skip to Main Content

দৃশ্যভাষ্য I আচম্বিত চুম্বন

১৪ আগস্ট ১৯৪৫। জাপানের রেডিও টোকিওতে সম্প্রচারিত হলো সে দেশের সম্রাট হিরোহিতোর একটি বিবৃতি। তাতে পরিষ্কার, যুক্তরাষ্ট্র জড়ানোর চার বছর পর সমাপ্তি ঘটল দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের। এরপর যুদ্ধ সমাপনীর ঘোষণা দিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস ট্রুম্যান। চুম্বনরত যুগলের এই আলোকচিত্র ঠিক সেই মুহূর্তের। দিনটি ‘ভিক্টোরি ওভার জাপান ডে’ নামে খ্যাত। যুদ্ধজয় উদ্যাপন করতে তখন নিউইয়র্কের টাইমস স্কয়ারে নেমে এসেছিলেন অগুনতি মার্কিন নাগরিক। স্বভাবতই এই আনন্দকে ক্যামেরাবন্দী করেছিলেন বেশ কয়েকজন আলোকচিত্রী। তোলা হয়েছিল অসংখ্য ছবি। অত ছবি থেকে, ‘ভিক্টোরি ওভার জাপান ডে ইন টাইমস স্কয়ার’, সংক্ষেপে ‘ভি-জে ডে ইন টাইমস স্কয়ার’ শিরোনামের এই ছবি কেন আইকনিক হয়ে উঠল?
বিকল্প শিরোনাম ‘দ্য কিস’ হিসেবেও বেশ পরিচিত এই আলোকচিত্রের কারিগর আলফ্রেড আইজেনস্টেড (১৮৯৮-১৯৯৫) ছিলেন পোল্যান্ডে (তৎকালীন জার্মান সাম্রাজ্যের অন্তর্গত) জন্মগ্রহণকারী একজন আমেরিকান আলোকচিত্রী ও আলোকচিত্র সাংবাদিক। ১৯৩৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমিয়ে, লাইফ ম্যাগাজিনে কাজ শুরু করেন। বিখ্যাত ওই ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে একজীবনে তার তোলা নব্বইটির বেশি আলোকচিত্র জায়গা করে নিয়েছে; প্রকাশ পেয়েছে আড়াই হাজারের অধিক ফটোস্টোরি। তাকে গণ্য করা হয় বিশ শতকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও সবচেয়ে সক্রিয় আলোকচিত্র সাংবাদিকদের একজন হিসেবে।
আলোচিত এই আলোকচিত্রের ক্যামেরাবন্দী হওয়ার দিনটি ছিল মঙ্গলবার। বেলা দ্বিপ্রহর। জনাকীর্ণ টাইমস স্কয়ারে, ছোট একটি ক্যামেরা হাতে, যুদ্ধজয় উদ্যাপনরত মানুষের ভিড় ঠেলে হাঁটছিলেন আইজেনস্টেড। উদ্যাপনের ছবি ছাপা হবে লাইফ ম্যাগাজিনে, তা তোলার দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন পারফেক্ট মোমেন্টের। সেই ক্ষণ যখন এলো, ঘড়িতে ৫টা ৫১।
‘দেখলাম, মার্কিন নৌবাহিনীর একজন নাবিক রাস্তাজুড়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে ছুটে বেড়াচ্ছেন, আর সামনে যে মেয়েকেই পাচ্ছেন, জড়িয়ে ধরছেন। আমি ক্যামেরা নিয়ে দৌড়ে বারবার তার আগে চলে যাচ্ছিলাম আর ঘাড় ঘুরিয়ে ছবি তুলছিলাম; কিন্তু কোনো ছবিই আমাকে তৃপ্ত করছিল না। তারপর আচমকা এক মুহূর্তেই দেখতে পেলাম, ধবধবে সাদা কিছু একটা আঁকড়ে ধরেছেন তিনি। ঘাড় ঘুরিয়ে ক্লিক করলাম; আর একজন নার্সকে ওই নাবিকের চুমু খাওয়ার মুহূর্তটি ধরা পড়ে গেল আমার ক্যামেরায়। ওই নার্সের পরনে যদি কোনো গাঢ় রঙা ড্রেস থাকত, তাহলে এই ছবি আমি কোনো দিনই তুলতাম না। অন্যদিকে, নাবিকটির পরনে সাদা ইউনিফর্ম থাকলেও নয়। আসলে গুনে গুনে ওই মুহূর্তের চারটি ছবি তুলেছিলাম। তা মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে,’ পরবর্তীকালে স্মৃতিচারণায় জানিয়েছেন আইজেনস্টেড। পুরুষটির ডার্ক ইউনিফর্ম আর নারীটির হোয়াইট ড্রেসের এই কনট্রাস্ট ‘দ্য কিস’কে এনে দিয়েছে ভিন্নমাত্রা।
নিজের আলোকচিত্রগত প্রক্রিয়া প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে আইজেনস্টেড তার সাফল্যের নেপথ্যে নিয়তিকে বারবার বড় করে তুলেছেন। ‘তবু আলোকচিত্রী হিসেবে চোখ সব সময় খোলা রাখতে হবে আপনাকে,’ পরামর্শ দিয়ে গেছেন তিনি। ‘দ্য কিস’ সম্পর্কে নিউইয়র্ক ম্যাগাজিনে দেওয়া সাক্ষাৎকারে নিজের ছোট্ট লাইকা ক্যামেরাকেও ধন্যবাদ জানিয়েছেন। বলেছেন, এমন ছোট ও মামুলি একটি ক্যামেরা সঙ্গে থাকায় ওই ভিড়ে তাকে আলোকচিত্রী হিসেবে নয়, বরং নিজেদের একজন বন্ধু হিসেবেই গণ্য করেছিল লোকজন। ফলে এমন মুহূর্ত ক্যামেরাবন্দী করা তার পক্ষে হয়েছিল সহজ।
ছবিটি লাইফ ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে ছাপা হলে রাতারাতি খ্যাতিমান হয়ে ওঠেন আইজেনস্টেড। এটি পরিণত হয় তার সবচেয়ে বিখ্যাত আলোকচিত্রে। এই ছবির কম্পোজিশনের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, নাবিকটি যখন নার্সকে জড়িয়ে ধরেছেন, নার্সের আনত শরীর তখন তির্যক হয়ে আছে; আর তার হাঁটুর নিচ থেকে পায়ের বাকি অংশ নাবিকের বাহুর সমান্তরালে রাখা। দুজনের চেহারাই যথেষ্ট আড়াল করা, যা জিডিপিআরের (জেনারেল ডেটা প্রটেকশন রেগুলেশন বা সাধারণ তথ্য সুরক্ষা প্রবিধান) বিধিসম্মত; তবু চাইলে এই যুগলের পরিচয় সন্ধান যেহেতু অসাধ্য নয়, তাই তা সমস্যামুখর হয়ে ওঠার উসকানিও জারি রেখেছিল। হয়েছিলও তা-ই। ছবিটি বিখ্যাত হয়ে উঠলে ত্রিশ বছরের অধিককাল ধরে অনেকে নিজেদেরকে এই যুগলের কোনো একজন হিসেবে দাবি তুলে ধরনা দিয়ে গেছেন লাইফ ম্যাগাজিন কার্যালয়ে।
এই রহস্যের সমাধান ঘটে ২০১২ সালে। ‘দ্য কিসিং সেইলর’ শিরোনামে একটি বই প্রকাশের পর। ‘দ্য মিস্টেরি বিহাইন্ড দ্য ফটো দ্যাট এন্ডেড ওয়ার্ল্ড ওয়ার টু’ ট্যাগলাইনের ওই বইয়ে প্রকাশ পায় যুগলটির প্রকৃত পরিচয়। নাবিকটির নাম জর্জ মেনডোনসা (১৯২৩-২০১৯); নার্সের নাম গ্রেটা জিমার ফ্রাইডম্যান (১৯২৪-২০১৬)। জর্জের ট্যাটু ও শরীরের দাগ ছবিটিতে থাকা লোকটির সঙ্গে মিলে গেছে; আর সবচেয়ে বড় প্রমাণ হিসেবে কাজে দিয়েছে তার নাবিক পরিচয়। ‘যুদ্ধজয়ের রোমাঞ্চে আমি ছিলাম আত্মহারা; তা ছাড়া কয়েক চুমুক পানাহারও করেছিলাম। তাই ওই নার্সকে সামনে দিয়ে যেতে দেখে জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়েছিলাম,’ বলেছেন তিনি। অন্যদিকে, গ্রেটা ছিলেন একজন ডেন্টাল নার্স, যিনি ১৯৩৯ সালে অস্ট্রিয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান। মজার ব্যাপার হলো, ওই ছবিতে থাকা আরেক নারীরও পরিচয় মিলেছে। তিনি রিটা পেট্রি। ওই সময়ে ছিলেন জর্জের প্রেমিকা; পরবর্তীকালে স্ত্রী। শেষ বয়সে নিউইয়র্ক পোস্টকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে রিটা মজা করে বলেছিলেন, ‘জর্জ কোনো দিনই আমাকে ওভাবে চুমু খায়নি!’
পরবর্তীকালে গ্রেটা এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমি অনুভব করেছিলাম, লোকটি ভীষণ শক্তিমান। তিনি আমাকে স্রেফ শক্ত করে আঁকড়ে ধরেছিলেন। ওই মুহূর্তে চুমুর ব্যাপারটি একেবারেই খেয়াল করিনি; কেননা, আমরা তো তখন যুদ্ধজয়ের আনন্দে মাতোয়ারা। তবে এটি কোনোভাবেই কোনো রোমান্টিক ঘটনা ছিল না। এ ছিল যুদ্ধে জয়লাভের কারণে স্রষ্টাকে কৃতজ্ঞতা জানানোর বিষয়।’
‘দ্য কিস’ নিয়ে বিতর্কও রয়েছে। কম্পোজিশনটিকে কেউ কেউ যৌননিগ্রহের একটি ফটো ডকুমেন্টেশন হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। আমেরিকান শিল্প সমালোচক মাইকেল কিমেলম্যানের মতে, এই কম্পোজিশন মূলত ওই সময়ের প্রকৃত মেজাজের একটি প্রতিফলন। তাতে ওই যুগল যুদ্ধফেরত সৈনিক এবং তাদেরকে যুদ্ধ শেষে সাদরে গ্রহণ করার প্রতিনিধিত্ব করে। অন্যদিকে, ২০০৫ সালে ওই যুগলের চুমুর একটি ২৫ ফুট উঁচু ভাস্কর্য সৃষ্টি করেছেন আমেরিকান আর্টিস্ট জন সুয়ার্ড জনসন, ‘আনকন্ডিশনাল সারেন্ডার’ শিরোনামে। আমেরিকার বিভিন্ন শহরে প্রদর্শন হয়েছে সেটির। কিন্তু জর্জ মেনডোনসার মৃত্যুর অল্প কিছুদিন পর সেই ভাস্কর্যে লাল কালিতে ‘মিটু’ লেখা গ্রাফিতি এঁকে দিয়ে জানানো হয়েছিল নিন্দা।
গ্রহণযোগ্যতা কিংবা বিতর্ক- যা-ই থাকুক, ‘দ্য কিস’ হয়ে আছে রক্তক্ষয়ী দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধ সমাপ্তির সাক্ষ্য বহনকারী ক্যানডিড ফটোগ্রাফির এক দুর্ধর্ষ উদাহরণ।

 লাইফস্টাইল ডেস্ক
সূত্র: অ্যাবাউট ফটোগ্রাফি ব্লগ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top