skip to Main Content

স্মরণ I ভুবনরঞ্জন

কাকতাল। প্রকৃতির খেয়াল। না হলে একজন বিজ্ঞানীর জীবন্মৃত্যু কেন দুজন বিজ্ঞানীর জন্ম-মৃত্যুর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হবে। তা-ও ওই দুজন আবার পদার্থবিদ- একজন কাজ করেছেন মহাকাশতত্ত্ব ও জ্যোতির্বিদ্যা নিয়ে। অন্যজন গণিত। উভয়েই মহাবিশ্বের রহস্য উদ্ঘাটনে জীবন পার করে দিয়েছেন। ওঁদের মতো তিনিও আজীবন নিরত ছিলেন ব্রহ্মান্ডচর্চায়। এঁদেরই একজন গ্যালিলিও। তাঁর মৃত্যু ১৬৪২ সালের ৮ জানুয়ারি। ঠিক ৩০০ বছর পর ওই দিনে জন্ম সদ্য প্রয়াত এই সেলিব্রিটি সায়েন্টিস্টের। অক্সফোর্ডে। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোল। সেই থেকে ৭৬ বছর। এই বিশ্বে থেকে জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করে, মহাবিশ্বের নানা রহস্য উদ্ঘাটনের প্রয়াস পেয়েছেন। তারপর ছেড়ে গেলেন এই পৃথিবীর চৌহদ্দি, গেল ১৪ মার্চ। ১৮৭৯ সালের যেদিনে পৃথিবীতে এসেছিলেন তাঁরই অগ্রজ, তাঁর আগ পর্যন্ত সবচেয়ে তারকাবিজ্ঞানী অ্যালবার্ট আইনস্টাইন। এভাবেই জীবনজয়ী বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংয়ের জীবন নিজেরই অজান্তে, প্রকৃতির খেয়ালে জড়িয়ে গেছে দুজন বিজ্ঞানীর সঙ্গে।
জন্মটা অক্সফোর্ডে হলেও সেখানে পড়া হয়নি। ইচ্ছে ছিল। ভর্তিও হয়েছিলেন। কিন্তু পড়লেন কেমব্রিজে। পদার্থবিদ্যা নিয়ে। তারপর ঘর ছেড়ে চলে গেলেন অন্যত্র। মহাভুবন পাঠে নিয়োজিত হলেন। পরে সেখানে তিনি হলেন সম্মানজনক লুকাসিয়ান প্রফেসর অব ম্যাথামেটিকস (১৯৭৯-২০০৯)। এর আগে বিশ্বের সবচেয়ে সম্মানজনক এই অ্যাকাডেমিক পদে ছিলেন অ্যালবার্ট আইনস্টাইন।
সেই কবে, তখন ১৯৬৩; তখন বয়স মাত্র ২১। কেমব্রিজের তুখোড় ছাত্র স্টিফেন। সতীর্থ ও বন্ধুর বোন জেন ওয়াইল্ডের সঙ্গে চুটিয়ে প্রেম করছেন। উচ্ছল তারুণ্যের উতল দিনে আচম্বিতে ছন্দপাত। নির্ণীত হলেন মোটর নিউরনের জটিল অসুখে। অ্যামিয়োট্রপিক ল্যাটারাল স্কলোরোসিস। এএলএস। জবাব দিয়ে দিলেন ডাক্তাররা। সাফ বলে দিলেন যে বিশ্ব নিয়ে তাঁর অতীব কৌত‚হল, সেখানে তিনি ক্ষণিকের অতিথি। থাকবেন বড়জোর দুটো বছর। অথচ তাদের সেই ফোরকাস্ট মিথ্যে করে তাঁর প্রিয় পৃথিবীতে থেকে গেলেন আরও সাড়ে পাঁচ দশক। প্রবল ইচ্ছাশক্তিতে মৃত্যুকে তুচ্ছ করেছেন। উপেক্ষা করেছেন। যদিও ওই দুরারোগ্য ব্যাধি একে একে কেড়ে নিয়েছে নানা কিছু। শরীরকে করে তুলেছে অশক্ত। কথা বলতে হয়েছে ভয়েস সিনথেসাইজার দিয়ে। তবু জীবনকে উপভোগ করতে ভোলেননি তিলমাত্র।
এরই দুই বছর পর ১৯৬৫ সালে বিয়ে করলেন জেনকে। দাম্পত্যে এলো তিন সন্তান। ১৯৯১ সালে বিচ্ছিন্ন হলেন তাঁরা। ১৯৯৫ সালে স্টিফেনের জীবনে এলো আরেক নারী। তাঁর নার্স এলেইন মেসন। কিন্তু তিনিও থাকলেন না বেশি দিন। ছেড়ে গেলেন ২০০৬ সালে। এরপর প্রথম স্ত্রী আর সন্তানদের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব কমে আসে।
শত সীমাবদ্ধতা, বাধা আর বিপত্তি সত্ত্বেও বিজ্ঞান, বিশেষত পদার্থবিজ্ঞানকে তিনি পৌঁছে দিয়েছেন সাধারণের বসার ঘরে। কারণ, এর আগ পর্যন্ত পদার্থবিজ্ঞান মানে দুর্বোধ্য ও জটিল, সাধারণের মাথার উপর দিয়ে যাওয়া কোনো বিষয়। এই ধারা থেকে নিজেকে মুক্ত করে পদার্থবিজ্ঞানকে তিনি সহজ থেকে সহজতর করেছেন। তাই তো তাঁর প্রথম বই ‘আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’ হয়ে গেল ইতিহাস। ১৯৮৮ সালে প্রকাশের পর বেস্ট সেলার থাকল টানা ২৩৭ সপ্তাহ। অনূদিত হলো ৪০টির বেশি ভাষায়। কালের সংক্ষিপ্ত ইতিহাসই শেষ নয়; লিখেছেন আরও কিছু অসামান্য বই। চিত্রিত করেছেন কল্পবিজ্ঞানের চরিত্র জর্জ।
অদ্ভুত ছেলেমানুষি ছিল এই বিজ্ঞানীর মধ্যে। বাজি ধরতে বেজায় ভালোবাসতেন। তা-ও আবার তাঁর গবেষণা নিয়ে। আর হেরেও যেতেন। তা নিয়ে মজা করতেন। ২০১২ সালে হিগস বোন আবিষ্কার না হওয়ার পক্ষে বাজি ধরে হারলেন ১০০ ডলার। কিন্তু সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, ১৯৮০-র দশকে বাজি ধরে বসলেন বন্ধু বিজ্ঞানী কিপ থর্ন-এর সঙ্গে। বিষয়: সিগন্যাস এক্স ওয়ান- মৃত নক্ষত্রটি ব্ল্যাকহোল কি না তা নিয়ে। স্টিফেন বললেন, না, থর্ন বললেন, হ্যাঁ। কিন্তু হারজিতের পুরস্কার কী? সেও তো কম মজার নয়। স্টিফেন জিতলে পাবেন হাসির পত্রিকা ‘প্রাইভেট আই’। টানা দুই বছর। আর থর্ন জিতলে পাবেন যৌনতাবিষয়ক রগরগে ম্যাগাজিন ‘পেন্টহাউজ’। এক বছর। হলোও তাই। হেরে গেলেন স্টিফেন। ফলে প্রতি মাসে নিয়ম করে যেতে থাকল পেন্টহাউজ, থর্নের বাসায়। লাস্যময়ী নারীদের সুতোহীন শরীরের ছবি সেই সাময়িকীর পাতায় পাতায়। আর তা দেখে থর্নের স্ত্রী বেজায় চটলেন। কিন্তু কী আর করা- বাজির পুরস্কার বলে কথা।
স্টিফেন হকিং। জীবন্ত কিংবদন্তি থেকে এখন কিংবদন্তি। তাঁকে নিয়ে হয়েছে ছায়াছবি। লেখা হয়েছে গান। হয়েছে কার্টুন।
২০০৮ সালে ‘হকিং’ ছবিতে তাঁর নাম ভূমিকায় অভিনয় করেন বেনেডিক্ট কামবারব্যাচ। তাঁর কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির ছাত্রজীবন নিয়ে নির্মিত এই ছবিতে জেনের ভূমিকায় ছিলেন লিসা ডিলন। এর আরও ১০ বছর পর ২০১৪ সালে হয়েছে ছবি ‘দি থিওরি অব এভরিথিং’। এ ছবি বস্তুত ১৯৬০-৮০ এই সময়ের স্টিফেনের জীবনালেখ্য। এডি রেডমেইন আর ফেলিসিটি জোন্স অভিনীত এই ছবি ব্যাপক সাড়া জাগায়। বেশ ক’টি শাখায় অস্কারের জন্য নমিনেশন পায়। সেরা অভিনয়শিল্পী হিসেবে অস্কারও পান এডি। এ ছাড়া স্টারগেট আটলান্টিস সিরিজের পঞ্চম সিজনের ষোড়শ পর্বে দেখানো হয় তাঁকে।
তিনি হয়েছেন কার্টুন চরিত্র, তা সে সিমসন সিরিজই হোক বা ফিউচারামা। নানা শোতে হয়েছেন অতিথি। তাঁর ভয়েস নমুনা হিসেবে ব্যবহার করেছেন পিঙ্ক ফ্লয়েড। দ্য ডিভিশন বেল অ্যালবামের কিপ টকিং ও দ্য এন্ডলেস রিভার অ্যালবামে টকিং হকিং ট্র্যাকে ব্যবহার করা হয় হকিংয়ের কণ্ঠ।
তবে সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো, দীর্ঘ অসুস্থতা সত্ত্বেও তিনি পাড়ি দিয়েছেন মহাকাশে। ২০১৬ সালে ন্যানো স্টারশিপ প্রজেক্টে হকিংয়ের মহাকাশযাত্রায় সহায়তা করে নাসা।
মহাকালের ডাক শুনেছেন জন্ম থেকেই। মহাবিশ্বে স্টিফেন নামক এই মানব কিংবা বলা যায় অতিমানব একাকী আবর্তন করেছেন বিস্ময়ে। তাঁর মহাকাশযাত্রাও হয়তো ছিল সেই বিস্ময়-রহস্যের কিনারা করতেই। কে জানে! তবে তা কতটুকু করতে পেরেছেন, সে পোস্টমর্টেম নয়, বরং যে পথ তিনি দেখিয়ে গেলেন, যে খেই তিনি ধরিয়ে দিয়ে গেলেন, তাতে নিশ্চয়ই আগামীর কোনো স্টিফেন এই ব্রহ্মান্ডের রহস্যভেদে হবেন সক্ষম এবং সফল।
ভালো থাকবেন স্টিফেন হকিং। মহাকালের অতিথি! অমৃতের পুত্র!!

 শেখ সাইফুর রহমান
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top