skip to Main Content

রসনাবিলাস I স্বাদকোরকে পুলক!

ধানমন্ডিতে কিছুদিন আগে দ্বারোদ্ঘাটন হওয়া জাপানি ভোজনালয় ইজাকায়ায় মধ্যাহ্নের রসনাবিলাস। সঙ্গে উদ্যোক্তার সঙ্গে আলাপ। অঘ্রানের দুপুরে যথাস্থানে যাওয়ার আগে পুরোনো স্মৃতি যতই পিছুটানের অনুঘটক হোক না কেন, রসনালিখিয়ে সামিউর রহমান ফিরেছেন পরম পুলকে। তাঁর বয়ানে নিপ্পনী পথখাবারের পরিপাটি পরিবেশনা ও স্বাদের অনুরণন

দিন কয়েক আগে হেমন্তের রোদ মরে আসা দুপুরে গিয়ে পৌঁছলাম ধানমন্ডির শংকরে। একটা সময় জায়গাটা বিখ্যাত ছিল স্টার কাবাবের জন্য। সন্ধেটা ভুরভুর করত কাঠকয়লার আগুনে সেঁকা কাবাব আর চিকেন টিক্কার গন্ধে। উল্টো দিকে আবাহনী মাঠ। এখানেই কাজী সালাউদ্দিনদের অনুশীলন দেখতেই জড়ো হতো হাজারো মানুষ! ফুটবল হারিয়েছে সেই জৌলুশ, স্টার কাবাব হারিয়েছে সেই স্বাদ। ধানমন্ডির এই সাতমসজিদ রোড জুড়ে বহুতল সব ভবনে হাজারো রেস্তোরাঁ যেন জোর গলায় স্টার কাবাবকে বলছে, ‘হেথা হতে যাও পুরাতন’। স্টার কাবাবকে হাতের বাঁয়ে রেখে নতুন তৈরি হওয়া দালান গ্রিন রওশনারা টাওয়ার। লিফটে পলকে পৌঁছে যাই লেভেল নাইনে। খোলা দরজা দিয়ে সামনে পা বাড়ালেই ইজাকায়া। বাংলাদেশে জাপানি পানশালার পথরসনার পসরা।
দরজা ঠেলে ঢুকলেই কর্মীরা উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাবেন জাপানি ভাষায়। ঘণ্টা তিনেক সময় কাটিয়ে কখনোই এর ব্যতিক্রম দেখলাম না। কর্মীরা আন্তরিক, হৃদ্যতাপূর্ণ যা মুহূর্তেই মনে জাগায় ভরসার উষ্ণতা। জাপানের স্থাপত্যরীতি অনুসরণে কাঠ ও কাগজের ব্যবহারে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ইজাকায়ার অন্দরসজ্জা। কাঠের মেঝে, নিচু ছাদে কৃত্রিম ফুলের সাজে জাপানের চেরি ব্লসমের রূপায়ণ। উদ্যোক্তা রায়ানা হোসেনের ভাবনার বাস্তবায়ন ইজাকায়া। জাপানি এই শব্দের মানে হচ্ছে একধরনের পানশালা, যেখানে সাধারণত পানীয়র সঙ্গে পরিবেশিত হয় হালকা টুকিটাকি খাবার। সংগত কারণেই বাংলাদেশের বাস্তবতায় পানীয় পরিবেশন সম্ভব হয়নি, ইজাকায়া থেকে রায়ানা ধার করেছেন খাবারের অংশটুকু। ধারণাটা ছোট্ট এবং সহজ। বন্ধুবান্ধব বা পরিবারের সদস্যরা একসঙ্গে বসে খানিকটা সময় কাটাবেন আর উপভোগ করবেন নানান স্বাদের হালকা সব খাবার, এটা-ওটা সেটা। সে জন্যই মেনু সাজানোর সময় প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে ‘লাইট’ অংশটাকেই।
কী আছে সেই হালকা খাবারের তালিকায়? চোখ বুলিয়ে যাই মেনুর দীর্ঘতম অংশে এবং খেই হারাই। রায়ানার পরামর্শে অমত করি না; কারণ, সূর্যোদয়ের দেশের খাদ্যসম্ভারের ব্যাপারে আমি যে নিতান্তই আঁধারে! ‘মেড ইন জাপান’ কথাটায় ইলেকট্রনিকসহ নানান পণ্যের বেলায় বাংলাদেশের মানুষ যতটা চোখ বন্ধ করে ভরসা রাখেন, জাপানি খাবারের বেলায়ও কি তাই? নব্বইয়ের দশকে পরিবারের সবাই মিলে বাইরে খেতে যাওয়া মানেই ছিল চীনা খাবার, মাঝে একটা সময় রাজধানীর অলিগলিতে গজিয়ে উঠেছিল পিৎজার দোকান। যদিও দুই জায়গাতেই উৎপত্তিস্থল চীন কিংবা ইতালির সঙ্গে বাংলাদেশে পরিবেশিত খাবারের বিস্তর তফাত। এখন বিপুল মানুষ দেশের বাইরে যাচ্ছে। তারা ভিন্ন ধরনের খাবার চেখে দেখতে চাইছে, রসনায় আরেকটু অ্যাডভেঞ্চারাস হতে চাইছে। আমাদের খাদ্যরুচি আস্তে আস্তে বদলাচ্ছে, বলেন তিনি।
ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটা জাপানি রেস্তোরাঁ খুলে গেছে। তবে তাদের থেকে ইজাকায়ার পার্থক্যটা কোথায়, সেটাও স্পষ্ট করে দিয়েছেন রায়ানা, ‘ইজাকায়াতে আমরা খাবার নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে ভালোবাসি।’
কথা বলতে বলতে সময় গড়ায়, টেবিলে হাজির হয় ‘ইজাকায়া’র সবচেয়ে জনপ্রিয় পদ নরি বিফ টাকো। নরি হচ্ছে একধরনের সামুদ্রিক শৈবাল, যার গায়ে আলতো করে মাখানো হয়েছে টেম্পুরা ফ্লাওয়ার। তারপর মেক্সিকান টাকোর আকৃতি দিয়ে সাঁতার কাটতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে ফুটন্ত তেলের চৌবাচ্চায়। তবে সেটা ক্ষণিকের জন্য, নইলে ফোসকা পড়বে যে! সেই টাকোর খোঁড়লে ঢুকেছে অল্প একটু স্টিকি রাইস, তার ওপর গরুর মাংসের ফালি। সবকিছু যখন এক কামড়ে মুখে ঢুকল, তখন জিভে যেন স্বাদের বিস্ফোরণ! কুড়মুড়ে, উমামি, চেনা-অচেনা অনেক ধরনের অনুভূতির একটামাত্র মৃদু তরঙ্গ। নরি বিফ টাকোর প্রস্থানের আগেই হাজির কুশিয়াগি। মুরগির নরম হাড়, পাখনা দিয়ে তৈরি এই পদটা অনেকটা সাসলিক ও ফ্রাইয়ের সংকর! বাইরে মুচমুচে পরতের ভেতর মাংস আর নরম হাড়ের কুড়মুড়ে স্বাদ। বাঁশের কাঠিতে গেঁথে ডিপফ্রাই করা এই পদ গার্লিক মেয়ো সসের সঙ্গে সত্যিই অনবদ্য। পাথরের বাটিতে করে পরিবেশন করা হলো গার্লিক ফ্রায়েড রাইস। চপস্টিক দিয়ে খাওয়ার অভ্যাস থাকলে দুটো কাঠি দিয়ে দিব্যি খেয়ে ফেলা সম্ভব রসুনগন্ধি এই স্টিকি রাইস।
লোহার চ্যাপ্টা থালা চুলোয় চাপিয়ে রান্না করার জাপানি কায়দার নাম তেপ্পানিয়াকি। বায়ান্ন বাজার তেপ্পান্ন গলির শহরে তেপ্পানিয়াকির মতো কঠিন নাম বেশ সহজেই আজকাল জিভের ডগায় রাখছেন সুখাদ্যপিয়াসীরা। ছোট ছোট করে কাটা গরুর মাংসের ফালির সঙ্গে কুচানো বাঁধাকপি, গাজর আর আলু। সঙ্গে নানান স্বাদের অনুষঙ্গ। রসুনের সস, টেরিয়াকি সস, স্যামন মাছের ডিমের সস, জাপানি স্বাদের মেয়োনেজ। এ যেন অনেকটা বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার সেই যেমন খুশি তেমন সাজোর মতো! যার যেমনটা ইচ্ছে, সেই সঙ্গতে মাখিয়ে খাও; ঝাল, ঝাঁজ যার যেমনটা চাই।
ইজাকায়া মনে পড়িয়ে দিয়েছে স্যাটেলাইট যুগের আগে বিটিভিতে প্রচারিত টেলিভিশন সিরিয়াল ‘ওশিন’-এর কথা। সেই ড্রামা সিরিজে জাপানিদের বাড়িঘর, আদবকেতা, খাবারদাবার গ্রহণের রীতিনীতি দেখার যে টুকরো টুকরো স্মৃতি সজীব হয়েছে ইজাকায়ার তৈজসপত্র আর পরিবেশনরীতিতে।
নাড়ির টানের পরেই বোধ হয় পেটের টান! ইজাকায়ার শেফ সংচাই বুডসানের সঙ্গে ভাষাযোগটা ঠিক না হলেও ভাবের আদান-প্রদান ঠিকই হলো। নিজের দেশ ছেড়ে নানা দেশের নানা শহরে কাজ করে এখন বাংলাদেশে। জানালেন, জাপানি খাবারগুলোকে বাংলাদেশের মানুষের রসনা উপযোগী করেই তুলে দিচ্ছেন পাতে।
গল্প করে ভালো লাগা থেকেই কিনা জানি না, শেষ পাতে একটা চমকই দিলেন শেফ। নিজ হাতে বানিয়ে আনলেন বিশেষ একটা পদ। বেকড স্ক্যালপ শেল। সামুদ্রিক ঝিনুকের খোলার ভেতর স্কুইড, সামুদ্রিক শেওলাসহ অনেক কিছুর ওপর গলানো চিজের চাদর। লবণের ছোট্ট ঢিবির ওপর বসানো এই ঝিনুকের খোলায় হেলান দিয়ে আছে এক ফালি সদ্য কাটা লেবু। ঝিনুকটা হাতে তুলে নিয়ে হালকা লেবুর রস নিংড়ে নিয়ে তাতে কামড় বসাতেই অভূতপূর্ব এক স্বাদের পুলক!
ইজাকায়াতে এসেছিলাম ভয় ভয় একটা মন নিয়ে। ফিরেছি নতুন রসনার সঙ্গে স্বাদকোরককে পরিচিত করার পরিতৃপ্তি আর ভয়কে জয় করার আনন্দ নিয়ে। ইজাকায়া স্মৃতি উসকে দিয়েছে ঠিকই, সেই সঙ্গে বদলেও দিয়েছে অদ্ভুত ভালো লাগায়।

লেখক: রসনারসিক, লিখিয়ে এবং দৈনিক কালের কণ্ঠের সিনিয়র রিপোর্টার
ছবি: ক্যানভাস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top