skip to Main Content

দৃশ্যভাষ্য I মরিয়া মায়ের মুখ

চরম দুঃসময়ে এক চিরন্তন জননীর হার না মানার প্রেরণা জোগানো কালজয়ী আলোকচিত্র। কী তার নেপথ্য গল্প?

দৃষ্টিজুড়ে উৎকণ্ঠা আর অনিশ্চয়তার স্পষ্ট আভাস। পরনে জীর্ণ পোশাক। আনমনে গালে আঙুলের চাপ রেখে বসে আছেন এক নারী। জননী তিনি। তার দুই কাঁধে মুখ লুকিয়ে দুই শিশুসন্তান। কোলে নবজাতক; গভীর ঘুমে। চিরকালীন মায়ের এক অন্যতর ভাষা ফুটিয়ে তোলা এই আলোকচিত্র প্রবল ঝাঁকুনি দিয়েছিল সংবেদনশীল মানুষদের মনে। এখনো দিচ্ছে। ছবির শিরোনাম মাইগ্রেন্ট মাদার। সরল বাংলায়, পরিযায়ী মাতা। তুলেছেন প্রখ্যাত আমেরিকান ফটোগ্রাফার ও ফটোজার্নালিস্ট ডরোথিয়া লাং [১৮৯৫—১৯৬৫]।
মাইগ্রেন্ট মাদার প্রথম ছাপা হয় ১৯৩৬ সালের মার্চে, যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিসকোর একটি সংবাদপত্রে। তখন শিল্পোন্নত পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ গ্রেট ডিপ্রেশন [১৯২৯—১৯৩৯], অর্থাৎ পুঁজিবাজারের চরম পতনের ফলে মারাত্মকতম অর্থনৈতিক মন্দা চলমান। সে সময়ে বিপুলসংখ্যক আমেরিকান নাগরিক ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও অসহায়ত্ব সহ্য করতে বাধ্য হয়েছিলেন। সেই পরিস্থিতিরই প্রতীকী চিত্রে পরিণত হয়েছে এই আলোকচিত্র। ক্যালিফোর্নিয়ার নিপোমো শহরের পরিযায়ী খামারশ্রমিকদের একটি শিবিরে একগুচ্ছ ছবি তুলেছিলেন ডরোথিয়া। এটি সেগুলোরই একটি।
ইতিহাসবিষয়ক পোর্টাল হিস্ট্রি ডটকম সূত্রে জানা যায়, বিপন্ন খামারশ্রমিকদের সাহায্য করতে গড়ে ওঠা যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের রিসেটেলমেন্ট অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে (পরবর্তীকালের ফার্ম সিকিউরিটি অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বা এফএসএ) ডরোথিয়া তখন কর্মরত। তিনি এবং ওই এজেন্সির অন্য আলোকচিত্রীরা ১৯৩৫ থেকে ১৯৪৪ সালের মধ্যে সংস্থাটির হয়ে প্রায় ৮০ হাজার আলোকচিত্র তুলেছিলেন। খরাবিধ্বস্ত অঞ্চল থেকে বাস্তুচ্যুত হওয়া অগুনতি মানুষের চরম দুর্দশা সম্পর্কে অপেক্ষাকৃত ভালো অবস্থানে থাকা আমেরিকানদের অবগত করতে ভূমিকা রেখেছিল সেগুলো।
এই ছবি যেদিন তোলা, লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে প্রায় ১৭৫ মাইল উত্তরে অবস্থিত সান লুইস অবিসপো কান্ট্রির ভেতর দিয়ে যাওয়া হাইওয়ে ১০১ সড়ক ধরে ডরোথিয়া তখন গাড়ি চালিয়ে উত্তর দিকে যাচ্ছিলেন, আর পরিযায়ী শ্রমিকদের ক্যাম্পসাইটের একটি নিদর্শন দেখে থেমে যান। বাজে আবহাওয়ার কারণে সেখানকার মটরজাতীয় শস্যের ফলন নষ্ট হয়ে গিয়েছিল; ফলে ফসল উত্তোলনকারীরা হয়ে পড়েছিলেন বেকার, তাদের অনেকে দিনাতিপাত করছিলেন চরম অনাহারে। সেখানেই ছিলেন আলোকচিত্রটির ওই নারী ও তার শিশুসন্তানেরা।
১৯৬০ সালে পপুলার ফটোগ্রাফি ম্যাগাজিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ডরোথিয়া বলেন, ‘দেখামাত্রই ওই ক্ষুধার্ত ও মরিয়া মায়ের মুখটি আমাকে চুম্বকের মতো টেনেছিল।’ তিনি আরও যোগ করেন, ‘তার কাছে নিজের উপস্থিতির কারণ কিংবা আমার ক্যামেরাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করেছিলাম, এখন আর মনে নেই। তবে মনে পড়ে, তিনি আমাকে কোনো প্রশ্নই করেননি। পাঁচটি ক্লিক করেছিলাম আমি; একই দিক থেকে, কাছ থেকে আরও কাছে গিয়ে। তার নাম কিংবা ইতিহাস তাকে জিজ্ঞেস করিনি। তিনি নিজের বয়স বলেছিলেন, ৩২। বলেছিলেন, আশপাশের জমিন থেকে কুড়িয়ে আনা সবজি আর তার সন্তানদের শিকার করা পাখি খেয়ে জীবন কাটাচ্ছেন। খাবার কেনার জন্য নিজের গাড়ির টায়ার বিক্রি করে দিয়েছেন সদ্যই। তাঁবুতে হেলান দিয়ে তিনি বসে ছিলেন তখন; তার দুই সন্তান তাকে জড়িয়ে রেখেছিল। দেখে মনে হয়েছিল, আমার তোলা ছবিগুলো হয়তো তাকে সাহায্য করবে; আর একইভাবে তিনি নিজেও সাহায্য করেছিলেন আমাকে। এ ছিল আসলে একধরনের সমতার ব্যাপার।’
অন্যদিকে, এই আলোকচিত্রীকে ঘিরে লেখা জীবনীগ্রন্থ ডরোথিয়া লাং: আ লাইফ বিয়ন্ড লিমিটস-এ লিন্ডা গর্ডন আলোচ্য ছবিটি তোলার প্রক্রিয়া সম্পর্কে লিখেছেন, ‘বেশ কয়েকটি ভিন্ন পজিশনে সরে যাওয়ার জন্য ওই মা ও তার সন্তানদের অনুরোধ করেছিলেন লাং। একটি মিড-ডিসটেন্স শট দিয়ে শুরু করেছিলেন তিনি। তারপর একটি ব্যাকআপ শট শেষে নিয়েছেন কয়েকটি ক্লোজ শট। ওই নোংরা জামাকাপড়ের স্তূপকে এক পাশে সরিয়ে দিয়েছিলেন (নিজের তোলা ছবির বিষয়বস্তুগুলো নিয়ে তিনি কখনোই বিব্রত হতেন না)। তারপর আরও কাছাকাছি এসে, তিনটি অল্পবয়সী শিশুর ওপর ফোকাস করেছিলেন এবং শেষ দিকের ছবিগুলোতে কিশোরী কন্যাটিকে ফ্রেমের বাইরে সরিয়ে দিয়েছিলেন।’
পত্রিকায় ছবিগুলো ছাপা হওয়ার পরপরই ওই শস্য উত্তোলনকারীদের ক্যাম্পসাইটে খাবারের ভর্তুকি হিসেবে ২০ হাজার পাউন্ড পাঠানোর ঘোষণা দেয় যুক্তরাষ্ট্র সরকার। কিন্তু সেই সাহায্য পৌঁছানোর আগেই তখনো অজ্ঞাতপরিচয় ওই নারী নিজের পরিবার নিয়ে অন্যত্র পাড়ি জমিয়েছিলেন। এমনকি বিভিন্ন ম্যাগাজিন থেকে শুরু করে ডাকটিকিটে তার সেই ছবি বারবার পুনর্মুদ্রিত হলেও, সেই মাইগ্রেন্ট মাদার যেন মিলিয়ে গিয়েছিলেন হাওয়ায়!
এভাবেই কেটে গেছে ৪২ বছর। ডরোথিয়া লাংও তত দিনে বেঁচে নেই। অবশেষে ১৯৭৮ সালে ক্যালিফোর্নিয়া থেকে প্রকাশিত পত্রিকা দ্য মডেস্টো বি-এর সম্পাদক বরাবর এক চিঠি এলো, ফ্লোরেন্স ওয়েন্স থম্পসন নামের এক নারীর কাছ থেকে। নিজেকে সেই মাইগ্রেন্ট মাদার দাবি করলেন তিনি। জানালেন, এর সপক্ষে প্রমাণ হাজির করতে চান। এরপর আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসে (এপি) প্রকাশ পায় একটি বিশেষ আর্টিকেল। ওম্যান ফাইটিং ম্যাড ওভার ফেমাস ডিপ্রেশন ফটো শিরোনামে। তাতে প্রতিবেদকের কাছে ফ্লোরেন্স দাবি করেন, ডরোথিয়ার তোলা প্রতিকৃতিটিতে তাকে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এদিকে ২০০২ সালে সান লুইস অবিপসো নিউ টাইমস-এ লেখা প্রতিবেদনে সাংবাদিক জিওফ্রে ডান তুলে ধরেন, মাইগ্রেন্ট মাদার খ্যাত ছবিটি যেভাবে ব্যাখ্যা করা হয়, তা নিয়ে চরম আপত্তি রয়েছে ফ্লোরেন্স ও তার সন্তানদের।
সে যাক! চলুন, জেনে আসি সাধারণ নাগরিক থেকে চরম দুঃসময়ে প্রতিমাতুল্য জননীর প্রতীকে পরিণত এই নারীর পরিচয়। তার জন্ম যুক্তরাষ্ট্রের ওকলাহোমায়। তিনি আসলে আপাদমস্তক একজন নেটিভ আমেরিকান। বাবা-মা উভয়েই চেরোকি জাতিগোষ্ঠীর মানুষ। ১৯২০-এর দশকের মধ্যভাগে তিনি ও তার প্রথম স্বামী ক্লিও ওয়েন্স চলে আসেন ক্যালিফোর্নিয়ায়। সেখানে তারা কারখানা ও খামারে কাজ খুঁজে পান। যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে ১৯৩১ সালে মৃত্যু ঘটে ক্লিওর। এ সময়ে ছয় সন্তানের ভরণপোষণের জন্য তুলা ও অন্যান্য শস্য তোলার কাজ নেন ফ্লোরেন্স।
১৯৭৯ সালে নেব্রাস্কা পাবলিক টেলিভিশন-এর ফটোগ্রাফার বিল গনজেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এই নারী বলেছিলেন, অল্পবয়সী মা থাকাকালে দিনপ্রতি ৪৫০ থেকে ৫০০ পাউন্ড তুলা তোলার সক্ষমতা ছিল তার। সে সময়ে দিনের আলো ফোটার আগেই ঘর ছাড়তেন; ফিরতেন রাত নামার পরে। ‘আমরা কোনোরকমে বেঁচে থাকছিলাম আরকি,’ বলেন তিনি।
১৯৩৬ সালের মার্চের সেদিন নিপোমোতে ফ্লোরেন্সের দেখা যখন পেয়েছিলেন ডরোথিয়া, তত দিনে তার কোলজুড়ে এসেছে আরও দুটি সন্তান। জিম হিল নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে পেতেছিলেন সংসার। লেটুসপাতা তোলার কাজে যাওয়ার পথে তাদের গাড়িটি নষ্ট হয়ে গেলে, ওই মটরশুঁটি উত্তোলনকারীদের ক্যাম্পের কাছে থামতে বাধ্য হয়েছিলেন তারা।
এই আইকনিক ছবি তোলার সময় ফ্লোরেন্সের বড় দুই ছেলে ছিল শহরে; গাড়ির রেডিয়েটর মেরামত করার কাজে। তাদেরই একজন, ট্রয় ওয়েন্স অবশ্য বলেছেন, খাদ্য কেনার জন্য গাড়ির টায়ার বিক্রি করেছিলেন ফ্লোরেন্স—ডরোথিয়ার এমন দাবি সত্য নয়। ‘বলছি না, ডরোথিয়া লাং মিথ্যে বলেছেন; তবে আমার ধারণা অন্য কারও গল্পের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেছিলেন তিনি।’
ছবিটি তোলার পর পরিবারটি বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াতে থাকে খামারে কাজ পাওয়ার আশায়। এরই মধ্যে আরও তিন সন্তানের জননী হন ফ্লোরেন্স। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ক্যালিফোর্নিয়ার মডেস্টো শহরে থিতু হন তিনি। বিয়ে করেন জর্জ থম্পসন নামের এক হসপিটাল অ্যাডমিনিস্ট্রেটরকে।
মাইগ্রেন্ট মাদার হিসেবে নিজের পরিচয় প্রকাশের পাঁচ বছর পর, ১৯৮৩ সালে একটি ট্রেলারে একা বসবাস করতে থাকেন ফ্লোরেন্স। ক্যানসার ও হৃদ্‌রোগে ভুগছিলেন। একপর্যায়ে সন্তানেরা তার চিকিৎসার জন্য অর্থ সাহায্যের আবেদন জানান। তাতে সাড়া দিয়ে আসতে থাকে হাজারো চিঠি; জমা পড়ে ৩৫ হাজার ডলারের বেশি। সে বছরের সেপ্টেম্বরে, নিজের ৮০তম জন্মদিনের কিছুদিন পর প্রয়াত হন ফ্লোরেন্স ওয়েন্স থম্পসন। অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা, মাতৃক আত্মত্যাগ ও মানব মর্যাদার প্রতীক হয়ে ওঠা একজন সাধারণ ব্যক্তিমানুষের জীবনের সমাপনী ঘটে। তার মৃত্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান এক শোকবার্তায় বলেন, ‘মিসেস থম্পসনের প্রয়াণ এমন একজন আমেরিকানকে হারানোর প্রতিনিধিত্ব করে, যিনি গ্রেট ডিপ্রেশনের দিনগুলোতে শক্তিমত্তা ও সংকল্পের প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন।’

সূত্র: হিস্ট্রি ডটকম; অ্যাবস্ট্রাকটেড রিয়েলিটি ডটকম
 লাইফস্টাইল ডেস্ক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top