skip to Main Content

ফিচার I থ্রিফট শপ

পুনর্ব্যবহারের জন্য পুরোনো পোশাক। ধারণাটি নতুন নয়। বদলে যাওয়া ফ্যাশনের ট্রেন্ডে এ-ও এক সমান্তরাল ধারা। চ্যারিটিই এর ভিত্তি

ফ্যাশনে নিত্যনতুন ট্রেন্ডের আনাগোনা চলতেই থাকে। পোশাকের উৎপাদনও দ্রুত বাড়ছে। আমরা ফ্যাশনসামগ্রী কিনতেই থাকি। অল্প কিছুদিন গেলে তা ফেলেও দিই। সেগুলোর শেষ ঠিকানা হয় ভাগাড়। আর এর বিরূপ প্রভাব পড়ে পরিবেশের ওপর।
পরিবেশ রক্ষায় পরিত্যক্ত বা সেকেন্ডহ্যান্ড জিনিস কেনাবেচার কোনো জুড়ি নেই। আর এগুলোর এক ভান্ডার হলো ‘থ্রিফট স্টোর’, যাকে ‘চ্যারিটি শপ’ বা ‘অপরচুনিটি শপ’ও বলা হয়ে থাকে। এখানে পোশাক-আশাক, আসবাবপত্র, মিউজিক্যাল বা ইলেকট্রিক্যাল যন্ত্রপাতিসহ যেকোনো জিনিস বিক্রি হতে পারে। সাধারণত দান হিসেবে পাওয়া এসব জিনিস সস্তায় বিক্রি হয়ে থাকে পুনর্ব্যবহারের জন্য। বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য এক ভরসার জায়গা এই থ্রিফট স্টোর। হালে ভার্চ্যুয়াল থ্রিফট শপ ওয়েবসাইট চালু হওয়ায় ক্রেতারা ইন্টারনেটেই সেকেন্ডহ্যান্ড জিনিস পছন্দ করতে পারছেন। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে থ্রিফট স্টোর এমন জনপ্রিয়তা পেয়েছে যে টায়রা ব্যাংকস, অ্যাঞ্জেলিনা জোলির মতো সেলিব্রিটিদেরও এসব স্টোর থেকে শপিং করতে দেখা যায়। ২০১৩ সালে বিলবোর্ড হট হান্ড্রেড চার্টের শীর্ষ স্থান দখল করে ম্যাকলমুর আর লুইসের সিঙ্গল ‘থ্রিফট শপ’। এই গানের ভাষায়, গুচির মতো নামিদামি ব্র্যান্ডের জিনিস কেনার কথা বলা হয়েছে। এভাবে থ্রিফট স্টোরে শপিং করার উৎসাহ দেওয়া হয়।
রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের সময় থেকেই ইংল্যান্ডে থ্রিফট স্টোর ছিল। অনেকে মনে করেন, খ্রিস্টান মিশনারি সংগঠনগুলো থ্রিফট স্টোরের উদ্ভাবক। কিন্তু ২০১৭ সালে প্রকাশিত নিউ ইংল্যান্ড কোয়ার্টারলি ম্যাগাজিনের অক্টোবর সংস্করণে ইতিহাসবিদ জেনিফার লে জটে বলেন ভিন্ন কথা। আমেরিকায় আসা নতুন ইমিগ্র্যান্ট, বিশেষ করে ইউরোপিয়ান ইহুদিরাই জীবিকার তাগিদে প্রথম রাস্তায় ঠেলাগাড়ি নিয়ে পুরোনো জিনিস সংগ্রহ ও বিক্রি শুরু করে। প্রথম দিকে তাদের ভালো চোখে না হলেও খুব শিগগির মিশনারি সংগঠনগুলো থ্রিফট শপে বিক্রির জন্য পুরোনো জিনিস সংগ্রহ করতে শুরু করে। মূলকথা হলো, গরিব মানুষের কাছে কম দামে জিনিস বিক্রি নয়, বরং তাদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে প্রথম থ্রিফট শপ খোলা হয়। বিশ শতকের শুরুতে অর্থনৈতিক মন্দা, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে এমনকি প্রযুক্তির উৎকর্ষের এই যুগেও থ্রিফট স্টোরের ওপর মানুষের নির্ভরতা বেড়েছে।
‘চ্যারিটি শপ’ বলা যাবে এমন প্রথম সংগঠন সম্ভবত স্ট্যাফোর্ডশায়ারের ‘উলভারহ্যাম্পটন সোসাইটি ফর দ্য ব্লাইন্ড’। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের সহায়তা দিতে সংগঠনটি দান হিসেবে পাওয়া জিনিস বিক্রি করত। ১৮৯৭ সালে খ্রিস্টান মিশনারি সংগঠন ‘স্যালভেশন আর্মি’ থ্রিফট শপ খোলে। চল্লিশ বছরের মধ্যেই এগুলো এত জনপ্রিয়তা পায় যে ১৯২৯ সালে সংগঠনটির আয়ের অর্ধেকই আসে থ্রিফট শপ থেকে। ১৯০২ সালে থ্রিফট শপ খোলে গুডউইল; আর বিশের দশকের মধ্যেই তাদের পণ্য আনা-নেওয়ার ট্রাকের সংখ্যা দাঁড়ায় হাজারে। এরপর ১৯৪৭ সালের অক্সফাম ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ডে চ্যারিটি স্টোরের কাজ শুরু করে। বই বিক্রির জন্য সুপরিচিত এই সংগঠনের এখন শুধু ইংল্যান্ডেই ৭০০টির বেশি আউটলেট আছে।
সিনথেটিক ফাইবার (বিশেষ করে পলিয়েস্টার) আবিষ্কারের ফলে মানুষ নতুন ফ্যাব্রিকের দিকে ঝুঁকে পড়ে। জমতে থাকে পরিত্যক্ত পোশাকের স্তূপ। এর সুবাদে পঞ্চাশের দশকে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে কনসাইনমেন্ট শপ। স্টোরগুলোয় অনেকটা কম দামে সেকেন্ডহ্যান্ড ট্রেন্ডি পোশাক পাওয়া যেত। ষাটের দশকে সাধারণত হিপিদের মধ্যেই থ্রিফট স্টোরের জিনিস ব্যবহার করার চল ছিল। কিন্তু আশি-নব্বইয়ের দশকে টিনেজারদের মধ্যেও এ প্রবণতা শুরু হয়।
আর্লি অটস এবং টেনজিসের সময়—যখন ফাস্ট ফ্যাশনের দৌরাত্ম্য চলছে, তখন প্রচলিত থ্রিফট শপের চিত্র বেশ বদলে গিয়েছিল। দেখা যায়, জিনিসের মানের চেয়ে কম দামের দিকেই ক্রেতারা বেশি ঝুঁকছেন। ‘ওভারড্রেসড: দ্য শকিংলি হাই কস্ট অব চিপ ফ্যাশন’ আর ‘দ্য কনশাস ক্লোজেট: আ রেভল্যুশনারি গাইড টু লুকিং গুড হোয়াইল ডুয়িং গুড’ বই দুইটির লেখক ও সাংবাদিক এলিজাবেথ ক্লাইন বলেন, ‘অনেক বেশি পোশাক উৎপাদিত হচ্ছে। আর মানুষের এক পোশাক চালিয়ে নেওয়ার সময়টা হুট করে কমেও এসেছে। ফলে পরিত্যক্ত পোশাকের সরবরাহ গিয়ে ঢুকছে সেকেন্ডহ্যান্ড পোশাক কেনাবেচা ব্যবস্থায়।’ নিউইয়র্কের ব্রুকলিনে ডাস্টি রোজ ভিন্টেজের মালিক ম্যারেসা পনিচ টেক্সটাইল রিসাইক্লিং ফ্যাসিলিটির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। কী পরিমাণ পরিত্যক্ত পোশাক প্রতিনিয়ত এসে জমা হচ্ছে, সে বিষয়ে অভিজ্ঞতা রয়েছে। বলেন, ‘এখনকার যে থ্রিফট স্টোর সিস্টেম, সেটা শুরু হয়েছিল এমন এক সময়ে, যখন পোশাকের সংকট ছিল, তাই এর মূল্যও ছিল। এটি নিয়ে ফাস্ট ফ্যাশনের এই যুগে নতুন করে ভাবা আর কাজ করা দরকার। আগের সিস্টেমটা এখন প্রায় ভেঙেই পড়েছে। থ্রিফট স্টোরে এখন যা বিক্রি হয়, তার বেশির ভাগই আসলে অন্য কোনো দোকানে জায়গাই পায় না।’
তবে ধীরে ধীরে মিইয়ে যাচ্ছে ফাস্ট ফ্যাশন। থ্রিফট শপ ফিরে আসছে সেই পুরোনো রূপে। থ্রিফটিংয়ে ঝুঁকেছে মিলেনিয়াল থেকে শুরু করে জেন জেড—সবাই। আমাদের দেশে টিনেজার আর তরুণদের জন্য অলটারনেটিভ শপিং অপশনস বেশ বেড়েছে। থ্রিফট স্টোরের কারণে সেকেন্ডহ্যান্ড আর ভিন্টেজ পোশাক এসেছে হাতের নাগালে। ফলে টেকসই পোশাক বানানো হচ্ছে, পাশাপাশি শক্তিশালী হচ্ছে ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি। এখানে একদল দৃঢ়চেতা ফ্যাশনমনস্ক তরুণ ধীরে ধীরে একটি থ্রিফট কমিউনিটি গড়ে তুলছে। বাংলাদেশ থ্রিফট, কালারস ঢাকা, অ্যাসথেইজডটবিডি হলো অনলাইননির্ভর থ্রিফট শপ। যেখানে সব পণ্যই হয় সেকেন্ডহ্যান্ড, না হয় রিসাইকেলড বা আপসাইকেলড। এসব অনলাইন শপে অলংকার, ব্যাগসহ অন্যান্য সঙ্গানুষঙ্গ খুবই সুলভ মূল্যে পাওয়া যায়। সেকেন্ডহ্যান্ড এসব পোশাক ও অ্যাকসেসরিজ ক্রেতাদের নাগালের মধ্যে এনে দিতে গিয়ে ফ্যাশনেও গতি আনছে এসব শপ।
গবেষণায় দেখা যায়, একজন আমেরিকান বছরে গড়ে ৮১ পাউন্ড পোশাক বাতিলের খাতায় ফেলে দেন। সে হিসেবে বছরে ২৬ বিলিয়ন পাউন্ড পরিত্যক্ত পোশাক সেখানকার ভাগাড়ে জমা হয়। কিন্তু থ্রিফটিংয়ের মাধ্যমে এ পোশাক বরং রিসাইকেল হয়ে অন্য কারোর হাতে গিয়ে পৌঁছায়।

 ফাহমিদা শিকদার
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top