skip to Main Content

ফিচার I বিফ ট্যালো

গো-মাংস থেকে আলাদা করা চর্বি। বিশেষ প্রক্রিয়ায় তেলে রূপান্তরিত হয়। স্বাস্থ্য রক্ষার পাশাপাশি রূপচর্চায় কাজে লাগে। লিখেছেন মোহাম্মদ বোরহান উদ্দীন

প্রাণিদেহ থেকে প্রাপ্ত স্নেহ পদার্থজাতীয় উপাদান হলো চর্বি। এর তেল কক্ষ-তাপমাত্রায় তরল অবস্থায় থাকে; তার বিপরীতে সেটি কঠিন অবস্থায় থাকে। রাসায়নিকভাবে তেল ও চর্বি উভয়েই ট্রাইগ্লিসারাইড নামক পদার্থ দিয়ে গঠিত। সাধারণত হাঁস-মুরগি, গরু-বাছুর, (পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে) শূকর ইত্যাদির দেহ থেকে চর্বিকলা সংগ্রহ করা হয়। গরুর মাংস থেকে সংগৃহীত চর্বির তেলকে বলা হয় বিফ ট্যালো।
গরুর মাংসের কিডনির আশপাশের চর্বিকে খুবই অল্প আঁচে আস্তে আস্তে রান্নার মাধ্যমে তরল করতে হয়, তার পর এটা একেবারে মাখন বা নারকেল তেলের মতো স্থিতিশীল হয়ে ওঠে। সাধারণত এভাবেই বিফ ট্যালো তৈরি করা হয়, যা সংরক্ষণ করে পরবর্তীকালে রান্নার কাজে ব্যবহৃত হতে পারে। বিশ শতকের শুরুতে রান্নায় সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়েছে বিফ ট্যালো বা গরুর চর্বির তেল। পরবর্তীকালে ক্রিসকো এবং অন্যান্য বীজ তেলের কারণে এটির প্রচলন কমে যায়।
একসময় প্রতিটি রান্নাঘরে, চুলার পাশে গরুর চর্বির তেলের দেখা মিলত। জলপাই তেল, ক্যানোলা তেল, এমনকি নারকেল তেল প্রচলিত হওয়ার অনেক আগে থেকেই এটি রান্নায় প্রথম পছন্দ ছিল। নানা কারণে এর চল কমে যেতে শুরু করলেও এখন বৈজ্ঞানিকভাবে আবারও বিফ ট্যালো বা গরুর চর্বির ব্যবহারকে সমর্থন করা হচ্ছে, ফলে এর প্রচলনও ফিরে আসছে।
ঝলমলে ত্বক বা রোগ প্রতিরোধের বিষয়ে ভাবলে তখন বিফ ট্যালোর কথা অবশ্যই মনে পড়বে। অগণিত কাজে ব্যবহারের জন্য ট্যালো অনেকে স্টোর রুমে সংরক্ষণ করতে চাইবে। তবে সত্তর দশকে প্রথম আবিষ্কৃত হয় প্রাণীর চর্বির কারণে হৃদ্রোগ ঘটে, ফলে বিফ ট্যালোর বদলে সব জায়গায় পলিআনস্যাচুরেটেড বীজ তেলের প্রচলন হয়। তবে প্রাণীর চর্বি কেবল ক্ষতিকরই নয়, বরং এটা অনেক ক্ষেত্রেই স্বাস্থ্যের জন্য উপকারীও হতে পারে।
হৃদ্রোগের আসল কারণ ছিল বিষাক্ত বীজ তেল, যা গরুর মাংসের চর্বির জায়গায় প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল। বীজ তেল দিয়ে রান্নার বদলে গরুর মাংসের চর্বি ব্যবহার কম ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। তাই ক্যানোলা তেল আবর্জনায় ফেলে দিয়ে এখনই বিফ ট্যালো সংগ্রহ করা যেতে পারে। এতে কোনো কার্বোহাইড্রেট বা প্রোটিন নেই। তবে এই চর্বিতে প্রচুর ভিটামিন সঞ্চিত রয়েছে।
আগে রান্নার জন্য ট্যালো ছিল সবচেয়ে প্রচলিত চর্বি। স্থায়িত্ব, স্বাদ এবং প্রাপ্যতার জন্য এটি জনপ্রিয় হয়েছিল। এটা ভাজার কাজ থেকে শুরু করে স্যুপ এবং স্টুতেও বাড়তি স্বাদ যোগ করত। রন্ধনবিদদের কাছে ট্যালো অন্যান্য তেলের চেয়ে বেশি কাক্সিক্ষত ছিল।
উচ্চ স্যাচুরেটেড ফ্যাটযুক্ত সামগ্রীর কারণে ট্যালো খুব স্থিতিশীল। সাবান, ময়শ্চারাইজার এবং মোমবাতি তৈরিতেও এটি ব্যবহৃত হয়। ট্যালো খাওয়ার নানা ধরনের সুবিধা রয়েছে। এটি ভিটামিন এ, ডি এবং ই ও ফ্যাটি অ্যাসিডের উৎস। চর্বিযুক্ত দ্রবণীয় ভিটামিনগুলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো গরুর মাংসের চর্বিতে উল্লেখযোগ্য হারে রয়েছে। মস্তিষ্কের বৃদ্ধি এবং নিউরোনাল ফাংশনের জন্য ডিএইচএ এবং এএএ’র মতো ফ্যাটি অ্যাসিডগুলোও গুরুত্বপূর্ণ, যা এর মধ্যে বিদ্যমান।
গরুর মাংসে সম্পৃক্ত ও অসম্পৃক্ত চর্বির পরিমাণ প্রায় সমান থাকে। এতে উপস্থিত ফ্যাটি অ্যাসিডের মধ্যে রয়েছে স্টিয়ারিক অ্যাসিড, ওলিক অ্যাসিড ও পামিটিক অ্যাসিড। গরুর মাংসে ট্রান্স ফ্যাটও রয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে কনজুগেটেড লিনোলেয়িক অ্যাসিড। এই ফ্যাটি অ্যাসিড ওজন কমাতে সাহায্য করে।
চর্বি গলিয়ে পাওয়া তেল সেঁকা ময়দার সুখাদ্যকে খাস্তা বানাতে, এর বুনট আরও ঝুরঝুরে করতে ব্যবহৃত হতে পারে। চর্বি গলানো তেল বিশেষ স্বাদের জন্য ব্যবহার করা হয়। অনেক সময় এই তেল অন্যান্য উপাদানের স্বাদ ধারণ ও বহন করতে পারে। এ ছাড়া চর্বিজাত তেল গরম করে তাতে অন্য খাবার রান্না করা যায়। কাজে উৎসাহ ও অধিক তৎপরতার জন্য ফ্যাট অপরিহার্য। শরীরের উত্তাপ উৎপাদন এবং চর্বি প্রস্তুতকরণ এই জাতীয় খাদ্যের প্রধান কাজ। দেহের কমনীয়তা রক্ষা ও লাবণ্যের জন্য চর্বির প্রয়োজন খুব বেশি।
যারা স্বাস্থ্যসচেতন বা ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে চান, তারা সব সময়ই চর্বিযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলেন। তবে সব চর্বিযুক্ত খাবারই কি ওজন বাড়াতে দায়ী! খাদ্য ও পুষ্টিবিষয়ক বিশেষজ্ঞরা নানা পরীক্ষার মাধ্যমে দেখিয়েছেন, ফ্যাট খাওয়া মানেই মোটা হওয়া নয়। যেসব খাবার শরীরের জন্য ক্ষতিকর চর্বিতে ভরপুর, সেগুলোই ওজন বাড়ায়। পাই ক্রাসট এবং অন্যান্য বেইক করা খাবারে ট্র্যান্স ফ্যাট থাকে। প্রক্রিয়াজাত করা এবং শস্য খাওয়া পশুর মাংসে স্যাচুরেটেড ফ্যাট থাকার পাশাপাশি অত্যধিক ক্যালরি থাকে, যা শেষ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত করে। কিন্তু স্বাস্থ্যকর চর্বি ঠিক তার উল্টো, তা যেমন ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণ করে এবং শরীর থেকে প্রতিদিনের খাওয়া বাড়তি ক্যালরি ঝরিয়ে ফেলে। তাই হৃৎপি-ের স্বাস্থ্য ভালো থাকে এবং বিপাকক্রিয়া সচল রাখে।
বিশেষজ্ঞদের মতে ঘাস খাওয়া পশুর মাংসে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিডের পরিমাণ অনেক বেশি থাকে, যা হৃদ্রোগের ঝুঁকি কমানোর ক্ষেত্রে কার্যকর। বিফ ট্যালো বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্যকর ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ। এর মধ্যে রয়েছে প্যালমিটোলিক অ্যাসিডের মতো মনোস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড, প্যালমেটিক অ্যাসিড এবং স্টেরিক অ্যাসিডের মতো স্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড এবং কনজুগেটেড লিনোলিক অ্যাসিডের মতো প্রাকৃতিক ট্রান্স ফ্যাট।
ওমেগা ৭ ফ্যাটযুক্ত প্যালমিটোলিক অ্যাসিড ত্বকের গুরুত্বপূর্ণ প্রাথমিক বিল্ডিং ব্লক। ওমেগা ৩ সিরিজের চর্বি হিসেবে বিফ ট্যালো একেবারে অত্যাবশ্যক না হলেও প্যালমিটোলিক অ্যাসিড এখনো হৃদ্রোগের স্বাস্থ্য এবং ইনসুলিনের সংবেদনশীলতা বজায় রাখতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে।
বিফ ট্যালো ত্বক এবং চুলের জন্য অত্যন্ত উপকারী। ওমেগা ৭-এর প্যালমিটোলিক অ্যাসিডের মতো ট্যালো রোদে গেলে ত্বকে ঘটে যাওয়া অক্সিডেটিভ ক্ষতির বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারে। বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা যায়, প্যালমিটোলিক অ্যাসিড ত্বক সতেজ ও মোলায়েম রাখে।
বিফ ট্যালোর কিছু পৃথক ফ্যাটি অ্যাসিড জ্বালানির জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এর কনজুগেটেড লিনোলিক অ্যাসিড দেহের ওজন এবং উন্নত শারীরিক গঠনের সঙ্গে সম্পর্কিত।
বিফ ট্যালোতে থাকা স্যাচুরেটেড ফ্যাটগুলোও আয়ু বাড়িয়ে তুলতে পারে। এই ফ্যাট যত বেশি খাওয়া যাবে, দেহকোষের ঝিল্লি তত বেশি স্যাচুরেটেড হবে। কোষের ঝিল্লি সংশ্লেষের উচ্চ মাত্রা কোষগুলোকে গ্লাইকেশন, জারণ, এন্ডোটক্সিন বিল্ডআপ এবং অন্যান্য ধরনের চাপ থেকে রক্ষা করে।

বিফ ট্যালো তৈরির প্রক্রিয়া
 গরুর মাংসের একটি চর্বিযুক্ত স্থান নির্বাচন করতে হয়
 মাংস থেকে সব চর্বি ছাঁটাই
 চর্বি ১ ইঞ্চি কিউব করে কাটতে হবে
 স্টেইনলেস স্টিল বা কাচের পাত্রের মধ্যে চর্বি রাখতে হবে। পাত্রটি প্রায় অর্ধেক পূর্ণ হতে হয়
 চুলা মাঝারি আঁচে জ্বালিয়ে প্রতি ১০ মিনিট পর পর নাড়তে হবে, যাতে তাপ সমানভাবে পাত্রে লাগে
 চর্বির খ-গুলো গলে যেতে শুরু করলে ক্রমাগত নাড়তে হবে। সব চর্বি গলে যেতে প্রায় ৩০ মিনিট সময় নেবে
 অবশিষ্ট অংশগুলো ছেঁকে সরিয়ে রাখতে হয়
 একটি বড় পাত্রে তরল অংশ তুলে ফেলতে হবে

ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top