skip to Main Content

রসনাবিলাস I কাবাব কারিগরদের ‘কারি অ্যাকসেন্ট’

পুরোনো দিল্লি থেকেই এসেছেন ‘কারি অ্যাকসেন্ট’-এর কাবাব কারিগরেরা। তাদের তামার তন্দুরে মাংস আর মাছের বিচিত্র প্রিপারেশন। অন্যসব মুখরোচক পদ তো থাকেই। বর্ণনায় সামীউর রহমান

ব্রিটিশ পতাকা যেখানে যেখানে উড়েছে, সেখানেই পৌঁছেছে ক্রিকেট আর কারি। সাহেবসুবোরা খেলতেন ক্রিকেট, কেরানি আর শ্রমিকের কাজের জন্য ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে তারা নিয়ে গিয়েছেন অগুনতি মানুষকে। কেনিয়ায় রেললাইন বানাতে, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ক্যারিবিয়ান দ্বীপে আখের খামারে। এরপর বিশ্বায়নের যুগে এসে তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষে ভারত হয়ে উঠেছে ‘মহাভারত’। ভারতীয়রা ছড়িয়ে পড়েছেন বিশ্বের নানান প্রান্তে, তারা সঙ্গে করে নিয়ে গেছেন নিজেদের রন্ধনশৈলী। বিশ্বের সব বড় শহরে তাই পিৎজা, চিকেন ফ্রাই আর কফির দোকানের মতো ভারতীয় রেস্তোরাঁরও হদিস মিলবে। প্রতিবেশী দেশের খাবারের স্বাদ ঢাকাবাসীর কাছে বহুদিন ধরেই প্রিয়। খাজানা, কয়লা, বুখারা, লক্ষেèৗসহ গুলশান বনানীর বেশ কিছু রেস্তোরাঁয় পরিবেশিত হচ্ছে খাঁটি উত্তর ভারতীয় কায়দায় তামার তন্দুরে তৈরি নানান রকম কাবাব, রুটিসহ দারুণ সব পদ। এই মানচিত্রে নবতম সংযোজন ‘কারি অ্যাকসেন্ট’। ঠিকানা নতুন হলেও এর পেছনের মানুষেরা পুরোনো। তারা অনেক দিন ধরেই ঢাকাবাসী এবং ঢাকায় বসবাসরত ভারতীয়দের মন ও পেট ভরিয়ে চলেছেন। তাই নতুন ঠিকানায় তাদের ঠিকই খুঁজে নিয়েছেন ‘জহুরী’রা।
কারি অ্যাকসেন্টের ‘ডিরেক্টর অপারেশনস’ পদে কাজ করছেন অভিষেক সিনহা। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বাড়ি হলেও তিনি এখানকার বাসিন্দা অনেক দিন ধরে। ক্রিকেট খেলার সুবাদে বাংলাদেশে আসা অনেক ভারতীয় ক্রিকেটার ও কর্মকর্তার ফোনবুক খুঁজলে সম্ভবত এখনো তার নম্বরটা পাওয়া যাবে। অভিষেক নিজেও একজন ‘খুশখানেওয়ালা’, তাই আলাপ জমতে সময় লাগল না। বললেন, ‘উত্তর ভারতীয় রান্নাটা মূলত তন্দুর আর গ্রেভির খেলা। তামার তন্দুরগুলো আনিয়েছি দিল্লি থেকে। মুরগি, পনির, মাছ— যা-ই এই তন্দুরে ঢোকে, বের হয় লা জওয়াব হয়ে। আর গ্রেভি মূলত ৩ রকমের; আদা-পেঁয়াজ-রসুনবাটার মাসালা গ্রেভি, চারমগজ-কাঠবাদাম-টক দইয়ের হোয়াইট গ্রেভি আর টমেটো-কাশ্মীরি লালমরিচ আর মাখনের বাটার গ্রেভি।’ তন্দুরে সেঁকা মুরগির ছোট ছোট টুকরো যখন বাটার গ্রেভিতে হাবুডুবু খেয়ে এসে হাজির হবে, তখন তার নাম চুজা মাখানি। কসমোপলিটান ভাষায় গোটা বিশ্বে যা পরিচিত বাটার চিকেন নামে।
গুলশান ২-এর ৫১ নম্বর রোডের ৮ নম্বর বাড়িটাই কারি অ্যাকসেন্ট। এই ঠিকানায় ঢুকলেই মনটা ভালো হয়ে যাবার কথা, সবুজের যথেষ্ট ছোঁয়া আছে যে! প্রশস্ত পার্কিং; কাচের দরজা ঠেলে ভেতরে। বসতে না-বসতেই হাজির হয়ে যাবে ‘ফুচকা শটস’। অভ্যাগত সবাইকেই পরিবেশন করা হয় জলজিরা আর তেঁতুল পানির টক দিয়ে ছোট গ্লাসে সাজানো ফুচকা, এটা খেলেই মনটা চনমন করে উঠবে। শুরুতে নিতে পারেন পাপড়ি চাট। টক দই, নানান রকম মসলায় মাখানো। এরপর ‘কৌন বনেগা ক্রোড়পতি’র মতো চারটে বিকল্প। চটজলদি, মুখরোচক, হালকা খাবারের জন্য মেনুতে আছে ‘স্ট্রিট কিচেন’ বিভাগ, যেখান থেকে চেখে দেখা যায় পেশোয়ারি পনির টিক্কা, গলৌটি কাবাব, কিংবা ‘রোটি পে বোটি’র মতো অভিনব পদগুলো। নিজেদের বানানো পনির তন্দুরে নানান মসলা মাখিয়ে সেঁকে ক্যাপসিকাম আর পেঁয়াজ দিয়ে পরিবেশন করা হয় পনির টিক্কা। গলৌটি কাবাব মিহি পেশাই করা কিমা দিয়ে তৈরি, মুখে দিলেই গলে যাবে। যদি জমিয়ে নৈশভোজটা সারতে চান, তাহলে চোখ রাখুন ‘দ্য বিগ প্লেট’ অংশে। আমিষ, নিরামিষ— দুই ধরনের খাবারই মিলবে এখানে। পালাক পনির, ডাল বাটার ফ্রাই, রাজমা মাসালার মতো নিরামিষ পদ যেমন আছে, তেমনি চিকেন টিক্কা মাসালা, চুজা মাখানি, নাল্লি রোগানজোশের মতো মুরগি ও মাটনের পদগুলোও মিলবে। আছে মাছের টিক্কা নাম ‘আওয়াধি মাহি টিক্কা’। এসবের সঙ্গে নানান স্বাদের নান রুটি, রুমালি রুটি, লাচ্ছাদার পরোটা, কুলচা থেকে শুরু করে সাদাভাত কিংবা দম বিরিয়ানি— সবই থাকছে ‘কারি অ্যাকসেন্ট’-এর আয়োজনে।
আমিষের তালিকায় মাছ, মুরগি ও মাটন থাকলেও গরুর মাংসের কোনো পদ নেই। অভিষেক জানালেন, বাংলাদেশে বসবাসরত অনেক ভারতীয়ই এখানে খেতে আসেন, দূতাবাসের অনুষ্ঠানের খাবারও যায় এখান থেকে। তাই কারি অ্যাকসেন্টে গোমাংসের প্রবেশ নিষেধ।
মেনুতে উত্তর ভারতীয় ঘরানার খাবারের পাশাপাশি আছে বাঙালি খাবারও। কলকাতার বিখ্যাত গোলবাড়ীর কষা মাংসের মতোই মাটন কষা আছে মেনুতে। আছে লুচি ছোলার ডাল, ভাপা ইলিশ, ভেটকি পাতুরি, চিংড়ি মালাইকারির মতো বাঙালি হেঁশেলের অনেক পদও। আর চটজলদি লাঞ্চ সারতে চেখে দেখতে পারেন মাটন ডাব্বা! মুম্বাইর অফিসগুলোতে বাড়ি থেকে দুপুরের খাবার পৌঁছে দেন ডাব্বাওয়ালারা, ‘লাঞ্চবক্স’ সিনেমায় যেটা অনেকেই দেখেছেন। ঠিক সে রকমই ‘লাঞ্চ ডাব্বা’, চার রঙা অ্যালুমিনিয়ামের টিফিন ক্যারিয়ারে ভাত, তরকারি, ডাল ও একটা মিষ্টির পদ ৪৯৯ টাকায়, যেটা দুপুরে দারুণ চলছে। এ ছাড়া রমজান মাসজুড়ে ইফতারে ছিল হালিম, জিলাপি ও ক্যালকাটা রোলের বিশেষ আয়োজন; অভিষেকের উক্তি, ‘তখন বিক্রি করে কুলিয়ে উঠতে পারিনি, লাইন ঐ রাস্তা অবধি গিয়েছিল।’ গলা ভেজানোর জন্য লাস্যি তো আছেই, শেষ পাতে মুখ মিঠা করার জন্য গুলাবজামুন চিজকেক আর মালাই কুলফি না খেলে বড্ড ভুল হবে।
১২০ জনের বসার ব্যবস্থা আছে কারি অ্যাকসেন্টে; আর আছে ৩০ জনের প্রাইভেট ডাইনিং। পুরোনো দিল্লির শাহি কাবাব কারিগরের হাতের স্বাদ চেখে দেখতে কারি অ্যাকসেন্টে ঢুঁ মারা যেতেই পারে। অথবা স্রেফ নিরামিষ চাখতে। পনির, ডাল আর মাশরুম দিয়ে যে এত সব মজার মজার পদ হতে পারে, সেটা কারি অ্যাকসেন্টে না গেলে অজানাই থেকে যায়।

লেখক: কালের কণ্ঠের সিনিয়র স্পোর্টস রিপোর্টার ও রসনালিখিয়ে
ছবি: ওমর ফারুক টিটু

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top