skip to Main Content

রসনাবিলাস I টার্কিশ মেহমানদারি

দর্শকনন্দিত একটি তুর্কি টেলিভিশন সিরিয়াল থেকে নামকরণ। খাবার, অন্দরসজ্জাতেও সেই ছাপ। রসনাভ্রমণের সেই অভিজ্ঞতা রসিয়ে শেয়ার করে সেখানে যেতে পাঠককে লুব্ধ করেছেন সামীউর রহমান

স্কুলজীবনে বাংলা দ্বিতীয় পত্র পরীক্ষায় কখনো নম্বর ভালো পাইনি। ব্যাকরণের সঙ্গে সন্ধি নয়, ছিল বিগ্রহ। আর বঙ্গ শব্দভান্ডারের বিবিধ রতনের ভেতর কোনটা যে আরবি, কোনটা ফারসি আর কোনটা তুর্কি, সেটা মনে রাখা ছিল ঢের কষ্টের। তার চেয়ে তুর্কি খাবার চেখে দেখাটা ঢের ভালো! তাই উত্তরার সুলতান সুলেমান রেস্তোরাঁয় পা রাখলাম এক বৈশাখী দুপুরে। ওমা, মেন্যুকার্ড উল্টে দেখি, বাংলা ব্যাকরণ বই থেকে অনেক চেনা শব্দই সেখানে হাজির! কোরমা, কোফতা, হালওয়া, কেবাব—সবই দেখি তুর্কি শব্দ। আফসোস, স্কুলজীবনে কোনো তুর্কি রেস্তোরাঁয় যাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি। হলে হয়তো ফারসি শব্দ আর তুর্কি শব্দের ভেদাভেদ বুঝতে পেরে লেটার মার্কস নিয়েই পাস করতাম।
ঢাকার চৌহদ্দি ছাড়িয়ে উত্তরা উপশহরেও গড়ে উঠেছে অনেক সুস্বাদু রসনাঠেক। সুখাদ্যপিয়াসীরা ঢাকার বিখ্যাত যানজট মাড়িয়েও তাই বেশ নিয়মিত ঢুঁ মারছেন উত্তরের ঠিকানায়। ১২ নম্বর সেক্টরে, শাহ মাখদুম অ্যাভিনিউর ‘সুলতান সুলেমান’ তেমনি একটি ঠিকানা। অকৃত্রিম তুর্কি খাবারের স্বাদ নিতে যেখানে প্রায়ই ভিড় করেন ধানমন্ডি-গুলশানের বাসিন্দারাও।
তুর্কি খাবার অবশ্য ঢাকার ভোজন-মানচিত্রে নতুন কিছু নয়। তোপকাপি, ইস্তাম্বুল, টার্কিশ বাজারের মতো বেশ কয়েকটি রেস্তোরাঁতেই পাওয়া যায় তুর্কি খাদ্যসম্ভার। ইউরোপ ও এশিয়ার সংযোগস্থলে অবস্থিত তুর্কি রসনায় মিশ্রণ ঘটেছে দুই ঘরানারই রন্ধনপ্রণালির। ফলে জন্ম হয়েছে ডোনার কেবাপ, কোফতে, দোলমা, হালভার মতো জিভে জল আনা সব পদের। সুলতান সুলেমানের বাবুর্চিদের হাতেও খোলতাই হয়েছে আল কাবসা, আদানা কাবাব, সিকান্দার কাবাবসহ আরও অনেক কিছুই।
সুলতান সুলেমানের অন্দরসজ্জায় মোগলাই ছাপটা স্পষ্ট। চেয়ার-টেবিলের পাশাপাশি আছে তাকিয়াও। দেয়ালে ঝোলানো তলোয়ার আর মধ্যপ্রাচ্য ঘরানার ঝালর দেখে মনে হতে পারে, কোনো শাহি মহলেই বোধ হয় খানা খেতে হাজির হওয়া! এই শাহি মহলের রসুই থেকে রসনায়োজন সামলাচ্ছেন মুস্তাফিজুর রহমান। মিসর, কাতারসহ মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশে কাজের সুবাদে থাকা হয়েছে দীর্ঘদিন। তার অভিজ্ঞতা বলে, মধ্যপ্রাচ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় খাদ্যঘরানা হচ্ছে তুর্কি। কারণ, তুর্কি খাবারের মতো বৈচিত্র্য আর অন্য কোনো খাবারে নেই। আসলেই তাই। ইউরোপ ও এশিয়ার সঙ্গমস্থলে অবস্থিত হওয়াতে তুরস্কে একদিকে যেমন গ্রিক ও রোমান প্রভাব যোগ হয়েছে সংস্কৃতি ও খাদ্যাভ্যাসে, তেমনি মধ্য এশিয়ার মসলাও ঠাঁই করে নিয়েছে তুর্কি রসুইঘরে। ভূমধ্যসাগরীয় আবহাওয়ায় আঙুর, জলপাই, আপেলের মতো ফলেরও ফলন বেশুমার। সব মিলিয়ে খুশখানেওয়ালাদের জন্য তুর্কিস্থানই তন্দুরস্তির জায়গা!
সুলতানি আমলে বাংলা ছিল খুবই সমৃদ্ধ। এই সুলতানরা ছিলেন তুর্কি বংশোদ্ভূত। তাই তো বাংলার শব্দভান্ডারে ঢুকে পড়ে অনেক তুর্কি শব্দ, যে কারণে তুর্কি খাবারগুলো অচেনা মনে হয় না। শুধু স্বাদে একটু আলাদা। আল কাপসা বা কাবসা অনেকটা বিরিয়ানির মতোই। তৈরি হয় সুগন্ধি সরু লম্বা চাল, তুর্কি মসলা আর বিশেষ মসলায় ১২ ঘণ্টা টক দইয়ে ভিজিয়ে রাখা খাসির মাংস দিয়ে। মাংসটা নরম, সহজেই গলে যায় মুখের ভেতর। সঙ্গে তুর্কি স্যালাড দিয়ে খেতে অনবদ্য। চেখে দেখা যেতে পারে আদানা কাবাব, শীষ তাউক, শীষ কাবাবসহ আরও পদ; যা বানানো হয় তুর্কি মসলায় জারিত মাংস ধীরে ধীরে কয়লার আঁচে পুড়িয়ে। কাবাবের সঙ্গে পরিবেশন করা রসুন-পুদিনার চাটনিটা লা জবাব। একসঙ্গে অনেক রকম কাবাব খেতে চাইলে কাবাব প্ল্যাটার নেওয়াই দস্তুর। তাতে অনেক রকম কাবাবের সঙ্গে থাকবে স্যালাড আর তুর্কি রুটি। প্রচলিত নানরুটির সঙ্গে তুর্কি রুটির বেশ তফাত, খেতে অনেকটা শাওয়ার্মার পিটা ব্রেডের মতো। কাবাব খেতে খেতে গলা শুকিয়ে গেলে আছে রাবানি, যা অনেকটা বোরহানির জ্ঞাতিভাই। আছে নানান রকমের মকটেল। শেষ পাতে টার্কিশ ডিলাইটসহ বেশ কয়েক রকম মিষ্টান্নেরও ব্যবস্থা আছে সুলতান সুলেমানে।
উত্তর ভারতীয় তান্দুরি চিকেন, টাংরি কাবাব কিংবা পুরান ঢাকার শিক কাবাব, ক্ষীরি কাবাব, গুর্দা কাবাবের চেয়ে তুর্কি ঘরানার কাবাব বেশ আলাদা। শিকে গেঁথে আগুনে পোড়ানোর মিলটুকু বাদ দিলে অমিলটা হচ্ছে মসলা আর ঝাঁজে। তুর্কি কাবাব অনেকটাই মোলায়েম, তাতে মসলার কড়া ঝাঁজটা নেই। উত্তর ভারতীয় বাটার চিকেন কিংবা তান্দুরি চিকেনে যেমন উগ্র লাল রঙের একটা ব্যবহার দেখা যায়, তুর্কি কাবাবে মাংসের চেহারা অনেকটাই নিরাভরণ। তবে সঙ্গে সস ও স্যালাডগুলোর সদ্ব্যবহার করে চেখে দেখলেই ভুলটা ভাঙবে।
সুলতান সুলেমানে খাবার খরচ খুব বেশি নয়। পরিবার বা বন্ধুসহ গেলে মোস্তাফা প্ল্যাটার বা হুররাম প্ল্যাটার নিলে চেখে দেখা যাবে অনেক রকম কাবাব আর দামটাও থাকবে সহনীয় পর্যায়ে। অন্দরসজ্জায় আছে ভিন্নতার ছোঁয়া। আবার কোনো উৎসব, বিয়েবার্ষিকীর উপলক্ষে ফটোশুটের জন্যও সুলতান সুলেমান হতে পারে পছন্দের গন্তব্য। সে ক্ষেত্রে ‘রথ দেখা আর কলা বেচা’ অর্থাৎ ইট আউট অ্যান্ড শুটিং—দুটোই সম্ভব এক ছাদের তলায়!

লেখক: কালের কণ্ঠের সিনিয়র স্পোর্টস রিপোর্টার এবং রসনালিখিয়ে
ছবি: সৈয়দ অয়ন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top