skip to Main Content

মনোযতন I সন্তানের আগমন তবু বিষণ্নতা

পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন। নারীদের জন্য গর্ভধারণকালীন ও প্রসব-পরবর্তী নীরব ঘাতক। কী এর লক্ষণ। কীভাবে সামলানো যায়। জানাচ্ছেন জিন্নাতুল বোরাক

‘তোরই জন্য শরীরের ভারে আমি নত
তোরই জন্য গল্প বুনেছি কত কত
তোরই জন্য গান, তোকে ঘিরেই খেলা
তোকেই দিচ্ছি আমার সকাল ছেলেবেলা’
—মৌসুমী ভৌমিকের গান

সন্তানের জন্ম অধিকাংশ পরিবারের জন্য পরম তৃপ্তিদায়ক হলেও কারও কারও ক্ষেত্রে এই আনন্দ উপভোগ করা অসম্ভব হয়ে ওঠে বিভিন্ন কারণে। অন্যতম প্রধান কারণ নীরব ঘাতক বিষণ্নতা, যা মানুষের জীবনকে বিভিন্ন পর্যায়ে আক্রান্ত ও বিপর্যস্ত করে তুলতে পারে। এই বিষণ্নতার রূপ ও প্রকরণ এক নয়। এমনকি বয়স, লিঙ্গ, ভৌগোলিক অবস্থানভেদে এর নানা মাত্রা দেখা যায়। সন্তান জন্মদানের পরে, এক মাস থেকে এক বছরের মধ্যে গুরুতর বিষণ্নতার আবির্ভাব হলে তাকে পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন (পিপিডি) বলা হয়। প্রায় ৫০ শতাংশ ক্ষেত্রে প্রসবের পূর্বেই বা গর্ভকালীন এর সূত্রপাত হয়। একত্রে একে পেরিপার্টাম ডিপ্রেশন বলে। বিশ্বজুড়ে আক্রান্তের হার প্রায় ১৭ দশমিক ২২ শতাংশ; দেশভেদে এই সংখ্যা ৩৯ দশমিক ৯ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। উপসর্গগুলো সাধারণত এমন হয়ে থাকে:
 দিনের বেশির ভাগ সময়, সাধারণত সকালবেলায় প্রচণ্ড দুঃখ অনুভব করা।
 প্রায়ই কান্না পাওয়া।
 পছন্দের কাজে আগ্রহ হারিয়ে ফেলা।
 রাতে ঘুম না হওয়া ও দিনে ক্লান্তি বোধ করা।
 খাওয়ার ইচ্ছা তাৎপর্যপূর্ণভাবে কমে কিংবা বেড়ে যাওয়া।
 অল্পতেই রেগে যাওয়া এবং আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠা।
 মেজাজ সব সময় খিটমিটে হয়ে থাকা।
 সহসা মনের পরিবর্তন বা মুড সুইং হওয়া।
 নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া। পরিবারের সদস্য ও বন্ধুদের এড়িয়ে চলা।
 সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও মনোযোগ দেওয়া খুব কঠিন বলে মনে হওয়া।
 সন্তানের সঙ্গে বন্ধন তৈরি করতে না পারা। সন্তানকে খাওয়ানো, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা, যত্ন নেওয়া, তার চোখে চোখ রেখে চাহিদাগুলো বোঝার চেষ্টা করা কষ্টকর মনে হওয়া।
 মা হিসেবে নিজেকে অযোগ্য মনে হওয়া এবং অপরাধবোধে ভোগা।
 নিজেকে বা বাচ্চাকে আঘাত করার ইচ্ছা হওয়া; কোনো কোনো সময় আঘাতও করা।
 বাচ্চাদের বিষয়ে কৌতূহল হারিয়ে ফেলা।
 আত্মহত্যার ইচ্ছা জাগা।
প্রসব-পরবর্তী উল্লিখিত এক বা একাধিক উপসর্গ থাকা স্বাভাবিক। তবে যদি তা দীর্ঘস্থায়ী হয়, দৈনন্দিন জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করে, বাচ্চা ও নিজের যত্নের প্রতিবন্ধকতা হিসেবে আবির্ভূত হয়, সে ক্ষেত্রে পেশাদার মনোরোগবিদের সাহায্য নেওয়া প্রয়োজন।
এটা শুধু মায়েদের ব্যাপারই নয়। দেখা গেছে, সংখ্যায় কম হলেও প্রায় ৪ শতাংশ বাবা এসব উপসর্গে ভোগেন, যাকে অনেক সময় পেটার্নাল পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন বলে। কম বয়সী বাবা—যাদের বিষণ্নতার ইতিহাস আছে, অর্থিক অসচ্ছলতা ও অনিশ্চয়তায় ভোগেন এবং পার্টনারের বিষণ্নতা আছে, তাদের ক্ষেত্রেও এমন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
পিপিডির ক্ষেত্রে একক কোনো কারণ নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। তবে শারীরিক পরিবর্তন, বিশেষ করে স্টেরয়েড ও পেপটাইড হরমোনের তারতম্যের কারণে এমনটা ঘটতে পারে বলে মনে করেন মনোবিজ্ঞানী সুজান ব্রামেলট ও লিসা এ এম গেলিয়া। পারিপার্শ্বিক বিদ্বেষ এবং পারিবারিক সহযোগিতার অভাব এই অবস্থা ত্বরান্বিত করতে পারে। তা ছাড়া কিছু কিছু বিষয়ের উপস্থিতি রিস্ক ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে। যেমন শৈশবে শারীরিক, মানসিক বা যৌন নির্যাতনের শিকার হলে তার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব মানস জগতে থেকে যায়, যা মাতৃত্বকালীন প্রকট হয়ে উঠতে পারে। অনেক সময় নিজের বা পরিবারের অন্য কারও বিষণ্নতার ইতিহাস পিপিডির ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয় অনেক গুণ। গর্ভকালীন চাপমূলক ঘটনার আধিক্য, যেমন গর্ভধারণ-সংশ্লিষ্ট জটিলতা, অনিরাময়যোগ্য অসুস্থতা, চাকরি হারানো বা হারানোর আশঙ্কা, কর্মক্ষেত্রে দ্বন্দ্ব, অসুস্থ প্রতিযোগিতা, পক্ষপাতমূলক পরিবেশ, দাম্পত্য কলহ ইত্যাদি বিষয় এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। নবাগত সন্তানের স্বাস্থ্যঝুঁকি এবং স্তন দানে ব্যর্থতা অনেক সময় হতাশার কারণ হয়। অপরিকল্পিত ও অনিচ্ছাকৃত গর্ভধারণ এবং সর্বোপরি জীবনসঙ্গীর পক্ষ থেকে যেকোনো ধরনের অসহযোগিতা ও মমতার অভাব জীবনকে বিপর্যস্ত করে তোলে।
চিকিৎসা করা না হলে এটা পোস্টপার্টাম সাইকোসিসে রূপ নিতে পারে, যার ফলে সন্তানকে হত্যা করার মতো নৃশংস ঘটনার উদাহরণ রয়েছে। অনেক সময় দীর্ঘমেয়াদি ক্রনিক ডিপ্রেসিভ ডিজঅর্ডারে রূপ নেয়। সবচেয়ে ক্ষতির সম্মুখীন হয় নতুন জন্ম নেওয়া সন্তানের বিকাশ: ঘুম ঠিকমতো না হওয়া, খাওয়ায় অরুচি, অতিরিক্ত কান্না, দেরিতে কথা শুরু করার মতো বিষয়গুলো দেখা যায়। বাবা-মায়ের সঙ্গে নিরাপদ বন্ধন তৈরি না হওয়ায় পরবর্তী জীবনে সেই বাচ্চার ভেতরেও বিভিন্ন আবেগীয় ও আচরণগত বিচ্যুতি এবং অনিশ্চয়তাবোধ দেখা দিতে পারে।
তবে পূর্বেই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিলে এসব জটিলতা মোকাবিলা করা সম্ভব। প্রসব-পরবর্তী বিষণ্নতা প্রতিরোধকল্পে নিচে বর্ণিত সাবধানতা অবলম্বন করা যেতে পারে:
 যথেষ্ট পরিমাণ শারীরিক, মানসিক ও অর্থনৈতিক প্রস্তুতি নিয়ে নতুন সদস্যের পরিকল্পনা করা প্রয়োজন। অনেক সময় মনে করা হয়, একটা সন্তান এলে দাম্পত্য কলহের অবসান হবে, যা পরিস্থিতিকে অনেক সময় আরও শোচনীয় করে তোলে। তাই দাম্পত্য সংকট নিরসনে প্রয়োজনে কাপল কাউন্সেলিং নেওয়া যেতে পারে।
 পারিবারিক ও সামাজিক নেটওয়ার্ক শক্তিশালী হলে কাজ ভাগ করে নেওয়া সম্ভব। ফলে শুধু মা বা বাবার ওপর চাপ কমে যায়। সাহায্য চাওয়াকে অনেক সময় দুর্বলতা মনে করা হয়, যা মজবুত সামাজিক বন্ধন তৈরির পথে বাধা। মনে রাখা প্রয়োজন, নিজের ও অন্যের চাহিদা বুঝতে পারা এবং সেই অনুযায়ী সাহায্য চাইতে পারা ব্যক্তিত্বের শক্তি; দুর্বলতা নয় কোনোভাবেই।
 নতুন সদস্যের আগমনে কাজ বেড়ে যাওয়ায় পরিবারের সব সদস্য, বিশেষ করে মায়ের মানসিক চাপও বেড়ে যায় বহুগুণ। তাই নিজের এবং অন্যদের প্রতি সমমর্মী হওয়া প্রয়োজন। কোনো কাজ মনমতো না হলেও সমালোচনা না করে নিজেকে মনে করিয়ে দেওয়া, আমি আমার সর্বোচ্চটা করছি। চাপমূলক পরিস্থিতিতে আমি যেমন অনুভব করছি—কষ্ট, বিষণ্নতা, রাগ, হতাশা—তা স্বাভাবিক। এই কষ্টকর অনুভূতি চিরস্থায়ী নয়।
 কষ্টকর অনুভূতি নিয়ে জীবনসঙ্গী ও বিশ্বস্ত বন্ধুর সঙ্গে কথা বলা যেতে পারে। অনেক সময় অন্য মায়েদের কাছ থেকে তাদের অভিজ্ঞতা শোনা যেতে পারে। একই ধরনের পরিস্থিতি তারা কীভাবে মোকাবিলা করেছেন, জানতে পারলে অনেক সময় তা কাজে লাগতে পারে।
 নিজের যত্ন নেওয়া, পর্যাপ্ত ঘুম, সুষম খাবার গ্রহণ, শরীরচর্চা, মাইন্ডফুলনেস চর্চা ও নিশ্বাসের ব্যায়াম করা প্রয়োজন। নবজাতক পরিচর্যার সময়ে এই বিষয়গুলো প্রায় অসম্ভব মনে হলেও সঠিক পরিকল্পনা ও পারিবারিক সহযোগিতায় মায়ের শারীরিক-মানসিক প্রশান্তি কিছুটা নিশ্চিত করা সম্ভব।
 উল্লিখিত বিষয়গুলো পালন করার পরও যদি মাতৃত্বকালীন বিষণ্নতা থেকে যায়, তাহলে মনোবিজ্ঞানী বা মনোরোগ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া দরকার।
তেল আবিব বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও লেখক হাইম সাপিরা ‘হ্যাপিনেস অ্যান্ড আদার স্মল থিংস অব অ্যাবসলিউট ইমপর্ট্যান্স’ বইয়ে পরিসংখ্যানের আলোকে লিখেছেন, ‘বেশির ভাগ নারীই সেই সময়টাকে তাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত মনে করেন, যখন তারা একটা প্রাণের জন্ম দিচ্ছেন দুনিয়ায়।’ পুরুষের জীবনেও তার সন্তানের জন্মক্ষণটা কোনো অংশে কম সুখের নয়। এই সুখের পাশাপাশি রয়েছে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা। পরিবার ও সমাজের সচেতনতা, দায়িত্বশীলতা, মমত্ববোধ ও যত্নশীলতা মা-বাবা ও সন্তানের এই নাজুক সময়কে আনন্দময় করে তুলতে পারে।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক ও চেয়ারপারসন, এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top