skip to Main Content

এডিটরস কলাম I চাই মহত্ত্বের অনুশীলন

বিশ শতকে সংঘটিত দুটি মহাযুদ্ধের ব্যয় মেটাতে গিয়ে রাষ্ট্রগুলো দেউলিয়া হয়ে পড়লে সেই চাপ ব্যক্তি-পরিবার-সমাজে অনিশ্চয়তার জন্ম দেয়। ফলে, সম্পর্কের দায় মেনে চলার চেয়ে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাটাই প্রধান একটি টেনশনে পরিণত হয়

উন্নত বিশ্বে দাম্পত্য জীবনে সুখ-শান্তি বজায় রাখার নিমিত্তে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে। তাদের জন্য, যারা বিয়ে করতে চান; কিংবা সংসার শুরু করতে গিয়ে যাদের মনে দেখা দেয় সম্পর্কজনিত নানা উদ্বেগ। ইউরোপের কয়েকটি দেশে ওই প্রশিক্ষণের সনদ দেখাতে হয় বিবাহ-ইচ্ছুকদের। নইলে সঙ্গীকে আইনগতভাবে সব সময়ের জন্য কাছে পাওয়া কঠিন, হয়তো অসম্ভব হয়ে পড়ে। এই ব্যবস্থার কারণ নির্ণয় করতে গেলে উন্নত দুনিয়ার রাজনৈতিক ও সামাজিক ইতিহাসের দিকে তাকাতে হয়। বিশ শতকে সংঘটিত দুটি মহাযুদ্ধের ব্যয় মেটাতে গিয়ে রাষ্ট্রগুলো দেউলিয়া হয়ে পড়লে সেই চাপ ব্যক্তি-পরিবার-সমাজে অনিশ্চয়তার জন্ম দেয়। ফলে, সম্পর্কের দায় মেনে চলার চেয়ে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাটাই প্রধান একটি টেনশনে পরিণত হয়। বিশ শতকের দ্বিতীয় দশক থেকে পরিবার ভেঙে যেতে শুরু করেছিল ইউরোপজুড়ে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধকল কাটিয়ে ওঠার পর, দেশগুলো পারিবারিক ও সামাজিক পুনর্গঠনে মনোযোগী হয়ে ওঠে। বিয়েতে উৎসাহ দেওয়া হয়, দাম্পত্য টিকিয়ে রাখা ও সন্তান জন্মদানে অনুপ্রাণিত করা হয়। এর অনুকূলে অর্থনৈতিক নিরাপত্তার ব্যবস্থাও নেওয়া হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানি ও পার্শ¦বর্তী দেশগুলো এই কাজে বেশি মনোযোগ দেয়। কেননা, এসব রাষ্ট্র প্রায় পুরুষশূন্য হয়ে গিয়েছিল এবং জীবিতদের বেশির ভাগই ছিল পঙ্গু। কেবল নারী-পুরুষের সাংখ্যিক সমতা নয়, সমাজকে গঠনমূলক ভারসাম্যাবস্থায় উত্তরণের জন্য এর প্রয়োজন ছিল।
বোঝা যাচ্ছে, পরিবার ও সমাজ গঠনে বিয়ের গুরুত্ব চিরন্তন। এমনকি রাষ্ট্রের মূল উপাদানের একটি যে জনগণ, তার বিকাশ ও ভারসাম্যাবস্থায় এই আইনগত ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। কিন্তু দুই নরনারীর যৌথ যাপনের বন্দোবস্ত নিশ্চিত হয়ে যাওয়ার পর যেসব দায়িত্ব উভয়ের ওপর বর্তায়, সেগুলো যথাযথভাবে অনুসরণ ও পালন করতে না পারলে জীবন হয়ে যায় কঠিন ও কষ্টকর এবং এর প্রভাব সমাজের ওপর পড়ে। এই আশঙ্কা থেকে উন্নত দেশগুলোয় দাম্পত্য শান্তিপূর্ণ করার জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কেননা, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মনোমালিন্য ও অস্থিরতা সন্তানের জীবনকেও বিপন্ন করে তুলতে পারে; পরিপূর্ণ ও সক্ষম মানুষ হিসেবে তাদের বিকাশ তখন আরও কঠিন বা অসম্ভব হয়ে পড়ে।
বেশ টাকাপয়সা খরচ করে তিন-চার দিনের জমজমাট একটা উৎসবের মধ্য দিয়ে দুই নরনারী পরিণত হয় স্বামী-স্ত্রীতে। বাসর উদযাপনের পর থেকেই তারা আরও ক্যাজুয়াল হতে থাকেন একে অন্যের কাছে। পারস্পরিক দায়িত্বও বেড়ে চলে। এ সময়টায় সবকিছু নিজেদের সামলানোই ভালো, সে জন্য দরকার উভয়ের বোঝাপড়া। এটা দ্বিপক্ষীয় বিষয়, তাই একে অন্যের ওপর আধিপত্য বিস্তারের মানসিকতা পরিহার না করলে চলে না। ‘লাইফ ইজ অ্যাডজাস্টমেন্ট অ্যান্ড কম্প্রোমাইজ‘- শেকসপিয়ারের এই বিখ্যাত বচনের বাস্তব অনুশীলনই দাম্পত্য সুখ ও শান্তির চাবিকাঠি। কিন্তু বিয়ে করেই কেউ তা শুরু করে দেবেন বা সঙ্গীকে শেখাবেন, ব্যাপারটা পুরোপুরি এমন নয়। খাপ খাওয়ানো ও ছাড় দেওয়ার মানসিকতা আগে থেকেই গড়ে তুলতে হয়। পারিবারিক সংস্কৃতি থেকেই তা সম্ভব। বলতে চাইছি, পরিবারই যৌথ যাপনে মানসিক ও আচরণগত সক্ষমতা অর্জনের উপযুক্ত প্রশিক্ষণস্থল।
মনে রাখা দরকার, একসঙ্গে অবস্থান করলেও স্বামী-স্ত্রী ব্যক্তি হিসেবে আলাদা। কেবল এ জন্য নয় যে, উভয়েই পৃথক পরিমন্ডল থেকে এসেছেন। কারণ এটাও- প্রত্যেকের রয়েছে নিজস্ব অতীত, রুচি, শিক্ষা, যোগ্যতা, আকাঙ্ক্ষা, মূল্যবোধ ইত্যাদি। কিন্তু কে কার চেয়ে শ্রেষ্ঠ, এই বিবেচনায় আগ্রহ মানুষ হিসেবে দৈন্যকেই প্রমাণ করে। ব্যক্তিমাত্রই যার যার জায়গায় অনন্য। কেননা প্রত্যেকেই যাপন করে নিজের জীবন। দাম্পত্য, পারিবারিক, সামাজিক ও পেশাগত জীবনে যে শেয়ারিং রয়েছে বা থাকে, তার বাইরে প্রত্যেকেরই নিজস্ব একটা স্পেস দরকার। এটাই বাস্তবতা। এর গুরুত্ব ও সম্মান পারস্পরিকভাবে স্বীকার করতে হয়। দাম্ভিক, দুর্বিনীত ও আত্মসর্বস্ব মানুষের শান্তি কোথাও নেই, বৈবাহিক জীবনে তো প্রশ্নই ওঠে না।
এটা ঠিক, মমতা, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, দায়িত্ববোধ- এই মানবিক গুণগুলো প্রশিক্ষণ দিয়ে হয় না। পারিবারিক পরিমন্ডল, সামাজিক পরিবেশ, সাংস্কৃতিক বাতাবরণ ইত্যাদি মিলে যে বৃহত্তর মানবসমাজ গড়ে ওঠে, সেখান থেকেই তৈরি হয় মানুষ হিসেবে ব্যক্তির বিকাশে পূর্ণতার পরিসর। কিন্তু যে মানুষটির মধ্যে ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, শুভ-অশুভ বিচারের সামর্থ্য ও চর্চা আছে, সে তো একাই যথেষ্ট; অন্তত যৌথ যাপনের শুরু থেকে!

ছবি: কে নাসিফ ফটোগ্রাফি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top