skip to Main Content

ফিচার I বৃষ্টি-খরার লোকবিশ্বাস

প্রকৃতিকে নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী চালিত করার বাসনা মানুষের চিরন্তন। সেটি চরিতার্থ করতে গিয়ে তারা আশ্রয় নিয়েছে জাদুমন্ত্র, বিভিন্ন আচার ও কর্মকান্ডের। লিখেছেন মনোজ দেব

প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ প্রকৃতির ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে। ভৌগোলিক কারণে পৃথিবীর অনেক অঞ্চলে পানি সহজলভ্য ছিল না। কিন্তু সেটি জীবন রক্ষায় অপরিহার্য। আবার অনেক স্থানে পানির জন্য বৃষ্টির ওপর নির্ভর করতে হয়। বৃষ্টি ছাড়া গছপালা শুকিয়ে যায়, পশুপাখি পিপাসায় মরে। এ জন্য প্রাচীন সমাজে বৃষ্টি খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। দেখা গেছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগে কোনো বছর অতিবৃষ্টি হলো তো পরের বছর খরা। অথবা কোনো মৌসুমে হয়তো ঝড়ে উড়ে গেল ঘরবাড়ি, গাছপালা, ফসল, গবাদিপশু। এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বা আকাশ থেকে বারিবর্ষণ অথবা প্রবল ঝড়বৃষ্টি থেকে রক্ষা পাবার জন্য প্রাগৈতিহাসিক মানুষেরা আশ্রয় নিয়েছিল জাদুবিদ্যার। এই পেশার লোকদের বলা হতো ওঝা, সে-সমাজে তাদের খুব সম্মান ছিল।
মধ্য-অস্ট্রেলিয়া, পূর্ব ও দক্ষিণ আফ্রিকা, রাশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, ভারতসহ পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে মাসের পর মাস হয়তো দেখা যায় মেঘশূন্য নীল আকাশ। প্রচ- খরায় মাটি ফেটে চৌচির। আবার ইউরোপের ভেজা আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণেও মানুষ মেনে আসছে কিছু রীতিনীতি। যেমন কোথাও বৃষ্টি নামাতে মাটিতে পানি ছিটানো বা মেঘের মতো ডাকা, অথবা বারিবর্ষণ থামিয়ে রোদ আনতে আগুনের আশ্রয় নেওয়ার রীতি মানা হয়। রাশিয়ার ডোরপাটের কাছে এক গ্রামে খরা শুরু হলে তিনজন কুঞ্জ আশ্রমের ফার গাছে উঠত। এদের একজন কেতলি বা ছোট বাসন নিয়ে তাতে হাতুড়ি পেটাত, যেন সে বজ্রের অনুকরণ করছে। দ্বিতীয়জন দুটো অলাতচক্র এত জোরে নাড়ত যে আগুনের ফুলকি ছিটকে পড়ত। এভাবে সে বিদ্যুৎ সৃষ্টি করত। তৃতীয়জন ‘বারিকর’। সে একগোছা ডাল কলসির পানিতে চুবিয়ে চারদিকে পানি ছিটাত। প্লোস্কা গ্রামের নারী ও কিশোরীরা খরার অবসান ঘটিয়ে বৃষ্টি নামাতে রাতে উলঙ্গ হয়ে গ্রামের শেষসীমায় গিয়ে পানি ঢেলে মাটি ভেজাত। হালমাহেরায় বা নিউগিনির পশ্চিমে বিরাট দ্বীপ গিলোলোয় বিশেষ একধরনের গাছের ডাল পানিতে চুবিয়ে চারপাশে বারিবিন্দু ছিটানোর রীতি। নিউ ব্রিটেনে বারিকর কলাপাতায় লাল-সবুজ ডোরাকাটা লতাপাতা মোড়ায়, অতঃপর তা জলে ভিজিয়ে মাটিতে পুঁতে রাখে। এরপর সে মুখ দিয়ে বৃষ্টির শব্দ করতে থাকে।
উত্তর আমেরিকার ওমাহা ইন্ডিয়ানদের ভেতর প্রচলিত রয়েছে ভিন্ন এক প্রথা। বৃষ্টির অভাবে শস্য পুড়ে গেলে সেখানকার পবিত্র বাফেলো সোসাইটির সদস্যরা বড় একটি জালিতে পানি ভরে তার চারপাশ ঘিরে চারবার নাচে। একজন জালি থেকে মুখ দিয়ে কিছু পানি টেনে নিয়ে শূন্যে ফুঁ দিয়ে ফোয়ারার মতো ছাড়ে। এভাবে সে বৃষ্টির ছিটে ও ঝিরঝিরে বারিবিন্দু সৃষ্টির ভান করে। তারপর জালিটা উল্টিয়ে ফেলা হয়, যাতে চারপাশের মাটি পানিতে ভিজে যায়। গড়ানো পানির ওপর তখন নর্তকেরা হুমড়ি খেয়ে পড়ে এবং ওই পানি পান করতে থাকে। এতে তাদের নাকমুখ জলকাদায় মাখামাখি হলে তারা মুখের পানি ফুৎকারে হাওয়ায় ছাড়ে, তাতে রেণুর মতো শিশিরের সৃষ্টি হয়। এতে মাঠের পোড়া শস্য রক্ষা পায় বলে তাদের বিশ্বাস। এই অঞ্চলের ন্যাচেজ জনগোষ্ঠীর বাজিকরেরা বৃষ্টির প্রয়োজনে উপবাস করত এবং মুখে ছোট ছোট ছিদ্রযুক্ত পাইপ ও মুখভর্তি পানি নিয়ে নাচত। তারপর সে আকাশের দিকে তাক করে ফুঁ দিত, যেদিকে ঘন মেঘ জমবে বলে তাদের বিশ্বাস। অন্যদিকে শুষ্ক আবহাওয়া কাম্য হলে বারিকর ঘরের চালে উঠে হাত উঁচিয়ে সব শক্তি দিয়ে মেঘ তাড়াত।
আরব ঐতিহাসিক মাকরিজি সে-অঞ্চলে বৃষ্টি থামানোর উপায় সম্পর্কে লিখেছেন। সেখানকার হদরামাউটের যাযাবর জাতি আলকামারদের মধ্যে চালু ছিল, তারা মরুভূমির বিশেষ এক গাছের ডাল কেটে তাতে আগুন ধরায়। এরপর সেই জ¦লন্ত শাখায় পানি ছিটাতে থাকে। এতে ঝড়বৃষ্টির প্রচ- বেগ কমে আসে। পূর্ব-আঙ্গামিদের মধ্যে এ ধরনের রীতির প্রচলন আছে। সেখানে অবশ্য বৃষ্টি নামানোর জন্য কারও কবরে গ্রামের মোড়ল জ¦লন্ত একটি ডাল পুঁতে দেয়। তারপর তাতে পানি ঢেলে আগুন নেভায় ও বৃষ্টির কামনায় প্রার্থনা করে এই বিশ্বাস থেকে যে, মৃত ব্যক্তি, যে অগ্নিদগ্ধ হয়ে পৃথিবী ত্যাগ করেছে সে চাইবে যেন বৃষ্টি নামে এবং তার ঝলসে যাওয়া হাড়ের জ্বালা জুড়ায়।
নিউ ব্রিটেনের শুল্কা গোত্রের লোকেরাও প্রবল ঝড়বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষার জন্য আগুন ব্যবহার করে। তারা আগুনে পাথরের টুকরো ফেলে একেবারে টকটকে লাল করে নেয়। তারপর সেগুলো বাইরে বৃষ্টিতে রাখে কিংবা বাতাসে গরম ছাই ছিটিয়ে দেয়। ধারণা করা হয়, এতে দ্রুত বৃষ্টি থেমে যাবে। তেলেগু জনগোষ্ঠী প্রবল ঝড়বৃষ্টি নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে সে সময় ছোট একটি মেয়েকে উলঙ্গ করে তার হাতে গনগনে জ¦লন্ত খড়ি ধরিয়ে বাইরে পাঠায়। সে ওই কাঠ বৃষ্টিতে নাড়তে থাকে।
দারুণ খরার সময় মধ্য-অস্ট্রেলিয়ার ডিয়েরি গোত্রের লোকেরা তাদের দুর্দশা ও আধা-উপোসের কথা বলে বিলাপ করে এবং পূর্বপুরুষের আত্মা মুরামুরাকে ডাকতে থাকে, যেন তারা মৃত্যুলোক থেকে বৃষ্টি নামাবার শক্তি দেয়।
কুনো ব্যাঙ, হোলা ব্যাঙের সঙ্গে পানির গভীর সম্পর্ক রয়েছে। ফলে এমন ধারণা প্রচলিত আছে- এই জীবগুলো জলরক্ষক। এ জন্য আকাশ থেকে বৃষ্টি নামানোর প্রয়োজন হলে আফ্রিকার ওরিনোকোর কোনো কোনো ইন্ডিয়ান কুনো ব্যাঙকে মনে করে জলের দেবতা। এ কারণে প্রাণীটিকে তারা হত্যা করতে ভয় পায়। জানা যায়, খরার সময় এই গোষ্ঠীর লোকেরা কয়েকটি ব্যাঙ হাঁড়ির নিচে রেখে লাঠিপেটা করে। আবার আইমরার ইন্ডিয়ানরা প্রায়ই ব্যাঙ অথবা অন্য জলচর প্রাণীর ছোট ছোট প্রতিকৃতি বানিয়ে পাহাড়ের চূড়ায় রেখে আসে। তাদের বিশ^াস এতে বৃষ্টি নামবে।
বাংলাদেশ এবং ভারতের কোথাও কোথাও বৃষ্টির প্রত্যাশায় ব্যাঙের বিয়ে দেওয়ার রীতি রয়েছে। এ ছাড়া এই অঞ্চলে খরার সময় বৃষ্টির জন্য কিশোর-কিশোরীরা মাটিতে গর্ত খুঁড়ে পানি দিয়ে সেখানে পা ডুবিয়ে জল ছিটায়। ছড়া বলে। ভারতের মধ্যপ্রদেশে একবার অনাবৃষ্টির কারণে স্থানীয়রা মাটির ব্যাঙের বিয়ে দেয়। দুদিন পর বৃষ্টি শুরু হলে দেখা গেল, তা আর থামার লক্ষণ নেই। একটানা বৃষ্টিতে বন্যার প্রকোপ হলে তারা ব্যাঙের বিবাহবিচ্ছেদ ঘটায়।
প্রকৃতির নিয়মের সঙ্গে এসব জাদু বা লোকবিশ্বাসের তেমন কোনো সম্পর্ক নেই। অন্তত আধুনিক বিজ্ঞান তা স্বীকার করে না। তবু এসব ধারণা ও সংস্কার কালপরম্পরায় সমাজে টিকে আছে। কোনো কোনোটি হয়তো সময়, বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিষ্কার, প্রযুক্তির দ্রুত বিকাশের কারণে অনুসৃত হয় না, কিন্তু এসব মিথ, লোকবিশ্বাস ও সংস্কারের মধ্য দিয়ে সমাজ এবং সভ্যতার অগ্রগমনের ধারা চিহ্নিত করা যায়।
ছবি: সংগ্রহ
বিশ্বাস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top