skip to Main Content

স্বাদশেকড় I হালিম বৃত্তান্ত

উৎপত্তিস্থল মধ্যপ্রাচ্য। মূলত বিভিন্ন ধরনের ডাল আর মাংসের মিশ্রণ। মজাদার ও পুষ্টিকর এই খাবারের আদ্যোপান্ত লিখেছেন আল নাহিয়ান

আরবি শব্দ ‘হালিম’-এর বাংলা তর্জমা ‘ধৈর্যশীল’। এটি কি তবে ধৈর্যশীলদের খাবার? নাকি হালিম নামের কোনো ব্যক্তির উদ্ভূত পদ? সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য উত্তর হচ্ছে, খাবারটির রাঁধতে হয় ধীর আঁচে। ফলে পদটির নামকরণে একমত হন অনেকে। এটির উৎপত্তি পারস্যে। সেখানকার সৈন্যরা যুদ্ধে যাওয়ার আগে গম, মাংস, টক দই যোগে তৈরি একটি খাবার খেত, যা ঝটপট ক্ষুধা নিবারণের পাশাপাশি শরীরে শক্তিও জোগাত। সেটি বিবর্তিত হয়ে এখনকার হালিম হয়েছে। এর আঁতুড়ঘর সেমেটিক-অধ্যুষিত। তবে তারা এটিকে হালিম নামে ডাকত না, ডাকেও না। ইরাক, সিরিয়া, লেবানন, ইয়েমেন ও আরবে এটি ‘হারিশা’ নামে পরিচিত। যেটি সম্ভবত ষষ্ঠ শতাব্দীতে রাজা খুসরোর হাত ধরে আমাদের অঞ্চলে প্রবেশ করে। তত দিনে বদলেছে এর রন্ধন উপকরণ। এমনকি কয়েকজন মোগল সম্রাট এটিকে নিরামিষ বানিয়ে ছেড়েছেন।
সেমেটিক ফুড হলেও এটিকে শুধুই মুসলমানের খাবার বলা চলে না। কেননা লেভান্ত অঞ্চলের খ্রিস্টানরাও তাদের বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে হারিশা রাঁধতেন। এখন সিরিয়া ও লেবানন অঞ্চল মিলে লেভান্ত। তবে তাদের হারিশা এ সময়ের হালিমের মতো ছিল না। তা ছিল প্রায় হালুয়ার মতো। তা ছাড়া স্পেনের ইহুদিরা তাদের সাবাথের দিন হারিশা রান্না করতেন। মানে, সেমেটিক তিন ধর্মেই এর কদর। তাদেরকে ঘিরেই খাবারটির উৎপত্তি।
হালিম যে হারিশার উত্তরপদ, এ বিষয়ে মত দিয়েছেন রন্ধন ইতিহাসবিদ ক্লডিয়া। তা ছাড়া লেবাননের রন্ধন বিশেষজ্ঞ আনিসা হেলউ রচিত ‘লেবানিজ কুজিন’ বই থেকে জানা যায়, লেভান্তে দুস্থদের গণভোজের উদ্দেশ্যে বড় পাতিলে হারিশা রান্না হতো। বেশ কিছু মুসলিম লেখকের গ্রন্থেও এর উল্লেখ মেলে। পদটির সবচেয়ে পুরাতন রেসিপি লেখা আছে ‘কিতাব আল তাবিখ’ বইতে। এর সংকলক আবু মুহাম্মদ আল মুজাফফর ইবন সায়ার। বাগদাদি গ্রন্থ। খ্রিস্টীয় দশম শতকে রচিত। ইবনে বতুতার ভ্রমণকাহিনিতেও পারস্যে ডাল, ঘি ও মাংসযোগে হারিশা রান্নার কথা বর্ণিত আছে। আইন-ই-আকবরীতে আবুল ফজল হালিমের উল্লেখ করেছেন। লিখেছেন, সম্রাট আকবরের দরবারে খাবারটি পরিবেশিত হতো। তাতে মাংসের স্টুতে থাকত গম, শালগম, গাজর, পালং ও মাংসের টুকরা। তবে স¤্রাট হুমায়ুন গরু হত্যা নিষিদ্ধ করার পর হালিম হয়ে ওঠে নিরামিষ পদ। কথিত আছে, আকবর ও আওরঙ্গজেব ছিলেন নিরামিষাশী। তাদের আমলে মাংসহীন হালিমও বেশ জনপ্রিয় হয়। সেটিকেও খুব সুস্বাদু উপায়ে রান্না করা হতো।
ভারতবর্ষে হারিশা প্রচলন সম্পর্কে একটি মত হচ্ছে, এই অঞ্চলে খাবারটি আসে মোগলদের মাধ্যমে। হুমায়ুনের আমলে। তবে তা জনপ্রিয়তা পায় আকবরের সময়ে। সম্রাট হুমায়ুনের সঙ্গে সাফাভি সাম্রাজ্যের সম্পর্ক ভালো ছিল। ফলে ধারণা করা যায়, সরাসরি পারস্য থেকেই খাবারটি ঢুকেছে ভারতে। অনেকে বলেন, মোগলরা পারস্যদের হারিয়ে খাবারটি নিজেদের মেন্যুতে যোগ করে নেয়। অবশ্য আরেক মতে, ভারতবর্ষে আরব বণিকদের যাতায়াত ছিল হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সময় থেকেই। ফলে হারিশা আরব থেকে এসেছে বলেও ধারণা করা হয়।
খাবারটির উৎপত্তিকথায় হায়দরাবাদী হালিমের বর্ণনা চলে আসে। ভারতবর্ষে পদটি ভোজনরসিকদের প্রিয় করে তুলতে হায়দরাবাদীদের ভূমিকা রয়েছে। ইতিহাসের দাবি, এই অঞ্চলের নিজামদের আরব সৈন্যরা হারিশা এনেছিল এই অঞ্চলে। তারপর তা ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। মানে, ভারতবর্ষের হালিমের আদি উৎপত্তিস্থল হলো হায়দরাবাদ। বিংশ শতাব্দীতে খাবারটি জনপ্রিয়করণে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছেন ইয়েমেনি জমিদার সুলতান সাইফ নাওয়াজ জং বাহাদুর। জানা যায়, তিনি ছিলেন হায়দরাবাদের নিজামদের দরবারের খানদানি আমির-ওমরাহদের একজন। তার বাড়িতে নানান সময়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠান হতো। সেখানে তিনি অতিথিদের ইয়েমেনি হারিশা পরিবেশন করতেন। যদিও ইয়েমেনের পদটি তত দিনে ভারতীয় মসলার যোগে ‘হালিম’ হয়ে গেছে।
১৯৫০ সালের দিকে হায়দরাবাদে গড়ে ওঠা ইরানি কুজিনের খাবার হোটেলগুলোতে প্রথম হালিম বিক্রি শুরু হয়। মাত্র ৩ পয়সায় এক বাটি হালিম মিলত তখন। ৬০ বছরের ব্যবধানে পদটি এতই জনপ্রিয় হয় যে ২০১০ সালে ইন্ডিয়ান পেটেন্ট অফিস হায়দরাবাদী হালিমকে প্রথম নন-ভেজ খাবার হিসেবে পেটেন্ট দেয়। মানে, এরপর থেকে ভারতে আর যেনতেন রেসিপির হালিমকে হায়দরাবাদী বলে চালিয়ে দেওয়া যাবে না। খাবারটি বিক্রির জন্য একটি নিয়মকানুন মেনে চলতে হবে। রেসিপিতে মানতে হবে নির্দিষ্ট স্ট্যান্ডার্ড। এখন হায়দরাবাদের বরকাস এলাকায় মিষ্টি স্বাদের হালিম পাওয়া যায়। ডালে চিনি মিশিয়ে ব্রেকফাস্টে পরিবেশন করা হয় পদটি। মোগলদের পরে ইংরেজদের খাবার টেবিলেও সমাদর পেয়েছে হালিম। তবে তারা এর রেসিপিতে কিছুটা বদল ঘটিয়ে নিয়েছিল।
এখন হালিমের মূল উপাদান হলো বিভিন্ন রকমের ডাল, গম, বার্লি, সুগন্ধি চাল ও মাংস। তা পরিবেশনকালে যোগ করা হয় পেঁয়াজের বেরেস্তা, ধনেপাতা, আদা, কাঁচা মরিচ ও লেবু। স্থান ও রাঁধুনিভেদে এর রেসিপি ভিন্ন হয়। খাওয়ার ধরনে পরিবর্তন আসে। যেমন দেশে ভাতের সঙ্গে খাওয়ার জন্য হালিমের একটি ভার্সন উদ্ভব হয়েছে। টাঙ্গাইল ও জামালপুর জেলায়, যা ম্যান্দা বা পিঠালি নামে পরিচিত। এই পদের রন্ধনশৈলী অনেকটা হালিমের মতো। তবে তাতে ডালের পরিবর্তে দিতে হয় চালের গুঁড়া। খাবারটির এই ভার্সন এবং নিরামিষ হালিম ছাড়া অন্য সবেতেই ডাল ও মাংসের উপস্থিতি থাকে।
তবে কারবালা যোদ্ধাদের খাবার হিসেবে হালিমের উৎপত্তি হয়েছিল বলেও লোকমুখে প্রচলিত রয়েছে।

ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top