skip to Main Content

ছুটিরঘণ্টা I সানি সান ফ্রান্সিসকো

সান ফ্রান্সিসকো। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার এক ঐতিহ্যবাহী শহর। গ্রীষ্মের দিনে এর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা বিবিধ রূপ-রস উপভোগ করে এসে লিখেছেন ফাতিমা জাহান

সাবওয়ে ট্রেন থেকে নেমেই দেখি ঝলমলে দুপুর। বেশ ঠান্ডাও পড়েছে। এই ঝলমলে হলদে রোদের মাঝে গুচ্ছ গুচ্ছ সূর্যমুখী ফুল পথের পাশে সাজিয়ে দুহাতে একমুঠো তুলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন এক নারী। তাকে আমি চিনি না। না চিনলে কি ফুল নিতে নেই এমন আনন্দের দিনে! তিনি সান ফ্রান্সিসকো শহরের অচেনা ফুল বিক্রেতা। চেহারা বলছে চায়নিজ হবেন। সানি সান ফ্রান্সিসকো শহরে একমুঠো সানফ্লাওয়ার যেন আমার সঙ্গে এমনিতেই দেখা করত! চীনা নারীটির কাছে গিয়ে দাম জানতে চাইলাম। তিনি ইংরেজি জানেন না। এ নতুন কিছু নয়। আমেরিকার মতো দেশে বহু অভিবাসী আছেন, যারা ইংরেজি জানেন না। আর সাবওয়ে স্টেশনের মুখেই ফারমার্স মার্কেট; তাই দুপুরে ফল, ফুল, সবজির বাজার বেশ জমে উঠেছে। এখানকার প্রায় সব বিক্রেতা হয় লাতিন, নয়তো চায়নিজ। চারদিকে লাল, হলুদ, সবুজ তাজা ফল আর সবজির ঘ্রাণে এখানেই বসে থাকতে ইচ্ছে করছে। যেকোনো শহরের ফারমার্স মার্কেটে গেলে আমি হারিয়ে যাই। এখানেও একই দশা। স্যুটকেস নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে কিছু তাজা ফলও কিনে নিলাম।
আমাকে এখন হোটেল খুঁজতে হবে। এক হাতে সানফ্লাওয়ার, কাঁখে ফল; আরেক হাতে স্যুটকেস আর কাঁধে ব্যাকপ্যাক নিয়ে ম্যাপে খুঁজে পেলাম আমার হোটেল। এখান থেকে দুই ব্লক পরে। কিন্তু কিছুদূর গিয়ে গুলিয়ে ফেললাম। প্রতিটি ব্লকে কালো ইউনিফর্ম পরা পুলিশের মতো দেখতে কয়েকজন কর্মী দাঁড়িয়ে আছেন। তাদের জিজ্ঞেস করতেই হোটেল দেখিয়ে দিলেন। আমেরিকার অন্য শহরে এখন গরম পড়ে গেছে। কিন্তু সান ফ্রান্সিসকো যেন এক মধুর বসন্তের দেশ।
হোটেল যেখানে, সেটি আসলে হোটেলপাড়া। আশপাশে সব বড় বড় হোটেল। এই জায়গার নাম মার্কেট স্ট্রিট। অনেক দর্শনীয় জায়গা আছে কাছেপিঠেই। প্রথমে কোথায় যাব ভাবতেই হিমশিম খেতে হলো। ডানে যাব না বাঁয়ে, উত্তরে না দক্ষিণে? মনে হলো আবার ফারমার্স মার্কেটে যাই। সেখান থেকে অনেক জায়গা কাছাকাছি, তাই একসঙ্গে দেখা যাবে। পথে যত ভবন পড়ছে, সবই দেখতে অষ্টাদশ কিংবা ঊনবিংশ শতাব্দীর পুরোনো আমলের বনেদি ইউরোপীয় দালানের মতো। চুনকাম করার ফলে খুব ঝকঝকে লাগছে। প্রতিটি ব্লকেই সুপারশপ রয়েছে। আমেরিকার অনেক শহরে সুপারশপ খুঁজে বের করতে হয় ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে! সেই বিবেচনায় সান ফ্রান্সিসকো আমার বেশ মনে ধরে গেল।
ফারমার্স মার্কেট এখন প্রায় ভেঙে যাচ্ছে। গ্রামের হাট ভাঙার সময় যেমন দেখা যায়, তেমন। অবশ্য বিক্রেতারা অস্থায়ী দোকানগুলো পরিষ্কার করে নিজেদের পিকআপ বা গাড়িতে সব তুলে নিয়ে যাচ্ছেন। আমি উল্টো দিকের সিটি হলের দিকে এগোলাম। দেখতে অনেকটা ওয়াশিংটন ডিসির ইউনাইটেড স্টেটস ক্যাপিটল ভবনের মতো। তবে এ ভবন সেটির চেয়ে উঁচু। আজ সাপ্তাহিক ছুটি বলে সরকারি এই দপ্তর বন্ধ রয়েছে। না হলে ভেতরে ঢোকা যেত। মাথায় গম্বুজের মতো চূড়া নিয়ে ১৯০৮ সাল থেকে ভবনটি একাধারে সংসদ ও অন্যান্য সরকারি গুরুত্বপূর্ণ অফিসারের দপ্তর হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ভবনের সামনে অনেকখানি খোলা জায়গা, যেখানে বেশ কয়েকজন নারী ও পুরুষ যোদ্ধার ব্রোঞ্জের ভাস্কর্য রাখা। এক নারীর ভাস্কর্য বেশ উঁচুতে, যার এক হাতে বল্লম, অন্য হাতে ঢাল; পায়ের কাছে লেখা—ইউরেকা। হয়তো ১৪৯২ সালে কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কারের কালে একইভাবে বলে উঠেছিলেন, ইউরেকা!
বেলা ঢলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে ঠান্ডাও জেঁকে পড়েছে। আমি সবে এসেছি পূর্ব দিকের উষ্ণ আবহাওয়া থেকে। এই শীতল সমীরণ গায়ের সঙ্গে অভ্যস্ত হতে আরও কয়েক দিন লাগবে। হোটেল রুমে আমার খুব ভালো লেগে গেল দেয়ালজুড়ে থাকা জানালা। সোফা, চেয়ার ইত্যাদি থাকা সত্ত্বেও জানালায় বসে থাকার মতো বেশ জায়গা রয়েছে। বেছে বেছে পুরোনো হোটেল খুঁজে নেওয়ার এ এক সুবিধা। এখন ঘুমানোর আগপর্যন্ত কফির মগ হাতে বসে বসে এ শহরের এই সব সরু পথের ওপর দিয়ে চলে যাওয়া গাড়ি, কখনো হেঁটে যাওয়া মানুষ আর ট্রাফিক সিগন্যালে থেমে থাকা সময় দেখব; সঙ্গে গান বাজবে, ‘হাউ লং ডিড ইউ ওয়েট ফর মি!’
পরদিন সকালে আমার প্রকৃত ভ্রমণ শুরু হলো। প্রথম গন্তব্য প্যালেস অব ফাইন আর্টস। নাম শুনেই মনে হয় বিশাল একটি রাজপ্রাসাদ হয়তো। এখন অবধি যত বাড়িঘর, হোটেল দেখেছি আশপাশে, সবই পুরোপুরি না হলেও আধাআধি রাজপ্রাসাদ বলেই মনে হয়েছে।
এ শহরে যাতায়াতের কতই না ব্যবস্থা রয়েছে! সাধারণ বাসে চড়ে চলে যাওয়া যায়। ট্যুরিস্ট বাস আছে আলাদা—এক স্পট থেকে আরেক স্পটে নিয়ে যাবে। এক বাস না পেলে অন্য বাস তো আছেই। সারা দিনই চলে ট্যুরিস্ট বাসগুলো। আর সান ফ্রান্সিসকো শহরের ঐতিহ্য এখনো ধরে রেখেছে ট্রাম। সেই আদ্যিকালে সাহেবরা যেমন ট্রামে চড়ে আপিস করতে যেতেন, তেমনি এখনো এই বাহন চলে শহরটির এক বিশেষ রুটে। আরেক ধরনের ট্রাম আছে, যাকে বলে ইলেকট্রিক ট্রাম বা মেট্রো। সেটি তুলনামূলক সাবেকি ট্রামের চেয়ে দ্রুতগতির। আর সাবওয়ে তো আছেই। সব যানবাহনের স্টপেজ আমার হোটেলের খুব কাছে। এখন যেহেতু আমি একটু দূরে যাব, তাই বাসে করে যাব প্যালেস অব ফাইন আর্টসের দিকে।
সান ফ্রান্সিসকো শহরের সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে এর পাহাড়ি পরিচ্ছন্ন উঁচু-নিচু পথ। একেক পথ এতই খাড়া, মনে হয় পিছলে পড়ে না যাই! সেই পথ খানিক গিয়ে আবার নিচের ঢালে নেমে গেছে। বাস আমাকে একটি হাইওয়ের মতো নির্জন পথে নামিয়ে গেল। অবশ্য আমেরিকার বেশির ভাগ শহরের পথঘাটই আমার কাছে নির্জন মনে হয়েছে, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া।
এ শহরের কিছু এলাকার ভিলার মতো বাড়িঘরগুলো এত সাজানো গোছানো, পরিচ্ছন্ন, ছিমছাম আর গাছপালা ও বাগানে পরিপূর্ণ, মনে হয় এখানে কেউ বাস করে না; এমনিই সাজিয়ে রাখা হয়েছে। এ রকম ঘরবাড়ি দেখতে দেখতে প্যালেস অব ফাইন আর্টসের দোরগোড়ায় পৌঁছে গেলাম। প্রবেশদ্বার তো নয়, যেন অষ্টাদশ শতাব্দীর কোনো ইউরোপীয় প্রাসাদে প্রবেশের তোরণ। বাইরে থেকে দেখতে সে রকমই মনে হচ্ছে। ১৯১৫ সালে এ বিশাল প্রাসাদসম ভবন নির্মাণ করা হয়েছিল বিভিন্ন ধরনের চিত্রকর্ম প্রদর্শনীর জন্য। তখন থেকেই প্রকৃতির কোলে গড়া, উদার, ছাদবিহীন বিরাট এই একতলা প্রাসাদ চিত্রকর্ম প্রদর্শনীর জন্য ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ভেতরে সবুজ বাগান আর মূল প্রাসাদ ঘিরে জলাধার। মূল ভবনটির চারপাশ খোলা। গোলাকার। সামনে-পেছনে করিন্থিয়ান কলাম সারি সারি দেয়ালের মতো সজ্জিত। প্রতিটি কলাম বা স্তম্ভের মাথার দিকে পাতা ঝাড়ের মতো নকশা করা। প্রাচীন গ্রিক ও রোমান স্থাপত্যশিল্পের অনন্য নিদর্শন এসব করিন্থিয়ান কলাম। চারপাশ খোলা মূল প্রাসাদের স্তম্ভগুলোর উপরিভাগও নকশাখচিত; আর বাইরের দিকের গোলাকার ছাদের নিচের দিকে, স্তম্ভের ঠিক ওপরে বিভিন্ন গ্রিক দেব-দেবীর ভাস্কর্য খোদাই করা সারি সারি—যা গোলাকার হয়ে ঘুরে এসেছে। বাইরের ফুলবাগান তখন আমায় ডাকছে। আমেরিকান ছাড়া অন্য কোনো দর্শনার্থী নেই এখানে। এরাও এসেছেন বাগানে পিকনিক করার জন্য। এই উদ্যান আসলেই অনেক বড়।
আমি প্যালেস অব ফাইন আর্টস দেখে চলে গেলাম সান ফ্রান্সিসকোর সবচেয়ে সাজানো গোছানো এলাকা আলামো স্কয়ারে। এখানে একটি পার্ক আছে। সেখানে পাহাড়ি ঢালে নিচের দিকে গড়িয়ে পড়া ঘাসের ওপর বসে সে পাড়ার ভিক্টোরিয়ান ধাঁচের সুসজ্জিত বাড়িগুলো দেখতে পাওয়া যায়। এগুলোর মধ্যে পাশাপাশি থাকা কয়েকটি বাড়ি দেখতে একই রকম। বিভিন্ন রঙে রঙিন এ বাড়িগুলোর নাম পেইন্টেড লেডিস। একটি হালকা আকাশি, আরেকটি হালকা হলুদ, পরেরটি ক্রিম—এ রকম পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। হলিউডের অনেক সিনেমার শুটিং হয়েছে এই এলাকায়। এখনো অনেক পর্যটক আসেন। পেইন্টেড লেডিসের দোতলা বাড়িগুলোর ছবি তোলেন, ভিডিও করেন। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেন। আনমনে ভাবলাম, বাড়ির বাসিন্দাদের স্বাধীনতা হরণ করার জন্য তো এটুকুই যথেষ্ট! প্রতিটি বাড়ি দেখতে একই রকম। নিচতলা থেকে সিঁড়ি, দরজা, জানালা, ছাদের বাংলো প্যাটার্নের ডিজাইন—সবই। সব কটির জানালায় লেস দেওয়া সাদা রঙের পর্দা ঝুলছে। আমার তো এই নীরব পার্ক, গাছপালা, ঘাসের ওপর প্রতিযোগিতায় নামা বসন্তের ফুটে ওঠা ফুলের রং দেখতেই ভালো লাগছে। কত যে নাম না জানা ফুল ফুটেছে বাগানে, আর কাঠবিড়ালি ছুটে বেড়াচ্ছে ফুরফুরে মেজাজে!
আলামো স্কয়ার থেকে আমার গন্তব্য সান ফ্রান্সিসকো শহরই নয়, ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যেরও আইকন—গোল্ডেন গেট ব্রিজ। সান ফ্রান্সিসকো বে ও প্রশান্ত মহাসাগরের ওপর ব্রিজটির নির্মাণকাজ শেষ হয়েছিল ১৯৩৭ সালে। ৮৭ বছরের পুরোনো এই স্থাপনা বহু বছর ধরে ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ব্রিজ। গিনেস বুকে লিখিয়েছিল নাম। আধুনিক বিশ্বের স্থাপনাগুলোর সপ্তম আশ্চর্যের তালিকায়ও নাম আছে এর।
ট্যাক্সিচালক আমাকে নামিয়ে দিলেন গোল্ডেন গেট ব্রিজের ভিউ পয়েন্টে। দূরের আকাশ নীল থেকে আরও গাঢ় নীল হয়ে সুনীল সাগরে মিশে যাচ্ছে, আর এর মাঝে এক আশ্চর্য সেতুবন্ধ তৈরি করেছে লালচে খয়েরি রঙের গোল্ডেন গেট ব্রিজ। অনেকের মতে এটিই দুনিয়ার সবচেয়ে সুন্দর সেতু।
আমেরিকার যেকোনো উল্লেখযোগ্য ট্যুরিস্ট স্পটেই বাগান থাকে। এখানেও ঘুরেফিরে বেড়ানোর অনেক জায়গা আছে। আরও আছে কফি শপ। বিভিন্ন দেশ থেকে নানা ধরনের, নানা রঙের পোশাক পরা পর্যটকেরা এসেছেন এই ব্রিজ দেখতে। বাসস্টপেজের কাছেই ব্রিজের স্প্যানের কিছু অংশ আর নাটবল্টু রাখা। সামনে বর্ণনাও দেওয়া আছে। মোট তারের দৈর্ঘ্য, ক্যাবলের প্রস্থ, প্রতিটি ক্যাবলে তারের সংখ্যা, ওজন, কন্ট্রাকটরের নাম ইত্যাদি লেখা। একটি দেশের উন্নয়নে জনগণকে অন্তর্ভুক্ত ও জানানোর এই উদ্দেশ্য খুব ভালো লেগেছে। ব্রিজের স্প্যান যে এত বিরাট, কাছ থেকে না দেখলে বুঝতেই পারতাম না।
আমি এখান থেকে যাব গোল্ডেন গেট পার্কে। নামের মিল থাকলেও দুটি জায়গা সম্পূর্ণ আলাদা এলাকায়। পার্কে বেড়াতে আমার বরাবরই ভালো লাগে। যেকোনো দেশের নিজস্ব গাছপালা আর ফুল ও ফলের সঙ্গে পরিচিত হওয়া যায়। গোল্ডেন গেট পার্ক সান ফ্রান্সিসকোর সবচেয়ে বড় পার্ক। আজকের দিন পুরোটাই এখানে কাটিয়ে দেওয়া যাবে। প্রায় সাড়ে চার বর্গকিলোমিটারের এই বিশাল পার্কে ভাগ ভাগ করা বিভিন্ন ছোট ছোট বাগান আছে। গোটা পাঁচেক লেক আছে বিভিন্ন কোনায়। আছে বোটানিক্যাল গার্ডেন, পোলো খেলার মাঠ, স্টেডিয়াম, এইডস মেমোরিয়াল গ্রোভ, ক্যালিফোর্নিয়া অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস, জাপানিজ টি গার্ডেন, দে ইয়ং মিউজিয়াম, শেক্সপিয়ার গার্ডেন, রোজ গার্ডেন, ডালিয়া গার্ডেন ইত্যাদি। সব দেখে শেষ করতে কয়েক দিন লেগে যাবে। আমি বোটানিক্যাল গার্ডেনের সবুজ বনে হারিয়ে গেলাম। এই বনভূমির বেশির ভাগেই লম্বা লম্বা ওক ও সাইপ্রেস গাছের ভিড়। এর মাঝ দিয়ে হেঁটে একেবারে পৌঁছানো যায় রোজ গার্ডেনের নানা রঙের, নানা সুবাসের গোলাপ ফুলের কাছে। এখানে বাবা-মায়েরা বাচ্চাদের নিয়ে এসেছেন খেলাধুলা করানোর জন্য। কেউ কেউ সাইকেল চালাচ্ছে।
জাপানিজ টি গার্ডেন সাজানো হয়েছে জাপানি বাড়ি বা প্যাগোডার আদলে। পাহাড়ের একটু উঁচুতে লাল রং করা কাঠের প্যাগোডায় যেতে হলে জাপানি কায়দায় বানানো পুল পার হতে হয়। ভেতরে বিশাল বাগানের মাঝে বারান্দায় চায়ের সরঞ্জাম রাখা। নাগরিক জীবনের ব্যস্ততা দূরে সরিয়ে শান্ত, সাধারণ জীবনযাপন পদ্ধতিও যে অবলম্বন করা সম্ভব, তা এই থিম গার্ডেন দিয়ে বোঝানো হয়েছে। এদিক-ওদিক ঘুরতে ঘুরতে ঠিকই এই পার্কের একটি লেকের সামনে এসে পড়লাম। লেকের জলে এখন খেলা করছে হাঁস। এত নীরব চারদিক, হাঁসের ডাক বহুদূর অবধি ছড়িয়ে পড়ছে। আমি বিভিন্ন জায়গায় সাকুলেন্ট গাছ দেখেছি, কিন্তু এই পার্কের বিশাল আকারের ও ধরনের সাকুলেন্ট দেখে মাথা ঘুরে যাচ্ছে! তা ছাড়া এদেশীয় হাইড্রেঞ্জা, লিলি ফুল ফুটে আছে এখানে-সেখানে।
সান ফ্রান্সিসকোতে তৃতীয় দিনে আমাকে ঘুরে বেড়াতে হবে ঐতিহ্যবাহী ট্রামে করে। শহরটিতে এই ট্রাম চালু হয়েছিল ১৮৭৩ সালে। তখন এখানে ট্রামের সংখ্যা ছিল ২৬। এখন শহরের মাঝে মাত্র তিনটি ট্রাম চলে শুধুই ট্যুরিস্টদের জন্য। ইউনিয়ন স্কয়ারে গ্রীষ্মের এই শীতমাখা সকালে অনেকে চলে এসেছেন ট্রাম দেখতে। সান ফ্রান্সিসকোর এই বাহন আজ অবধি বিশ্বের একমাত্র ম্যানুয়ালি চলা ট্রাম। আমিও জনতার ভিড়ে দাঁড়িয়ে ট্রামের কীর্তিকলাপ দেখতে লাগলাম।
ইউনিয়ন স্কয়ার আসলে একটি বাণিজ্যিক এলাকা। বিভিন্ন বড় বড় কোম্পানির অষ্টাদশ শতাব্দীর নান্দনিক ইউরোপীয় ধাঁচের অফিস ভবন আর শপিং মলের ছড়াছড়ি। এর মাঝখানে জায়গা করে নিয়েছে পথের ওপর ট্রাম। ঝকঝকে পথের কোথাও কোথাও এখনো কবলস্টোনের চিহ্ন রয়ে গেছে।
যেহেতু ম্যানুয়ালি চলে, তাই গন্তব্য শেষে যখন ইউনিয়ন স্কয়ারে এসে থামে, তখন কর্মীরা লাইনের ওপর রেখেই ট্রামটিকে ফিরতি গন্তব্যের দিকে ঘুরিয়ে দেন। একবার ঘোরানোর পর উপস্থিত জনতা হাততালি দিয়ে ওঠে। আস্ত একটি ট্রামকে মানুষ এভাবে চালাচ্ছে—এমন মজার ব্যাপার এখন আর অন্য কোথাও দেখা যায় না। চালক বসেন ট্রামের পেছনে, আর যাত্রীদের শহর দেখার সুবিধার্থে লম্বালম্বিভাবে ট্রামের দুদিকে পথের দিকে মুখ করা বসার বেঞ্চ পাতা আছে। গাছপালায় ঘেরা, পুরোনো ভবনের সারি আর এর মাঝে ট্রামের উপস্থিতি—এই দৃশ্য কোনোমতেই এখনকার হতেই পারে না! এ যেন নিশ্চিতভাবেই অষ্টাদশ শতাব্দীর গ্রীষ্মের কোনো এক দিন।
একটি ট্রাম চলে যাওয়ার পর আমার পালা এলো ট্রামে চড়ার। এ রকম গতির ট্রামে আমি চড়েছি কলকাতায়। কিন্তু সেটিও পুরোপুরি ম্যানুয়েল নয়। অতিরিক্ত আনন্দিত ও ভাবাবিষ্ট হয়ে আমি ট্রামের এক কর্মীকে বললাম, ‘ট্রাম যখন চলবে, তখন কি আমি ট্রামের সঙ্গে সঙ্গে দৌড়াতে পারব?’ তিনি সজোরে মাথা নেড়ে বললেন, ‘না, একদম নয়। পথে অন্য অনেক গাড়ি চলে। দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। তবে তুমি যেকোনো স্টেশনে নেমে আবার উঠতে পারবে।’ অগত্যা ট্রামে বসেই সান ফ্রান্সিসকো শহরের শোভা ঘণ্টায় ১৫ কিলোমিটার বেগে দেখতে লাগলাম। পাহাড়ি উঁচু-নিচু পথও ট্রাম বেশ আয়ত্ত করে নিচ্ছে। চায়না টাউন, ফিন্যান্সিয়াল ডিস্ট্রিক্ট পার হয়ে একসময় সমুদ্রসৈকতের সামনে আমাকে নামিয়ে দিল ট্রামটি। দূর থেকে যখন নিচের দিকে নামছিল, মনে হচ্ছিল এই ট্রাম নির্ঘাত সমুদ্রে নাইতে নামছে! ট্রাম কোম্পানি যত্নআত্তি করে ঠিকই, কিন্তু ট্রামের কি একবারও ইচ্ছে জাগে না সমুদ্রে নেমে যেতে!
আমি যেখানে নামলাম, এর নাম ফিশারম্যানস ওয়ারফ। সামনে অফুরন্ত নীল সাগর। জায়গাটি আদতে ট্যুরিস্ট স্পট। মানুষ সাগর দেখতে আসে, পাশেই জাহাজের জেটি। সাগরতটের রাস্তা ধরে সারি সারি সি-ফুডের দোকান, স্যুভেনির শপ। মানুষ সাগরতটের চেয়ে সেখানে ভিড় জমিয়েছে বেশি। আমি চলে গেলাম সাগরের দিকে। তটে দু-একজন ছাড়া কেউ নেই। কেন নেই, এবার বুঝলাম। তটের যতই কাছাকাছি যাচ্ছি, বাতাসের তোড় আরও তীব্র হচ্ছে আর ততই ঠান্ডা লাগছে। তা-ও একসঙ্গে এই যে ঘন নীল পরিষ্কার আকাশ সাগরের নীলে ডুবে যাচ্ছে আর সাগর চাইছে আরেকটু রং বাড়িয়ে নিজের মাঝে আকাশকে লুকিয়ে ফেলতে—এসব দেখতে হলে শীত, গ্রীষ্ম—সব উপেক্ষা করা যায়।

ছবি: লেখক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top