skip to Main Content

বিশেষ ফিচার I আহা স্টেক!

চটজলদি ভেজে নেওয়া একফালি মাংস। তাতে সামান্য লবণ আর টাটকা গোলমরিচের গুঁড়া ছড়ানো। মাংসের প্রকৃত স্বাদ নিতে চাইলে চেখে দেখতে হবে স্টেক। লিখেছেন সামীউর রহমান

হুমায়ূন আহমেদ নেই, আছে তাঁর সৃষ্টি। স্টেক নিয়ে লেখার ফরমায়েশ যখন এল, তখন ভাবনার জগতে ডুব মেরে আবিষ্কার করলাম ভিনদেশি এই খাবারের সঙ্গে প্রথম পরিচিতি তো এই কথাকারের হাত ধরেই!
‘হোটেল গ্রেভার ইন’ হুমায়ূনের প্রবাসজীবনের নানান অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ রচনার সংকলন, প্রথম প্রকাশ ১৯৮৯ সালে। সেই বইতে হুমায়ূন লিখেছেন, প্রবাসজীবনে আর্থিক সংকটে তিনি যখন ‘বিফ অ্যান্ড বান’ নামের একটা রেস্তোরাঁয় দিনের পর দিন মেনুর সবচেয়ে সস্তা খাবার ‘ফ্রেঞ্চ টোস্ট’ খাচ্ছিলেন, তখন একদিন ওয়েটার ও ওয়েট্রেসরা মিলে তাকে সারপ্রাইজ ডিনার উপহার দিয়েছিল। খাইয়েছিল ‘টি-বোন স্টেক’। সেই বই পড়বার দিন থেকেই মাথায় ঢুকে গিয়েছিল ‘টি-বোন স্টেক’ চেখে দেখার ইচ্ছে। সময় ও সুযোগ হয়েছে যদিও অনেক পরে। কারণ স্টেকহাউসগুলোতে এক বেলা উদর পূর্তি করতে যে ট্যাঁকের বেশ জোর থাকা চাই!

রোমানো ক্রাটৎজ
এক্সিকিউটিভ শেফ, রেনেসাঁ

ভারতীয় উপমহাদেশে মাংস খাওয়ার যে রীতি, তাতে মাংসের প্রকৃত স্বাদ খুঁজে পাওয়া কঠিন। তেলে, ঝোলে, আদা-রসুন-পেঁয়াজের ঝাঁজ আর গরমমসলার খুশবাইতে মাংসের আসল স্বাদই তো যায় হারিয়ে। মাংসের সত্যিকারের স্বাদ পেতে হলে চেখে দেখতে হবে গরমাগরম স্টেক। ঢাকার পাঁচ তারকা হোটেল রেনেসাঁর (দ্বারোদ্ঘাটনের অপেক্ষায় রয়েছে) এক্সিকিউটিভ শেফ হিসেবে কাজ করছেন রোমানো ক্রাটৎজ। সদালাপী এই জার্মান জীবনের বড় একটা অংশ কাটিয়েছেন থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশের তারকা হোটেলগুলোতে। তাঁর কাছেই শুনলাম ভালো স্টেক রান্নার প্রক্রিয়া।
রোমানোই বললেন, ‘স্টেক বানাবার জন্য আগে বুঝে নিতে হবে কেমন স্টেকটা চাই? কারণ, একেক অংশের মাংস দিয়ে একেক রকম স্টেক তৈরি হয়। টি-বোন, সারলিওন, টেন্ডারলিওন নাকি রিব আই। জেনে নিতে হবে— যে খেতে চাইছে, সে কী রকম স্টেক চাইছে। কোন কোন স্টেক বেশিক্ষণ চিবিয়ে খেতে হয়, কোনটা মুখে দিলেই মিলিয়ে যাবে। সেটা বুঝে মিডিয়াম রেয়ার নাকি ওয়েল ডান— সেভাবে স্টেক তৈরি করতে হবে।’ শুধু তা-ই নয়, মাংসটা কোন জায়গা থেকে এসেছে, সেটাও স্টেকের বেলায় খুব গুরুত্বপূর্ণ। শুধু মেসি বা ম্যারাডোনার জন্যই নয়, উৎকৃষ্ট গরুর মাংস রপ্তানির জন্যও খুবই প্রসিদ্ধ আর্জেন্টিনা। পাম্পাসের আদিগন্তবিস্তৃত তৃণভূমিতে জš§ানো বিশেষ ধরনের ঘাস খেয়েই গরুগুলোর মাংসের ভাঁজে ভাঁজে জমে চর্বি। এই মাংসখ- ভাজাই নোলা থেকে জল ঝরায় স্টেকপ্রেমীদের। ১৯৩০ সালের বিশ্বকাপের শিরোপা নিয়ে যেমন মারামারি আছে দুই প্রতিবেশী আর্জেন্টিনা ও উরুগুয়ের, সেরা গোমাংস নিয়েও লড়াই এ দুই প্রতিবেশীর! উরুগুয়ের লোকজন বলে, আর্জেন্টিনার গরুর মাংস আবার মাংস নাকি! আসলে বড় প্রতিবেশীর সঙ্গে ছোট প্রতিবেশীর একটু তো টকঝাল সম্পর্ক থাকেই। উরুগুয়েতে মানুষ ৩ মিলিয়ন আর গরুর সংখ্যা ১২ মিলিয়ন। সেখানকার গরুগুলো খোঁয়াড় কাকে বলে জানেই না! মুক্ত তৃণভূমিতে চরে বেড়ানো গরুগুলোকে কখনোই খাওয়ানো হয় না কৃত্রিম পশুখাদ্য। তাই তো উরুগুয়ের গরুর মাংসের স্বাদ বেশি! কে জানে, হয়তো এ জন্যই উরুগুয়ের জাতীয় প্রতীকেও আছে গরু। লাতিন আমেরিকাই শুধু নয়, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের বাণিজ্যিক পশুখামারেও পালন করা হয় স্টেকের মাংসের জন্য বিশেষ জাতের গরু। স্কটল্যান্ডের অ্যাঙ্গাস মিট, জাপানের কোবে বিফ, মাতসুকা বিফসহ বিশ্বের নানান জায়গার নানান স্বাদের গরুর মাংসের বৈচিত্র্য থেকে স্টেকের প্রকারভেদ অনুযায়ী বেছে নেওয়া হয় মাংস।
শুধু মাংসই নয়, জ্বালানিও বিশাল একটা ভূমিকা রাখে স্টেককে সুস্বাদু করে তুলতে। খোলা তাওয়ায় রান্না করা হচ্ছে, নাকি কাঠের আগুনের ঢাকা দেওয়া চুল্লিতে, সেটা গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ বিশেষ কাঠের সুঘ্রাণ মিশে যায় মাংসেও। ওক, ম্যাপল, সেডার, মেসকিট নানান কাঠের ধোঁয়া মাংসের সঙ্গে মিশে গিয়ে তাকে করে তোলে আরও সুস্বাদু।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অবশ্য এভাবে স্টেক বানানোটা বেশ ঝক্কিরই। বিকল্প উপায়ও বাতলে দিয়েছেন শেফ রোমানো। ভালো স্টেক বানাবার গোপন রহস্য জানাতে গিয়ে বললেন, ‘আমার কাছে স্টেক মানে স্মৃতি রোমন্থন। যেন সেই গুহামানবের যুগে ফিরে যাওয়া! শিকার করা টাটকা মাংসের ফালি, আগুনে পুড়িয়ে সামান্য লবণ আর গোলমরিচ ছড়িয়ে খেয়ে ফেলা; স্টেকের সৌন্দর্যই হচ্ছে খাবারটির সহজিয়া বৈশিষ্ট্য। টাটকা মাংস নিন। তাতে হালকা একটু তেল হাতে চেপে দুপাশে মাখান। ভালো করে গরম করা প্যানে মাংসের টুকরাটি ছেড়ে দিন। হাতে একটু চেপে ধরে রাখুন, মিনিট তিনেক পর উল্টে দিন এবং অন্য পাশটাও ভাজুন। মিনিট তিনেক পর নামিয়ে নিন এবং কিছুক্ষণ রেখে দিন। কারণ, গরম অবস্থায় কাটলে ভেতর থেকে রস সব গড়িয়ে বের হয়ে যাবে।’ রেস্তোরাঁয় কিংবা ইউরোপিয়ান বাড়িতে রান্নার বেলায় স্টেক প্যান থেকে নামিয়ে তারা অনেক সময়ই ওভেনে ঢুকিয়ে রাখেন, গরম ভাবটা ধরে রাখার জন্য। বাংলাদেশের বাসাবাড়িতে গ্যাস আভেন ব্যবহারের খুব একটা চল নেই, আছে মাইক্রোওয়েভ। সে কথা বলতেই রোমানো মাথা নেড়ে বলে উঠলেন, ‘নো নো। মাইক্রোওয়েভ ভুলেও ব্যবহার করো না।’
রোমানোর কাছ থেকে আরও জানা গেল দুর্দান্ত সব স্টেক বানানোর কিছু সূত্র, ‘ভালো স্টেকের জন্য ম্যারিনেশনটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। টাটকা গোলমরিচের গুঁড়া, লবণ হচ্ছে একদম মৌলিক ম্যারিনেটর। কেউ চাইলে চৈনিক বা প্যান এশিয়ান ফ্লেভার যোগ করতে পারেন। সে জন্য লালমরিচ বাটা আর থাই আদা বাটায় মাংসটা মাখিয়ে রাখতে পারেন। এমনকি ভারতীয় মসলার পরশ যোগ করতে পারেন, যদি চান। তারপর গ্রিলারে সেঁকে নিন বা করতে পারেন প্যান ফ্রায়েড।

একদম ক্ল্যাসিক ইউরোপিয়ান ঘরানায় করতে চাইলে মাংসে স্রেফ নুন আর গোলমরিচ ব্যবহার করুন। চাইলে খানিকটা থাইম আর রোজমেরি। নামানোর পর গরম মাংসের ওপর একটু মাখন ছড়িয়ে দিন।’ একফালি মাংস ভাজা, কোনো একটা সস, সঙ্গে খানিকটা ম্যাশড/বেইকড/ফ্রায়েড পটেটো আর বয়েলড/স্টার ফ্রায়েড ভেজিটেবল— এই হচ্ছে পরিপূর্ণ স্টেক মিল। রোমানোর পরামর্শ, নতুনত্ব কিংবা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান সাইড ডিশগুলোতে, ‘সস হিসেবে বারবিকিউ সস কিংবা হল্যান্ডাইজ সস পরিবেশন করা হয় স্টেকের সঙ্গে। চাইলে গার্লিক মাশরুম সসও বানাতে পারেন। ম্যাশড পটেটোতে হালকা লেমন জেস্ট মিশিয়ে দিন, তাতে সতেজ একটা সুরভি আসবে। চাইলে পারমেজানো চিজ মেশাতে পারেন।’ অনেকেই ম্যাশড পটেটো খেতে চান না, রোমানো নিজেও পছন্দ করেন ফিঙ্গার চিপস, ‘আমার পছন্দ ঘরে বানানো ফ্রেঞ্চ ফ্রাইজ। এর থেকে ভালো আর কিছু হয় না! পটেটো ওয়েজেসও খুব ভালো মানিয়ে যাবে স্টেকের সঙ্গে।’ সবজি হিসেবে রোমানো পরামর্শ দিলেন গাজর আর মটরশুঁটি রাখতে, ‘মাখনে ভাজা গাজর ও মটরশুঁটি খুব ভালো লাগবে স্টেকের সঙ্গে খেতে। কেউ চাইলে ব্রকলি আর মাশরুমও রাখতে পারেন। অনেকেরই পছন্দ পালংশাক। তবে একটা ব্যাপার মাথায় রাখতে হবে, কোনো উপাদানই যেন খুব তীব্র স্বাদের না হয়। তাহলে মাংসটা ম্যাড়ম্যাড়ে লাগবে।’
ভিনদেশি রোমানোকে কোরবানির ঈদের ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলতে একটু সময় লাগলেও বুঝে গিয়ে হো হো করে হেসে মূল্যবান একটা পরামর্শই দিলেন, ‘মাংস কোন জায়গা থেকে কীভাবে কাটা হচ্ছে, স্টেক বানাবার জন্য সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শুধু তা-ই নয়, মাংস সংরক্ষণটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে চর্বি। সবাই আজকাল রেডমিট এবং চর্বি নিয়ে খুব ভয়ে থাকে। কিন্তু চর্বিটা না থাকলে তো মাংসের সৌরভ আসবে না।’ চাহিদামতো জায়গা থেকে মাংস কেটে নেওয়ার সুযোগ তো বছরের অন্য সময়ে খুব বেশি মেলে না। তাই কোরবানির ঈদে মাংস কাটার সময় পছন্দসই স্টেকের মাংস মাপমতো কেটে নিন। ভুনা, কালিয়া, কষা থেকে একটু বেরিয়ে এসে স্বাদ বদল করে স্টেক বানিয়ে খেয়ে দেখুন। মন্দ লাগবে না। রোমানো অবশ্য বলেই দিয়েছেন, ‘প্রথমবারেই যে কেউ দুর্দান্ত স্টেক বানিয়ে ফেলবেন, এমনটা কদাচিৎ হবে। বানাতে বানাতেই বুঝে যাবেন কোন মাংস কতটুকু সময় ভাজতে হবে। আমার শেফ জীবনের একটা লম্বা সময় আমি গ্রিল স্টেশনে কাটিয়েছি, যেখানে ১০টা চুলায় কোনটা রেয়ার হবে, কোনটা মিডিয়াম রেয়ার হবে— এসব ইগলের চোখে নজর রাখতে হতো।’ তাই খেতে খারাপ হলে হতাশ হবেন না, আগামী বছর আরেকটা ঈদ তো আসবেই!

লেখক: কালের কণ্ঠের সিনিয়র স্পোর্টস রিপোর্টার এবং রসনালিখিয়ে
ছবি: সংগ্রহ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top