skip to Main Content

বিশেষ ফিচার I খাদ্যসংস্কৃতিতে নারী

কৃষি আবিষ্কারের কৃতিত্ব নারীকেই দেওয়া হয়। সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকেই খাদ্য উৎপাদনে এগিয়ে তারা। বেশ আগেই কৃষিকাজে পুরুষের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হলেও খাদ্যসংস্কৃতিতে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের নারীরা আজও সম্পৃক্ত। লিখেছেন শিবলী আহমেদ

সভ্যতায় পৌঁছাতে নারীর অবদান পুরুষের চেয়ে কম নয়, বরং বেশিই। সভ্যতার বনিয়াদ কৃষি; এ কথায় দ্বিমত কম। চাষবাসই মানুষকে খাদ্যের জোগান ও নিরাপত্তা দিয়েছে। কৃষির আবিষ্কারক যে নারীই ছিল, এই সিদ্ধান্তে ইতিহাসবেত্তাদের বিপুল-অধিকাংশই একমত। যদিও খুব শক্ত প্রমাণ মেলে না। তবে পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত টিকে থাকা ও পিছিয়ে পড়া নৃগোষ্ঠীগুলোর ‘উপকথা’ থেকে প্রাপ্ত তথ্যাদিতে এ কাজে নারীর কৃতিত্বের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। এ ক্ষেত্রে আমেরিকান ‘চেরোকি’ আদিবাসীরা উদাহরণ হতে পারে। তাদের উপকথা অনুসারে, বনের মধ্যে একটি মেয়েই প্রথম শস্য আবিষ্কার করেছিল। মৃত্যুকালে সে নির্দেশ দিয়ে যায়, তার মরদেহ যাতে মৃত্তিকার ওপর দিয়ে টেনে নেওয়া হয়। শরীরটি যে মাটির ওপর দিয়ে টেনে নেওয়া হলো, সেখানেই গজিয়ে উঠল প্রভূত শস্যাদি। দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের লেখা ‘মাতৃতান্ত্রিক সমাজ: সে যুগে মায়েরা বড়’ বইতে খাদ্য উৎপাদনে নারীর অসামান্য ভূমিকা সম্পর্কে বিস্তর জানা যায়। ইসরায়েলি ইতিহাসবিদ ইউভাল নোয়া হারারি বিষয়টিকে আরও বিশদভাবে উপস্থাপন করেছেন তার ‘সেপিয়েন্স’ বইতে।
কৃষি আবিষ্কারের ইতিহাস ১২ হাজার বছরের পুরোনো। তার আগে কিছুকাল মানুষ আধবুনো ছিল। নারী-পুরুষ দল বেঁধেই শিকার করত। কিন্তু বল্লম আবিষ্কারের পর মেয়েরা ঘরকুনো হতে বাধ্য হলো। তাদের আরেকটি বাধা ছিল সন্তান উৎপাদন ও লালনপালন। এক হাতে বল্লম, আরেক হাতে শিশু নিয়ে শিকারের পেছনে ধাওয়া করা কঠিন ছিল। ফলে একসময় নারীরা হলো গৃহী। কৃষির সঙ্গে স্থায়ী আবাসনের সম্পর্ক আছে। নির্দিষ্ট জমিতে ফসল ফলানো ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ভূমির পাশেই ঘর বাঁধা জরুরি ছিল। সেসব কক্ষেই নারীরা থাকত। সন্তান পালনের পাশাপাশি জঙ্গলের কলাটা-মুলাটা সংগ্রহ করাই ছিল তাদের নিত্যকার কাজ। পাকা ফল আনা-নেওয়া, খোসা ও দানা ছাড়ানো, খাওয়া—এসব করতে করতেই নারীর নজরে এলো যে, ফলের বীজ মাটিতে পড়লে সেখানে গাছ জন্মায়। এরপর থেকেই মেয়েরা শুরু করল বীজশাসন। আবিষ্কৃত হলো কৃষি। যাযাবর জীবনের অবসান ঘটল। বার্ষিক খাদ্যের জোগান পাওয়া গেল। উদ্বৃত্ত খাবার মজুত হলো; বাড়ল খাদ্য নিশ্চয়তা। সঞ্চিত খাদ্য মানুষকে অবসর এনে দিল। ফুরসত কাজে লাগিয়ে মানুষ শিল্প-সংস্কৃতিতে মনোনিবেশ করে গড়ে তুলল সভ্যতা।
কিন্তু এরই মধ্যে কৃষিকাজের দায়িত্ব চাপল পুরুষের ওপর। এটি ঘটল লাঙল আবিষ্কার এবং পশু দিয়ে চাষের কাজ শুরু হওয়ার পর। লাঙল পরিচালনা ও পশুশাসনে প্রয়োজনীয় পেশিশক্তি ছিল পুরুষের। তারাও দেখল যে শিকার সংগ্রহের চেয়ে কৃষিকাজই বেশি নিরাপদ। বিশেষ করে খাদ্য মজুতে। তাই বন্য পশুর পেছনে দৌড়ে পরজীবীর মতো জীবন না কাটিয়ে কৃষিকে গ্রহণ করে স্বনির্ভর জীবনব্যবস্থাই পুরুষকে আকৃষ্ট করছিল। চাষের কাজ গেল পুরুষের দখলে। কিন্তু খাদ্য নিশ্চয়তা আনতে নারীর অবদানকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া যায়নি। বর্তমানে গ্রামেগঞ্জে চাষের ক্ষেতে দেখা যায় মেয়েদের। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে এখনো তারা খাদ্য নিশ্চয়তা বাড়াতে কাজ করে যাচ্ছেন। সেসব কীর্তিমান নারীর হদিস হয়তো এই ক্ষুদ্র বয়ানে তুলে ধরা সম্ভব হবে না। তবে কয়েকজনের কথা তো উল্লেখ করাই যায়।
বিশ্বব্যাংকের মতে, বর্তমানে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে কৃষি খাতে অর্ধেক অবদান নারীর। তা ছাড়া, উন্নত দেশগুলোতে খাদ্যনিরাপত্তায় কাজ করে যাচ্ছে মেয়েরা। ইতালীয় সংস্থা সিডসঅ্যান্ডচিপস-এর চিফ কন্টেন্ট অফিসার শ্যারন সিটোন। বিশ্বজুড়ে খাদ্য খাতে কাজ করে—এমন সব ব্যক্তিকে এক সারিতে আনতে চেষ্টা করছেন তিনি। বর্তমান ও আগামীর খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অবদান রেখে চলেছেন। যুক্তরাজ্যের প্রান্তিক কৃষকদের উন্নয়নে কাজ করছেন জ্যোতি ফার্নান্দেজ। চাষবাসে ভর্তুকি কমিয়ে প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করাই তার উদ্দেশ্য। পেরুর ‘পোর এসো’ সংস্থার মাধ্যমে দেশজুড়ে সবজির বাগান বৃদ্ধির কাজ করে চলেছেন জোনালদা বুয়েটস ও সিমোন হেমস্কার্ক। পাশাপাশি শিশুদের পুষ্টিকর খাবারের নিশ্চয়তা বৃদ্ধিতেও চেষ্টা করছেন। কেনিয়ার কৃষি উন্নয়নে সেবা দিচ্ছেন জামিলা আবাশ। মোবাইল প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে কৃষকদের পারস্পরিক সম্পর্কের উন্নতি করার পাশাপাশি ফসলের রোগবালাই সম্পর্কিত তথ্য এবং বাজারদর সম্পর্কে ওয়াকিবহাল করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন এ নারী।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রানসিসকোর জনস্বাস্থ্য বিভাগের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ড. রিতা এনগুইন। ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপে ভুগছে, এমন নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য বিনা মূল্যে স্বাস্থ্যকর খাবার সরবরাহ করার মাধ্যমে খাদ্যনিরাপত্তায় বিশেষ ভূমিকা রেখে চলেছেন তিনি। সে দেশে একই কাজ কিছুটা ভিন্নভাবে করছেন ‘ফ্রেশ গ্লো’ কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা কবিতা শুক্লা। ভেষজ খাবার ও মসলাদি নিয়ে তার কর্মপরিধি। তা ছাড়া, সবজি ও ফল দীর্ঘ সময় ভালো রাখার প্রযুক্তিতে উন্নতি সাধন করেছেন তিনি। খাদ্যনিরাপত্তার সঙ্গে সম্পৃক্ত যুক্তরাষ্ট্রের আরেকজন নারী জুলি কার্নি। ‘গার্ডেন ফর লাইফ’-এর প্রতিষ্ঠাতা। নারী কৃষকদের সর্বাত্মকভাবে সহায়তা করার পাশাপাশি তাদের সুস্থতা ও পুষ্টির দিকে খেয়াল রেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করাই জুলির কাজ। আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ কৃষকদের আইনি সেবা প্রদানে কাজ করেন জিলিয়ান হিশো। কালোদের জমির মালিকানা নিশ্চিত করে তার প্রতিষ্ঠান। পাশাপাশি চাষিদের উৎপাদিত উদ্বৃত্তের বাজার তৈরিতেও হিশোর ভূমিকা রয়েছে। আমেরিকান রিয়েল ফুডের প্রতিষ্ঠাতা পেই-রু কো। রোগ প্রতিরোধে খাবারকে কীভাবে সর্বোচ্চভাবে কাজে লাগানো যায়, সেটাই তার লক্ষ্য। এ ছাড়া আগামীর খাদ্যসংস্কৃতি তৈরিও পেই-রু কোর পরিকল্পনার অংশ।
ভারতের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ ও কৃষিসহায়ক কিছু প্রতিষ্ঠানের উচ্চ পদে আছেন বেশ কজন নারী। যেমন ‘খ্যাতি’ নামের সংগঠনের সহ-প্রতিষ্ঠাতা সৌম্য। প্রান্তিক কৃষকদের দারিদ্র্যের দুষ্ট চক্র থেকে বের করে আনাই তার উদ্দেশ্য। সাশ্রয়ী মূল্যে গ্রিনহাউস সুবিধা, কৃষিঋণ ও কৃষিবিষয়ক শিক্ষা সম্প্রসারণে অক্লান্ত কাজ করে যাচ্ছেন। ইতিমধ্যে অল্প পানি ব্যবহারে অধিক ফসল ফলাতে সফলতা পেয়েছেন এই কীর্তিমতী। তারই মতো আরেকজন সকিনা রাজকোটওয়ালা। মুম্বাইভিত্তিক প্রতিষ্ঠান হার্বিভোর ফার্মসের সহ-প্রতিষ্ঠাতা। ভারতের হাইপার-লোকাল, হাইড্রোফনিক ও উল্লম্ব কৃষিকাজের কেন্দ্র ধরা হয় তার প্রতিষ্ঠানকে। পানির ব্যবহার ৮০ শতাংশ কমিয়ে অর্গানিক সবজি উৎপাদনে কাজ করছেন সকিনা। এর পাশাপাশি ইনডোর ফার্মিং কনসেপ্টকে ভারতে জনপ্রিয় করেছে হার্বিভোর ফার্মস। সবজির হোম ডেলিভারি সার্ভিসও চালু করেছেন রাজকোটওয়ালা। কৃষিক্ষেত্রে গীতাঞ্জলী রাজমণির কাজও উল্লেখ করা যেতে পারে। ভারতীয় প্রতিষ্ঠান ফার্মিজেনের প্রতিষ্ঠাতা তিনি। ভূমিহীন চাষিদের ছোট ছোট জমি লিজ নেওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। এতে একদিকে যেমন ফলন বাড়ছে, তেমনি ভাগ্য বদলাচ্ছে প্রান্তিক কৃষকদের। আরেকজন কীর্তিমতী হচ্ছেন আতরাম পদ্মা বাই। ভারতের প্রান্তিক চাষিদের মধ্যে তিনি কৃষিসহায়ক যন্ত্রপাতি সরবরাহ করেন।
পরিশেষে বলা যায়, প্রত্যক্ষ কৃষি থেকে ছিটকে পড়লেও খাদ্যনিরাপত্তা থেকে পুরোপুরি সরে যাননি নারীরা। বিশ্বের নানা প্রান্তে আরও কত কত নারী যে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষি ও খাদ্যকর্মের সঙ্গে যুক্ত, সে হিসাব অজানা।

ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top