skip to Main Content

বিশেষ ফিচার I প্রমীলা বিজ্ঞানী

মনে করা হয় কেবল সংগীত, নৃত্য ও শিক্ষকতাতেই নারীর কৃতিত্ব। বিজ্ঞানেও যে তাদের বিস্তর অবদান রয়েছে, তার পুরোপুরি হদিস কি আমরা পাই?

সভ্যতার অগ্রগমনে নারী-পুরুষের অবদান ছিল সুষম। কিছু ক্ষেত্রে অবশ্য মেয়েদের অবদানই বেশি। আগুনের আবিষ্কার নারীর হাত ধরে হয়েছিল বলে অনুমেয়। এমনকি কৃষিও। মৃৎপাত্র, সুতা কাটার কৌশল, তাঁত, শণ ও তুলা কাজে লাগানোর কৃতিত্ব নারীরই। তবে তাদের উদ্ভাবন, আবিষ্কার ও প্রবর্তনকে উপেক্ষা, অবহেলা ও গোপন করার অভিযোগ আছে পুরুষতন্ত্রের প্রতি। সে আলাপ ভিন্ন। স্বীকৃতি-অস্বীকৃতির এসব ধাঁধায় বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে নারীর অবদানের বিষয়টিকে পুরোপুরি ধামাচাপা দেওয়া সম্ভব হয়নি। বাধার জাল ভেদ করে অনেক কীর্তিমতীর কাজের প্রমাণ প্রকাশ্যে এসেছে।
বিজ্ঞানে আলোকশিখা জ্বালিয়েছেন, এমন ১৩৫ জনের বেশি নারীর কথা এখন অনেকেরই জানা। অল্প কথায় তাদের সবার যথাযথ বিবরণী তুলে ধরা সম্ভব নয়। তবে ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা চলতেই পারে। শুরু করা যাক ‘হাইপেশিয়া’কে দিয়ে। মিসরীয় নব্য প্লেটোবাদী দার্শনিক ও গণিতজ্ঞ তিনি। প্রাচীন বিজ্ঞান বোঝার দরজা হিসেবে স্মরণীয় এই নারী। উল্লেখ করা যায় অষ্টাদশ শতাব্দীর ফরাসি গণিতবিদ সোফি জার্মেইনের কথাও। সংখ্যাতত্ত্ব ও গাণিতিক পদার্থবিদ্যায় তার অবদান অসামান্য। বিশেষ করে স্থিতিস্থাপকতার সূত্রে।
প্রথম ফসিলের অনুসন্ধানকারীও একজন নারী। মেরি অ্যানিং; জন্ম ইংল্যান্ডে। লন্ডনের জিওলজিক্যাল সোসাইটি থেকে কাজের স্বীকৃতিও পেয়েছেন। উড়ন্ত সরীসৃপ জাতীয় প্রাণীর জীবাশ্ম আবিষ্কার করেছিলেন তিনি। পাথরে ঢাকা একটি সমতল জায়গা দেখে তার মনে সন্দেহ জেগেছিল। খনন করে সেখান থেকে চার ফুট লম্বা একটি মুখম-ল পাওয়া যায়। জীবাশ্মটির নাম দেওয়া হয় সামুদ্রিক ড্রাগন। নারীদের মধ্যে দুবার নোবেল জয়ী কীর্তিমতীও আছেন। তার নাম মেরি কুরি। পোল্যান্ডের এ বিজ্ঞানী রেডিয়াম ক্লোরাইডকে তড়িৎ বিশ্লেষণ করে সম্পূর্ণ বিশুদ্ধ রেডিয়াম নিষ্কাশনে সমর্থ হয়েছিলেন।
নোয়েথারের উপপাদ্যের সঙ্গে গণিতজ্ঞরা পরিচিত। তা প্রমাণ করেন এমি নোয়েথার। তিনি জার্মানির একজন নারী বিজ্ঞানী। আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্বের ওপর করা তার কাজ নোয়েথারের তত্ত্ব নামে পরিচিত। গণিতে পিএইচডি করেন এ নারী। ১৯১৮ সালে দুটি উপপাদ্য প্রমাণ করেন নোয়েথার। ডিএনএ এবং উদ্ভিদের ভাইরাস-সংক্রান্ত গবেষণায় বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন লন্ডনের নারী বিজ্ঞানী রোজালিন ফ্রাঙ্কলিন। ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক অ্যাসিডের একক তন্তুর উচ্চ বিশ্লেষণী ফটোগ্রাম নেওয়ার উপায় প্রবর্তন করেন তিনি। লন্ডনের আরেক নারী বিজ্ঞানী আডা বায়রন। সায়েন্টিফিক গণনার প্রতিষ্ঠাতা এই কীর্তিমতী। ফ্লায়িং মেশিনের নকশাও প্রণয়ন করেন তিনি।
রিকার্সিভ ফাংশন তত্ত্বের প্রতিষ্ঠাতা হাঙ্গেরির নারী বিজ্ঞানী রোজসা পিটার। আধুনিক গণিতে তার অবদান বহুমুখী। বিজ্ঞানে হেলেন সয়ের হগের অবদানও অনস্বীকার্য। দুই শর বেশি গবেষণাপত্র তৈরি করেছেন তিনি। ভেরিয়েবল স্টারের ওপর করা তার তালিকা এখনো জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা ব্যবহার করেন। মিল্কিওয়ে থেকে অন্য গ্যালাক্সিগুলোর দূরত্ব পরিমাপের কৌশল আবিষ্কার করেছেন এই নারী।
নৃবিজ্ঞানী জেন গুডল। শিম্পাঞ্জিদের সামাজিক ও পারিবারিক জীবনের ওপর গবেষণা করেছেন দীর্ঘ ৫৫ বছর। প্রাণীটি সর্বভুক এবং শিখিয়ে দিলে ওরা বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে পারে—এটি আবিষ্কার করেছেন এই নারী। কিছু মরণব্যাধির প্রতিষেধক আবিষ্কারে মেয়েদের অবদান আছে। ম্যালেরিয়ার ওষুধ তৈরিতে ভূমিকা রেখেছেন গার্টরুড ইলিয়ন। এ কারণে ১৯৮৮ সালে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন তিনি। জিনতত্ত্ব নিয়ে কাজ করেছেন বারবারা এমসিক্লিন্টক। ক্রোমোজমের অভ্যন্তরে জিনের স্থান পরিবর্তনের ক্ষমতা আবিষ্কার করেছেন তিনি। ভুট্টার আণবিক গঠন আবিষ্কার করে বিজ্ঞানী মহলে খ্যাতি পেয়েছেন। ১৯৮৩ সালে ফিজিওলজিতে নোবেল পুরস্কার পান বারবারা। অ্যাটমিক নিউক্লেইয়ের গঠন ব্যাখ্যা করে এই পুরস্কার পান আরও একজন নারী। তার নাম মারিয়া গোএপ্পার্ট মায়ার। ডরোথি হডজকিনও নোবেল পুরস্কার লাভ করেছেন। ১৯৪৫ সালে তিনি ডাইমেনশনের বায়োমলিকিউলার স্ট্রাকচার বিজ্ঞানীদের সামনে আনেন। ১৯৪৮ সালে ভিটামিন বি১২ এর মলিকিউলার স্ট্রাকচার আবিষ্কার করেন ডরোথি। রসায়নে নোবেল পুরস্কার পান নারী বিজ্ঞানী আইরিন জোলিয়ট কুরি। কৃত্রিম রেডিও অ্যাকটিভিটি আবিষ্কার করেছেন এই নারী। এ বিষয়ে কাজ করেছেন লিসে মাইটনারও। তবে তা ছিল নিউক্লিয়ার ফিজিকসের ওপর। তিনি প্রটেক্টিনিয়াম ও নিউক্লিয়ার ফিশন আবিষ্কার করেন। তার নামানুসারেই ‘মাইটনারিয়াম’-এর নাম রাখা হয়। এসব কৃতিত্ব ১৯৪৪ সালে তাকে নোবেল পুরস্কার এনে দেয়।
আগুনের ভয়াবহতা থেকে মানুষকে বাঁচাতে অ্যানা কোন্নেলি আবিষ্কার করেন ফায়ার স্কেপ। যা এখনো অগ্নিনিরাপত্তার জন্য বিভিন্ন বিল্ডিংয়ে ব্যবহৃত হয়। পেপার ব্যাগ বানানোর যন্ত্র আবিষ্কার করেন নারী উদ্ভাবক মার্গারেট নাইট। এই থলে সুবিধাজনক ও পরিবেশবান্ধব। এ ছাড়া বর্তমানে আমরা বিদ্যুচ্চালিত যে রেফ্রিজারেটর ব্যবহার করি, সেটির নেপথ্যে আছেন ফ্লোরেন্স পারিপার্ট। এই মেশিন ছাড়াও ১৯০০ সালে রাস্তা পরিষ্কারক যন্ত্র নির্মাণের প্যাটেন্ট লাভ করেন এই নারী।
চিকিৎসাবিজ্ঞানে ইনজেকশন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি সরঞ্জাম। সেটির আবিষ্কারক লেটিটা গির। যিনি একজন নারী। নিরাপত্তাব্যবস্থার উন্নতিতেও মেয়েদের ভূমিকা আছে। বাসার সিকিউরিটি সিস্টেম তৈরি করেন ম্যারি ভ্যান। ক্যামেরার সাহায্য বাড়ি ও আঙিনার ছবি সরাসরি একটি টেলিভিশনে দেখার কৌশলের আবিষ্কারক এই নারী। এই সিস্টেমের সঙ্গে টু-ওয়ে অডিও ইকুইপমেন্ট যুক্ত করে দরজার সামনে থাকা আগন্তুকের সঙ্গে কথা বলার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
নারীদের আরেকটি আবিষ্কার হচ্ছে ডিশওয়াশার। এই কৃতিত্ব জসেফিন কোক্রেইনের। তার অধীনে থাকা সাফাই কর্মীদের কষ্ট কমাতেই মোটরচালিত ডিশওয়াশার তৈরি করেছিলেন। গাড়ির উইন্ডশিল্ড ওয়াইপারের আবিষ্কারকও একজন নারী। নাম ম্যারি অ্যান্ডারসন। ধনী হওয়ার মজার খেলা নামে পরিচিত মনোপলি বোর্ড নারীরই দান। ১৯০৪ সালে এলিজাবেথ ম্যাগি আবিষ্কার করেন এটি। পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে এ খেলার জন্ম দেন তিনি। নারীদের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার হচ্ছে তারবিহীন যোগাযোগব্যবস্থা। এ যুগের বেতার ইন্টারনেট ও ফোন যোগাযোগ পদ্ধতি সেটিরই আধুনিক রূপ। ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহার করে আবিষ্কৃত এই পদ্ধতি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় চালু হয়। এই প্রযুক্তির আবিষ্কারক হ্যাডি লামার। তিনি একজন অভিনেত্রীও ছিলেন।
বড় বড় জাহাজে লাইফবোট দেখা যায়। সামুদ্রিক প্রতিকূলতায় বিপন্ন মানুষের জীবন বাঁচাতে এ ধরনের নৌকা আবিষ্কার করেন মারিয়া ব্যেইস নামের একজন নারী উদ্ভাবক। এ ছাড়া আইসক্রিম বানানোর যন্ত্র উদ্ভাবন করেন আমেরিকান নারী বিজ্ঞানী ন্যান্সি জনসন। বর্তমানেও তার ফ্রিজার বিশ্বের নানা জায়গায় ব্যবহৃত হচ্ছে।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ দিন দিন বেড়েই চলেছে। এক জরিপে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, গত ২০ বছরে নারী আবিষ্কারকদের পেটেন্ট গ্রহণের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে।

 শিবলী আহমেদ
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top