত হচ্ছে নানা প্রজাতির বাঁশ; সেই সঙ্গে কোড়ল। যে পরিমাণ বাঁশ কেটে ফেলা হচ্ছে, সে পরিমাণে চাষ হচ্ছে না। এখনই সচেতন না করা গেলে হারিয়ে যাবে এই উদ্ভিদ। সেই সঙ্গে মানুষের খাদ্যতালিকা থেকে বিলুপ্ত হবে কোড়ল।

ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top